MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ১০ জুলাই, ২০১৬

ভেঙে পড়ে আছে রথ......।
‘রথ দেখা কলা বেচা’ কথাটা শুধু শহরে কেন গ্রামের মানুষকেও হরবখত্ বলতে শুনতাম।ছোটবেলায় রথ দেখতে যেতাম।রথের মেলাও ঘুরতাম।সেখানে নানান জাতের কলাও বেচতে দেখেছি মানুষজনকে।কলাগাছও বেচতে দেখেছি।কাঁঠাল বেচতেও দেখেছি তবু কেন যে কেউ ‘রথ দেখা কাঁঠাল বেচা’ বলত না কেন কে জানে!তবে রথের সংগে দেখা ও বেচার যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে সেটা সেই বয়সে না বুঝলেও পরে বুঝেছি।আচ্ছা ইংরাজিতে যে ‘উইন্ডো শপিং’ কথাটি চালু হয়েছে সেটা কি আমাদের ওই ‘রথ দেখা কলাবেচা’ থেকেই?
আমাদের গ্রামে চড়ক ছিল,গাজন ছিল,রাসের মেলা ছিল,দোলের মেলা ছিল কিন্তু রথের মেলা ছিল না।বাড়ির বাস্তুদেবতা রঘুনাথকে ছোট্ট রথে চড়ানো হোত,ঝুলন পূর্ণিমায় ঝুলায় দোলানোও হত কিন্তু রথের সেই জাঁকজমক ছিল না।তাই আমাদের রথের মেলা দেখতে ছুটতে হোত এখানে ওখানে।পুরীর রথ যেমন বিখ্যাত।মাহেশের রথ-এর কথা যেমন বঙ্কিমের উপন্যাস থেকে সবাই জানে আমাদের মহিষাদলের রথ তার চেয়ে কিছু কম নয়।মহিষাদলের রথ রাজাদের ছিল এই সেদিনও এখন পঞ্চায়েতের।আগে ছিল সতের চূড়ার।রাজবাড়ি থেকে মাসির বাড়ি আসতে কয়েক ঘন্টা লেগে যেত।পরে হোল তেরো চূড়ার।বড়ো হয়ে আমি মহিষাদলের রথের মেলায় গেছি কবিতা বেচতে আর বাড়ির কাঁচা ও পাকা বিচিকলা বেচতে যেতাম রাধামনির হাটে কি রঘুনাথবাড়ির রথের মেলায়।রঘুনাথবাড়ির রথও বেশ নামকরা ছিল।বেশ কয়েকদিন ধরে মেলা বসত।নাগরদোলা থেকে ম্যাজিক,গাছ-গাছালি থেকে চপ-পাঁপড়, গজা থেকে মণ্ডা-মিঠাই সবই থাকত।আমরা ডিমারীতেও মেলা দেখতে যেতাম। ডিমারীর হাটও বিখ্যাত ছিলকাঁক্টিয়া,ডিমারী,রামতারক,হাকোল্লা,ব্যবত্তা,কলাতলা, নিমতৌড়ি-বেগুনবাড়ির হাট পাট,পান আর ধান-চালের জন্য বিখ্যাত ছিল।আর রাধামনির হাট সারা ভারতে বিখ্যাত রংসুতো-গামছা-মশারি-চাদরের জন্যে।এসব জায়গাতেও রথ টানা হোত তবে তা তেমন নামকরা ছিল না যতটা ছিল ডিমারী,রঘুনাথবাড়ি,ময়না আর মহিষাদলের রথযাত্রা।তবে যেখানেই রথের মেলা বসুক না কেন আমরা সকাল থেকেই নিজেদের হাতে বানানো তালপাতার ভেঁপু বাজাতাম। ছোট,বড়ো নানান মাপের।হাতে তালপাতার ঘড়ি,চোখে তালপাতার চশমা আর মুখে পাতার ভেঁপু।আজকের ‘ভুভুজেলা’র থেকে তার স্বর ছিল অনেক মিষ্টি।অনেক মধুর।
মোকাম কলিকাতায় এসে দেখলাম রথের মেলা নেই উলটে মেলা রথ।সবার হাতে একটা করে রথ।ছোট-বড়-মাঝারি......অলিতে গলিতে এমনকি বড়ো রাস্তাও বাদ নেই।সব কেমন একা একা আত্মকেন্দ্রিক।এখন যেমন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতেই সেলফোনে একা একা চোখ রাখা এও অনেকটা তেম্নিই।আর রেষারেষি......। আত্মম্ভরিতা......।তারপর দেখলাম স্বদেশী রাস্তায় বিদেশী রথ।খেজুর পাতার ঝাঁটা আর নারকেল কাঠির ঝাঁটায় ঝ্যাঁটানোয় অভস্ত্য আমি প্রথম দেখলাম সোনার ঝাঁটা। দেখলাম রথের উপরে বসে আছে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম এর চেয়েও অধিক গুরুত্ত্বে এক ধর্মগুরু।রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ইস্কনের এই শোভাযাত্রা দেখে রবি ঠাকুরের লেখা নিজের অজান্তেই আওড়াতাম-‘রথ ভাবে আমি দেব,রশি ভাবে আমি,মূর্তি ভাবে আমি দেব,হাসেন অন্তর্যামী’।গ্রামের রথের মেলায় কিন্তু তা নয়। সেখানে রথের রশি সবাই টানে।রাজা থেকে আমজনতা,সন্ন্যাসী থেকে শূদ্র সবাই তার অংশীদারএই শোভাযাত্রা সবার মিলন মেলা।
দেশ গাঁয়ের মেলা মানেই মেলা লোক একটা জায়গায় জড়ো হয়ে বিড়ি কি সিগারেট ফোঁকে আর এটা ওটা দেখে।কেউ ঘুরে ঘুরে দেখে।কেউ এক জায়গায় চুপটি করে বসে লোকের মাথা গোনে আর চায়ের গেলাসে সশব্দ চুমুক দিয়ে বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে পাশের লোকটিকে বলে-‘বুইলে(বুঝলে)কি না এবারে তেমন লোক হয়নি’।পাশের লোকটি সেও চায়ের গেলাসে আরও জোরে চুমুক দিয়ে ফতুয়ার পকেট থেকে বিড়ির বাণ্ডিল বের করে তার থেকে একটি পাশের লোকটিকে দিয়ে আর নিজেও একটি নিয়ে বিড়িটাকে দুই আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কানের পাশে নিয়ে এসে আবার মুখের কাছে এনে ফুঁ দিয়ে তারপর পাশের লোকের কাছে সালোই(দেশলাই)চেয়ে নিয়ে বিড়ির মুখে আগুন দিয়ে পরের বিড়ির মুখেও আগুন ধরিয়ে বিজ্ঞের মতো বলে উঠত-‘কী যে কও জ্যানার পো,আমি তো দেখতিছি লোক থিক্ থিক্ করতিছে!ওই কাঁঠালের ভুতির উপর যেমন ডেঁয়ো মাছি ভন্ ভন্ করতিছে।তেমনি লোক হচে(হয়েছে)ইবারের মেলায়’।এই কথায় রথের মেলার স্থায়ী চায়ের দোকানে স্থানীয় ও মেলা উপলক্ষ্যে আগত মানুষ অবধারিত ভাবে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং গুন্তিতে মানুষের মাথা বেশি না কম এই নিয়ে তুমুল তর্ক তুলবে।সেখান থেকে চলে যাবে মেলার জৌলুস হারানো নিয়ে আক্ষেপে,জিনিসের দাম বাড়া নিয়ে চাপা বিক্ষোভে সেখান থেকে মেয়েদের পোশাক আশাক যে আর ঠিক ঠাক নেই সেই বিষয়ে প্রকাশ্য ক্ষোভেতার পাশাপাশি কে কার বাড়ির মেয়েকে কবে ফুঁসলে নিয়ে গেছে সে কথায়।কে হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে উঠল সে কথাও বাদ যাবে না। এমনকি কোন চাতুরীতে একদিন তার ‘পোঁদ’ মেরে খাওয়া যায় তার ছক কষাও চলতে থাকবে।
অবশ্য এটা যে শুধু রথের মেলাতেই হয়ে থাকত তা কিন্তু নয়।সব মেলা কি সব হাটেই এমন কিছু লোক ছিল তখন যারা নিছক আমোদ বা ক্লান্তিহীন পরচর্চা ও পরনিন্দায় মশগুল থাকতে ভালোবাসত।মেলায় যেমন পসরা আসে।কেনাবেচার লোক আসে।এরাও আসে।তবে এরা আর কোনও দোকানে নয়,চায়ের দোকানেই আসর জমায়।পাশের মনোহারীর দোকানে নয়,খুন্তি-কড়াই-শাবল-কোদাল-খুরপি-গাঁইতির দোকানে নয়।মণ্ডা-মিঠাই-সন্দেশ-জিলিপির দোকানেও নয় এই চপ-চায়ের দোকানেই তাদের আসন।এক এক সময় মনে হবে বসে থাকতে থাকতে এদের শিকড় গজিয়ে গেছে।এরা গাছ হয়ে গেছে।
রথের মেলার বৈশিষ্ট্য বলতে সবাই বোঝেন জুলাবি(জিলিপি)আর পাঁপড় ভাজা।আমরা কিন্তু দেখেছি রথের মেলা মানেই ইয়া বড়ো বড়ো মালদার ফজলি আম,স্থানীয় আনারস,দেশী কাঁঠাল আর নানান ফুল-ফলের গাছ।আর আসত পাখি।নানান জাতের পাখি।পায়রা,টিয়া,চন্দনা,ময়না,বদ্রি,মুনিয়া,লাভ বার্ড যেমন থাকত খাঁচায় তেমনি কাকাতুয়াও থাকত।গ্রামের মেলায় ম্যাকাও কি ময়ূর বেচতে দেখিনি তবে বাঁদর-বেঁজি,ভালুক-কুকুর বেচতে দেখেছি। হাটেও মাছ-গাছ-পাখি বিক্রি হোতো।নানান জাতের ফুল-ফলের চারা কি বীজ তাও থাকত কিন্তু রথের মেলায় কতো রকমের পাখি,কত জাতের মাছ আর গাছ আসত।
বাবা প্রতি রথের মেলায় গাছ কিনত।বিশেষ করে আমগাছ,জামগাছ,পেয়ারা গাছ, বাতাবি লেবুর গাছ।নারকেল কি সুপুরিগাছ কেনা হোত না আমাদের বাড়িতে।ওগুলো বাড়ির নারকেল কি সুপুরি থেকেই হোত।ওগুলো রাখা হোত রান্নাঘরের জল যে নালা দিয়ে এসে একটা ডোবায় পড়ত সেখানে।সেখানে গাছ বড়ো হলে তাদের লাগানো হোত।আর তালগাছ আপনা থেকেই গজাত।আষাঢ়-শ্রাবণ ধান-পাট চাষ আর গাছ লাগানোর কাল।গুরুদেব এই ধারাকেই শান্তিনিকেতনে উৎসবের আকার দিয়েছিলেন। বৃক্ষরোপন আর হলকর্ষন উৎসব বাংলার প্রচলিত ধারার পরিশীলিত রূপ।শুধু দেশজ গাছ-লতাগুল্ম নয় সারা পৃ্থিবীর যেখানেই গেছেন সেখান থেকে বীজ বা বৃক্ষ এনে তা শান্তিনিকেতনের মাটিতে রোপন করেছেন।সেইসব গাছ আজও রয়েছে।তার পাশাপাশি তাঁরই অগোচরে যে সব বিষবৃক্ষ রোপিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেতাঁর জীবব্দশাতেই তারা চারা থেকে মহীরূহ হয়েছে।আজ তারাই সংস্কৃতে “এরণ্ডবি ধ্রূমায়তে”(যখন ভ্যারেণ্ডা গাছও নিজেকে ধ্রূম(মহীরূহ)ভাবে)বাক্যটিকে নগ্ন বাস্তবের মাটিতে নিজেদের প্রোথিত করে দূষিত করে চলেছে আশ্রমের আকাশ-বাতাস।
আমার জ্যাঠাবাবু প্রয়াত দুর্গাচরণ সরকার গুরুদেবের আদর্শকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছিলেন।আমাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন।তাই জ্যাঠাবাবু বাবার মতো এইসব তুচ্ছ গাছ আনতেন না কখনও।উনি আনতেন তেজপাতা গাছ কি কারিপাতার গাছ।একবার তো দারচিনি(দারুচিনি)গাছ আনলেন।আমরা বেশ উত্তেজিত,গাছটা বড় হোলে তার ছাল খাব কাঁচাই।গাছ বড়ো হোল কিন্তু সেটা দারুচিনি গাছ না হয়ে কাবাবচিনির গাছ হয়ে গেল!এই সেদিনও আমাদের বাগান এমন বেশকিছু অজানা নামহীন গাছে ভরা ছিল।আর একবার আনলেন ছোট এলাচের গাছ।বাড়ির পাশেই লাগানো হোল।আদার মতো গাছের ঝাড় হোল।ফুল এলো দোলন চাঁপার মতো।ছোট এলাচ আর হোল না।তা না হোক জ্যাঠাবাবুর এই অ্যাডভেঞ্চার আমাকে খুব উত্তেজিত করত।
মৌমাছির চাষ,নতুন ধারার ধানের চাষ,ম্যানিওর পিট(সারের জন্য)বানানো,জল তোলা ডিজেল পাম্প থেকে দেশি ডোঙাকল, ইকমিক কুকার,নতুন ধারার মাছের চাষ তার সংগে রান্নাঘরে নানান ধারার রান্নার প্রচলন।তার জন্যে মা-কাকিমার ভোগান্তিও কম ছিল না।বাইরের থেকে যা খেয়ে আসতেন তাই শিখে আসতেন আর তার প্রয়োগ চলত ভিকিরিপতি গ্রামের সরকার বাড়ির রান্নাঘরে।জ্যাঠাবাবুর উদ্যোগেই আমাদের প্রথম স্যালাড খাওয়া শেখা। শীতকালে রাতের খাওয়ার শেষে বাড়ির গোরুর দুধে কফি খাওয়া কি দক্ষিণী খাবার উপমা বাড়ির বউয়েদের ‘রিলিফ’ দেবার জন্যে সারা সন্ধ্যে কুচো চিংড়ি বেটে তার পকৌড়া বানানো এসব জ্যাঠাবাবুর মস্তিষ্ক প্রসূতরথের মেলার কথা বলতে গিয়ে জ্যাঠাবাবুর কথায় চলে আসাটা অনেকেরই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হতে পারে কিন্তু আমার জীবনে এসবই ছিল নিত্যদিন নতুনের অভিযান।ঠিক যেভাবে রথ দড়ির টানে তার নিজের বাড়ি থেকে মাসির বাড়ি যায় আবার কিছুদিন মাসির বাড়িতে থেকে উল্টোরথে নিজের বাড়ি ফিরে আসে আমার জীবনে জ্যাঠাবাবু ছিলেন তেমনই এক মানুষ।বারে বারে কোথায় চলে যেতেন আর ফিরে আসতেন নতুন কিছু না কিছু রসদ নিয়ে।বড়ির দেশ মেদিনীপুরে আমরা ভারতের নানা প্রকারের,নানা রঙের,নানান স্বাদের বড়ি খেয়েছি ভিকিরিপতি গ্রামের বাড়িতে বসেই।বেনারসের প্যাঁড়া থেকে বেনারসী জর্দা,গুজরাতি আচার থেকে পাঞ্জাবি তড়কার স্বাদ নেওয়া,দিল্লীর কালাকাঁদ আর লাড্ডু,লক্ষ্ণৌয়ের পান,তার পাশে শক্তিগড়ের ল্যাংচা,বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ,কৃষ্ণনগরের শরপুরিয়া আর শরভাজা কী ক্ষীরকদম্ব,সিউড়ির বেলের মোরব্বা,কলকাতার বড়বাজারের বিখ্যাত পাঁপড় আর ভাঙা বিস্কুট সব জ্যাঠাবাবুর কল্যাণে।
জ্যাঠাবাবুকে আমার কেন জানি না মহাভারতের কর্ণের মতো ‘ট্র্যাজিক হিরো’ মনে হোত।জ্যাঠাবাবুর পাণ্ডিত্য সংস্কৃত-বাংলা-ইংরাজী সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি ভিকিরিপতির মানুষদের কাছে সমীহ নয়, সম্ভ্রম নয় সবিশেষ দূরত্ব আদায় করত।তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা জানতেন কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কথা,তার ‘নব জীবনের গান’এর কথা জানতেন কি না জানি না।জ্যাঠাবাবুকে কোন দিন গাইতে শুনিনি।সলিল চৌধুরীর গণনাট্য কালের গানের গ্রামাফোন ডিস্ক আমাদের বাড়িতে ছিল কিন্তু সলিলদার ‘আজ তবে এইটুকু থাক,বাকি কথা পরে হবে/ধূসর ধুলির পথ/ভেঙে পড়ে আছে রথ/বহুদূর দূর যেতে হবে......’গানটা আমার যত প্রিয় জ্যাঠাবাবুর ততটা প্রিয় ছিল কি না আমি জানতে চাইনি কোন দিন।আসলে জ্যাঠাবাবু ছিলেন আগাগোড়া বঙ্কিম আর রবি ঠাকুরের ভক্ত।কালিদাস আর ভবভূতির একনিষ্ঠ পাঠক।শেক্সপিয়র আর ম্যাক্সমুলারের অনুগত।

আর তাই জ্যাঠাবাবু চেয়েছিলেন সরকার বাড়ির সংস্কৃতির রথটাকে এই ভিকিরিপতি ছাড়িয়ে,কেলোমাল থেকে সরিয়ে,তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে যাত্রা করে অনেক অনেক দূর নিয়ে যেতে কিন্তু বাড়ির বাকি মানুষ জন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো,অনাথ অপোগণ্ডের মতো ওই রথেই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকাতে রথটা বেশি দূর যেতে পারেনি।আলস্যের গেঁয়ো কাদায় পচনধরা চিন্তা চেতনার দড়ি মৌরসীপাট্টার শিক্ষার বাসা প্রগতির রথটাকে সামনে এগোতে দিল না কিছুতেই।সামুদ্রিক লোনা হাওয়ায় দড়ি ছিঁড়ে,ধ্বজা উড়ে,চাকা ভেঙে সে পড়ে রইল ওইখানেই।

রবিবার, ৩ জুলাই, ২০১৬

মা-মুড়ি-খৈ-চালভাজা
কোন দিন ছোটোবেলার মুড়ি ভাজা নিয়ে এই বড়ো বেলায় এসে লিখব এটা জানা ছিল না।ঠিক যেমন এই বর্ষায় জল জমা উঠোনে কি বাগানে কি বাড়ির দাওয়ার পাশে গলা ফুলিয়ে ‘গ্যাঙর গ্যাং’ করে ডাকতে থাকা কোলা ব্যাঙ আর সোনা ব্যাঙেরাও যে হারিয়ে যাবে ভাবতেও পারতাম না।আমার শৈশবে গ্রামের বাড়ির বর্ষাকাল খুব সুখের ছিল না।গ্রীষ্মের দাবদাহের পর যখন হঠাৎ কাল বৈশাখীর বৃষ্টি নামত আমরা যে যেখানে যে অবস্থায় থাকতাম উঠোনে নেমে ভিজতাম কারণ সারা শরীরের ঘামাচি মরবে।আর বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজতাম বাধ্য হয়ে নয়ত স্নান করতে।
চারদিক জল থৈ থৈ......সারাদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি।এমনও হয়েছে ছ-সাত দিন আমরা সূর্যের মুখ দেখিনি।বিকেলে আচমকা পশ্চিমের আলো এসে যখন পড়ত তেরছা হয়ে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়তাম পরে যেভাবে লোডশেডিংয়ের পর আলো এলে উল্লাস করত কলকাতার সব গলি-পাড়া-রোয়াক।মজাও ছিল কম নয়।এক তো প্রথম বারিধারায় ডোবা পুকুর খাল থেকে জিয়ল মাছ উঠে আসত উঠোনে বাগানে বাড়ির দাওয়ায়।একবার আমি তখন পাইকপাড়ায় থাকি প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে হাওড়া থেকে ট্রেনে চড়ে দেশে বাবা-মায়ের কাছে গেছি।রেল লাইন জল ছুঁই ছুঁই।কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ঢুকতেই মা হাত মুখ ধুয়ে হাতে পায়ে ভালো করে তেল মেখে নিতে বলল।তারপর হাতে ধরিয়ে দিল আদা দেওয়া গরম চা আর আচারের তেল মাখা ছোলা-বাদাম মেশানো চাল ভাজা, সংগে বাগানের কাঁচালংকা।
বাবা বলল-‘গোয়াল ঘরটা একবার দেখে আয় তো’।
গোয়াল ঘর দেখতে যাওয়ার কারণ ওই সময় খাল-বিল ডুবে যায় বলে গর্তে্র ইঁদুর উঠে আসে শুকনো জায়গায়।তাদের পিছু পিছু চলে আসে সাপ বিষধর কি দাঁড়াস।তারা নিরাপদ স্থান বলতে গোয়াল ঘরকেই বেছে নেয়।আমি টর্চ না নিয়ে একটা সামান্য লণ্ঠন নিয়েই টিপটিপ করে পড়া বৃষ্টির মধ্যেই পায়ের পাতা ভেজা জল ছুঁয়ে যখন গোয়ালের দিকে যাচ্ছি দেখি আমাদের বাড়ির পোষা বেড়াল তার থাবা দিয়ে কাকে যেন ধরতে চাইছে আর সে একটু একটু করে পালিয়ে যেতে চাইছে।প্রথমটায় মনে হোলো সাপ।আমাদের দেশের পোষা বেড়াল সাপ খেত,পুকুরের মাছ খেত এমনকি পায়রা-ঘুঘুও খেত।তেমন সুযোগ পেলে কাঠবিড়ালির লেজ কামড়ে খেত।আর শীতকালে আমাদের মশারি ছিঁড়ে বিছানায় ঢুকে লেপের মধ্যে চেপে ঘুমোত।সাপ ভেবে আমি তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে বড়ো টর্চ নিয়ে এসে দেখি বেড়াল যাকে জব্দ করতে পারছে না সে সাপ নয় মস্ত সাপের মতো দেখতে হাতখানেক শোল মাছ।সেটাকে ধরে একটা হাঁড়িতে জিইয়ে রেখে আবার বেরোলাম। গোয়ালের গোরুরা নিরাপদেই আছে দেখে এবার বেরোলাম মাছ ধরতে।বেড়াল আমার সামনে আর আমি আলো ফেলে দেখছি।ও দেখিয়ে দিচ্ছে আর সেই মতন আমি আলো ফেলে দেখছি হয় কৈমাছ কি ল্যাঠা কি শোল।সারা বাগান ঘুরে বেশ কয়েকটা পেলাম।পরের দিন বেড়ালের কপালে জুটল আঁশকাঁটা আর নিজের ধরে আনা চ্যাং মাছ।
বর্ষায় সারা রাত আমার ঘুম হোতো না।আমি সারা রাত জেগে শুনতাম বিচিত্র শব্দাবলী।এক তো ঝিঁ-ঝিঁ দের নানান স্বর আর নানা জাতের ব্যাঙেদের সিম্ফনি।বৃষ্টির এক টানা শব্দ।বৃষ্টি থেমে গেলেই অন্য স্বরবিন্যাস,অন্য ধ্বনি।বৃষ্টির ফোঁটা কলাপাতা থেকে কচুপাতায় পড়ে অদ্ভূত শব্দ তৈরি করত।আর টালির চালের থেকে জল নিচে বালি-কাঁকরে এমনভাবে পড়ত আমার মনে হোতো কোনও এক মস্ত পুরুষ তিনি হয়ত বা আমারই পূর্বপুরুষ খড়ম পরে সারা বাড়ি পরিক্রমণ করছেন।আমাদের বাড়িতে খড়ম পরার চল ছিল।বাবা,জ্যাঠাবাবু পরতেন।আমরাও পরেছি।চলার সময় ‘খড়াস’ ‘খড়াস’ শব্দ হোত।টালির চালের থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ওই রকম শব্দ করেই পড়ত।আর তার সংগে মিশে যেত আমাদের শোওয়ার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ।ভোর হলেই সেই সব শব্দ কোথায় যে মিলিয়ে যেত!
সকালবেলা আমরা টালির চালের জল বালতিতে জমিয়ে তাই দিয়েই মুখ ধোওয়ার কাজ সারতাম।আর একান্তই বাইরে বেরোতে হলে তালপাতার টোকা আর তালপাতার ‘পেখা’ মাথায় দিয়ে বেরোতে হোত।‘টোকা’ এখনও দেখা যায় শান্তিনিকেতনে।বাঁশের কি তালপাতার কিন্তু ‘পেখা’ কি আর আছে?’পেখা’ হোলো লম্বা লম্বা তালপাতা দিয়ে তৈরি যা মাথা থেকে হাঁটু অব্দি ঢাকা দেওয়া যায় পিঠের দিকে।আমরা বড় বড় চটের বস্তাকেও পেখার মতো ব্যবহার করতাম।ছাতা নিত বড়রা।বেতের বাঁটের কালো কাপড়ের।বেশ বড় আর ভারী হোত।আমাদের মতো ছোটদের সে ছাতা সামলানো দায় হোত।
বরষায় সবকিছু ভিজে আর স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত।রোদ উঠত না বলে মোটা আর ভারী জামাকাপড় শুকোত না।বিছানা বালিশ,মাটির মেঝে সব ভিজে।আর কেমন একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। এ ঠাণ্ডা শীতের ঠাণ্ডা নয়।এ এক ভেজা ঠাণ্ডা।তাই বাক্স-প্যাঁটরা-তোরঙ্গ থেকে বেরোত ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা চাদর আর কাঁথা।ছোটবেলায় তার সংগে মিশে যেত মায়ের গায়ের গন্ধ।সে গন্ধ আর কোথাও পাই না।কোথাও না।বরষায় ভুঁইচাপা ফুলের গন্ধ,মল্লিকা-মালতীর গন্ধ,কামিনীর গন্ধ,রজনীগন্ধার তীব্রতা আর মায়ের গায়ের গন্ধ কোথায় হারিয়ে গেল?বিশেষ করে জ্বর হলে মাকে কাছে পেতাম।একান্নবর্তী পরিবারে মাকে কাছে পাওয়ার এই একটি উপায় ছিল তাই মনে মনে চাইতাম আমার অসুখ হোক আমার অসুখ হোক।আরও অনেক কিছুই চাইতাম।অসুখ হলে শালুক ফুলের শুকনো বীজএর খৈ ভেজে খাওয়াত মা।সহজপাচ্য আর সুস্বাদু ছিল সেই খৈ।এখন মেদিনীপুরের কোনও গ্রামে কোনও মা তার অসুস্থ সন্তানদের এই খৈ ভেজে খাওয়ান?খাওয়ান কি আর ‘পোরের ভাত’? ‘পোরের ভাত’ তৈরী হোত ছোট মাটির ভাঁড়ে সিদ্ধ চাল দিয়ে একটা লোহার কড়াইয়ে ঘুঁটের ধিকিধিকি আগুনে।

ধিকিধিকি আগুনে আরও অনেক কিছু হোত।পাকা তালের কাদ ধিকিধিকি আগুনে সারারাত ফুটে ক্ষীর হোত।সেই ক্ষীরের সংগে চিনি বা গুড় ও আটা বা ময়দা মিশিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ধিকিধিকি আগুনে সারারাত রেখে দিলে ভোরবেলা ‘পোড়াপিঠে’ তৈরি হোত।ধিকিধিকি আগুনে এই বরষায় তৈরি হোত ইলিশের পাতুরি আর ভুট্টা পোড়া খেতাম ধিকিধিকি আগুনেই।খৈ-মুড়ি-চালভাজাতেও বেশি আগুন লাগত না।বেশি আগুন লাগত ধান সেদ্ধ করার সময়।ভাতের চালের জন্য ধান সেদ্ধ করা হোত একবার।প্রথমে ধান কয়েকদিন জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর মাটির হাঁড়ি বা লোহার কড়াইয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিয়ে ধান কলে ধান থেকে চাল করা হয়।আর মুড়ির চালের জন্যে ধান দুবার সেদ্ধ করা হোত।খৈ ভাজা হোত শুকনো ধানেই।বাড়ির উঠোনে তৈরি হোত ধান সেদ্ধর দু-মুখো উনুন আর মুড়িভাজার জন্যে ছিল আলাদা উনুন।কুমোর বাড়ি থেকে মুড়িভাজার স্পেশাল খোলা আনা হোত।তার মধ্যে শুকনো বালি আর নারকেলের কাঠি দিয়ে নাড়া হোত।সে এক অন্য স্বাদ ছিল গরম মুড়ি-খৈ-চালভাজার।এখন যখন মেশিনে তৈরি প্যাকেট মুড়ি খাই আর খেতে খেতে ভাবি মা আমার জীবন থেকে চলে গেছে একা নয় মা নিয়ে গেছে অনেক কিছু।রেখে গেছে যা হারিয়ে গেছে তার টুকরো টুকরো কথকতা।