MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

কার ঘরে জ্বলেনি দীপ...।চির আঁধার
সলিল সরকার
পাড়ায় পাড়ায়,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে,আবাসনে গৃহপ্রাঙ্গণে এখন উৎসব।মাইকে অমায়িক উল্লাস।এখন সেই গান আর শোনা যায় না-“জিনিসের দাম বেড়েছে,মানুষের দাম কমেছে,হায় রে কপাল করব কী?” মাইকে না বাজলেও রেডিয়োয় এখনও শোনা যায় জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই গান
“কেউ বলে ফাল্গুন,কেউ বলে পলাশের মাস।
আমি বলি আমার সর্বনাশ”
ঠিক এইভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলা ও বাঙ্গালির উৎসবের মাস আবার প্লাবনেরও মাস।কোথাও মানুষ আনন্দে-উৎসবে ভাসছে আবার একই সময়ে বাংলার মানুষ বরষনে প্লাবনে ভাসছে।উৎসবে ভাসা মানুষজনকে এখনও সবাই ‘পল্লীবাসি’ বলে আর ভেসে যাওয়া জীবনকে ডাকা হয় ‘বানভাসি’ বলে।
উনপঞ্চাশ(১৯৪২)সালের ঝড়ের কথা লিখতে গিয়ে নিজের কালের ৭৮এর দুর্বিপাকের কথা ঝড়ের মতো উড়ে এলো স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ত্রাস-সন্ত্রাস-কারাবাস-রক্তের স্নানের পর বাংলায় এসেছে বামফ্রন্ট মানুষের অদম্য প্রয়াসে।বাংলা নাটকে তার আগে থেকেই এসেছিল প্লাবন।বাংলায় প্লাবন এলো শারদীয় উৎসবের কিছু আগে।তখনও মানুষ সে শহর হোক কি গ্রাম ত্রাস ও সন্ত্রাসের দিন গুলো মন থেকে মুছে উঠতে পারেনি।তখনও রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পায়নি।তখনও ‘জমানা বদল হোলে দেখে নেবার’হুমকি দিয়ে চলেছে দেবী ও দেবের পারিষদরা। তখনও বাসে পেট্রোল বোমা পড়ে।খোলা রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ও চপার নিয়ে ঝন্টু-মিন্টু-পিন্টু-কাল্টু(কল্পিত)রা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে না হোলেও রাতের অন্ধকারেই।
পেশাদার থিয়েটারে তখন নাভিঃশ্বাস।‘এ’মার্কা থিয়েটার বিদায় নিচ্ছে কালের নিয়মেই। গ্রুপ থিয়েটার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আক্ষরিক অর্থেই।লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল,টি,জি)থেকে পিপলস লিটল থিয়েটার তৈরি হয়ে গেছে।“দুঃস্বপ্নের নগরী” তখনও যায়নি।চলছে “টিনের তলোয়ার”, “এবার রাজার পালা”।থিয়েটার ইউনিট করছে “পন্তু লাহা” আবার শেখর চট্টোপাধ্যায় বাণিজ্যিক থিয়েটারে করছেন “শ্রীমতি ভয়ংকরী”।নান্দীকার করছে “ফুটবল”।থিয়েটার ওয়র্কশপ করছেক “চাক ভাঙা মধু”, “রাজরক্ত”।চার্বাক করছে “কর্ণিক”।থিয়েটার কমিউন “কিং কিং”,“দানসাগর”।চেতনা করছে “জগন্নাথ”। বহুরূপী কুমার রায়ের পরিচালনায় নিয়ে এলো “মৃচ্ছকটিক”।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন “পাপ পুণ্য” নিয়ে।সুন্দরম্ করছে “সাজানো বাগান”।আর কিছু তরতাজা যুবক নির্মাণ করল নতুন সংগঠন শূদ্রক।এলো সময়ের প্রকাশ্য প্রতিভাস “অমিতাক্ষর”।বাদল সরকার প্রসেনিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কার্জন পার্কের ঘাসে,অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর লনে করছেন “ভোমা”, “মিছিল”, “সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস”।কেউ করছেন “লাল লন্ঠন”।কেউ করছেন “পদ্মা নদির মাঝি” আবার “গোরুর গাড়ির হেডলাইট”ও চলছে রমরমিয়ে।গ্রামে,মফঃস্বলে নাট্যকর্মী্রা কোমর বেঁধে নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার মঞ্চেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর,ঝরিয়ায়,কুলটিতে সুনীল রায়,সুনীল মুখোপাধ্যায়,বংশী মুখোপাধ্যায়, দুর্গাপুরে গোপাল দাস,বোকারোয় নিমু ভৌমিক,বালুরঘাটে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করছেন “দেবাংশী”।বহরমপুরে প্রদীপ ভট্টাচার্য লড়ে যাচ্ছে নাটক নিয়ে।চাকদহে নাট্যকার চন্দন সেন নাটক লিখছেন,পরিচালনা করছেন।দক্ষিণেশ্বরে কালী মা নয় গোর্কির “মা” করছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।কথায় কিছু এলোমেলো হোলো যদিও লুটেপুটে খাওয়ার দিন ছিল না সেইসব দিন।বন্যায় ভেসে যাওয়া আবার ভেসে ওঠার পরে ছয় ছয়টি নাট্যদল দলাদলি না করে নয় ছয় না করেই ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রকে নিয়ে করল বারটোল্ট ব্রেষটের নাটক “গালিলেওর জীবন”।সুব্রত নন্দী এর আগেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সেটিই “বহুরূপী” করল “গালিলেও” নামে।সবটাই সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তা বলব না তবে আজকের ক্যান্সারের মতো তা নিঃশব্দ প্রকট ব্যাধি হোয়ে ওঠেনি।
বাংলায় বন্যা নতুন কিছু নয়।উপ সাগরীয় অঞ্চল,খাল-বিল-নদি-নালার দেশ।ঝড়-তুফান সে তো উঠবেই।মা-মাটি সে তো ভাসবেই।একটু হাল্কা চালেই বলি-আমার বাবা কবি ছিলেন না,জ্যাঠাবাবুর মতো রসিকও ছিলেন না।ছিলেন খাজনা আদায়ের ‘তহশিলদার’।নিজেদের নাম দেব-দেবীর নামে হোলেও আমাদের নাম রেখেছিলেন-মলয়
মিলন,সলিল।কী আশ্চর্য আমার জন্মের ঠিক পরের বছর বাংলায় বন্যা হয়েছিল।১৯৪২ এর পরে ১৯৫৬ আর ১৯৫৯।এই দুই বারে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু এর পরে ১৯৭৮ এ এই সময়ে বিপুল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল বাংলার প্রায় সব জেলা।এমনকি কলকাতাও।
আমরা তখন সারা রাজ্যজুড়ে মঞ্চে-খোলা মাচায় নাটক করে বেড়াই।সেবার নাটক ছিল বর্ধমান রাজ কলেজে।তখনও দাপুটে বাহিনী “অমিতাক্ষর” করার সময় নাটক থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোলো।সেই রাতে আমাদের ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল।আমরা না থেকে বাস নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।রাস্তায় নেমে বুঝলাম আমরা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বড়ো রাস্তার উপরেই জল বইতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে নামলাম এক হাঁটু জলে।
মা-বাবা-জ্যাঠা-কাকা-কাকিমা-ভাই-বোনেরা সবাই তখন ভিকিরিপতি গ্রামে।অনেক বন্যা হয়েছে কিন্তু তাম্রলিপ্ত বন্দর কখনও জলে ভাসেনি।কাঁথি-দীঘায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে কিন্তু আমরা কখনো ভাসিনি।এবার কোলাঘাট,বাগনান,রাধামনি,হাকোল্লা,ব্যবত্তা সব ভেসে গেল।গ্রামের ডাকঘরে ট্রাংককল করা যাচ্ছে না।স্থানীয় সংবাদ রেখে ঢেকেও যা জানাচ্ছে তা ভয়ংকর।রূপনারায়ণ বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।রেললাইন জলের তোড়ে ভেসে গেছে বাগনানে।বাড়ির সবাই,গ্রামের মানুষ সব ফেলে রেখে উঠছে স্থানীয় স্কুলে।সেই প্রথম ভিকিরিপতি গ্রাম দেখল লঙ্গরখানা।
আমার দাদা আর আমি কলকাতা থেকে ডাল-চাল-চিঁড়ে-বাতাসা-গুড়-মুড়ি-কেরোসিন তেল নিয়ে নূরপুর থেকে নৌকায় গেঁওখালি হয়ে মহিষাদল,সেখান থেকে কীভাবে যে তমলুক হয়ে মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিলাম তা মনে করতেও ভয় পাই।কাতারে কাতারে মানুষ জলেডোবা গ্রামে যাচ্ছে স্বজন-পরিজনকে উদ্ধার করতে।ঠিক ৪২এর দুর্বিপাকের বিপরীত।পথে ঘাটে মরা পশু।জলে ভাসছে মরা মাছ।রাতেরবেলা ভরা মাঠের থেকে ভেসে আসছে গুম গুম শব্দ!বাবা বল্লে-“মাটির বাড়ি জল নামার সংগে সংগে জলের উপরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!তারই শব্দ ভেসে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে!”

আটাত্তরের সেই দুর্বিপাক কাটিয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ আর বামফ্রন্ট।তার কতো বছর পরে গ্রীষ্মকালে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল বামফ্রন্ট।একেই বলে “বিধি বাম?” না কী এরই নাম সিঙ্গুর,খেজুরি,নন্দীগ্রাম?