সাতটি কালুয়া ও মোকাম কলিকাতার কথা......।
ভিকিরিপতি গ্রামটা ছিল পদ্মলোচনের কানাখোঁড়া নামের মতো।অর্থ
ছিল,সংস্কৃতি ছিল, শিক্ষাদীক্ষা ছিল,পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে সদ্ভাব ছিল,বুনিয়াদী
শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বেসিক ট্রেনিং কলেজ তাও ছিল।সবচেয়ে বড় কথা
ছোটোদের জন্যে মন্তেসারি স্কুল আর মেয়েদের জন্যেও স্কুল ছিল যেখানে বাইরের মেয়েদের
থাকার জন্যে হস্টেল ছিল সেই কালেই।ছেলেদের হস্টেলও ছিল।খেলাধুলোর মাঠ ছিল।সাঁতার
কাটার ভালো পুকুর ছিল।বাইরের থেকে পড়তে আসা ছেলেদের হস্টেলে থাকার ও খাওয়ার ভালো
বন্দোবস্ত ছিল।প্রতি সকাল সন্ধ্যে হস্টেলে প্রেয়ার হোতো।এক সংগে জন ষাটেক ছেলে
গাইত-“আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ সত্য সুন্দর”।কিম্বা-“আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও
প্রাণে......”।যেহেতু আমাদের বাড়ির পাশেই স্কুল আর হস্টেল তাই আমিও ওদের সংগে
গাইতাম রোজ দু-বেলা পড়তে বসার আগে।এমনকি একটু দূরের বেসিক ট্রেনিং কলেজে বৈতালিক-এ
যোগ দিতাম।শীতকালে ওখানে বেশ কয়েকদিন
জুড়ে উৎসব চলত।যেখানে কবিতা আবৃত্তি,গান,নাটকে যোগ দিতাম। কলেজের মাঝখানে ছিল মস্ত
দিঘী।সেখানে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হোতো।সাংস্কৃতিক উৎসব তো হোতোই।এই সমস্ত
অঞ্চলটির নাম ছিল ‘কেলোমাল’।নামটা শুনে আজকের অনেকের এটাকে নিম্নমানের মনে হোতে
পারে কিন্তু এই নামের ইতিহাস জানা থাকলে এখানকার ও এখনকার ছেলেমেয়েরা লজ্জিত নয়
গর্বিত হবে অবশ্যই।
শোনা যায় অনেক কাল আগে এই স্থানটি ছিল ভুঁইঞা
রাজাদের।গ্রামগুলো তাই ‘কালুয়া’ ছিল।যেমন ডুবকালুয়া,রামকালুয়া,ভুবনকালুয়া,বনমালীকালুয়া,বলীকালুয়া,
মুরারীকালুয়া ও সাতকালুয়া এই সাতটি কালুয়া নিয়ে কালুয়ার মাল>কেলোমাল।মালের অর্থ
যে সমষ্টি এটা শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই জানেন।এই কালুয়া ছাড়াও ছিল বাটি ও বাড়,পুর ও
গঞ্জ।এখানেও জয়রামবাটি আছে।কুমোরগঞ্জ আছে।পোদোম্পুর,হীরাপুর, চোন্সোদপুর,মামুদপুর,রাধামনি,রাধাবল্লভপুর,রঘুনাথপুর,নাইকুড়ি,মৈশালী
এরকম নানা নাম ও তার ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।গ্রামগুলোর নাম থেকে আশা করি বোঝা যাচ্ছে
এখানে হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি বাস করত।আজও বাস করে।এখানে চড়ক-গাজন যেমন হয়
মহরমের তাজিয়াও বেরোয়।কিন্তু তা নিয়ে কোথাও কখনও কোনও কাজিয়া ঘটেনি।এখানে দোলখেলা
যেমন হয় ঈদও মহাসমারোহে হয়।এখানে কোনদিন কেউ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা
ভাবেনি।এখানে নীলচাষ যেমন হয়েছে আবার জমির আন্দোলন সেও হয়েছে।এখানে নানা শ্রেণীর
মানুষের সহাবস্থান সবার ঈর্ষার বিষয় ছিল।আমাদের প্রপিতামহ এখানে এসেছিলেন
তাম্রলিপ্ত রাজার নয় মহিষাদল রাজার করণিক হিসাবে তাই আজও আমাদের কিছু জ্ঞাতি
‘কারকুন’ হিসাবে পরিচিত।
শোনা যায় মহিষাদল রাজা গর্গ ‘দে’ ও ‘ঘোষ’দের এই গ্রাম দান
করে।আমাদের মূল পদবী ‘দে’ পরে ‘সরকার’।গ্রাম দান করার কালে নানা জীবিকার মানুষদেরও
বসতের ব্যবস্থা হয়।তার পাশাপাশি আত্মীয়তা সূত্রে নাগ,চন্দ,বোস,মিত্র,ভঞ্জ,দত্ত
এরকম কায়েতকুল বসতি গাড়ে।গ্রামে একটা কথা আজও শোনা যায়-‘দেখাদেখির চাষ,লাগালাগির
বাস’।আজও তাই বামুন কায়েতের পাশে ‘হাঁড়ি-মুচি-ডোম-ধোপা-মালাকার-নাপিত’ সব
সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন।যদিও আজ তারা সবাই প্রাচীণ জীবিকাতেই যে ব্যস্ত তা নয়।উড়িষ্যা
থেকে জীবন ও জীবিকার কারণে এখাণে আশা মানুষের সংখ্যাও কম নয়।ব্রাহ্মণদের মধ্যে
যেমন সৎপতি(শতপথী?)সুকুল,ষড়ঙ্গী,মিশ্র আবার মাহিষ্য সম্প্রদায়ের
জানা(জেনা?)মাইতি,বেরা এমন বহু পদবি ও উপাধি ছড়িয়ে আছে পূর্ব মেদিনীপুরে।পান-লাল-বাগ-সিংহ-হাতি-কাঁঠাল-চিনি-বিজলী-দিণ্ডা
ধাড়া-খাঁড়া-ধর-বর-বারুই-পাড়ুই-কুইল্যা-কোলে-পাঁজা-প্রামানিক-পরামানিক-পাত্র-পাল-পাখি-পাখিরা-বল-বালা-ঘোড়া-ঘোড়ুই-গোড়ুই-গুছাইত-মান্না-দাস-দাশ-শাসমল
আরও বহু পদবির সমাহার।বস্তুত কেলোমাল তথা তাম্রলিপ্ত ‘মিনি ভারতবর্ষ’।
এখানে ঘোষ ও সরকারদের মধ্যে বিত্তের রেষারেষি ছিল।তা নিয়ে
নানা গল্প ও কাহিনি চালু আছে।ঘোষেদের একজন সে কালে ‘কালাপানি’ পার হয়েছিলেন বলে
তার গ্রামে প্রবেশাধিকার ছিল না।এক আতর বিক্রেতা সারা গ্রাম ঘুরে কোথাও আতর বেচতে
না পেরে বিদ্রুপ করায় আমাদের এক পিতামহ পুকুর থেকে স্নান সেরে ওঠার সময় সমস্ত আতর
কিনে পায়ের চটিতে ঢেলে দিতে বলেছিলেন এমনই কৌলিন্যের দাম্ভিকতা।আমাদের শৈশবেও এই
দাম্ভিকতা প্রত্যক্ষ করেছি।তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমাদের সরকার বাড়ির থেকে
ঘোষেদের বাড়িতে শিক্ষার চর্চা ছিল অনেক বেশি।আবার বিপদে আপদে দুই বাড়ির সবাই
একসাথে হোতো নির্দ্বিধায়।
আমাদের সেকালেই একটা ক্লাব ছিল ‘কেলোমাল অ্যাথেলেটিক
ক্লাব’।নামে অ্যাথেলেটিক হলেও খেলাধুলোর পাশাপাশি পুজো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোতো
যখন তখন।যাত্রা ও নাটকের বিশেষ গুরুত্ব ছিল।আমার ছোটোকাকা কমেডি অভিনয়ে ওস্তাদ
ছিল।তাই তার ডাক পড়ত সবার আগে।আমার রাঙাকাকাকে আমি যোগেশ চৌধুরির “সীতা” নাটকে
সীতার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি।শংকুদা পয়সার জোগান দিত বলেই হয়তো সবসময় নায়ক
চরিত্রে অভিনয় করত।আমাদের এক জ্ঞাতিকাকা ছিল রুদ্র নামের।তিনি সবসময় শংকুদার পাশে
থাকতেন।নাটকের অভিনয়ের কালেও।অনেকটা মেফিস্টোর মতোই।নিয়ম মাফিক নয় হুজুগ উঠলেই
নাটকের মঞ্চ তৈরি হোতো।আবার জগদ্ধাত্রী পুজোর শেষ দিন যাত্রা হোতো।রাস পূর্ণিমায়
সাতদিন ধরে ম্যারাপ বেঁধে যাত্রার আসর বসত।বাইরের আমন্ত্রিত দলের পাশে একদিন
নিজেদের পালাও থাকত।
আসর বসত রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটার পরে।সবাই রাতের খাবার
খেয়ে,মেয়েরা হেঁসেলের কাজ সেরে পানের ডিবে হাতে নিয়ে চিকের আড়ালে এসে বসবে।সংগে আমরা কচিকাচার দল।বড়রা আসরের সামনে।হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত আসরে যখন একে
একে বাদকের দল এসে বসবে।কনসার্টের প্রথম ঘন্টা বাজবে ঢং করে আমাদের মন হবে উতলা
রাধার মতো।থার্ড বেল পড়া মানেই বাজনা শুরু হবে। সবাই যে যেখানে থাকবে পড়িমরি
ছুটবে।কারো কোঁচড়ে মুড়ি,আঁচলে পান,কানে বিড়ি কিম্বা হাতে সিগারেট।কেউ
কেউ মেলায় বসা দোকান থেকে একশ বিশ কি গোপাল জর্দা দিয়ে, কেউ কেউ কড়া দোক্তা দিয়ে
পান সাজাবে সারা রাতের জন্যে।কেঊ কেউ ধেনো টেনে এসেছে।তারা বসবে দূরে।তবু গন্ধ
আড়াল করবে কী করে?সারা আসর পান-বিড়ি-সিগারেট-গুড়াকু আর ধেনোর গন্ধে ম ম করবে।রাত
গভীর হলে এর সংগে বদহজমের বায়ু......তবু সব ভুলে জনতা উত্তাল হবে যুদ্ধের
‘সীন’-এ।আর পাছে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে তাই প্রতি দৃশ্যের পরেই থাকত একটি ‘আইটেম সং’
কিম্বা ‘আইটেম ডান্স’।ভালো অভিনেতাকে ‘মেডেল’ বা টাকা দেওয়া হোতো।বলতে ভুলে গেছি
তখন ছেলেরাই নারী চরিত্রে রূপদান করত।বহুপরে নারী চরিত্রে অভিনয় করতে
দেখেছি।কুমোরগঞ্জে যখন পেশাদার যাত্রার দল হয়েছিল তাদের ফাইন্যাল মহড়ায় আমরা
যেতাম।সেখানে মেয়েরাই অভিনয় করত।তারা কেউ সুন্দরী ছিল না।অভিনয় করত এক অদ্ভূত
কন্ঠে।আমার তাই নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনেতার অভিনয়ই জুতসই মনে হোতো।পরে কেতকীদির
(কেতকী দত্ত)ভাই চপলরানি(চপল ভাদুড়ি)কে নিয়ে কাজ করতে গিয়েও তাই মনে হয়েছে।যাত্রার
কিংবদন্তী চপল ভাদুড়ি বাংলা প্রসেনিয়ম মঞ্চে প্রথম আমার “নিজভূমে” নাটকেই অভিনয়
করেন কেতকী দত্তের সংগে।এর পর তাকে বেশ কয়েকবার মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা
হয়েছে।এখানে সুযোগ মতন জানিয়ে রাখি বাংলা যাত্রার প্রথম ‘নটী’ জ্যোৎস্না দত্ত যার
অভিনয় দেখে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মানুষ আপ্লুত হতেন তিনি অপূর্ব সুন্দরী
ছিলেন।রাখাল মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে যাত্রার আসরে নানান পালায় তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ
হয়েছি।সেই তিনি যখন অকালে অসুস্থ হয়ে হেদুয়ার গলিতে বিছানায় শয্যাশায়ী তাকে দেখতে
গিয়ে অবাক হয়েছি।যে মানুষটি এক কালে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন।যাত্রার মালিক মরসুমের
শুরুতে টাকার থলে আর দামি গাড়ি নিয়ে হাজির হোতো সেই তিনি তখন একা। দেখার কেউ
নেই।খবরটা প্রকাশ করেছিলাম ‘সত্যযুগ’-এর পাতায়।সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব
ভট্টাচার্য খবরটা প্রকাশের সংগে সংগেই মেডিকেল টিম পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কোনও
অনুদান কি অনুগ্রহ নিতে রাজি নয়।এই হোলো জাত শিল্পীর আত্মাভিমান।আর একটা কথাও
জানিয়ে রাখি অনেকেই ‘নটী’ কথাটিতে অসম্মানের সন্ধান করেন কিন্তু ‘নট’ ও ‘নটী’
কথাটিকে যারা অশ্লীলভাবে ব্যবহার করেন সেটা তাদের শালীনতা ও রুচির বিষয়।আমি নিজেকে
‘নাটুয়া’ ভাবতে গর্ব অনুভব করি।
আমরা যখন অভিনয় করা শুরু করেছিলাম তখন আমাদের এক জ্ঞাতিদাদা
দুলুদা, ভালো নাম তপন সরকার আমাদের মেন্টর ছিলেন।দুলুদার কণ্ঠস্বর,পড়াশোনা আমাকে
মুগ্ধ করত।দুলুদা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত।‘শের আফগান’, ‘নানা রংয়ের দিন’,
‘তিন পয়সার পালা’ ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’র সব সংলাপ তার মুখস্থ।কবিতা পাঠে আবার
শম্ভু মিত্রের ভক্ত।এখনও মনে করি তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল চমৎকার। দুলুদার মতো অনেক
না হলেও বেশ কিছু মানুষকে এই পোড়া দেশে দেখেছি যারা সুযোগ পেলে কিছু করে
দেখাতেন।সেই দুলুদা একবার ‘সাজাহান’ নাটক পরিচালনা করল।নিজে হলেন সাজাহান।সে এক
অভিজ্ঞতা!প্রতি সীনের শেষ-এ ড্রপ পড়ত।আর কেউ সংলাপ ভুলে গেলেও ড্রপ পড়বে।আর দড়ির
টানাটানিতে ড্রপ আটকে গেলে আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে।সখের থিয়েটারের অভিনেতা
অভিনেত্রীদের নিয়ে কতো ঝামেলাই যে হোত সে বলার নয়।আবার নাটক করতে এসে প্রেম
ভালোবাসাও হয়ে যেত।আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা
বৌদির বিয়ে হয়েছিল “শ্রীমতি ভয়ঙ্করী” নাটকেই।
ভিকিরিপতি গ্রামে আমার এক বন্ধু ছিল কুমোরগঞ্জের মোহনদা
মোহন মাইতি।প্রাইমারী স্কুলের টিচার।ছবি আঁকায় পটু।সেও আমাদের নাটকের দলে জুটে
গিয়েছিল।আমরা এক বৈশাখে ‘ডাকঘর’ করলাম।কলকাতা থেকে নাটকের কিছু আত্মীয় গিয়েছিলেন দেখতে। আমি তাদের হাত ধরে থলিতে করাত-বাটালি-হাতুড়ি-র্যাঁদা-তুরপুন নিয়ে চলে এসেছিলাম মোকাম কলিকাতায় নাটকের কাজে।ফেলে এলাম ছবি-কবিতা-সখের থিয়েটার।ছেড়ে এলাম ভিকিরিপতি।ফেলে এলাম আমার শৈশব,আমার কৈশোর।আমার গুটিপোকা আমিকে।