MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬

ওরা ডাকে-আয়......আয়
সলিল সরকার
শক্তি চাটুজ্যে লিখেছিলেন-যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?অথচ সেই তিনিই কিন্তু বারবার চলে যেতেন এখানে সেখানে।আমরা আদতে বোধহয় তাই।কতবার কত আত্মীয়ের বাড়ি যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি।আবার সামান্য চেনা বন্ধু যখন ডেকেছে একছুটে চলে গেছি পিঠে সামান্য জামাকাপড় গুছিয়ে হ্যাভারস্যাকে ভরে।
শরতকাল এলেই পাহাড় আমাকে ডাকে-আয় আয় আয় আয়।ডাকলেই তো আর যাওয়া যায় না।কতো পিছুটান থাকে।কতো বাধা এসে ন্যাওটা বেড়ালের মতো পায়ে লুটোয়।এর পরেও জেদী ডানপিটেদের মতো বেরিয়ে পড়তে পারলে-ব্যস!আর পায় কে?
সংসারে প্রবেশের আগে আমরা কয়েকজন বন্ধু সুযোগ পেলেই পালাতাম।পাহাড়েই গেছি বেশি।তবে সেগুলো অনেক দূরে দূরে।হিমালয়ের কোলে।দেরাদুন-মুসৌরি-হরদুয়ার-হৃষিকেশ-গঙ্গোত্রী-গোমুখ-যমদুয়ার-নৈনিতাল-বৈজুনাথ-টেহেরি গাড়োয়াল।পালানোর অনেক সুঁড়িপথ আর নেমে আসার পাকদণ্ডী ছিল।খুচরো টাকা পয়সাতেই হয়ে যেত।থাকা খাওয়ার কোনও বিলাস ছিল না।অবকাশও ছিল না ওসব জায়গায়। আমাদের আশেপাশে যেসব পাহাড় আর টিলা আছে সেগুলোয় আর কজন যায়?কিন্তু পৌঁছে গেলে অন্য মজা।এই তো হাতের কাছে গালুডি ওখানে আমাদের বন্ধু মিউজিকের গৌতম ঘোষেদের বাড়ি ছিল।বাড়ি মানে বাড়ির চৌহদ্দিতে একটা ছোট্ট টিলাও ছিল।আমরা সকাল-বিকাল ওটার উপর চড়ে চা খেতাম।প্রায় পাশ দিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন গুলো হিংসে করে ভোঁস ভোঁস করে ধোঁয়া ছেড়ে আর হুইসিল বাজিয়ে চলে যেত।শিমূলতলা গেছি সেখানে ছাতু পাহাড় আর লাটু পাহাড় ইউক্যালিপ্টাস জংগলের ভেতর থেকেই হাতছানি দিত।সেখানেও দূরপাল্লার ট্রেন কি লম্বা লম্বা মাল গাড়ি বেজায় শব্দ করে নিরুপায় হয়ে টানেলের মধ্যে হারিয়ে যেত।অযোধ্যা পাহাড়ে গেছি লাক্ষার চাষ হোত সেখানে।বাঁকুড়া-পুরুল্যা চষে বেড়িয়েছি শরতে-শীতে এমনকি বর্ষায়।তবে এসবই আইবুড়ো জীবনের বাউন্ডুলেপনা।
বিয়ের পর এভাবে না হলেও আমি আর অপর্ণা বাসায় রান্না ফেলে রেখে,জামাকাপড় দড়িতে মেলে বেরিয়ে পড়েছি হুট করে আর ফিরেছি দিন সাতেক পরে।ভাত আবার চাল হয়ে যেত।আর তরি-তরকারী নেংটি ইঁদুরে চেটেপুটে খেয়ে নিত।ওদেরও তো বাঁচার তাগিদ ছিল?
ত্রিপুরায় গেলাম রাজ্যের অতিথি হয়ে নাটকের কাজে।সেই যে গেলাম দুজনে প্রায় মাস খানেকের জন্যে ফিরে এলাম টাক্কাল(আদিবাসীদের চপার)বাঁশের হুঁকো,বুনো অর্কিড,ওদের দেওয়া অজস্র উপহার আর আন্তরিকতা ঝুলিতে ভরে।এমন কি যে মানুষটি আমাদের নিয়ম করে গাড়িতে নিয়ে ছুটে বেড়াতেন সার্কিট হাউস থেকে মঞ্চ আর সারা ত্রিপুরা তিনিও একবার নিয়ে এলেন দু-পেটি ওখানকার পাহাড়ি আনারস।আহা কী তার রং!কী তার আস্বাদন!
তিথি আসার পর আমাদের আর তেমন করে কোথাও অতিথি হওয়া হয়ে ওঠেনি। তিথি একটু বড়ো হতেই আবার ঝোলাঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়া শুরু হয়ে গেল।আর সেই সুযোগটাই করে দিয়েছিল শুসুনিয়ার সংহিতা।ওর বাবা একজন লোককবি।আর সংহিতা এই শহরে চাকরি সূত্রে থাকে।শরত এলেই ফিরে যায় উমার মতো মা-বাবার কাছে।সেবার আমরাও গেলাম।তিথিপর্ণা,অপর্ণা আর আমি।
শুসুনিয়ার অর্থ না কী ছোটো হাতি।দূর থেকে দেখতে সত্যিই অনেকটা ওই রকম।ঠিক যেন একটা পুচকে হাতির ছানা মস্ত হয়ে শুয়ে আছে শুঁড় গুটিয়ে।ওই পাহাড়ে একটা ঝোরা আছে।সারাক্ষণ কী মিষ্টি জল পড়ছে।ওখান কার মানুষ ওই জলই পান করে।আর আছে নরম পাথর।যা দিয়ে কত কিছু বানায় ওরা।ওই পাহাড়ের সব গাছই মেডিসিন।ওই পাহাড়ে ‘র‍্যাটল স্নেক’ও আছে।তাদের আমি দেখা পাইনি।পাহাড়ের একদিকে ‘ন্যাচার‍্যাল চিমনি’।শীতকালে সবাই পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের ট্রেনিং নিতে শিবির গড়ে।ওখানে বড়ো বড়ো মোষ আর মাকড়সা দিব্যি মিলেমিশে থাকে।ছাতিমফুল আর ছাতারে্র মতো আদিবাসী ছেলেরা কী অল্পেই খুসি থাকে।

সংহিতা,ওর বাবা,মা আর ওর কত্তা দেবরাজের আতিথেয়তা অতুলনীয়।ওদের বাড়িতে একটা চন্দন গাছ আছে।আর আছে ওর মায়ের হাতের অপূর্ব রান্না।ওখানে যে নদি আছে তার নাম গন্ধেশ্বরী।আছে নয় ছিল বলাই ভালো।সেটা এখন খাল হয়ে গেছে।যখন সারা বাংলায় অশান্তি তখন ওই জায়গাটা কী শান্ত ছিল।কী জানি এখন আবার যদি শুসুনিয়া আমাকে ডাকে আমি কী সেই আগের মতো শান্তি ফিরে পাব?