MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১৬

রম্যগীতি ও রামপাখির কথকতা
আমার শৈশবে বিনোদনের সময় কাটত দম দেওয়া কলের গানে আর রেডিয়োর অনুষ্ঠানে৷রবিবারের সকালে ঘুম ভাঙত রবীন্দ্রনাথের গানে৷তারপর ছটফট করতাম কখন শুনতে পাব ইন্দিরাদির সেই স্বর......"ছোট্ট সোনা বন্ধুরা তোমরা ভালো আছো তো...?"মুহুর্তে কচিকাচাদের কলকাকলি......স্টুডিয়োর ভেতরের ছোটদের মতো আমরাও ভিকিরিপতির আকাশে একসংগে চিৎকার করে উঠতাম “হ্যাঁ”।তারপর কতো গান,কতো কবিতা আবৃত্তি।ছুটির দিনে দিন গুলো কেমনভাবে কাটাতে হয় তার মধুর উপদেশ।একদিন শুনলাম ‘ইন্দিরা’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।মনটা খারাপ হয়ে গেল।যাহ্ আর তো পাব না তাকে রবিবারে রোববারে!বড়রা কে যেন কান মুলে বলেছিল-‘দ্যুর গাধা,এ ইন্দিরা সে ইন্দিরা নয়’।আমি কানের ব্যথা নিয়েই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।তার বহু পরে ওনাকে আমি দেখেছি আকাশবাণী ভবনে।কথাও বলেছি। আমার কল্পনার অবয়বের সংগে মানুষটির কী আশ্চর্য সাদৃশ্য!আমি যখন আমার সেই সব দিনের কথা ওনাকে বলছি উনি তখন মিটমিট করে হাসছেন।কী অপূর্ব সে হাসি!
রবিবারের সকাল মানেই পঙ্কজ মল্লিকের কাছে গান শেখা........."ভয় হতে তব অভয় মাঝে"৷গ্রাম বাংলায় আমার মতো বহু মানুষই দূরের থেকে গান শিখেছেন এই কিংবদন্তী মানুষের কাছে।পংকজ মল্লিককে বিদায় দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল সুচিত্রাদিকে(সুচিত্রা মিত্র)তারও পরে দেবব্রত বিশ্বাসকে।এসব আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তি ছিল।আবার বিষাদও পেয়েছি কম নয়।যে বার আচমকা মহালয়া হোলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সরিয়ে ধ্যানেশবাবু আর মহানায়ক উত্তমকুমারকে নিয়ে।না বাংলার কেউ সেটা মেনে নিতে পারেননিআমরা তো নয়ই।উনি ছিলেন আমাদের জ্ঞাতি জ্যাঠতুতো দাদার খুড়শ্বশুর।আমাদের দেশে উনি পুজোর সময় যেতেন।এটা আমাদের কাছে বেশ শ্লাঘার বিষয় ছিল।আকাশবাণীতেও তাকে দেখেছি ক্বচিৎ কখনও।পরে তার প্রয়াণের পর নৃপেনদার(নৃপেন্দ্র সাহা)অনুরোধে নাট্য আকাদেমি পত্রিকায় তাকে নিয়ে লিখেছি।তার জন্য শ্যামপুকুরে তার বাড়িতে গেছি।বাড়ির লোকজনের সংগে কথা বলেছি।আজও আকাশবাণীর নাটক বিভাগে তার ছবিটা দেওয়ালে টাঙানো আছে।এসব কজনেই বা স্মরণে রেখেছে?আমি নিশ্চিত জানি শহরের মানুষ মনে না রাখলেও এ বাংলার যে সব মানুষের বয়স পঞ্চাশ থেকে একশ তারা কেউ ভোলেননি।মজদুর মণ্ডলীতে তার মহাভারত পাঠ,বীরুপাক্ষের রম্যরচনা আর মহালয়া ভুলবে কী করে?

কলকাতার ছোটোদের রবিবারটা কেমন ছিল আর কী দিয়ে শুরু হোতো জানি না কিন্তু আমাদের রবিবারের সকাল এমন ছিল।রবিবার মানে বাগবাজারের কচুরি, নকুড়ের সন্দেশ,দুপুরবেলা খাসি কি রেওয়াজি পাঁঠার মাংস না এমনটা ভাবা যেত না।বড়জোর ফুলকো ফুলকো লুচি।সংগে মিহি করে কাটা আলুভাজা কি বেগুনভাজা আর চিনি।কালে ভদ্রে রসগোল্লা কি মাখা সন্দেশ।পাঁঠার মাংস আমরা খেতাম পুজোর বলির প্রসাদ হিসেবে।দুপুরবেলা মাংস খাব কী করে?ছাগল কাটাই হবে বিকেলে সবাই জড়ো হলে।কে কতোটা নেবে সেই মতো। আর অবশ্যই খাসি।রাত্রে রান্না হবে। হ্যারিকেনের আলোয় পড়ার ফাঁকে মন চলে যাবে রান্নাঘরে।গরম ভাত আর ধোঁয়া ওঠা মাংসকার পাতে কতোটা মাংস পড়ল সেটা কেউ কেয়ার করত না।মেটে পড়ল কি না সেটাই আসল।তা ছাড়া নৈনিতাল আলু পাতে না পড়লে কীসের মাংস খাওয়া?
আমাদের ছুটির দিন মানে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা।নারকেল গাছের থেকে ডাব নারকেল পাড়া।বাগানে জল দেওয়া।কাপড় কাচা আর গায়ে মাথায় সোডা-সাবান ঘষা।সকালবেলা গাছের ডাল দিয়ে ডাংগুলি আর ক্রিকেটের উইকেট আর ব্যাট বানানো।টক বাতাবি লেবু পেড়ে ফুটবল খেলা।এর বাড়ি,ওর বাড়ির থেকে চাল-ডাল-আলু-তেল চেয়ে বাগান থেকে আনাজপাতি চুরি করে চড়ুইভাতি।দিনে হোক কি রাতে স্বাদ হোতো অনবদ্য।চেয়ে চিন্তের চড়ুইভাতি তাই খিচুড়িই হোতো।কারও বাড়ি থেকে হাঁস কি রামপাখির ডিম জোগাড় হলে ডিমের ঝোল।চাটনিটা ছিল অধিকন্তু। রামপাখির কথা সবাই বুঝবেন কি না জানি না কিন্তু আমাদের ছোটোবেলায় বাড়িতে মুরগীকে রামপাখিই বলা হোত।যার ডিমের প্রবেশই ছিল বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ সহ। মাংস তো দূরস্ত।
বাড়িতে হাঁসের ডিম খাওয়া হোতো,হাঁসের মাংস নয়।একবার খুব সখ হোলো হাঁস পোষার।বড় জামাইবাবু ঝাড়গ্রাম থেকে দুটো তিনটে খাকি ক্যাম্পবেল এনে দিলেন।ওরা জলের চেয়ে ডাঙায় থাকাই পছন্দ করে।হাঁস ডিম পাড়ে রাতেরবেলা আর রামপাখি সকালবেলা।আমাদের হাঁসগুলো মাঝে মাঝে দিনেরবেলাও ডিম পাড়ত।তাও আবার তার আস্তানায় নয়,বাগানের যেখানে সেখানে।হাঁস পোষার সংগে সংগে রামপাখি পোষার সখ হোলো হাঁসের ডিম ফোটানোর জন্যে।যে মুরগী সদ্য কুকড়া ধরেছে অর্থাৎ কি না তার ডিম পাড়ার পালা শেষ এবার সে ডিমে তা দিতে চায়।যার তার ডিম পেলেই হোলো।তার কাছে রেখে দেওয়া হোলো কিছু হাসের ডিম আর মুরগীর ডিম।আমি প্রতিদিন তার খাঁচার কাছে বসে থাকতাম।সে আমাকে কিচ্ছুটি বলত না।শুধু মাঝে মাঝে ডিমগুলোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখত আর আগে পিছে করত।একবার দুবার খাবার খেতে উঠত আবার বসে পড়ত ডিমগুলোর উপর।শেষের দিকে কয়েকদিন আর ডিম ছেড়ে নড়লই না।সবাই বলল-এবার বাচ্চা ফুটবে।সত্যি সত্যি একদিন সকালে দেখি ডিমগুলো নড়ছে আর মুরগীটা একটু একটু করে ডিমগুলোকে ঠোকরাচ্ছে।একটু পরেই বেরিয়ে এলো হলুদ রঙের ছোট্ট ছোট্ট ছানা।ছড়িয়ে দিলাম চালের খুদ।মা মুরগীটা খুঁটে খুঁটে খেতে থাকল।তার দেখাদেখি ছানাগুলোও।ছোট্ট পাত্রে জল দিলাম ওরা খাওয়ার থেকেও ছড়াল বেশি।এবার হাঁসের ছানা আর মুরগীর ছানাকে আলাদা আলাদা খাঁচায় রাখার পালা।পটাসিয়াম পারমাংগানেটের জল খাওয়ানো।মুরগীর ছানাদের চাল আর গমের ভাঙা দানা আর হাঁসের ছানাদের ভাতের সংগে তুষ মিশিয়ে খেতে দিতে হোত।
এক ছুটির দিনে বড় জামাইবাবু এলেন শ্বশুরবাড়িতে।এর মধ্যে একটা দুটো মুরগী বাঁশ বনের শেয়াল খাঁচা ভেঙে তুলে নিয়ে গেছে রাতেরবেলায়।একটা দুটো মোরগও বেশ বড়ো হয়েছে।জামাইবাবু বুদ্ধি দিলেন রামপাখির মাংস খাওয়ার।বাড়ির সবাই রে রে করে তেড়ে এলো।সেদিন ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা।প্রতি পূর্ণিমায় বাড়ির ঠাকুর ঘরে সত্যনারায়ণ পুজো হোতো আর তুলসীতলায় হোতো হরির লুঠ।পুজোর পরের শিরনি আর হরির লুঠের গুড়ের বাতাসার ওপর ছিল আমাদের বেজায় লোভ।পুজোর পরে বামুন ঠাকুরকে চিৎকার করে আমরা ছেলেরা বলতাম- বামুন ঠাকুর এদিকে পড়েনি। কোনও কোনও বার তার ছেলে যার নাম ‘বকা’ আমাদের বয়সী সে যখন হরির লুঠ করত আমরা রীতিমতন তাকে ধমকে বেশি বেশি বাতাসা আদায় করে ছাড়তাম।রাম পাখির মাংস খাওয়ার দিন আমাদের হরির লুঠ মাথায় উঠল।আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি মাংসের তরিবতে।বাগানের দক্ষিণ পাড়ের এক কোণে ছাড়ানো হোলো।বাড়ির উঠোনের এক কোণে তোলা আঁচে সেই মাংস রান্না হোলো।খাওয়া হোলো বাইরের উঠোনে। আমার জীবনে সেই প্রথম নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ।তাও আবার শ্রাবণী পূর্ণিমায়।তার পরে কতো আষাঢ়,কতো শ্রাবণ চলে গেছে আরও এক নিষিদ্ধ মাংসে উদরপূর্তিতে।কতো শীত রসনার তৃপ্তি হয়েছে বরাহনন্দনে।কতো সন্ধ্যে অতিবাহিত হয়েছে নিষিদ্ধপল্লীতে। কবুল করতে দ্বিধা নেই কামতাড়িত হয়ে নয় নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে।তাও পল্লীতে। পল্লীর কোনও নিভৃত কক্ষে প্রবেশের সৌভাগ্য হয়নি আমার আজও।তেমন ছুটি পাইনি।
যদিও সপ্তাহের প্রতিটি দিন আমাদের ছুটির দিন ছিল না তবু অবসর খুঁজে নিতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।স্কুলের টিফিনের সময়ে কেউ বাড়ি থেকে টিফিন এনেছে কৌটোয় ভরে?অসম্ভব।বড়জোর শংকরদার দোকানের ‘সল্টিস(সল্টেড)চিনেবাদাম,কি প্রজাপতি বিস্কুট,কি লেড়ো বিস্কুট,কি লম্বু নয়ত ঘুগনি।সে বাদে বাগানের আম-পেয়ারা, রাস্তার পাশের কঁদ বেলের গাছ থেকে কাঁচা কি পাকা বেল পেড়ে খাওয়া। আর হঠাৎ টিফিনের আগে ছুটি হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে দেখতাম উঠোনে সার দিয়ে মানুষ শুয়ে বসে আছে।রেডিয়োটা রাখা হয়েছে বৈঠকখানায়।সবাই অলস দুপুরে শুনছে অনুরোধের আসর কিম্বা রম্যগীতি।ওখানেই তো প্রথম শোনা স্বর্ণযুগের সেইসব কালজয়ী গান।পরে বাড়ির দম দেওয়া কলের গানে।কোনও কোনও ছুটির দুপুরে গ্রামের মানুষ ঝেঁটিয়ে আসত কলের গানে নাটকপালা শুনতে কি প্যারোডি গান শোনার জন্যে।নাটকপালা মানেই কমপক্ষে দশ বিশটা রেকর্ড তার আবার এপিঠ ওপিঠ।শুনতে শুনতে বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হোতো।সেদিন আর মাঠে যাওয়া হোত না তাদের।পরে পরে চায়ের দোকানে রেডিয়ো এলো।ভীড়টা চলে গেল চায়ের দোকানে।চায়ের বিক্রী বাড়ল।তবে বছরের শেষে পোস্ট অফিসে গিয়ে রেডিয়োর লাইসেন্স রিনিউ করাতে হোতো।ঠিক যেমন টেলিভিশনের প্রথম যুগেও তাই দস্তুর ছিল।
আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সকালবেলা খবর শোনাটা অবশ্য কর্তব্য ছিল।দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরাট কণ্ঠে......"আকাশবাণী কলকাতা৷খবর পড়ছি........." তার পরেই ঘোষক কি ঘোষিকার কণ্ঠে-‘এখন রবীন্দ্রসংগীত শুনবেন দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’ কিম্বা কোন দিন সুচিত্রা মিত্রের সেই মুক্ত স্বরে ‘আমায় যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি/আমার যত বিত্ত প্রভু,আমার যত গ্লানি সব দিতে হবে’।আজ যেমন রেডিয়ো বলতে আকাশবাণী ছাড়াও বেশ কিছু প্রাইভেট এফ এম চ্যানেল একাত্তরেও আমরা পেয়েছিলাম একটা নতুন রেডিয়ো স্টেশন। কলকাতা ‘ক’,কলকাতা ‘খ’ আর বিবিধ ভারতী ছাড়াও রেডিয়োর নব্ ঘোরাতেই ভেসে এলো রেডিয়ো বাংলাদেশ।সেখান থেকে ভেসে আসত মুক্তিযুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের কণ্ঠস্বর-“আমারে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা”।আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রখ্যাত লোকসংগীত গায়ক অংশুমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গান-“শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কথার ধ্ব্নির প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি”,নয়ত একুশে ফেব্রুয়ারীর সেই গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।আমি কি ভুলিতে পারি?ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুভরা এ ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি......?আর রবি ঠাকুরের গান –“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।এসব শুনতে শুনতে আমাদের ধমণীর রক্তেও কেমন শিহরণ জাগত।মনে হোতো লড়াইটা ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-যশোর-বরিশাল-বগুড়া-কুষ্ঠিয়ায় নয় এদেশেও চলছে।আমাদের খেলাধূলা,আমাদের ছোটাছুটি সবের মধ্যেই মিলে মিশে গিয়েছিল ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধ আর এ বাংলার নকশাল আন্দোলন।তবে আমাদের মুক্তি ছিল শুক্কুরবারে রাত আটটায়।
সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে সেদিন আমরা সন্ধ্যে নামলেই হ্যারিকেনের আলোয় বসে পড়তাম পড়তে।এক একটা হ্যারিকেন পিছু চারজন।এভাবে চার থেকে ছটা হ্যারিকেনের আলোয় বৈঠকখানা আলো হয়ে থাকত।বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।তার মধ্যে সকলের সমস্বরে চিৎকার করে কেউ পড়ছে ভূগোল তো কেউ পড়ছে ইতিহাস।কেউ বা জ্যামিতির সূত্র,কেউ বা গাছের শালক সংশ্লেষ।এমন শব্দের মন্তাজ আকবর বাদশা কি মহম্মদ বিন তুঘলকের সংগে আসানসোল ঝরিয়ার কয়লা উত্তোলন,তার পাশে ত্রিভূজের তিন বাহুর সমষ্টি মিশে যাচ্ছে লজিকের ফ্যালাসিতে।সে যে না শুনেছে সে উপলব্ধি করতেই অক্ষম।যেন কিছুটা বা পাশ্চাত্যের সিম্ফনির মতো।সময় যত গড়িয়ে আসবে সেই ধ্ব্নি ক্রমে ক্ষীণ হতে হতে মিছিমিছি বইয়ের পাতায় ম্লান হবে।জেগে উঠবে ঘোষকের স্বর ‘আজকের নাটক...... “তাহার নামটি রঞ্জনা” রচনা বিধায়ক মিত্র,অভিনয়ে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র...’। সেদিন নাটক শেষ হলে অবধারিত ভাবে আমি কাঁদব।আমার চোখের জলে ভিজবে ইতিহাসের পাতা।তখন কি জানতাম একদিন আমার নাটকও ভেসে যাবে ইথারের প্রচার তরঙ্গে.........?

আজ কতকাল ধরে আমার নাটক প্রচারিত হয় কলকাতা "ক" এ.........।কতো স্মৃতি তার.........আমার আকাশবাণীর নাটক লেখা অনুবাদের হাত ধরে।মাসের শেষ শনিবার ‘অখিল ভারতীয় কার্যক্রম’এ ভারতের নানা ভাষার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত নাটকের বংগানুবাদ।অনুবাদের জন্যে হাতে পেতাম হিন্দী কি ইংরাজীতে টাইপ করা নাটক।কখনও বা হাতে লেখা নাটকও পেয়েছি।যার উদ্ধার ছিল বড়ো কঠিন কর্তব্য। আমার নাটক এরপর  সরাসরি সম্প্রচারিত(Live Broadcast) হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিশুদার (বিশ্বনাথ দাস) প্রযোজনায়৷বহুরূপীর অমর গাঙ্গুলি,অরুণ মুখোপাধ্যায় এছাড়াও বহু দিকপাল অভিনেতা অভিনেত্রী সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। ছোটবেলায় কোনদিন সরাসরি সম্প্রচারিত নাটক শুনিনি।যা শুনতাম সবই ‘প্রি রেকর্ডেড’।আগে থিয়েটার মঞ্চ থেকেও নাটক সরাসরি সম্প্রচারিত হোত।আর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমার নাট্যরূপ সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়া এ ছিল আমার পরম প্রাপ্তি।জ্যাঠাবাবু,বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হোতো।এই কথাটা এইজন্যে বলতে পারছি বাবার মৃত্যুর পর বাবার ডায়েরিতে সংসারের হিসেব নিকেষের পাশে যেদিন আমার নাটক কলকাতার ‘আকাদেমি অব ফাইন আর্টস’এ মঞ্চস্থ হচ্ছে সেই তারিখে সেই নাটকের নাম বাবা সযত্নে লিখে রেখেছিল তা খুঁজে পেয়েছি।অবশ্য মা শুনেছে আমার নাটক।অপর্ণার অভিনয়ও দেখেছে।
একবার বিমল করের "পলাশ" গল্পের বেতার নাট্যরূপ দিয়েছিলাম তাঁর জীবদ্দশাতেই৷ বেতার নাটকের নাম রাখা হয়েছিল “পলাশের দিন”।লেখকের সল্টলেকের বাড়িতে গিয়ে অনুমতি নিয়েছিলাম৷অভিনয় করেছিলেন রুদ্রদা (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) ছন্দাদি (উৎপল দত্তের ‘টিনের তরোয়াল’ নাটকের সেই বিখ্যাত অভিনেত্রী ছন্দা চ্যাটার্জি)আর ঋতা দত্ত চক্রবর্তি৷একজন হরবোলার দরকার পড়েছিল৷পাখির ডাক আর রেললাইনে ট্রলি ঠেলার শব্দের জন্যে.........সবাই খুব অবাক হয়েছিলাম তার কণ্ঠের কেরামতিতে৷তার চেয়েও অবাক হয়েছিলাম আমি যেদিন লেখককে প্রথম ফোনে যোগাযোগ করে রেডিয়োর প্রস্তাবটা দিলাম উনি শুনেই বললেন-‘মধ্যদিনে যবে গান’ ওই গানটা রাখছেন তো?আমি স্তব্ধ!যে লেখক কয়েক’শ গল্প-উপন্যাস লিখে ফেলেছেন।পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন সেই তিনি তাঁর একটি ছোটো গল্পে রবি ঠাকুরের কী গান রেখেছিলেন তা এতদিন পরেও মনে রেখেছেন?
"ছুটি"র নন্দিনী মালিয়াকে মনে আছে...?উনি কতবার যে আমার নাটকে অভিনয় করেছেন৷অমর গাঙ্গুলি,হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়,দেবরাজ রায়,দেবাশিস বসু,গৌতম বসু এরাও......।
আমার প্রিয় লেখক প্রয়াত অমলেনন্দু চক্রবর্তীর বেশ কয়েকটি গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছিলাম আকাশবাণীর জন্যে৷অমলেন্দুদা খুব খুশি হয়েছিলেন৷মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সরীসৃপ” গল্পের নাট্যরূপ দেবার সময় কয়েক রাত যন্ত্রণায় ছটফট করেছি।সেই নাটকে গঙ্গাপদ বসুর ছেলে গৌতম বসু অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন।সংগে ছিল ঋতা দত্ত চক্রবর্তি।এই নাটক সম্প্রচারের কিছু আগেই বেতারে মহানায়ক উত্তমকুমারের এক আলেখ্যে হুবহু মহানায়কের কণ্ঠ অনুকরণ সবাইকে চমকে দিতে দিতে আচমকাই মহানায়কের মতো চলে গিয়েছিলেন গৌতম।নন্দনে ঋতা খবরটা দিতে আমিও কম চমকে উঠিনি।পরে রঙ্গনায় তার স্মরণ সভায় আবার সেই কণ্ঠ শুনে নতুন করে চমকে উঠতে হয়েছিল।গৌতম নেই কিন্তু আজও তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে বেতারে।
ভাবতে ভালো লাগে আজও বাংলার বহু মানুষ বেতার নাটক শোনেন৷বিশেষ করে এফ এম প্রচার তরঙ্গ আসার পরে যেন বা নতুন করে ফিরে আসছে বেতারের দিন। বেতার নাটকের কথা বলার সময় আকাশবাণীর প্রযোজকদের কথা না বলাটা অমার্জনীয় অপরাধ হবে।প্রবাদপ্রতিম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে আমি প্রযোজক হিসেবে পাইনি কিন্তু শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়েছিলাম যিনি ষাট বছর বয়সেই সাত থেকে সত্তর যে কোনও কণ্ঠ প্রকাশ করে অভিনয় করতেন।শুক্লাদি নাট্যকারদের খুব সম্মান দিতেন। টেলিভিশনের যুগেও রেডিয়ো নাটককে গুরুত্ব দিতেন।নিছক চাকরি হিসেবে দেখতেন না।এরকম আরও একজন ছিল বিশুদা।বিশ্বনাথ দাস।বিশুদার অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না।‘পলাশের দিন’ নাটকটা প্রযোজনার সময় মাঝ রাত অব্দি নাটক নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেত ল্যান্ডফোনে।রামজীবন মিত্র রামুদাও আমার অনেক নাটক প্রযোজনা করেছে।রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র দীপক পোদ্দার আকাশবাণীর ‘পেক্স’(প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ)বেতার নাটকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে।আমার নাট্যরূপে অমলেন্দু চক্রবর্তির কাহিনি নিয়ে নাটক প্রযোজনা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জুনিয়র ভ্রাতৃপ্রতিম সুব্রত মজুমদার বাংলা মঞ্চে আলোক প্রকল্পক আকাশবাণীর প্রযোজক হিসেবে এখনও নাটক প্রযোজনা করে চলেছে।আর একজন আকাশবাণীর নাটক বিভাগের না হলেও বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের সংগে তার নিবিড় যোগাযোগ কেন না তিনি একজন লেখক।স্বপ্নময় চক্রবর্তি আমাদের কালের একজন শক্তিশালী লেখক নিঃসন্দেহে।বন্ধুপ্রতিম স্বপ্নময় তখন আকাশবাণীর কলকাতা বিজ্ঞান বিভাগের প্রযোজক।কেন্দ্র থেকে বয়ঃসন্ধির উপর একটা প্রজেক্ট এলো যেটা মূলত ধারাবাহিক নাটক।ডাক পড়ল আমার ও নাট্যকার চন্দন সেনের।কেন্দ্র থেকে পাঠানো পাণ্ডুলিপিকে তুড়ি মেরে ফেলে দিয়ে আমাদের স্বাধীন ভাবে লেখার সাহস দিল
সন্ধিক্ষণ’ ধারা বেতার নাটক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।লেখক স্বপ্নময় আকাশবাণী থেকে অবসর নিয়েছেন কিন্তু রেখে গেছেন এক যোগ্য উত্তরসূরী মানস দাসকে।
আর যার কথা না বললেই নয় মানস মিশ্র।মানস রবীন্দ্রভারতীতে আমার সহপাঠী ছিল।আকাশবাণীর অ্যাসিসটেন্ট স্টেশন ডাইরেক্টর যখন সাধারণ অফিসার ছিল আমার বাসায় নাটক লেখার দাবি নিয়ে পৌঁছে যেত।আমিও তাকে কোনও দিন নিরাশ করিনি।বিশ্ব মাতৃস্তন্যপান দিবসের জন্য সে আমাকে দিয়ে একটি গবেষণা মূলক নাটক লিখিয়ে নিয়েছিল।তখনও মানস বিয়ে করেনি।আর আমি সদ্য বিয়ে করেছি। ‘অমৃতধারা’ আজও প্রচারিত হয় বেতারে।সেই কোন যুগে রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সংগে তুলনা করেছিলেন।আজ বাঙালি মাতৃভাষা না জানাতেই গর্ব অনুভব করে।আর মাতৃদুগ্ধ?না হাজার বেবিফুড আর কৌটোর দুধ ওটাকে বর্জনে অপারগ।
আগামী শুক্রবার ৮ এপ্রিল ২০১৬ রাত আটটায় বরুণ দাসের প্রযোজনায় আমার নতুন বেতার নাটক "সেদিন সন্ধ্যা" প্রচারিত হবে কলকাতা "ক" প্রচার তরঙ্গে............।
আমি কান পেতে থাকব............।আপনি............?