MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বুধবার, ২৮ জুন, ২০১৭

অন্তরঙ্গ নাট‍্য১
ছোটবেলায় দেশঘরে থিয়েটার দেখেছি, করেছি মাঠে অস্থায়ী স্টেজে।পরে জেনেছিলাম ওকেই বলে প্রসেনিয়ম স্টেজ।নাটক নিয়ে পড়তে এসে বুঝলাম ওটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।তখন আকাদেমি, রবীন্দ্রসদন, মুক্তাঙ্গন, রঙ্গনা, রঙমহল, মিনার্ভা, বিশ্বরূপা এগুলোই ছিল থিয়েটার করার স্টেজ।এর মধ‍্যে আকাদেমিই ছিল সবার প্রাণকেন্দ্র।সে বহুরূপীই হোক কি পি এল টি।নান্দীকার হোক কি থিয়েটার ওয়র্কশপ।থিয়েটার কমিউন হোক কি চার্বাক।বাকি অনেকের যাদের নাম নিলাম না তারা কালেভদ্রে সুযোগ পেতেন বেড়ালের ভাগ‍্যে শিকে ছেঁড়ার মতন।অজিতেশ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় এর নাটক তখন সকালে হয়।
তখনও বাংলা নাট‍্যচর্চায় নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না অবস্থা হয়নি পেশাদার থিয়েটারের।জমিদারী যেতে চলেছে এটা বোঝা গেলেও ঠাটবাট বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টাটা আছে।তার সংগে অনুপ্রবেশ ঘটল প্রাপ্তবয়স্ক নামের অশ্লীল অনাটক।বারবধূ প্রতাপ মঞ্চে রমরমিয়ে চলছে শুধু "A" লেখার টানে।আমি পরে স্ক্রিপ্টটা পড়েছি মন দিয়ে।কোথাও অশ্লীল ছিল না।
এর মধ‍্যেই চুপিসাড়ে এসে পড়ল বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার।নাটক দেখতে গিয়ে মারা পড়ল প্রবীর দত্ত কার্জন পার্কে।এসে গেল বামফ্রন্ট।বেঁচে গেল গ্রুপ থিয়েটার।বাংলা নাটক অক্সিজেন নিল বার্টোল্ট ব্রেক্ষ্টে।
এবার বাংলা থিয়েটার একদিকে হাতিবাগানের বাণিজ‍্যিক থিয়েটার, ক্ষয়িষ্ণু পেশাদার থিয়েটার, গণনাট‍্য, গ্রুপ থিয়েটার আর অন‍্য ধারার থার্ড থিয়েটার।
বাদল সরকার এই প্রসেনিয়ম কনসেপ্ট ভাঙলেন তা কিন্তু নয়।চারের দশক থেকেই গণনাট‍্য পথে নাটক করছে।সামান‍্য কিছু উপকরণ, বাদ‍্যযন্ত্র গলায় ঝোলানো।পুলিশ তাড়া করলেই পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে হয়।অভিনয় আর নাট‍্যবিষয় এই ছিল সম্পদ।থার্ড থিয়েটার আনল নতুন চিন্তাধারা নাট‍্যদর্শনে।সবাইকে নয় কিছু মানুষ আসুক দেখুক ভাবুক।জানুক এভাবেও থিয়েটার হয়।দর্শকের সংগে অন্তরঙ্গ হবার প্রয়াস।ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের গানের পঙক্তির মতো " কোনো আয়োজন নাই একেবারে।সুর বাঁধা নাই এ বীণার তারে"‌
দেখতে দেখতে বাদলবাবু জনপ্রিয় হতে থাকলেন বুদ্ধিজীবী মহলে আর যারা প্রসেনিয়মের হাতির খোরাক জোগাতে অক্ষম তাদের কাছে।এর ফলে একদিকে সারস্বত চর্চা বাড়ল আবার একটা ধোঁয়াশাও তৈরি হতে থাকল।
ঠিক এই জায়গাতেই ঢুকে পড়ল অন্তরঙ্গ বা ইন্টিমেট থিয়েটার।গ্রোটোস্কি, অউগস্ত বোয়াল এসে পেনিট্রেট করছেন।অবণী বিশ্বাস প্রবীর গুহ থিয়েটারের ধারা পাল্টানোয় শিক্ষা শিবির চালাচ্ছে।
(ক্রমশ)
অন্তরঙ্গ নাট‍্য2
রঙ্গ রঙ্গশালা অন্তরঙ্গ হওয়া অন্তরঙ্গ করে তোলা অন্তর বিকশিত করা? ইংরেজি ইন্টিমেট ইন্টিমেসি এই শব্দবন্ধকে আশ্রয় করেই কি এই নাট‍্যকথা?
যদি খুব ভুল না করি নয়ের দশকে এই ধারার নাটক করা শুরু হতে থাকে।নন্দন চত্বরে, মধুসূদন মঞ্চের চাতালে উৎসবে বাংলা ছাড়াও কেরালার কিছু কাজ দেখি যেখানে প্রপস্, মেক আপ এমনকি চমৎকার ভাবে আলো আর সাউন্ড ডিজাইন করা হচ্ছে।বাদলবাবুর থিয়েটারের মতো নয়।হাসমির নুক্কড় ড্রামাও নয়।পথ নাটক নয়।এই উপস্থাপনা আমার মধ‍্যে একটা ছাপ ফেলল ঠিক যেমন সাতের দশকে আকাদেমির ঘাসের গালিচায় সফদর হাসমি ও তার নাট‍্যযোদ্ধাদের আওরৎ আমাকে নাড়া দিয়েছিল নাটকের বিষয় ও উপস্থাপনায়।
হাসমি আর তার নাট‍্যধারা পাত পেল মৃত‍্যুর পর।তার আগে এই বাংলায় হাসমি বাংলা নাটকের বন্ধু।আমার মতো সামান‍্য কজন তার সংগে তর্ক তুলতাম।অনেকেই তোয়াজ করতেন দিল্লিতে উৎসবে সুযোগ পাবার আশায়।হাসমির বড়ো গুণ ছিল নিজে পথ ঘাট মাঠের বাম রাজনীতির নাটক করলেও বাংলার প্রসেনিয়ম মঞ্চের নাটককে রাজনৈতিক আদর্শেই সম্মান জানাত।এখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি হাসমির নাটক কী অন্তরঙ্গ ছিল না?বিশেষ করে ওর শেষ স্থাপনা হল্লাবোল ছিল শিল্প গুণে ভরপুর।এ বাদে বাকি নাটক মূলত আ্যজিটেশন প্রোপাগান্ডা।আওরৎ অবশ‍্য অনেকটাই উঁচুমানের নাটক।আমার কথা থেকেই উঠে আসছে আমি বারবার নাটকের বিষয় তার লেখনী এগুলোর কথাই বলছি কারণ জননাট‍্য মঞ্চের উপস্থাপনায় কোনোও অভিনবত্বের ছাপ দেখিনি।তার চেয়ে অনেক বেশি চমৎকৃত হয়েছি ঢাকায় বসে ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা ছাড়াও অপ্রতিষ্ঠিত অনেক নাট‍্যদলের মাঠ প্রযোজনা দেখে।
এ বাংলায় এই অন্তরঙ্গ প্রযোজনা অনেক দেখেছি এমন দাবি করতে পারব না।তবে যা দেখেছি তাও নেহাত কম নয়।অনেক আলোচনা সভাতেও যোগ দিতে হয়েছে।সেটারও একটা কারণ বোধহয় এখন যে ধারার পারফরমেন্স করছি তাতে অনেকেরই অন্তরঙ্গ থিয়েটারের সংগে মিলিয়ে ফেলার অবকাশ থেকে যায়।
বিভাবন এর আমন্ত্রণে প্রসেনিয়ম আর্ট সেন্টারে "উৎসারিত বর্ণমালা" করেছি।এ প্রজন্ম এই পারফরমেন্স দেখে রিএক্ট করেছে। আবার অনেকের মনে হয়েছিল এ আবার নাটক হলো কী করে!
এরপর বন্ধু প্রবীর গুহর আমন্ত্রণে ওই প্রসেনিয়ম আর্ট সেন্টারেই "অজাতক" করেছি।
এরপরে নাট‍্যসুহৃদ তথাগত চৌধুরির আমন্ত্রণে পার্ক স্ট্রিটের স্পন্দন আর্ট গ‍্যালারিতে "অজাতক" ও "অজহলিঙ্গ" উপস্থাপন করেছে নির্মাণ কলাকুশলী।যার সব কটিই ছিল "পোস্টমর্টেম পারফরমেন্স"।
(ক্রমশ)
অন্তরঙ্গ নাট‍্য3
শিল্প সৃজনে দুটো দিক থাকে।এক, তাগিদ।দুই, প্রয়োজন।এই প্রয়োজনের দুটি দিক থাকে।একটা অর্থের প্রয়োজন।আর একটা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন।
তাগিদ কথাটা লিখলাম কারণ অন্তরের তাগিদ না থাকলে সময়ের তাগিদ না থাকলে কোনোও শিল্প সৃজন সম্ভব নয়।যে বা যারা বলেন আমি রাজনীতি বুঝি না শিল্প করি।কেউ বলেন এটা করেই আমার পেট চলে।এরা কেউই উপরের কথাগুলো অস্বীকার করতে পারেন না।
বাংলার নাট‍্যচর্চায় ছোট বড় ও অনুবাদ মিলিয়ে পঞ্চাশের মতো নাটক লিখেছি যার অধিকাংশই মঞ্চস্থ ও পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত আর তার সবই ছিল প্রসেনিয়ম মঞ্চের নাটক।তার মধ‍্যে কয়েকটা আবার এখনকার বাংলা নাট‍্যের "মহারথী"দের কাছে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে।বাংলাদেশের ঢাকা চট্টগ্রাম বগুড়া যশোর খুলনার নাট‍্যকর্মীরা বেশ কিছু প্রযোজনা আন্তরিকতার সংগেই প্রসেনিয়ম মঞ্চে করেছেন।তারপরেও কেন মনের ভিতরে সাড়া পাচ্ছিলাম না নতুন নাটক লেখার।নাট‍্যরথীরা সবাই বলেন উপযুক্ত নাটককার আর নাটকের বড়ই অভাব।কেউ কি উল্টোটা কখনোও ভেবেছেন নাটকের মাপের উপযুক্ত নাট‍্য উপস্থাপকের অভাবটাই প্রকট। কেউ কি ভেবেছেন কেন আজ পরিচালনায় নয় প্রচারেই আত্মপ্রচারেই নাট‍্যের হাতি শোভাযাত্রায় বেরিয়েছে পথে।সারা বাংলায় কেন নেই একটিও বিজ্ঞানসম্মত মঞ্চ।কেন নেই একটিও স্টুডিয়ো থিয়েটার।জাতীয় নাট‍্যশালা খায় না মাথায় দেয় এ প্রজন্ম জানতেও পারল না।তার দায় আমরা এড়াব কোন্ আত্মমহিমায়?এইখানেই অন্তরঙ্গ থিয়েটার তার আসন পেতেছে।যদিও আমি মনে করি বাংলা থেকে প্রসেনিয়ম চর্চা পুরোপুরি অপসৃত হবে না দীর্ঘ নাট‍্য ঐতিহ‍্য আর এ কালের প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতায়।অপরদিকে ভিন্নধারার থিয়েটার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় ও অনাড়ম্বর উপস্থাপনায় ক্রমে ক্রমে প্রসারিত হতে থাকবে।
"ভাতজোছনা" লিখেছিলাম শিল্পের অজুহাতে কৃষকদের উপর গুলি চালানোর উদ্ধত অহংকারের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে।স্পেস পেলাম শান্তিনিকেতনে এসে।কলাভবনের অঅভিনেতাদের মনে হোল এ নাটকের উপযুক্ত উপস্থাপক হতে পারে।তারা প্রথাগত নাট‍্যশিক্ষায় শিক্ষিত নয় বা তারা প্রথাগত নাটুকে প‍্যাঁচ পয়জারে অভস্ত‍্য নয়।তারা লিখিত স্ক্রিপ্টের মধ‍্যে চিত্রের ভাষা সন্ধান শুরু করল।স্পেস ব‍্যবহারের সূত্র সন্ধানে শুরুতেই তাদের নিয়ে তর্ক জুড়লাম।এক সংগে সঞ্চয়নের সহযোগিতায় স্পেস ধীরে ধীরে নাট‍্যের দাবি মেনে গড়ে উঠতে থাকে।ঘাসের জমি পাল্টে হয়ে যাচ্ছে অভিনয়ের স্পেস।
(ক্রমশঃ)
অন্তরঙ্গ নাট‍্য4
পারফরমেন্স স্পেস গড়ে উঠতে উঠতে অভিনেতা হয়ে ওঠার আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক।এই ব‍্যাপারটা কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া ছিল না।টেক্সটের বাহ‍্যিক অর্থ আর অন্তর চলন কী হতে পারে সেটা ওই গড়ে ওঠা স্পেসেই প্র‍্যাকটিস করতে করতেই নির্মিত হতে থাকে।স্ক্রিপ্টের ভাষা বাংলা, ইংরাজি, মালায়লাম,হিন্দি এমনকি স্থানীয় ডায়লেক্ট তাও স্থান করে নিচ্ছে।কারণ থাইল‍্যান্ডের কর্মা সিরিগোকর মালায়ালি জমি, বাঙালি মিমি, স্থানীয় ফকির একরাম আলি, ভূমিকন‍্যা সুকুরমনি কমিউনিকেট করছে নিজেদের মধ‍্যে আবার প্রতিদিন মহড়া দেখতে আসা দর্শকদের সংগেও।যেহেতু সবটাই ওপেন স্পেসে হচ্ছে যার কারণে শ্রমজীবী মানুষরাই কাজ শেষে ফেরার পথে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে অভিনেতাদের সংগে সংলাপ মুখস্থ করছে,ভাষা বিনিময় করছে।নির্দেশক আমি শুধু নিয়ন্ত্রণ করছি।আটকে দিচ্ছি না।নাট‍্যের মুহুর্ত গড়ে উঠতে সাহায‍্য করছি।এর ফাঁকে আমি কলাকুশলীদের মানসিক দ্বন্দ্ব ও তত্ত্ব থেকে প্রয়োগ এর বিষয়টা অনুধাবন করছি।বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছি এরা কেউই ট্রেন্ড অভিনেতা নয় আর তাই উঠে আসছে এক ভিন্নতর বিন‍্যাস।
দেখতে আসা নাট‍্যবোদ্ধাদের কারো কারো মনে হয়েছিল অভিনয়ে খামতি আছে।আমি তাদের একবারের জন‍্যেও স্মরণ করিয়ে দিইনি আপনারা কি কাঙ্খিত অভিনয়ে পৌঁছতে পারেন।আসলে তারা প্রথাগত প্রসেনিয়মের নিগড় থেকে বেরুতে পারছিলেন না।তাদের যদি বলা হোত ওই বিশাল স্পেস জুড়ে অভিনয় করতে ও সারাক্ষণ স্পেসে সক্রিয় ভূমিকায় উপস্থিত থাকতে তারা অস্বীকার করতেন।
পোস্টমর্টেম পারফরমেন্স অনেকটা মাঠে বাইশজনের ফুটবল খেলার মতো।
এর মধ‍্যে আর একটা বিষয় উঠে আসছিল কলাকুশলীরা প্রতিদিন অনুশীলনে ক্লান্ত ও বিরক্ত হচ্ছিল।এটা যে হবে তা নাট‍্যের মানুষ আমার জানা।তাই অনুশীলনের অবসরে কিছু খেলা কিছু শিথিল আলাপচারিতা থেকে ফিরিয়ে আনতে হোত তাদের।এখানে পরিচালকের অসীম সহিষ্ণুতা প্রয়োজন।কারণ থিয়েটার দৈনন্দিন জীবনেরই শিল্পিত রূপ।তফাৎ সংসারে ঘটে চলে,এখানে সচেতনভাবে ঘটানো হয়।একইসংগে প্রস্তুত থাকতে হয় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিকে অভিনয় উপস্থাপনায় অনুকূলে আনা।খুব দক্ষ কলাকুশলীদের কাছেও যা অনায়াস সাধ‍্য নয়।
কলাকুশলীদের অধিকাংশই যেহেতু কলাভবনের তাই তারা স্পেসটার পরিবর্তনকে ক‍্যানভাসে রঙ চাপানো বা কাঠ কি পাথর কুঁদে ভাস্কর্যে পৌঁছনোর মতোই দেখছিল।আর এর ফলে অনেকেই মাঠের সাইডলাইন থেকেও খেলায় যোগ দিতে থাকল নানান ভূমিকায়।
(ক্রমশঃ)
অন্তরঙ্গ নাট‍্য6
মালদা থেকে এসেছিল ছেলেটি পরিমল ত্রিবেদীর একটা চিঠি নিয়ে।এই শহরের রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে পড়বে আর নাটকের কাজ করবে।কথায় কথায় জানলাম বাবা ডাক্তার, দাদা দিদি চাকরি করেন।
বাস্তুভিটে নির্মাণের প্রথম প্রযোজনা সেখানে একটি চরিত্রে নিলাম।
বাস্তুভিটে বারো মাসে তেরোটা শো করেছিলাম অনেক টাকা ব‍্যয় করে।সংসার চালানোর টাকা চলে যেত নাটকের কাজে।আমি আর অপর্ণা যা আয় করি সব যায় ওখানে।আর এক বন্ধুভাই টাকা যোগাত।দলের কাউকে এক টাকাও চাইনি কোনদিন।তারাও দেয়নি।তাদের আমি পেশাদার হতে শিখিয়েছিলাম।দাদাগিরি আমার চির কালের না পসন্দ্।তাই এক সময় থামিয়ে দিলাম ঠিক যেমন হুট করে শুরু করেছিলাম "একটি নির্মাণ প্রয়াস"।বাকি ইতিহাস লিখছি না কারণ সেটা নাট‍্যের অন্তরঙ্গ দিক ছিল না।
থামিয়ে দিলাম তবু থামল না।আমরা দুজনেই থিয়েটারের কাজ করে যাচ্ছি দেখে কয়েকটি যুবক সংগে লেগেই থাকল।তার মধ‍্যে সুপ্রিয় একজন যে ততদিনে বিভাবন নাম দিয়ে ইন্টিমেট থিয়েটার করছে নানা জায়গায়।এর মধ‍্যে সুপ্রিয় বাদলবাবু থেকে প্রবীরের নাট‍্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে।আমাকে দেখতে ডাকছে।
বহুকাল পরে সেই সুপ্রিয়র আমন্ত্রণে এলাম শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় "উৎসারিত বর্ণমালা" নিয়ে।এই পারফরম্যান্স পুরোটাই প্রেমের আন্দোলন।রবীন্দ্রনাথ,লালনের গান আর আমার আঁকা ও লেখা কবিতা।
পারফর্ম করলাম আমরা চারজন।রবি গানে সঙ্গীতা,লালনের গানে মঞ্জু বারিক বাউল আর আমার সংগে আমাদের মেয়ে তিথিপর্ণা।
এই পারফরম্যান্স এর অন্তর পোস্টমর্টেম হলেও বহিরঙ্গে অবশ‍্যই অন্তরঙ্গ বা ইন্টিমেট থিয়েটার।পারফরম্যান্স শুরুই হয় তিন নারীর গড়ে তোলা রিচুয়ালস দিয়ে।এটা যে একটা পারফরম্যান্স সেটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি।আবার অনেকেই এর মধ‍্যে পেয়েছিল প্রেম সুধারসের সন্ধান।বিশেষ করে যারা অন্তরঙ্গ নাট‍্য ভাষার সন্ধান করছেন।
ওপেন স্পেস থেকে এইভাবে ইন্টিমেট স্পেসে ঢুকে পড়া আমার কাছেও ছিল পোস্টমর্টেম এর আর এক দিক যা তখনো অসম্পূর্ণ প্রযোজনা প্রক্রিয়া।
(ক্রমশ)
অন্তরঙ্গ নাট‍্য5
পোস্টমর্টেম পারফরম্যান্স করার সময় যখনই কলাকুশলীদের নির্বাচন এর পর্যায় আসে আমি সচেতনভাবে প্রসেনিয়ম থিয়েটারের প‍্যাঁচ পয়জারে অভ‍্যস্ত অভিনেতাদের এড়িয়ে চলি।তার একটাই কারণ এরা ওপেন স্পেস বা ইন্টিমেট স্পেসে এসেও অকারণে উচ্চকিত করে ফেলে নিজেকে নয়ত আড়ষ্ট বোধ করে।এদের অধিকাংশই ভাবেন প্রসেনিয়ম হলো ম‍্যানারিজম আর ম‍্যাজিক প্রদর্শন কেন্দ্র।তারা একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে আধো আলো অন্ধকারে মায়া সৃষ্টি কখনও বা সীমাবদ্ধতা ঢাকতে আপ্রাণ প্রয়াসী হন।আর এর ব‍্যতিক্রমীরাই আমাদের দেশের অবিজ্ঞান প্রসেনিয়মেই উল্লেখ যোগ‍্য উপস্থাপন ঘটান।আমার দেখা উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়।আর সাম্প্রতিক কালে দেখলাম দেবাশিস রায়ের হৃদিপাশ প্রযোজনায়।মোহিত মৈত্র মঞ্চের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই অডিটোরিয়ামের পরিসরে বেরিয়ে এসে দর্শক ও কলাকুশলীদের মধ‍্যের বেড়াটা ভেঙে দিচ্ছে বারবার।এর কারণ দেবাশিস খড়দহে হলঘরে যখন নাটক প্রযোজনা করত সেখানে সে এটার শিক্ষা পেয়েছে।এমনকি সে অনভিজ্ঞ কলাকুশলীদের সংগে অভিজ্ঞদের মিশিয়ে একটা সিম্ফনি সৃষ্টি করছে যা দেখবার মতোই।
আমি মনে করি যারা শিল্পের যে কোনো শাখায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তাদের দিয়ে নাট‍্যের কাজ করা অনেকটাই নবতর ব‍্যঞ্জণার সম্ভবনাময়।তাই "ভাতজোছনা"য় কলাভবনের ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত মনে করেছিলাম।পাশাপাশি বাইরের থেকে যাদের নিলাম তাদের একজন ফকির একরাম যে অপটু কণ্ঠে অজস্র লোকায়ত গান অবিরাম গেয়ে যেতে পারে।আর এলো সুকুরমনি।একটি আদিবাসী কিশোরী।পড়াশোনা করে।
একরামের কাজ ছিল শুরু থেকে শেষ অব্দি উপস্থাপনে কথা ও গানে মুহুর্তের মালা গাঁথা।আর সুকুরমনি আসত স্বপ্নে।
কর্মা,জমি,মিমি এদের সংগে একরাম আর সুকুরমনি চমৎকার মিশে গিয়েছিল।
ওই ওপেন স্পেসে কল্পিত সীমারেখার মধ‍্যে অভিনয়ে যথেষ্ট অনুশীলনের প্রয়োজন হয়।তারা তা করেছিল।হাজার দর্শকের উপস্থিতি তাই তাদের কাছে বাধা হয়ে ওঠেনি।
(ক্রমশ)
প্রতিবাদের নাট‍্যাভ‍্যাস
কিছু কিছু শব্দ বড়ো আটপৌরে।যে কেউ যে কোনোও সময় উচ্চারণ করে।ইন্ডাস্ট্রিতে কথায় কথায় বলে "হাঁড়ি চড়িয়ে আসিনি" অর্থাৎ তিনি শিল্প করতে এসেছেন পয়সা কামাতে নয় যদিও তার নিজের জানা নেই তিনি ঠিক কতটা যোগ‍্য আর কাকেই বা বলে পেশাদারিত্ব।বাম আমলে অনেকেই কথায় কথায় গর্জে উঠতেন আর বলতেন প্রতিবাদ করতে হবে।সেই প্রতিবাদ কালে কালে পোতিবাদ হয়ে গেল।খেয়াল পড়ল যখন তখন সেটাই অভ‍্যাসে পরিণত হয়ে গ‍্যাছে।এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ বলে থাকেন আমি নিজেকে বিকিয়ে দিইনি।তাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা যায় আচ্ছা আপনাকে কেউ কিনতে এসেছিল?আবার কেউ কেউ সুমন চট্টোপাধ‍্যায়ের গানে শান দিয়ে বলেন যদি ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ।অন্তরঙ্গ নাট‍্যের সুপ্রিয় সমজদার ফোন করে জানাল তারা একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যার বিষয় নাটকের প্রতিবাদের ভাষা বিক্রী হয়ে যাচ্ছে কী?শুনে বেশ আগ্রহ জন্মেছে।শুনতে ইচ্ছে করছে কে কী বলেন।কেমন ভাবে বলেন।কোন্ ভাষার কথা কোন্ ভাষায় বলেনআচ্ছা নাটকে প্রতিবাদ ঠিক কী?মঞ্চে কিছু স্লোগান আর নিশান?সে তো এজিটপ্রপ।গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যে নাটক হয় সে যে রাজনৈতিক দলের হোক না কেন সে তো নির্বাচনী প্রচার নাট‍্য নয়।যে ভাষায় কথা বলা হয় সে তো একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট এজেন্ডার।সেও কী নাট‍্যভাষা ছিল কোনদিনই?তাহলে নাট‍্যের ভাষা কী?দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বার্টোল্ট ব্রেষটকে যখন আন আমেরিকান এক্টিভিটিজ অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা করে বলা হোলো আপনি কমিউনিস্ট।তিনি অস্বীকার করলেন।তাকে জানতে চাওয়া হোলো তার নাটকের সংলাপ তাহলে কমিউনিস্টদের মতো কেন?তার উত্তরে চতুর ব্রেষট বললেন ওটা চরিত্রের ভাষা।তার ভাষা নয়।ভাষা কী করে বিক্রী হয়?ভাষাকে কী কেনা যায়?ভাষা নষ্ট হতে পারে।ভাষা ব‍্যর্থ হতে পারে।ভাষা ব‍্যবহারে জীর্ণ হতে পারে।ভাষা রিক্ত হতে পারে।আবার যোগ্য মানুষের হাতে পড়ে বেগবান, তীব্র, তীক্ষ্ণ ও মোক্ষম হতে পারে।
ভাস এর নাট‍্যে কি ছিল না প্রতিবাদ ও নাট‍্যভাষা?শূদ্রক এর মৃচ্ছকটিকম্ এও কি আমরা খুঁজে পাইনি প্রতিবাদী নাট‍্যভাষা।এমনকি কালিদাস বিরচিত অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ সেও কী তুলে ধরেনি সময়ের ব‍্যভিচারী সমাচার?যে নাটকগুলোর কথা বললাম এর সব কটিই তো রাজানুগ্রহে।কালিদাস তো বিক্রমাদিত‍্যের নবরত্নের এক অপার অমোঘ রত্ন।বাংলা নাট‍্যে নীলদর্পণ আর নবান্ন ই শুধু প্রতিবাদী ভাষা।রক্তকরবী নয়?যেমনসাম্প্রতিক কালে দেখলাম "হৃদিপাশ"।