যদি হয়
সুজন,কলাপাতায়......
আমার এই বাউল জীবনে অনেক
পাগলের দেখা পেয়েছি শান্তিপুর থেকে শান্তিনিকেতন, কোলাঘাট থেকে কোলকাতায় কিন্তু
খোদ কোলকাতায় এমন খ্যাপা খেপির সন্ধান পাব স্বপ্নেও ভাবা ছিল না।ছেলেটি বদ্যি
বাঙাল মেয়েটি মেদিনীপুরের ঘটি।মেয়েটি যতটাই বকবক করে ছেলেটি ঠিক ততটাই চুপচাপ।মেয়েটি
যাচাই না করেই যাকে তাকে আপন ভেবে ঠকে আর ছেলেটি যাচাই করেই ঠকতে চেয়েই ঠকে।মেয়েটি
যদি উত্তর হয়,ছেলেটি প্রশ্ন।ছেলেটি অরূপ দাশগুপ্ত,মেয়েটি সুদীপ্তা বোস।ওদের দুজনের
হাজারটা অমিলের মধ্যে একটাই মিল ওরা দুজনেই আন্তরিকভাবে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী।পার্টি
যখন ক্ষমতায় তখন আর পাঁচজনের মতো গুছিয়ে নেবার সদস্য নয়।ওরা নিজের নিজের বিচার
বুদ্ধি দিয়েই রাজনীতি আর কাজনীতি চালিয়ে যেত।
ওদের দুটোকে প্রথম দেখি
৬৬ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা-নয় এ গণনাট্য সংঘের দপ্তরে সন্ধ্যে
নামলে।তখন গণনাট্য পত্রিকা ও গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকা দপ্তর এক ঠিকানায়,এক ছাতার
তলায়।গণনাট্য দপ্তরের বাবলু দাশগুপ্ত যখন শেষ বেলায় পত্রিকা প্রকাশের তাড়ায় প্রুফ
না পেয়ে পায়চারি করতে করতে হতাশ হয়ে বসে পড়েছে ঠিক তখন এক সুন্দরী যুবতীর উপস্থিতি
এক তাড়া প্রুফ হাতে দপ্তরে বিশুদার সামনে।তার পিছনে পরম নিশ্চিন্ত ভাবে যুবকের
প্রবেশ।বিশুদার ততোধিক যান্ত্রিক নিষ্ঠায় ঘোষণা-‘বাবলুদা ভিতরে আছে’ বলেই সকালের গণশক্তি
পত্রিকায় রাত্রির নিবিড় মনোনিবেশ নয়ত হিসাবের পাতায় জমা খরচের নিখুঁত উত্তর
মেলানোর নিরলস প্রয়াস।
আশুদা(সেন)তখন হয়ত গ্রুপ
থিয়েটার দপ্তরের থেকে আমাকে ডেকে ওই ছেলে মেয়েটির সংগ্রামী প্রয়াসকে সাহায্য করার
জন্যে আমাদের পত্রিকাকে ওদের কাজ দিতে বলছেন।শিশিরদা(সেন)কিছু না বলে শুধু একবার
চাইলেন আমার দিকে।বুঝলাম উনিও তাই চান।আর বিমলদা বলে উঠলেন_’বাঙালি ব্যবসা করতে
ভুলে গেছে’।এরা ছিলেন চিরকালের চিরকুমার।তবু
সংসার পাততে চাওয়া কমরেডকে সাহায্য করার চেষ্টা।পরে জেনেছিলাম বাবলু দাশগুপ্ত আর
অরূপ দাশগুপ্ত একটা বদ্যিতুতো সম্পর্ক ছিল আর বাবলুদা ও শিশিরদা ছিলেন মামাতো
পিসতুতো দাদাভাই।কায়েত বামুনদের মতো না তার চেয়েও বেশি বদ্যিদের মধ্যে ‘কমিউনিটি
ফিলিং’।ওই অনুভবটা প্রায় ‘জর্মন’দের মতো।
সুদীপ্তা অরূপের কম্পোজের
হাত ছিল মারাত্মক দ্রুত।ওদের ওটা ছিল স্বাধীন প্রচেষ্টা।ওরা উল্টোডাঙার সরকারি
আবাসনে বসেই কম্পিউটরে কম্পোজের কাজ করে দিত আমরা সেটাকেই সত্যযুগ দপ্তরে অফসেটে
ছাপতাম।এক সময় ওরা দুজন সত্যযুগ দপ্তরের কাজও শুরু করল।তার পর সত্যযুগ যখন সান্ধ্য
পত্রিকা বের করল আমার সংগে ওরাও জুটে গেল।তখন ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।
সুদীপ্তারূপ-এর বিয়ে ১৯৯৮
এ আমার মেয়ে তিথি হবার প্রায় এক মাস পরে জুনের একুশে।ওরা যখন চুটিয়ে প্রকাশনার কাজ
করছে তখন আচমকাই অরূপ চা বাগানের ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে আসাম চলে গেল।আমরাও
ততোদিনে নিজেদের কম্পিউটরে কম্পোজ করে সত্যযুগে প্রিন্ট করি।যোগাযোগটা ছিন্ন হবার
কথা কিন্তু কমিউনিস্টরা ফিউডাল পরিবারের মতোই গায়ে গায়ে লেগে থাকতে ভালোবাসে যদি
তাদের কিছু একটায় সাদৃশ্য থাকে।এখানে সাদৃশ্যটা বোধহয় না গুছিয়ে নেবার না ‘কামিয়ে
নিস’এর।অরূপ বাবা-মা থাকতেও অবিবাহিতা মাসির কাছেই মানুষ।আর সুদীপ্তারা ছিল হাতের
পাঁচ আঙুলের মতো-বাবা-মা-সুদীপ্তা-পিংকি-টুটুন।হাতের পাঁচ আঙুল যেমন এক মাপের হয়
না সুদীপ্তারাও তাই।এখন ওদের বুড়ো আঙুলটাই নেই।রবি বোস ছিলেন ওদের বাবার চেয়েও
বেশি ছন্নছাড়া,বাঁধনহারা জীবনের বুড়ো আঙুল। কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের সামান্য
চাকুরেজীবী ও জাত বামপন্থী কিন্তু মুক্ত মনের।না হলে সেই দুহাজার সালেই মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানেই মিটিং করতেন সেখানেই ছুটে যেতেন না।ডায়লিসিস করেই ছুটেছেন
একদিন জ্যোতি বোস আর একদিন মমতা ব্যানার্জির সভাস্থলে।বাংলায় এই প্রজাতি বিলুপ্ত
হয়েছে।এখন সবটাই সাদা-কালো।রবি বাবু আমার নাটকের খুব ভক্ত ছিলেন।আর অরূপের পালিকা
আমাদের সবার মাসি (যদিও এরা সবাই আমাকে সলিলদা বলেই ডাকে।সুদীপ্তা-অরূপের বাবা মা
থেকে ওরা ও ওদের ছেলে টুপাই আর পিংকির ছেলে পুপু আমাকে সলিলদাই বলে।ওরা কি তখনই জানত
আমি একদিন শান্তিনিকেতনে পড়াতে যাব?)বরানগরের লাল বাড়ির মেয়ে।ওদের বরানগরের বাড়িতে
বাংলার সব বাম নেতারাই যেতেন।মাসি কিন্তু কোন দিন রাজনীতি করেননি।এ,জি,বেংগলে
চাকরি করতেন।পরের ছেলেকে মানুষ করতে হবে বলে সংসার পাতেননি।এখন অবসর জীবনে দিব্যি
আছেন দাবাড়ু নাতিকে নিয়ে।
অরূপ আসামে যেমন গেল আবার
ফিরেও এলো।আবার শুরু হোলো ব্যবসা।আর বারেবারেই ডাক পড়ে আমার।যেন আমি কতো চৌকস
তুখোড় ব্যবসায়ী বানিয়া। আসলে ওরা আমাকে পরম আত্মীয় ভাবত।এখনও ভাবে।ওদের কেউ শাসন
করার সাহস পায় না।আমি পারি।আর সেই পারার দায় ঘাড়ে নিয়ে আমি নয় ওরাই আমাকে ডেকে
ডেকে শাসন চেয়েছে,প্রশ্রয় চেয়েছে।
বীরভূমের রূপপুরে
‘রক্তকরবী কারুগ্রাম’ হোলো।আমি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ছুটে গেলাম।নেচে গেয়ে খেয়ে
এলাম।ট্রাভেল এজেন্সী খুলল।সবাই মিলে ছুটলাম সিকিমে।এই ২১ এ জুন ফোন করে জানাল ওরা
কলাপাতায় কিছু খাওয়াবে।আমি বহুদিন কলাপাতায় গরম ভাত খাইনি।তাই ৪৮ দমদম রোড এ গিয়ে দেখি “ক লা পা তা” একটি
রেস্তোরার নাম।যার মালিক ওরা।
এটা ওদের ১৮ বিবাহ
বার্ষিকী ছিল।আমার মেয়ে তিথি তারও তো আঠারো হোলো? তা হলে সুদীপ্তা অরূপ ওরাও এবার বুঝি
ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে এডাল্ট হোলো।রাত আটটা থেকে এগারোটা অব্দি নানান পদ চেখে দেখলাম।তার
মধ্যে ‘কালি চিকেন’, ‘হলদি চিকেন’, ‘ড্রাগন বল’, ‘চিকেন মুমতাজ’,’কাশ্মীরি পোলাও’,
‘কোলকাতা বিরিয়ানী’, ‘বাটার নান’ চমৎকার।
চাইলে আপনার ইচ্ছেটাকে
লাগাম না টেনে নাগের বাজার থেকে হনুমান মন্দির পেরিয়ে ঘুঘুডাঙা ফাঁড়িতে রাস্তার
উপরেই রেস্তোরায় পৌঁছে যেতে পারেন।আর যদি চিড়িয়া মোড়ের দিক থেকে কি ট্রেনে বা
মেট্রোয় আসেন তাহলে দমদম স্টেশন ছাড়িয়ে একটুখানি।ওদের ঠিকানা
সুদীপ্তা-অরূপ এ জীবনে
বহু ঘুঘু দেখেছে।বহু ফাঁদেও পড়েছে কিন্তু ফান্দে পড়িয়া বগার মতো না কেঁদে জীবনের
শক্ত ডাঙায় দাঁড়ানোর জন্যে হেসে খেলে লোককে খাইয়ে তৃপ্তি পেতে ও তৃপ্তি দিতে চায়।
মন্দ কী?BUY ONE কলা,GET ONE FREE পাতা।