শিক্ষা গুরু...দীক্ষা গুরু
TARAWOHOPI HI JIBANTI
JIBANTI MRIGAPOKSHINO
SA JIBATI MANO YASSYO
MANANENO HI JIBATI.
JIBANTI MRIGAPOKSHINO
SA JIBATI MANO YASSYO
MANANENO HI JIBATI.
এই বিশ্ব-জগতে সব প্রাণীই প্রাণ ধারণ করে।কিন্তু একমাত্র সেই জীবিত যিনি
মান-যশ ও আপন আত্মাভিমানে বাঁচেন।
শৈশবে দেশের বাড়ির বৈঠকখানায় মায়ের হাতে তৈরি রেশমী সুতোর সূচীশিল্পে একটা
ফ্রেম টাঙানো ছিল যেখানে ফুল-পাতা মাঝে রেখে লেখা ছিল “শাসন করা তারই সাজে/সোহাগ করে
যে”।এই দুটো কথারই অর্থ বুঝতাম না সেই বয়সে।শুধু কোনও মা তার ছেলেকে মারলে বা
বকুনি দিলে জ্যাঠাবাবু ফ্রেমটা পেড়ে সবার সামনে রেখে দিতেন।সেই মা লজ্জায় আর সেই
কাজ করতেন না।আর জ্যাঠাবাবুই এই শ্লোকটি আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়েছিলেন যার
অর্থ সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি এই বয়সের প্রতি পদক্ষেপেই।
শিক্ষক অনেক প্রকারের হন।বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথাই সবাই আজ উচ্চারণ করবেন।তাদের
কথায় আসব,তবে আমার প্রথম ও যথার্থ শিক্ষক ছিলে আমার জ্যাঠাবাবু প্রয়াত দুর্গাচরণ সরকার।এবং
আমি এই অনুভবে গর্ব বোধ করি তিনি তার যৌবন কালে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণননের সান্নিধ্য
লাভ করেছিলেন।আর আমি শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষক জ্যাঠাবাবুর কাছে যিনি জাতীয় শিক্ষক
রাধাকৃষ্ণনন,রবীন্দ্রনাথ,চিত্তরঞ্জন,সুভাসচন্দ্র প্রমুখদের কাছ থেকে
দেখেছেন,বক্তৃতা শুনেছেন,অথিক গুরু,পথিক গুরুর কাছেও শিক্ষা গ্রহণে বঞ্চিত হননি। জ্যাঠাবাবু
যখন উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন “সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি,তারায় তারায় খচিত” বা “এই লভিনু
সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর” আমি তখন ভাবতাম আমি ভাগ্যবান কেন না আমি এমন একজন
শিক্ষক পেয়েছি।আজ শিক্ষক দিবসে আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জ্যাঠাবাবু।
আমার অক্ষর জ্ঞান বাড়িতে হলেও প্রাথমিক শিক্ষা লাভ মন্মথ প্রাথমিক বুনিয়াদী
বিদ্যালয়ে। আগেও লিখেছি আমাদের স্কুল জীবন আমাদেরই সরকার বংশের নির্মিত প্রাথমিক ও
উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।প্রাইমারি স্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ির বাগানের গড়খাইয়ের
ওপারে।সারাবছর আমরা স্কুলে যেতাম হাতে স্লেট-পেন্সিল আর বই-খাতা নিয়ে পায়ে হেঁটে।
গ্রীষ্মকালে স্কুলে যেতাম শুকিয়ে যাওয়া গড়খাই পেরিয়ে।আজকের ভাষায় ‘স্কুল বাংক’ করার
কোনও অবসর ও অবকাশ ছিল না।বাড়ির বৈঠকখানা থেকেই আমাদের কীর্তিকলাপ দেখা যেত।আমাদের
ব্যাপারে শিক্ষকদের কোনও অভিযোগ কি প্রশস্তি থাকলে খালের জলের এপার-ওপারেই
আদান-প্রদানে কোনও বাধা ছিল না।বাধা ছিল না প্রকাশ্য শাসন কি বেত্রাঘাতেও।যে কোনও
কারণেই আমাকে অফিসঘর থেকে বেত ও চক-ডাস্টার আনতে হোত ক্ষয়ে আসা চকও ক্লাস শেষে
পেতাম কিন্তু বেতের ঘা পেতাম না।আজ আমার কবুল করতে লজ্জা নেই আমিও কোন দিন আমার কোনও
ছাত্র-ছাত্রীকে অপমান কি অসম্মান করিনি।এ কথা কবুলেও লজ্জা নেই কেউ কেউ অপমান অসম্মান
করেছে কারও না কারও প্ররোচনায় আবার পরে লজ্জায় মাথা হেঁট করে ক্ষমা চাইতে
এসেছে।আমি তাদের অনেক আগেই ক্ষমা করেছি।শুধু ক্ষমা করতে পারি না সেই সব শিক্ষকদের
যারা এইসব অজ্ঞানী ছাত্র-ছাত্রীদের প্ররোচিত করেন স্থূল স্বার্থে ও আত্ম অন্তঃসার
শূন্যতাকে চাপা দেবার চেষ্টায়।এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ“আশ্রমের রূপ ও বিকাশ”
পুস্তকে অতি চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন।
প্রাইমারি স্কুলে আমার যে শিক্ষকগণ ছিলেন তাদের মধ্যে দুজনের কথা আমার আজও মনে
আছে।হেডমাস্টারমশায়ের নাম ছিল নীরেন কোলা আর একজন ছিলেন অন্নদাবাবু।নীরেনবাবু
ছিলেন ধীর-স্থির আর অন্নদাবাবু ছিলেন ত্রাস।‘জলদ গম্ভীর’ শব্দটি শিখে ছিলাম ওনার
কাছেই আর ওনার কণ্ঠও ছিল তাই।আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে পড়াশোনায় ভালো ছিল কিন্তু
দোষের মধ্যে পড়া বলতে গেলেই তোতলাতো।একদিন অন্নদাবাবু তাকে কাছে ডেকে তার হাত
থেকেই দু-দুটো পেন্সিল নিলেন।তাকে জিভ বের করতে বল্লেন।এবার জিভের উপর-নীচে
পেন্সিল রেখে চাপ দিয়ে জিভটা টান দিলেন।আমরা শিউরে উঠলাম।ছেলেটি একটু ধাতস্থ হতেই
দেখলাম তার উচ্চারণ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এ যেমন দেখেছি আবার এও সত্যি তার মার খেয়ে
অনেক ছেলেই মানুষ হবার পরিবর্তে বাঁদর থেকে চোর-চোট্টা হয়েছে।না মাস্তান বা গুন্ডা
হয়নি।আর নীরেনবাবুর কাছে আমরা সব বিষয়েই পাঠ নিতাম, বলা ভালো পেতাম।আমাদের কালে
ক্লাস ফোরে বৃত্তি পরীক্ষার চল ছিল।প্রধান শিক্ষক অনেকের থেকে জনা কয়েক ছেলেকে
নির্বাচন করে পরীক্ষায় বসাতেন।তার জন্যে তিনি স্কুলের পাঠের বাইরেও দিন-রাত তার
বাসাতে আমাদের পড়াতেন।এমন অনেক রাত গেছে রাতের খাওয়া সেরে তার বাসায় গিয়ে সারারাত
পড়াশোনা সেরে ভোরে হ্যারিকেন নিভিয়ে বাড়ি ফিরেছি।সেবার আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম।সেই
নীরেনবাবু আর আমার সাক্ষাতের একটি দিন আমি আজও বিস্মৃত হতে পারিনি।
তখন কলকাতায় নিয়মিত নাট্যচর্চায় যুক্ত আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক
হিসেবে পড়াচ্ছি।বাবা-মা বেঁচে।তাদের কাছে যাব বলে আজকের হলদিয়া হাইওয়েতে রাধামনিতে
নেমে বাড়ির দিকে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিলাম।উল্টোদিক থেকে সাইকেলে চেপে নীরেনবাবু বাড়ি
ফিরছিলেন।আমাকে দেখেই নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে।আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই উনি
ছিটকে সরে যেতে চাইলেন।আমি ভাবলাম উনি কি কোনও কারণে আমার এখনকার
ব্যবহারে অসন্তুষ্ট?সে কথা প্রকাশ করার আগেই উনি দ্বি্ধাজড়িত স্বরে বল্লেন-‘তুই
এ কী করছিস?আমি সামান্য প্রাইমারি স্কুলের টিচার!আর তুই এখন ইউনিভারসিটিতে পড়াস।আমাকে
প্রণাম করা তোকে মানায়?লোকে কী বলবে?”আমি অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলাম-‘আমার অক্ষর
শিক্ষা আপনার কাছেই।আপনি আমার প্রণম্য।আপনাকে সম্মান না জানালে আমার
ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে সম্মান জানাবেন কেন?’নীরেনবাবুর চোখে তখন জল।উনি
কাঁদছেন।আমাকে আবার অপ্রস্তুত করে সাইকেল চালিয়ে মিলিয়ে গেলেন।নীরেনবাবু তার পর বহুবার
বাবার কাছে আমার সংবাদ নিয়েছেন সেটা বাবার কাছেই শোনা।
হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে আমার অনেক মাস্টারমশায় ছিলেন।তাঁদের মধ্যে লজিক টিচার
দীপকবাবু,ইংলিশ টিচার নিরঞ্জনবাবু,সায়েন্সের টিচার সুদিনবাবু আর সুকুমারবাবু আমাকে
কী জানি কেন খুব স্নেহ করতেন।আমি তাদের ছাত্র ছিলাম।যখন কলেজে পড়ি আমি তাদের বন্ধু
হলাম।আমি জানি না এই সৌভাগ্য কজনের হয়?
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বাংলা মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত শিল্পীদের।অভিনয় শেখাতেন অভিনেতা-পরিচালক কুমার রায়,রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্ত,গণেশ মুখোপাধ্যায়।স্ক্রিপ্টের ক্লাস নিতেন(অভিনয়েরও)প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার ডঃ বিভূতি মুখোপাধ্যায়।মঞ্চস্থাপত্য শেখাতেন আর্ট ডিরেক্টর রবি চট্টোপাধ্যায়।মেক-আপের ক্লাস নিতেন রূপ সজ্জাকর শক্তি সেন।আলোর কাজ শিখেছি অমর ঘোষের কাছে যিনি সারকারিনা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা।বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পেয়েছিলাম অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামের শ্রদ্ধেয় তরুণ রায়কে।
গান শিখেছি সুচিত্রা মিত্র,মায়া সেনের কাছে।নাচ শিখেছি বেলা অর্ণবের কাছে।মূকাভিনয় শিখেছি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যোগেশ দত্তের কাছে।
আজ সব্বাইকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।