মা-মুড়ি-খৈ-চালভাজা
কোন দিন ছোটোবেলার মুড়ি ভাজা নিয়ে এই বড়ো বেলায় এসে লিখব
এটা জানা ছিল না।ঠিক যেমন এই বর্ষায় জল জমা উঠোনে কি বাগানে কি বাড়ির দাওয়ার পাশে
গলা ফুলিয়ে ‘গ্যাঙর গ্যাং’ করে ডাকতে থাকা কোলা ব্যাঙ আর সোনা ব্যাঙেরাও যে হারিয়ে
যাবে ভাবতেও পারতাম না।আমার শৈশবে গ্রামের বাড়ির বর্ষাকাল খুব সুখের ছিল
না।গ্রীষ্মের দাবদাহের পর যখন হঠাৎ কাল বৈশাখীর বৃষ্টি নামত আমরা যে যেখানে যে
অবস্থায় থাকতাম উঠোনে নেমে ভিজতাম কারণ সারা শরীরের ঘামাচি মরবে।আর বর্ষার
বৃষ্টিতে ভিজতাম বাধ্য হয়ে নয়ত স্নান করতে।
চারদিক জল থৈ থৈ......সারাদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি।এমনও হয়েছে
ছ-সাত দিন আমরা সূর্যের মুখ দেখিনি।বিকেলে আচমকা পশ্চিমের আলো এসে যখন পড়ত তেরছা
হয়ে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়তাম পরে যেভাবে লোডশেডিংয়ের পর আলো এলে উল্লাস করত
কলকাতার সব গলি-পাড়া-রোয়াক।মজাও ছিল কম নয়।এক তো প্রথম বারিধারায় ডোবা পুকুর খাল
থেকে জিয়ল মাছ উঠে আসত উঠোনে বাগানে বাড়ির দাওয়ায়।একবার আমি তখন পাইকপাড়ায় থাকি
প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে হাওড়া থেকে ট্রেনে চড়ে দেশে বাবা-মায়ের কাছে গেছি।রেল লাইন
জল ছুঁই ছুঁই।কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ঢুকতেই মা হাত মুখ ধুয়ে হাতে পায়ে ভালো করে তেল
মেখে নিতে বলল।তারপর হাতে ধরিয়ে দিল আদা দেওয়া গরম চা আর আচারের তেল মাখা
ছোলা-বাদাম মেশানো চাল ভাজা, সংগে বাগানের কাঁচালংকা।
বাবা বলল-‘গোয়াল ঘরটা একবার দেখে আয় তো’।
গোয়াল ঘর দেখতে যাওয়ার কারণ ওই সময় খাল-বিল ডুবে যায় বলে
গর্তে্র ইঁদুর উঠে আসে শুকনো জায়গায়।তাদের পিছু পিছু চলে আসে সাপ বিষধর কি
দাঁড়াস।তারা নিরাপদ স্থান বলতে গোয়াল ঘরকেই বেছে নেয়।আমি টর্চ না নিয়ে একটা
সামান্য লণ্ঠন নিয়েই টিপটিপ করে পড়া বৃষ্টির মধ্যেই পায়ের পাতা ভেজা জল ছুঁয়ে যখন
গোয়ালের দিকে যাচ্ছি দেখি আমাদের বাড়ির পোষা বেড়াল তার থাবা দিয়ে কাকে যেন ধরতে চাইছে
আর সে একটু একটু করে পালিয়ে যেতে চাইছে।প্রথমটায় মনে হোলো সাপ।আমাদের দেশের পোষা
বেড়াল সাপ খেত,পুকুরের মাছ খেত এমনকি পায়রা-ঘুঘুও খেত।তেমন সুযোগ পেলে কাঠবিড়ালির
লেজ কামড়ে খেত।আর শীতকালে আমাদের মশারি ছিঁড়ে বিছানায় ঢুকে লেপের মধ্যে চেপে
ঘুমোত।সাপ ভেবে আমি তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে বড়ো টর্চ নিয়ে এসে দেখি বেড়াল যাকে জব্দ
করতে পারছে না সে সাপ নয় মস্ত সাপের মতো দেখতে হাতখানেক শোল মাছ।সেটাকে ধরে একটা হাঁড়িতে
জিইয়ে রেখে আবার বেরোলাম। গোয়ালের গোরুরা নিরাপদেই আছে দেখে এবার বেরোলাম মাছ
ধরতে।বেড়াল আমার সামনে আর আমি আলো ফেলে দেখছি।ও দেখিয়ে দিচ্ছে আর সেই মতন আমি আলো
ফেলে দেখছি হয় কৈমাছ কি ল্যাঠা কি শোল।সারা বাগান ঘুরে বেশ কয়েকটা পেলাম।পরের দিন
বেড়ালের কপালে জুটল আঁশকাঁটা আর নিজের ধরে আনা চ্যাং মাছ।
বর্ষায় সারা রাত আমার ঘুম হোতো না।আমি সারা রাত জেগে শুনতাম
বিচিত্র শব্দাবলী।এক তো ঝিঁ-ঝিঁ দের নানান স্বর আর নানা জাতের ব্যাঙেদের
সিম্ফনি।বৃষ্টির এক টানা শব্দ।বৃষ্টি থেমে গেলেই অন্য স্বরবিন্যাস,অন্য
ধ্বনি।বৃষ্টির ফোঁটা কলাপাতা থেকে কচুপাতায় পড়ে অদ্ভূত শব্দ তৈরি করত।আর টালির
চালের থেকে জল নিচে বালি-কাঁকরে এমনভাবে পড়ত আমার মনে হোতো কোনও এক মস্ত পুরুষ
তিনি হয়ত বা আমারই পূর্বপুরুষ খড়ম পরে সারা বাড়ি পরিক্রমণ করছেন।আমাদের বাড়িতে খড়ম
পরার চল ছিল।বাবা,জ্যাঠাবাবু পরতেন।আমরাও পরেছি।চলার সময় ‘খড়াস’ ‘খড়াস’ শব্দ
হোত।টালির চালের থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ওই রকম শব্দ করেই পড়ত।আর তার সংগে মিশে যেত
আমাদের শোওয়ার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ।ভোর হলেই সেই সব শব্দ কোথায় যে
মিলিয়ে যেত!
সকালবেলা আমরা টালির চালের জল বালতিতে জমিয়ে তাই দিয়েই মুখ
ধোওয়ার কাজ সারতাম।আর একান্তই বাইরে বেরোতে হলে তালপাতার টোকা আর তালপাতার ‘পেখা’
মাথায় দিয়ে বেরোতে হোত।‘টোকা’ এখনও দেখা যায় শান্তিনিকেতনে।বাঁশের কি তালপাতার
কিন্তু ‘পেখা’ কি আর আছে?’পেখা’ হোলো লম্বা লম্বা তালপাতা দিয়ে তৈরি যা মাথা থেকে
হাঁটু অব্দি ঢাকা দেওয়া যায় পিঠের দিকে।আমরা বড় বড় চটের বস্তাকেও পেখার মতো
ব্যবহার করতাম।ছাতা নিত বড়রা।বেতের বাঁটের কালো কাপড়ের।বেশ বড় আর ভারী হোত।আমাদের
মতো ছোটদের সে ছাতা সামলানো দায় হোত।
বরষায় সবকিছু ভিজে আর স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত।রোদ উঠত না বলে
মোটা আর ভারী জামাকাপড় শুকোত না।বিছানা বালিশ,মাটির মেঝে সব ভিজে।আর কেমন একটা
ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। এ ঠাণ্ডা শীতের ঠাণ্ডা নয়।এ এক ভেজা ঠাণ্ডা।তাই বাক্স-প্যাঁটরা-তোরঙ্গ
থেকে বেরোত ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা চাদর আর কাঁথা।ছোটবেলায় তার সংগে মিশে যেত মায়ের
গায়ের গন্ধ।সে গন্ধ আর কোথাও পাই না।কোথাও না।বরষায় ভুঁইচাপা ফুলের
গন্ধ,মল্লিকা-মালতীর গন্ধ,কামিনীর গন্ধ,রজনীগন্ধার তীব্রতা আর মায়ের গায়ের গন্ধ
কোথায় হারিয়ে গেল?বিশেষ করে জ্বর হলে মাকে কাছে পেতাম।একান্নবর্তী পরিবারে মাকে
কাছে পাওয়ার এই একটি উপায় ছিল তাই মনে মনে চাইতাম আমার অসুখ হোক আমার অসুখ হোক।আরও
অনেক কিছুই চাইতাম।অসুখ হলে শালুক ফুলের শুকনো বীজএর খৈ ভেজে খাওয়াত মা।সহজপাচ্য
আর সুস্বাদু ছিল সেই খৈ।এখন মেদিনীপুরের কোনও গ্রামে কোনও মা তার অসুস্থ সন্তানদের
এই খৈ ভেজে খাওয়ান?খাওয়ান কি আর ‘পোরের ভাত’? ‘পোরের ভাত’ তৈরী হোত ছোট মাটির
ভাঁড়ে সিদ্ধ চাল দিয়ে একটা লোহার কড়াইয়ে ঘুঁটের ধিকিধিকি আগুনে।
ধিকিধিকি আগুনে আরও অনেক কিছু হোত।পাকা তালের কাদ ধিকিধিকি
আগুনে সারারাত ফুটে ক্ষীর হোত।সেই ক্ষীরের সংগে চিনি বা গুড় ও আটা বা ময়দা মিশিয়ে
কলাপাতায় মুড়ে ধিকিধিকি আগুনে সারারাত রেখে দিলে ভোরবেলা ‘পোড়াপিঠে’ তৈরি
হোত।ধিকিধিকি আগুনে এই বরষায় তৈরি হোত ইলিশের পাতুরি আর ভুট্টা পোড়া খেতাম
ধিকিধিকি আগুনেই।খৈ-মুড়ি-চালভাজাতেও বেশি আগুন লাগত না।বেশি আগুন লাগত ধান সেদ্ধ
করার সময়।ভাতের চালের জন্য ধান সেদ্ধ করা হোত একবার।প্রথমে ধান কয়েকদিন জলে ভিজিয়ে
রেখে তারপর মাটির হাঁড়ি বা লোহার কড়াইয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিয়ে ধান কলে ধান
থেকে চাল করা হয়।আর মুড়ির চালের জন্যে ধান দুবার সেদ্ধ করা হোত।খৈ ভাজা হোত শুকনো
ধানেই।বাড়ির উঠোনে তৈরি হোত ধান সেদ্ধর দু-মুখো উনুন আর মুড়িভাজার জন্যে ছিল আলাদা
উনুন।কুমোর বাড়ি থেকে মুড়িভাজার স্পেশাল খোলা আনা হোত।তার মধ্যে শুকনো বালি আর
নারকেলের কাঠি দিয়ে নাড়া হোত।সে এক অন্য স্বাদ ছিল গরম মুড়ি-খৈ-চালভাজার।এখন যখন
মেশিনে তৈরি প্যাকেট মুড়ি খাই আর খেতে খেতে ভাবি মা আমার জীবন থেকে চলে গেছে একা
নয় মা নিয়ে গেছে অনেক কিছু।রেখে গেছে যা হারিয়ে গেছে তার টুকরো টুকরো কথকতা।