শেষ নাহি
যে......অশেষ-কথা কে বলবে?
বয়সে সে আমার চেয়ে কিছু
ছোটো ছিল।মনের বয়সে আমার থেকে কিছুটা,কিছুটা কেন অনেকটাই বড়ো ছিল।বুদ্ধিতে সে
বায়সের মতো ধূর্ত ছিল।ফূর্তিতে সে ছিল চড়াইয়ের মতো সদা চঞ্চল ও
স্ফূর্তিবাজ।প্রিয়জনের পাকশালায় প্রবেশে সে ছিল শালিকের মতোই তৎপর।চলনে সে ছিল
ছাতারের মতোই ছটফটে।যাকে তাকে কারণে অকারণে ঠোকরাতে সে ছিল বাহারি কাটঠোকরা।বচনে
সে ছিল টিয়াপাখি।লোচনে সে ছিল ময়না।মানুষের পাশে দাঁড়াতে সে ‘সুখের পায়রা’ হতে
পারেনি।সে ছিল দুখের পায়রা।দ্রুততায় ছিল চিতাবাঘ।অভীষ্টলাভে সে সিঙ্ঘ।আক্রমণে রয়েল
বেঙ্গল টাইগার। গাধার মতো পরিশ্রমী।সারমেয়-র মতো সে ছিল কমিটেড।এমন এক যুবকের সংগে
আমার মতো এলেবেলের কীভাবে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল সেটাই পরম বিস্ময়!
আমি ছিলাম গেঁয়ো,সে ছিল
শহুরে।সে ছিল ‘কাঠ বাঙাল’ আর আমি ‘গাছ ঘটি’।সে ছিল বদ্যি সে ছিল লম্বা।আমি বেঁটে-কায়েত।তার চুল পাতলা পাতা করে
আঁচড়ানো।আমার চুল তখন ঘন আর কোকড়ানো।সে ছিল ইংরেজিতে তুখোড় আর আমি গোমুখ্যু।সে ওই
বয়সেই প্রেম করে সংসার পাতার চিন্তা করছে তখন আমি দাদার সংসারে এবেলা ওবেলা পাত
পেড়ে খাই।প্রেমে শুধু
পড়ি,কোনও পরী(ডানাকাটা তো দূর অস্ত)আমাকে ফ্রেম করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।অভিনয়ে
সে নিজেকে ডাস্টিন হফম্যান ভাবত আর আমি গাঁ থেকে আসা ভবম নাপিত কি হানিফ
মিস্ত্রী।সারাদিন থিয়েটারের নেপথ্য কর্মী।আর সে শো শুরু হবার কিছু আগে হন্তদন্ত
হয়ে এসে মেক-আপ এ বসে পড়ত।কথা বলার সময় সে অফুরাণ থুতু ছেটাত আর আমি কিছু কথা বলতে
গেলেই ঢোঁক গিলতাম।শুধু ক্বচিৎ কখনও শোয়ের শেষে কোনও সুন্দরী গ্রীনরুমে এসে আমাকে
‘হাগ’ করলে রঞ্জনদা আর অশেষ প্রকাশ্যে হিংসায় পুড়ে মরত?না আমাকে মারত।
অশেষ-এর নাটকের ফাঁদ পাতা
ভুবনে ধরা পড়া নেহাতই বিধির লিখনে।অশেষ তখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার
ডিগ্রীর ছাত্র।ইউনিভার্সিটির নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমাদের নাট্যদলের প্রধান
অভিনেতা দ্বিজেন(বন্দ্যোপাধ্যায়)দার পাল্লায় পড়ে গেল।আমাদের কাজই ছিল ইন্সিওরেন্স
কোম্পানির এজেন্টের মতো নিমরাজি ছেলেদের ধরে এনে দলে ঢোকানো।অশেষ এলো তবে একা এলো না।আরও
কয়েকজন জুটিয়ে নিয়ে এলো।একসময় তারা পালালো।ধরা পড়ল অশেষ।এ বড় কঠিন ঠাঁই।এ বড় জটিল
বিন্যাস।যে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় দলের প্রধান অভিনেতা তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক,পারিবারিক
টানাপোড়েন প্রতিষ্ঠানের সংগে একাকার।এক দিন সরতে হোলো তাকে।রয়ে গেল অশেষ।
আমি তখন নানা ঘটনার
টানাপোড়েনে ছারখার।জীবন সংগ্রাম, নাট্যদল,পারিবারিক সম্পর্ক আর পাশের মানুষদের
অতিরিক্ত বিশ্বাস,ইউনিভার্সিটির অন্তিম পরীক্ষা, প্রেমের প্রতি অগভীর অনাস্থা,......নাট্য
আন্দোলনের কাছে অন্ধ প্রণিপাত এই সব আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল দু-দুটো মৌলিক নাটক-‘আবরণ’
ও ‘প্রবহতি’।লিখলাম আমি নামকরণ করল অশেষ।এই দুটি নাটকেই অশেষ অসাধারণ অভিনয় করল।খুব
সামান্য ব্যয়ে নাটক দুটি মঞ্চস্থ হোতো কিন্তু তাতে কী?নাটক দুটি বেশিদিন চালানো
হোল না।আমিও থামিয়ে দিলাম নাটক লেখা।আমি যে তখন নাট্যভক্ত হনুমান।সীতাকে রক্ষা করাই
কাজ।রামের আদেশ পালনেই কৃতার্থতা।গন্ধমাদন বয়ে আনা তুচ্ছ।প্রভুর বাণী শ্রবণেই
তৃপ্তি।কিন্তু প্রাপ্তিও যে হয়নি তাই বা বলি কী করে?আজ অ্যাতোদূর হেঁটে আসা তো ওই
প্রাপ্তির জোরেই।
ধ্বনির শ্রীপতি দাস,রূপ
সজ্জাকর শক্তি সেন কী সাহস জোগালেন সারাক্ষণ পাশে থেকে।নাট্যকার মোহিত
চট্টোপাধ্যায় প্রথম শোয়ের শেষে এক ‘দাদা’কে ডেকে বলেছিলেন-‘সলিল যেন নাটক লেখা না
থামায়’।হায়!নটনাথ নাকি ভরত মুনি মুচকি হাসলেন?পরের প্রযোজনায় আমি ফিরে গেলাম ছুতোর
মিস্ত্রীর কাজে।অশেষ তখন দামাল অভিনয় করছে।অশেষ তখন দলের অপরিহার্য অঙ্গ।আমি তখন
নিজে নিজেই একা নিঃসঙ্গ।শক্তিদা এক দিন ডেকে বললেন-‘সলিল ভুল করছ।চোরের উপর রাগ করে
মাটিতে ভাত খেয়ো না’।আমি এবার নাটক অনুবাদে হাত দিলাম।আর লিখে চললাম নাট্য প্রবন্ধ।অশেষও
তখন কেমন দোলাচলে।আমি একা এবং কয়েকজন বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম কুক্ষিগত বৃত্ত
থেকে।না আমি অতীতের কেচ্ছা লিখতে বসিনি।আমি অশেষের মহিমা কীর্তনে গা ভাসাইনি।আমি
লিখছি পুরানো পাতার আড়ালে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো অতীত যা আজ অবশ্যই ইতিহাস।