MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
তখন এখানে সেখানে,আদাড়ে-বাদাড়ে,শহরে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই সিনেমার কাজে।রাজা সেন আর আমি চিত্রনাট্য(কিছু হাতে লেখা,কিছু মগজে রাখা)নিয়ে সকাল থেকে রাজার গাড়িতে তেল ভরে ঘুরে বেড়াতাম।সেবার মহাশ্বেতাদির 'ঘাতকের মা' নিয়ে কাজ করছি।চলচ্চিত্রের নাম রাখা হোলো 'চক্রব্যুহ'।সকাল সকাল আমি পৌঁছে গেলাম রাজার বাড়ি।সেখান থেকে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম লোকেশন দেখতে।ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম শ্রীরামপুর।শ্রীরামপুর রাজবাড়ির ওখানে থাকত আমাদের পরিচিত একজন অভিনেত্রী।সে আমাদের পেয়ে পুলকিত চিত্তে বেদম খাইয়ে(স্বহস্তে তৈরি খাবার)ছাড়ল।রাজা খুব খেতে ভালোবাসে।আর সবাই ওকে খাইয়ে মজাও পায়।পেট ঠুসে খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ি থেকে চলে এলাম কোঠিবাড়িতে।রেল লাইনের ধারে।দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার আর লখনৌ এর ভুল্ভুলাইয়ার থেকেও জটিল অলি গলি।চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে আমাদের দরকার ছিল একটি শহরতলির যৌনপল্লী।ওই ভরদুপুরে আমরা ঢুকে পড়লাম।না,আমাদের সংগে কোনও দালাল ছিল না।স্থানীয় মানুষও নয়।রাজা খুব ডাকাবুকো।ঢুকেই এদিকে ওদিকে উঁকি দিচ্ছে।আমি ভয়ে ভয়ে পিছনে পিছনে।এর আগে বিডন স্ট্রিটের পাশে নীলমনি মিত্র স্ট্রিটে নাটকের রিহারসাল দিতে দিন রাত পড়ে থাকতাম।ওদের মেজাজ মর্জি জানি।আমাকে অবাক করে ওই দুপুরে চুলের গোড়ায় তেল দিতে দিতে এক প্রৌঢ়া এক যুবতীকে বল্ল-"আরে খদ্দের নয়।শ্যুটিং পার্টি!"আমি সেদিন বুঝেছিলাম এরাই ঠিক ঠাক মানুষ চেনে।
আর একবার গেলাম মানে যেতে হোল টাটা ইস্পাত নগরী পেরিয়ে দলমা পাহাড়ে।তখন ওখানে থাকে হাতির দল আর চোরাকারবারী,পরিযায়ী পাখি আর সশস্ত্র মানুষজন।সারাক্ষণ জ্যামার লাগানো।ছিলাম আমি আর কান্তি(অভিনেতা-পরিচালক শ্রদ্ধেয় দিলীপ রায়ের ভাইপো)আর তার ছেলে পাপু আর রামুদার শ্যালক উজ্জ্বল।আমরা থাকতাম পাহাড়টার তলায় হাইওয়ের পাশে একটা রিসর্টে।
পাহাড়তলীতে থাকে ভূমিকন্যা ও ভূমিপুত্ররা।তারা দিন বদলের কোনও সংবাদ পায়নি।প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে না ফিরলে রাতে চুলায় হাঁড়ি চড়ে না।
তারা 'স্টোন ক্রাসারে' কাজ করে।তারা 'স্পঞ্জ আয়রনের' গ ন গ নে আগুনে চুটা ধরায়।আবার তারাই বাড়ি ফিরে মাল টেনে মাদলে তাল তোলে।
একদিন জ্যোৎস্নারাতে খুব ঝুঁকি নিয়ে চলে গেলাম তাদের ডেরায়।অন্ধকারে কূপীও জ্বলছে না কেরোসিনের অভাবে কিন্তু প্রাণশক্তির অভাব নেই।
উঠোনের কাঠের চুলায় মাটির হাঁড়ির ভাতের গন্ধ আর মহুয়ার ঘ্রাণ স্পঞ্জ আয়রনের কালো ছাই মিশে চাঁদটাকে ফ্যাকাশে বিবসনা করে দিয়েছে।খুঁটিতে বাঁধা গাধাগুলোকে মনে হচ্ছে মহীনের ঘোড়া।আর ছাগল্গুলো বড়ো বড়ো বৃষ্টির দানার মতো বিষ্ঠা ছড়াচ্ছে অবিরাম।
বাচ্চাগুলো ক্ষিদে তেষ্টায় কেঁদে উঠলে মা আগুনের পাশ থেকে উঠে আগুনেই ফিরে এসে মুখে গুঁজে দিচ্ছে শুকনো বুক।অন্ধকারে থেকে থেকে আগুনের শিখায় সে দৃশ্য মনে হচ্ছিল সোমনাথ হোড় আড়ালে বসে 'তেভাগার ডায়েরী'র স্কেচ করছেন।না ইচ্ছে করেই তখন কোনও ছবি তুলিনি।ছবি তুলেছি ল্যাংটো রোদের মাধুকরী ধূলায়।
চলচ্চিত্রের নাম ছিলঃরক্তকরবী।ঠিক ধরেছেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ আমার হোলেও পরিচালক ছিলেন বন্ধু সুকান্ত রায়।প্রযোজক ছায়াবাণী আর কাহিনি?অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।