মন খেরোর খাতা
পাবলো নেরুদার দেশ থেকে এসেছিল সেই ছেলেটি ২০১০ এর দীপাবলীর রাত্রে আমাদের
বাগুইআটির বাসায়।ওকে নিয়ে এসেছিল সুদীপ্তা-অরূপ।সুদীপ্তা-অরূপ আমার সংগে জুটেছিল
কর্মসূত্রে।তারপর সেই কর্ম থেকে কবে যে তারা আমার অকর্মের পারিবারিক মর্মস্থানে
বাসা বেঁধে ফেলেছে নিজেরাও কী জানে?আমি তো জানিই না।তবে এটা জানি ওরা হোলো সেই
শ্রেণীর যারা নিজেরা দুপায়ে সরষের পুটুলি বেঁধে ওদের গোত্রের বাকিদেরও পায়ের তলায়
সরষে ছড়িয়ে রাখে যাতে তারাও সুস্থির না থাকে।আর গোলা পায়রা যেমন দল(কমিউনিটি)ভারী
করতে এবাড়ি ওবাড়ির পোষা পায়রাদেরও জুটিয়ে আনে।ওরা দুজন হোলো সেই জুটি।নিজেরা
সুস্থির থাকে না।অন্যদেরও অস্থির করে তোলে।ফলে তারাই যে দীপাবলীর রাত্রে আর একটি
ভবঘুরেকে জুটিয়ে আনবে এতে খুব একটা আশ্চর্য হইনি সেদিন কিন্তু সেই ভবঘুরেটি যে
আমার প্রিয় কবির দেশের ছেলে আর এদেশে এসেছে ভারতীয় ভাষা আর সংগীত শিখতে এটা শুনেই
আমি পরাস্ত।এসেই পরিস্কার বাংলায় বল্ল-“সোলিল আমার নাম ইভান ভিক্তর জদ্রেসিক
অগুইলা”!না,আমি এতেই ইভানের প্রেমে পড়ে যাইনি বা আমার বাড়ির জামাই করার কথা
ভাবিনি।এদেশে এসে এরকম বাংলা-হিন্দি প্রায় সবাই বলতে পারে।আমাদের দেশের বাড়িতে
অনেক বিদেশি আসত।আর সত্তরের কলকাতায় হিপিরা দাপিয়ে
বেড়াত।রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের সংগে অনেক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়ত।মুগ্ধ হয়েছিলাম
ওর কিছু আচার ও আচরনে।ও এদেশে এসেছিল সেতার শিখতে।যদিও ও নিজে বাঁশি বাজাতে
জানে,গীটার বাজিয়ে স্প্যানিশ গান করে।ইভান কোনও রকম নেশা করে না।আর
নিরামিষাশী।ইভানের ব্যবহার অতি চমৎকার।বাংলা শেখার আপ্রাণ চেষ্টা।সুদীপ্তা-অরূপের
সংগে ও নিজেই নিজেকে জুটিয়েছিল হিমালয় পাহাড়ের কোলে।
সেই দীপাবলীর রাত্রে ইভান আমাদের বাড়িতে নিরামিষ নৈশভোজ সারল আমরা বাকিরা যখন
মাংসাশী প্রাণীর মতো হাড় চিবুচ্ছি।তার পর যখন তার কানে এলো পাড়ার কালীপুজোর তাসা
পার্টির “কুড় কুড় কুড় কুড়”বাজনা ও আর থাকতে না পেরে জুটে গেল তাদের সংগে।শুরু হোলো
ইভানকে ঘিরে উদ্দাম নাচ।ফেরার সময় বল্ল-“সখা আবার আসব!”
সেই যে ইভান এ বাড়িতে এলো তার পর সে যে কতোবার কত কারণে অকারণে এসেছে তার
হিসেব রাখিনি।মধ্যমগ্রামের ডেরা থেকে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এসেছে আমাদের
বাসায়।আমাদের সংগে এক টেবিলে রুটি-চাটনি-আচার যেমন খেয়েছে আবার আমার হাতে তৈরি
পাস্তা খেয়েও আপ্লুত হয়েছে।দেশে ফেরার সময় নিয়ে গেছে অপর্ণার হাতে তৈরি
আচার-চাটনি-কাসুন্দি আর গুড়ের বাতাসা।
ইভান ফিরে এলো একবছর পরে।এর মধ্যে ‘ফেসবুকে’ আর মেইলে কথা হয়েছে কখনও
সখনও।এসেই আমাকে হণ্যে হয়ে খুঁজছে।কারণটা কী?ওর এক বান্ধবীর আমার কথা শুনে আর ছবি
দেখে মনে হয়েছে আমি না কি মেয়েটির আগের জন্মের দাদু(তখন কিন্তু আমার এমন
পাকাচুল-গোঁফ-দাড়ির জংগল ছিল না)আর মেয়েটি না কি সেই জন্মে ছিল ভারতীয়।এ জন্মে
মেয়েটির নাম ‘ফুন্সুক দোল্মা দেচেন পামো’।আমাকে ইভানের হণ্যে হয়ে খোঁজার কারণ পামো
আমার জন্যে চিলির পাহাড়ের টুকরো,চিলির মূদ্রা,বৌদ্ধ স্মারক এইসব পাঠিয়েছে।আর পামো
একদিন এই বাংলায় এসে আমার সংগে কয়েকটা দিন কাটাবে।এই কথায় আমাদের একটু কেমন লাগে কিন্তু
ওদের দেশে ওরা সম্পর্কগুলোকে খুব খোলা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত।
কিছুদিন আগে ইভান বিয়ে করেছে মায়াকে।না,মায়া কোনও ভারতীয় মেয়ে নয়।মায়া
চেক।মায়া চাকরি করে সংসার চালায়।আর ইভান দেশে দেশে ঘরে ঘরে গান ফেরি করে বেড়ায়।
আজ ইভানের জন্মদিন।আমি ওকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।আমি জানি ইভান একদিন মায়াকে নিয়ে
আসবে এই বাংলার মায়ায়।