মন্বন্তরে মরিনি আমরা
সলিল সরকার
১
বাংলা এই উপকূল বছর বছর বর্ষা হলেই জলে ভাসবে,বানভাসি হবে মানুষ এ আর নতুন কথা কী?বানভাসি মানুষের ত্রাণ,বাঁধভাঙার চাপান-উতোর,কিউসেকের হিসেব নিকেস তাও চলবে চ্যানেলে চ্যানেলে।যদিও মানুষ তখন জলমগ্ন।আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা বল্লেন আমি যেন মানুষের কথা বলি।বেশ আমি বরং ঝড়ের খুড়সিনামা(কুরসিনামা) খুলে বসি।
বাংলার উনপঞ্চাশ সালের উপকুলীয় ঝড় আর জলোচ্ছাস,পঞ্চাশের মন্বন্তর আমার জন্মের তেরো-বারো বছর আগের দুর্বিপাক।আমার জন্মের কালে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে দেশভাগ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,উদ্বাস্তু উদ্বে্গ আর “এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” কমিউনিস্ট আন্দোলনে।যদিও রেখে গিয়েছিল তার রেশ শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্পকলায়,গীতিকার-সুরকারদের সুর আর কথায়,গায়িকা-গায়কের গানে যা ভিকিরিপতি গ্রামেও ছাপ ফেলেছিল।আর ছিল জলবসন্তের দাগের মতো গভীর সামাজিক ক্ষত যা সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনও মুছে দিতে পারেনি।
কবুল করতে লজ্জা নেই রবীন্দ্রানুরাগী জ্যাঠাবাবুর কণ্ঠে কোন দিন “নব জীবনের গান” শুনিনি।শুনিনি ইকবালের “সারে জাঁহাসে আচ্ছা......”কিন্তু রেডিয়োতে কি বাড়ির ‘কলের গানে’ শুনেছি “অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি” কি “পথে এবার নামো সাথী” আর শুনেছি ‘রানার’।শুনেছি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পুত্র কাজী সব্যসাচীর উদাত্ত কণ্ঠে “কারার এই লৌহ কপাট”, “কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই” কি “বিদ্রোহী রণক্লান্ত......”।
তবে বাবার কাছে,জ্যাঠাবাবুর আর ঠাকুমার কাছে উনপঞ্চাশ সালের ঝড়ের বিবরণ শুনেছি যখনই সাইক্লোন এসেছে কি অতি বর্ষনে ভেসে গেছে সারা গ্রাম।সেই সময়ের সাময়িক সংকটের কথা শুনেছি কিন্তু “ম্যান-মেড ফেমিন”এর ভয়াবহতা,শহরের পথে পড়ে থাকা সারি সারি লাশ, ‘প্রাণ দাও,ফ্যান দাও’ আর্ত চিৎকারের বিবরন দেখেছি,শুনেছি,পড়েছি তৃপ্তি মিত্রের লেখায়, বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” নাটকে,নিমাই ঘোষের“ছিন্নমূল”সিনেমায়,চিত্তপ্রসাদের,জয়নুল আবেদীনের স্কেচে,সোমনাথ হোড়ের পেন্টিংয়ে আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কবিতা আর ‘নব জীবনের গান’এ,সলিলদার কথায়-সুরে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দপ্তরে নিয়মিত কাজের মধ্যেই শুনেছি রেবা রায়চৌধুরির বলিষ্ঠ স্বরে “প্রাণের দেউলে যত বধূরা প্রদীপ জ্বালাবেই” তার পরেই নরেনদার(মুখোপাধ্যায়)ব্যারিটোন ভয়েসে “ঝড়ে ভাঙা ঘর যত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবেই”।তার বেশ কিছু আগেই পড়ে জেনেছি ১৯৪২-এ পূর্ব মেদিনীপুরের প্রায় ৪৫০ স্কোয়ার মাইল ভেসে গিয়েছিল সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে।প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৪০০ স্কোয়ার মাইলেরও বেশি অঞ্চল।৩২০০ স্কোয়ার মাইল বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঝড় আর লাগাতার বৃষ্টিতে।মানুষ মরেছিল চোদ্দ-পনের হাজার।গবাদি পশু মরেছিল কমপক্ষে এক লক্ষ নব্বই হাজার কি তারও বেশি।গ্রাম থেকে শহরে বাঁচবার আশায় পালিয়ে এসেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে লুটপাট করেনি,কেড়ে খায়নি।খেটে খাওয়া মানুষেরা শহরের রাস্তায় খুঁটে খেয়েছে।উৎসব-আনন্দের ভোজসভায় প্রবেশ না করে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে নেড়ি কুকুরের সংগে লড়াই করেই।ব্রিটিশ সরকার নীরব থেকেছে।কালোবাজারীরা দু-হাতে টাকা লুটেছে। আড়তদারেরা চড়া দামে মাল বেচেছে সম্পন্ন শহরবাসীদের কাছে।একমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গান গেয়ে,নাটক মঞ্চস্থ করে টাকা,জামাকাপড়,খাদ্য সংগ্রহ করে রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজ চিত্তপ্রসাদের মুদ্রিত চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে দিয়েছে।অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বেড়াজালে ফেলে নাটকের গতি স্তব্ধ করতে চেয়েছে,পারেনি। রবীন্দ্রনাথের গান দেখিয়েছে পথের দিশা।সুচিত্রা মিত্র,দেবব্রত বিশ্বাস এর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠল বিদ্রোহের গান।কালের অমোঘ নিয়মে মানুষ না খেতে পেয়ে যত মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মারা গেল অনেক দিনের না খাওয়ার পর খেয়ে।মাঠে মাঠে ফসল।ফসল কাটার কেউ নেই।ঘরে ঘরে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ।গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।রেংগুনে বোমা পড়ল কলকাতা শহরের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালাল গ্রামে।কালের পরিহাসে গ্রামের মানুষ আশ্রয় দিল শহরবাসীদের,যে শহুরে বাবুরা পথে পথে পড়ে থাকা অভুক্ত মানুষদের মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে অন্ন তুলেছে মুখে।তারাই প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিল গ্রামে।জন্ম নিল ‘ড্যাংচি বাবু’রা যারা কথায় কথায় বলত “ড্যাম চিপ”।
আমার শৈশবেও এই ‘ড্যাংচি বাবুদের’ আমি দেখেছি।তারা পালা-পার্বণে,দোল-দুর্গোৎসবে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সপরিবারে দেশে যেতেন।বাস থেকে নেমেই সামনে যাকেই পেতেন (সে চাষি হোক কি মুনিষ)তাকে ধমকে তার মাথায় বাক্স-প্যাঁটরা চাপিয়ে দিতেন।এই দেখে একবার আমার এক জাঠতুতো দাদা মাথায় কাঁধে-পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে তাদের বাড়ি অব্দি যাওয়ার পর বাড়ির মানুষজন দুলুদাকে চিনতে পেরে কোথায় মুখ লুকোবে ভেবে পায় না।শেষে দুলুদার কাছে ক্ষমা চেয়ে পুজোর মিষ্টি খাইয়ে নিস্তার চেয়েছিল।
গ্রামের পুজোয় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় কুটুম্ব দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে ফিরে আসবে এটাই ছিল রেওয়াজ।যার যা সংগতি তাই দিয়েই গ্রামের মানুষ অতিথি আপ্যায়ণে ত্রুটি রাখত না।সহজলভ্য শাক-সব্জি,খাল-বিলের মাছ,বাড়ির ধানের খৈ-মুড়ি,ক্ষেতের আখের আখিগুড় আর পুকুর পাড়ের তালের সারির তাল গুড় দিয়ে মুড়কি।ঘরের গাই-গোরুর দুধের ছানা-দৈ-ঘি।গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে আর বাড়ির গাছের নারকেলের নাড়ু-চিত্রকূটে পাড়া জুড়ে মিঠে সুবাস।খাল-বিলের মাছ ভাজা হোলে বিশেষ করে বেলে মাছ,গুলে মাছ,গুড় জাউলি মাছ,পারষে মাছ,নোনা চিংড়ি মাছের গন্ধ পেয়ে অবারিত দ্বা্রের বৈঠকখানায় বসে পড়ত যে কেউ বিনা আমন্ত্রণেই।পেট পুরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তবে তার নিস্তার মিলত।ষষ্ঠীতে নিরামিষ সোনা মুগের ডাল,আলুভাজা,বেগুনভাজা,শাক,শুক্তো,আলুপোস্ত,ছানার ডালনা,আলুবখরার চাটনি।সপ্তমীতে মাছ ভাত।অষ্টমীতে নুচি(লুচি)-কুমড়োর ছক্কা,ছোলার ডাল আর ধোঁকার ডালনা,প্লাস্টিক চাটনি।নবমীতে বলির পাঁঠার মাংস পাড়ায় বিলিয়ে যা পড়ে থাকত তার সংগে বাজার থেকে কিনে এনে তাই দিয়ে সবার পাতে দু-টুকরো মাংস আর চার-টুকরো আলু দিতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর উঠত।যার পাতে মেটে পড়ত সে ভাগ্যবান।সে সময় কেউ অসুস্থ হলে সে পেত ‘টেংরির জুস’।
যাদের এই সংগতি ছিল না তারাও হীণমন্যতায় না ভুগে এই কয়েকটা দিন আউস ধানের পায়েস তৈরি করত বাড়ির আখের গুড় দিয়ে।মাঠে ‘মুগরি’(বাঁশের তৈরি মাছ ধরার খাঁচা)বসিয়ে কুচো মাছ আর নোনা চিংড়ি ধরত।জলভরা আমন ধানের ক্ষেতে বঁড়শিতে আরশোলা,ঘুরঘুরে পোকা কি জ্যান্ত চিংড়ি টোপ দিয়ে বড়ো বড়ো ট্যাংরা,শোল,ভেটকি ধরত।শোলাকে ছোট ছোট করে কেটে তাতে সুতো বেঁধে কাঁটাতে কেঁচো লাগিয়ে ভাসিয়ে দিত ধান ক্ষেতে।ভোরবেলা সেগুলোকে তুলে দেখত কী মাছ গেঁথেছে সেই ভাসা বঁড়শিতে।প্রায় সব বাড়িতেই কচু,মান কচু,ওল,চুপড়ি আলু, বিচিকলা,নটে শাক,পালং শাক,কাটোয়ার ডাঁটা,বেগুন,লংকা,ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,চিচিঙ্গে,কুদরি, কাঁচা আর পাকা কুমড়ো অঢেল না হোলেও অপ্রতুল ছিল না।এই সময়টা শাপলা-শালুক,গেঁড়ি-গুগলি,কলমি শাক,সজনে পাতা,শুষনি শাক অঢেল ছিল।গুগলির তরকারী কম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ছিল না।কুমড়োফুল,বকফুলের বড়া আহা কী লোভনীয় যে ছিল।গ্রামের মানুষ এইসব খেয়েই অষ্টমীর সারারাত কয়েক ক্রোশ-মাইল পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখত।কী অফুরান প্রাণশক্তি!কী অনাবিল উচ্ছ্বলতা!
আমাদের বাড়িটাই ছিল একটা ক্লাবের মতো।ছোটোরা সারাদিন-রাত চোর-পুলিশ, ক্যারাম,ব্যাগাডুলি,সাপ-লুডো,রং-মিলান্তি,বাঘবন্দী খেলা খেলতাম।বড়োরা ব্রীজ,ব্রে আর মা-জেঠিমা-কাকিমা-ঠাকুমা খেলত টুয়েন্টি নাইন।শুধু ন’পিসেমশায় একা একা তাসের পেশেন্স খেলতেন আর জর্দা-পান খেতেন।ছোটো কাকা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেত। মেজপিসি আর চমৎকারী গুড়াকু দিয়ে সময়ে অসময়ে দাঁত মাজত।কেউ কেউ ভাঁড়ার থেকে চুরি করে পুকুর পাড়ে গিয়ে লুকিয়ে খেত আর পেটের ব্যথায় কাৎরাতো। কাড়াকাড়ি পড়ত শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে।হুড়োহুড়ি পড়ত বাড়িতে হঠাৎ কোনও অতিথি এলে।আর ঢাকের আওয়াজ থেমে গেলে অলস দুপুরে সবাই দিনের খাওয়ার পাট চুকিয়ে মাদুরে গা এলিয়ে চুপ করে শুনত রেডিয়োয় পুজোর গান-“প্রান্তরের গান আমার,মেঠো সুরের গান আমার”, “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”, “একটা গান লিখো আমার জন্যে”, “আকাশ-প্রদীপ বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার আগুনে গান গেয়ে” এসব গান শুনতে শুনতে কখন যে ঝুপ্ করে সন্ধ্যে নেমে আসত।পশ্চিম আকাশে সাঁঝতারার একটু ওপরে ঝুলত ফালি চাঁদ।হাল্কা হিমে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা আজকের এল,ই,ডি আলোর মতো টিমটিম করে আলো ছড়াত।শিউলি ফুলের আর হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে যেত বাতাসে।আকাশের উত্তরে ভাসত সপ্তর্ষি,দক্ষিণে কালপুরুষ।আর আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে রমণীয় ছায়াপথ।
দশমীর ভোরে আকাশবাণীর গানে “শুকতারা গো,নিও না বিদায়,নিও না......”আজও কানে বাজে।দশমীর দিন শুধু দিনের বেলায় রান্না হোত। দেবীমূর্তি জলে পড়লেই দশমী শুরু হোত না।ঘরের ঠাকুমা পুজোর দালান থেকে শান্তিজল আর অপরাজিতার লতা নিয়ে আসবে।বাড়ির সবাই পা ঢেকে বৈঠকখনায় বসবে।শান্তিজল ছেটানো হবে।তারপর অপরাজিতার বালা পরানো হবে এই মন্ত্র আউড়ে-“জয়দে বরদে দেবি,দশম্যে অপরাজিতে......”।এবার ছোটোরা প্রণাম করবে।বড়োরা করবে কোলাকুলি(পরে জেনেছি এই কোলাকুলি প্রথাটি এসেছে ঈদের থেকে)আর শুরু হবে মিষ্টি বিতরণ।ডানহাত বাড়িয়ে মিষ্টি নেওয়াটাই ছিল সৌজন্য।কিন্তু অধিকের আশায় হাতপাতা কারও পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে এমন ভাবে হাত বাড়াতাম যেন দুই মানুষের ভিন্ন হাত।বাড়ির প্রণাম সারা হোলে বেরিয়ে পড়া পাড়ার প্রণামে।আমাদের জানা ছিল প্রণামের পর কোন বাড়িতে নিমকি দেবে,কোন বাড়িতে ঘুগ্নি।যে বাড়িতে বয়স্ক-প্রবীণ মানুষজন থাকতেন তারা নিজের হাতে কিছু তৈরি করতে পারতেন না তাই ময়রার দোকান থেকে দরবেশ-সন্দেশ-মিহিদানা-সীতাভোগ আনিয়ে রাখতেন।সেই রাত্রে সবার বাড়িতে যেতাম না।পেট ভরে যাওয়ার কারণে পরের দিনের জন্যে ওই বাড়িগুলো রাখা থাকত।
এইভাবেই কেটে যেত কটা দিন।এবার আমাদের পড়ায় মন বসাতে হবে আর যারা এসেছিল আবার তারা বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে ফিরে যাওয়া ঢাকির দলের প্রায় সংগে সংগেই চাল-নারকেল-নাড়ু ব্যাগে ভরে ফিরে গেলে গ্রামগুলো শোকে মলিন হয়ে পড়বে।এবার অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মী স্থাপন করে দীপাবলীর প্রদীপ জ্বালিয়ে মরা গ্রামের প্রাণ ফিরিয়ে আনার কাজ।সে আর এক উৎসব।
বাংলার বানভাসি নাটকের বান
২
“কেউ বলে ফাল্গুন,কেউ বলে পলাশের মাস।
আমি বলি আমার সর্বনাশ”
ঠিক এইভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলা ও বাঙ্গালির উৎসবের মাস আবার প্লাবনেরও মাস।কোথাও মানুষ আনন্দে-উৎসবে ভাসছে আবার একই সময়ে বাংলার মানুষ বরষনে প্লাবনে ভাসছে।উৎসবে ভাসা মানুষজনকে এখনও সবাই ‘পল্লীবাসি’ বলে আর ভেসে যাওয়া জীবনকে ডাকা হয় ‘বানভাসি’ বলে।
উনপঞ্চাশ(১৯৪২)সালের ঝড়ের কথা লিখতে গিয়ে নিজের কালের ৭৮এর দুর্বিপাকের কথা ঝড়ের মতো উড়ে এলো স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ত্রাস-সন্ত্রাস-কারাবাস-রক্তের স্নানের পর বাংলায় এসেছে বামফ্রন্ট মানুষের অদম্য প্রয়াসে।বাংলা নাটকে তার আগে থেকেই এসেছিল প্লাবন।বাংলায় প্লাবন এলো শারদীয় উৎসবের কিছু আগে।তখনও মানুষ সে শহর হোক কি গ্রাম ত্রাস ও সন্ত্রাসের দিন গুলো মন থেকে মুছে উঠতে পারেনি।তখনও রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পায়নি।তখনও ‘জমানা বদল হোলে দেখে নেবার’হুমকি দিয়ে চলেছে দেবী ও দেবের পারিষদরা। তখনও বাসে পেট্রোল বোমা পড়ে।খোলা রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ও চপার নিয়ে ঝন্টু-মিন্টু-পিন্টু-কাল্টু(কল্পিত)রা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে না হোলেও রাতের অন্ধকারেই।
পেশাদার থিয়েটারে তখন নাভিঃশ্বাস।‘এ’মার্কা থিয়েটার বিদায় নিচ্ছে কালের নিয়মেই। গ্রুপ থিয়েটার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আক্ষরিক অর্থেই।লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল,টি,জি)থেকে পিপলস লিটল থিয়েটার তৈরি হয়ে গেছে।“দুঃস্বপ্নের নগরী” তখনও যায়নি।চলছে “টিনের তলোয়ার”, “এবার রাজার পালা”।থিয়েটার ইউনিট করছে “পন্তু লাহা” আবার শেখর চট্টোপাধ্যায় বাণিজ্যিক থিয়েটারে করছেন “শ্রীমতি ভয়ংকরী”।নান্দীকার করছে “ফুটবল”।থিয়েটার ওয়র্কশপ করছেক “চাক ভাঙা মধু”, “রাজরক্ত”।চার্বাক করছে “কর্ণিক”।থিয়েটার কমিউন “কিং কিং”,“দানসাগর”।চেতনা করছে “জগন্নাথ”। বহুরূপী কুমার রায়ের পরিচালনায় নিয়ে এলো “মৃচ্ছকটিক”।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন “পাপ পুণ্য” নিয়ে।সুন্দরম্ করছে “সাজানো বাগান”।আর কিছু তরতাজা যুবক নির্মাণ করল নতুন সংগঠন শূদ্রক।এলো সময়ের প্রকাশ্য প্রতিভাস “অমিতাক্ষর”।বাদল সরকার প্রসেনিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কার্জন পার্কের ঘাসে,অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর লনে করছেন “ভোমা”, “মিছিল”, “সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস”।কেউ করছেন “লাল লন্ঠন”।কেউ করছেন “পদ্মা নদির মাঝি” আবার “গোরুর গাড়ির হেডলাইট”ও চলছে রমরমিয়ে।গ্রামে,মফঃস্বলে নাট্যকর্মী্রা কোমর বেঁধে নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার মঞ্চেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর,ঝরিয়ায়,কুলটিতে সুনীল রায়,সুনীল মুখোপাধ্যায়,বংশী মুখোপাধ্যায়, দুর্গাপুরে গোপাল দাস,বোকারোয় নিমু ভৌমিক,বালুরঘাটে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করছেন “দেবাংশী”।বহরমপুরে প্রদীপ ভট্টাচার্য লড়ে যাচ্ছে নাটক নিয়ে।চাকদহে নাট্যকার চন্দন সেন নাটক লিখছেন,পরিচালনা করছেন।দক্ষিণেশ্বরে কালী মা নয় গোর্কির “মা” করছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।কথায় কিছু এলোমেলো হোলো যদিও লুটেপুটে খাওয়ার দিন ছিল না সেইসব দিন।বন্যায় ভেসে যাওয়া আবার ভেসে ওঠার পরে ছয় ছয়টি নাট্যদল দলাদলি না করে নয় ছয় না করেই ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রকে নিয়ে করল বারটোল্ট ব্রেষটের নাটক “গালিলেওর জীবন”।সুব্রত নন্দী এর আগেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সেটিই “বহুরূপী” করল “গালিলেও” নামে।সবটাই সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তা বলব না তবে আজকের ক্যান্সারের মতো তা নিঃশব্দ প্রকট ব্যাধি হোয়ে ওঠেনি।
বাংলায় বন্যা নতুন কিছু নয়।উপ সাগরীয় অঞ্চল,খাল-বিল-নদি-নালার দেশ।ঝড়-তুফান সে তো উঠবেই।মা-মাটি সে তো ভাসবেই।একটু হাল্কা চালেই বলি-আমার বাবা কবি ছিলেন না,জ্যাঠাবাবুর মতো রসিকও ছিলেন না।ছিলেন খাজনা আদায়ের ‘তহশিলদার’।নিজেদের নাম দেব-দেবীর নামে হোলেও আমাদের নাম রেখেছিলেন-মলয়
মিলন,সলিল।কী আশ্চর্য আমার জন্মের ঠিক পরের বছর বাংলায় বন্যা হয়েছিল।১৯৪২ এর পরে ১৯৫৬ আর ১৯৫৯।এই দুই বারে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু এর পরে ১৯৭৮ এ এই সময়ে বিপুল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল বাংলার প্রায় সব জেলা।এমনকি কলকাতাও।
আমরা তখন সারা রাজ্যজুড়ে মঞ্চে-খোলা মাচায় নাটক করে বেড়াই।সেবার নাটক ছিল বর্ধমান রাজ কলেজে।তখনও দাপুটে বাহিনী “অমিতাক্ষর” করার সময় নাটক থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোলো।সেই রাতে আমাদের ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল।আমরা না থেকে বাস নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।রাস্তায় নেমে বুঝলাম আমরা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বড়ো রাস্তার উপরেই জল বইতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে নামলাম এক হাঁটু জলে।
মা-বাবা-জ্যাঠা-কাকা-কাকিমা-ভাই-বোনেরা সবাই তখন ভিকিরিপতি গ্রামে।অনেক বন্যা হয়েছে কিন্তু তাম্রলিপ্ত বন্দর কখনও জলে ভাসেনি।কাঁথি-দীঘায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে কিন্তু আমরা কখনো ভাসিনি।এবার কোলাঘাট,বাগনান,রাধামনি,হাকোল্লা,ব্যবত্তা সব ভেসে গেল।গ্রামের ডাকঘরে ট্রাংককল করা যাচ্ছে না।স্থানীয় সংবাদ রেখে ঢেকেও যা জানাচ্ছে তা ভয়ংকর।রূপনারায়ণ বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।রেললাইন জলের তোড়ে ভেসে গেছে বাগনানে।বাড়ির সবাই,গ্রামের মানুষ সব ফেলে রেখে উঠছে স্থানীয় স্কুলে।সেই প্রথম ভিকিরিপতি গ্রাম দেখল লঙ্গরখানা।
আমার দাদা আর আমি কলকাতা থেকে ডাল-চাল-চিঁড়ে-বাতাসা-গুড়-মুড়ি-কেরোসিন তেল নিয়ে নূরপুর থেকে নৌকায় গেঁওখালি হয়ে মহিষাদল,সেখান থেকে কীভাবে যে তমলুক হয়ে মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিলাম তা মনে করতেও ভয় পাই।কাতারে কাতারে মানুষ জলেডোবা গ্রামে যাচ্ছে স্বজন-পরিজনকে উদ্ধার করতে।ঠিক ৪২এর দুর্বিপাকের বিপরীত।পথে ঘাটে মরা পশু।জলে ভাসছে মরা মাছ।রাতেরবেলা ভরা মাঠের থেকে ভেসে আসছে গুম গুম শব্দ!বাবা বল্লে-“মাটির বাড়ি জল নামার সংগে সংগে জলের উপরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!তারই শব্দ ভেসে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে!”
আটাত্তরের সেই দুর্বিপাক কাটিয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ আর বামফ্রন্ট।তার কতো বছর পরে গ্রীষ্মকালে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল বামফ্রন্ট।একেই বলে “বিধি বাম?” না কী এরই নাম সিঙ্গুর,খেজুরি,নন্দীগ্রাম?
সলিল সরকার
১
বাংলা এই উপকূল বছর বছর বর্ষা হলেই জলে ভাসবে,বানভাসি হবে মানুষ এ আর নতুন কথা কী?বানভাসি মানুষের ত্রাণ,বাঁধভাঙার চাপান-উতোর,কিউসেকের হিসেব নিকেস তাও চলবে চ্যানেলে চ্যানেলে।যদিও মানুষ তখন জলমগ্ন।আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা বল্লেন আমি যেন মানুষের কথা বলি।বেশ আমি বরং ঝড়ের খুড়সিনামা(কুরসিনামা) খুলে বসি।
বাংলার উনপঞ্চাশ সালের উপকুলীয় ঝড় আর জলোচ্ছাস,পঞ্চাশের মন্বন্তর আমার জন্মের তেরো-বারো বছর আগের দুর্বিপাক।আমার জন্মের কালে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে দেশভাগ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,উদ্বাস্তু উদ্বে্গ আর “এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” কমিউনিস্ট আন্দোলনে।যদিও রেখে গিয়েছিল তার রেশ শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্পকলায়,গীতিকার-সুরকারদের সুর আর কথায়,গায়িকা-গায়কের গানে যা ভিকিরিপতি গ্রামেও ছাপ ফেলেছিল।আর ছিল জলবসন্তের দাগের মতো গভীর সামাজিক ক্ষত যা সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনও মুছে দিতে পারেনি।
কবুল করতে লজ্জা নেই রবীন্দ্রানুরাগী জ্যাঠাবাবুর কণ্ঠে কোন দিন “নব জীবনের গান” শুনিনি।শুনিনি ইকবালের “সারে জাঁহাসে আচ্ছা......”কিন্তু রেডিয়োতে কি বাড়ির ‘কলের গানে’ শুনেছি “অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি” কি “পথে এবার নামো সাথী” আর শুনেছি ‘রানার’।শুনেছি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পুত্র কাজী সব্যসাচীর উদাত্ত কণ্ঠে “কারার এই লৌহ কপাট”, “কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই” কি “বিদ্রোহী রণক্লান্ত......”।
তবে বাবার কাছে,জ্যাঠাবাবুর আর ঠাকুমার কাছে উনপঞ্চাশ সালের ঝড়ের বিবরণ শুনেছি যখনই সাইক্লোন এসেছে কি অতি বর্ষনে ভেসে গেছে সারা গ্রাম।সেই সময়ের সাময়িক সংকটের কথা শুনেছি কিন্তু “ম্যান-মেড ফেমিন”এর ভয়াবহতা,শহরের পথে পড়ে থাকা সারি সারি লাশ, ‘প্রাণ দাও,ফ্যান দাও’ আর্ত চিৎকারের বিবরন দেখেছি,শুনেছি,পড়েছি তৃপ্তি মিত্রের লেখায়, বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” নাটকে,নিমাই ঘোষের“ছিন্নমূল”সিনেমায়,চিত্তপ্রসাদের,জয়নুল আবেদীনের স্কেচে,সোমনাথ হোড়ের পেন্টিংয়ে আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কবিতা আর ‘নব জীবনের গান’এ,সলিলদার কথায়-সুরে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দপ্তরে নিয়মিত কাজের মধ্যেই শুনেছি রেবা রায়চৌধুরির বলিষ্ঠ স্বরে “প্রাণের দেউলে যত বধূরা প্রদীপ জ্বালাবেই” তার পরেই নরেনদার(মুখোপাধ্যায়)ব্যারিটোন ভয়েসে “ঝড়ে ভাঙা ঘর যত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবেই”।তার বেশ কিছু আগেই পড়ে জেনেছি ১৯৪২-এ পূর্ব মেদিনীপুরের প্রায় ৪৫০ স্কোয়ার মাইল ভেসে গিয়েছিল সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে।প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৪০০ স্কোয়ার মাইলেরও বেশি অঞ্চল।৩২০০ স্কোয়ার মাইল বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঝড় আর লাগাতার বৃষ্টিতে।মানুষ মরেছিল চোদ্দ-পনের হাজার।গবাদি পশু মরেছিল কমপক্ষে এক লক্ষ নব্বই হাজার কি তারও বেশি।গ্রাম থেকে শহরে বাঁচবার আশায় পালিয়ে এসেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে লুটপাট করেনি,কেড়ে খায়নি।খেটে খাওয়া মানুষেরা শহরের রাস্তায় খুঁটে খেয়েছে।উৎসব-আনন্দের ভোজসভায় প্রবেশ না করে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে নেড়ি কুকুরের সংগে লড়াই করেই।ব্রিটিশ সরকার নীরব থেকেছে।কালোবাজারীরা দু-হাতে টাকা লুটেছে। আড়তদারেরা চড়া দামে মাল বেচেছে সম্পন্ন শহরবাসীদের কাছে।একমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গান গেয়ে,নাটক মঞ্চস্থ করে টাকা,জামাকাপড়,খাদ্য সংগ্রহ করে রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজ চিত্তপ্রসাদের মুদ্রিত চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে দিয়েছে।অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বেড়াজালে ফেলে নাটকের গতি স্তব্ধ করতে চেয়েছে,পারেনি। রবীন্দ্রনাথের গান দেখিয়েছে পথের দিশা।সুচিত্রা মিত্র,দেবব্রত বিশ্বাস এর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠল বিদ্রোহের গান।কালের অমোঘ নিয়মে মানুষ না খেতে পেয়ে যত মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মারা গেল অনেক দিনের না খাওয়ার পর খেয়ে।মাঠে মাঠে ফসল।ফসল কাটার কেউ নেই।ঘরে ঘরে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ।গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।রেংগুনে বোমা পড়ল কলকাতা শহরের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালাল গ্রামে।কালের পরিহাসে গ্রামের মানুষ আশ্রয় দিল শহরবাসীদের,যে শহুরে বাবুরা পথে পথে পড়ে থাকা অভুক্ত মানুষদের মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে অন্ন তুলেছে মুখে।তারাই প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিল গ্রামে।জন্ম নিল ‘ড্যাংচি বাবু’রা যারা কথায় কথায় বলত “ড্যাম চিপ”।
আমার শৈশবেও এই ‘ড্যাংচি বাবুদের’ আমি দেখেছি।তারা পালা-পার্বণে,দোল-দুর্গোৎসবে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সপরিবারে দেশে যেতেন।বাস থেকে নেমেই সামনে যাকেই পেতেন (সে চাষি হোক কি মুনিষ)তাকে ধমকে তার মাথায় বাক্স-প্যাঁটরা চাপিয়ে দিতেন।এই দেখে একবার আমার এক জাঠতুতো দাদা মাথায় কাঁধে-পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে তাদের বাড়ি অব্দি যাওয়ার পর বাড়ির মানুষজন দুলুদাকে চিনতে পেরে কোথায় মুখ লুকোবে ভেবে পায় না।শেষে দুলুদার কাছে ক্ষমা চেয়ে পুজোর মিষ্টি খাইয়ে নিস্তার চেয়েছিল।
গ্রামের পুজোয় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় কুটুম্ব দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে ফিরে আসবে এটাই ছিল রেওয়াজ।যার যা সংগতি তাই দিয়েই গ্রামের মানুষ অতিথি আপ্যায়ণে ত্রুটি রাখত না।সহজলভ্য শাক-সব্জি,খাল-বিলের মাছ,বাড়ির ধানের খৈ-মুড়ি,ক্ষেতের আখের আখিগুড় আর পুকুর পাড়ের তালের সারির তাল গুড় দিয়ে মুড়কি।ঘরের গাই-গোরুর দুধের ছানা-দৈ-ঘি।গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে আর বাড়ির গাছের নারকেলের নাড়ু-চিত্রকূটে পাড়া জুড়ে মিঠে সুবাস।খাল-বিলের মাছ ভাজা হোলে বিশেষ করে বেলে মাছ,গুলে মাছ,গুড় জাউলি মাছ,পারষে মাছ,নোনা চিংড়ি মাছের গন্ধ পেয়ে অবারিত দ্বা্রের বৈঠকখানায় বসে পড়ত যে কেউ বিনা আমন্ত্রণেই।পেট পুরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তবে তার নিস্তার মিলত।ষষ্ঠীতে নিরামিষ সোনা মুগের ডাল,আলুভাজা,বেগুনভাজা,শাক,শুক্তো,আলুপোস্ত,ছানার ডালনা,আলুবখরার চাটনি।সপ্তমীতে মাছ ভাত।অষ্টমীতে নুচি(লুচি)-কুমড়োর ছক্কা,ছোলার ডাল আর ধোঁকার ডালনা,প্লাস্টিক চাটনি।নবমীতে বলির পাঁঠার মাংস পাড়ায় বিলিয়ে যা পড়ে থাকত তার সংগে বাজার থেকে কিনে এনে তাই দিয়ে সবার পাতে দু-টুকরো মাংস আর চার-টুকরো আলু দিতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর উঠত।যার পাতে মেটে পড়ত সে ভাগ্যবান।সে সময় কেউ অসুস্থ হলে সে পেত ‘টেংরির জুস’।
যাদের এই সংগতি ছিল না তারাও হীণমন্যতায় না ভুগে এই কয়েকটা দিন আউস ধানের পায়েস তৈরি করত বাড়ির আখের গুড় দিয়ে।মাঠে ‘মুগরি’(বাঁশের তৈরি মাছ ধরার খাঁচা)বসিয়ে কুচো মাছ আর নোনা চিংড়ি ধরত।জলভরা আমন ধানের ক্ষেতে বঁড়শিতে আরশোলা,ঘুরঘুরে পোকা কি জ্যান্ত চিংড়ি টোপ দিয়ে বড়ো বড়ো ট্যাংরা,শোল,ভেটকি ধরত।শোলাকে ছোট ছোট করে কেটে তাতে সুতো বেঁধে কাঁটাতে কেঁচো লাগিয়ে ভাসিয়ে দিত ধান ক্ষেতে।ভোরবেলা সেগুলোকে তুলে দেখত কী মাছ গেঁথেছে সেই ভাসা বঁড়শিতে।প্রায় সব বাড়িতেই কচু,মান কচু,ওল,চুপড়ি আলু, বিচিকলা,নটে শাক,পালং শাক,কাটোয়ার ডাঁটা,বেগুন,লংকা,ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,চিচিঙ্গে,কুদরি, কাঁচা আর পাকা কুমড়ো অঢেল না হোলেও অপ্রতুল ছিল না।এই সময়টা শাপলা-শালুক,গেঁড়ি-গুগলি,কলমি শাক,সজনে পাতা,শুষনি শাক অঢেল ছিল।গুগলির তরকারী কম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ছিল না।কুমড়োফুল,বকফুলের বড়া আহা কী লোভনীয় যে ছিল।গ্রামের মানুষ এইসব খেয়েই অষ্টমীর সারারাত কয়েক ক্রোশ-মাইল পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখত।কী অফুরান প্রাণশক্তি!কী অনাবিল উচ্ছ্বলতা!
আমাদের বাড়িটাই ছিল একটা ক্লাবের মতো।ছোটোরা সারাদিন-রাত চোর-পুলিশ, ক্যারাম,ব্যাগাডুলি,সাপ-লুডো,রং-মিলান্তি,বাঘবন্দী খেলা খেলতাম।বড়োরা ব্রীজ,ব্রে আর মা-জেঠিমা-কাকিমা-ঠাকুমা খেলত টুয়েন্টি নাইন।শুধু ন’পিসেমশায় একা একা তাসের পেশেন্স খেলতেন আর জর্দা-পান খেতেন।ছোটো কাকা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেত। মেজপিসি আর চমৎকারী গুড়াকু দিয়ে সময়ে অসময়ে দাঁত মাজত।কেউ কেউ ভাঁড়ার থেকে চুরি করে পুকুর পাড়ে গিয়ে লুকিয়ে খেত আর পেটের ব্যথায় কাৎরাতো। কাড়াকাড়ি পড়ত শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে।হুড়োহুড়ি পড়ত বাড়িতে হঠাৎ কোনও অতিথি এলে।আর ঢাকের আওয়াজ থেমে গেলে অলস দুপুরে সবাই দিনের খাওয়ার পাট চুকিয়ে মাদুরে গা এলিয়ে চুপ করে শুনত রেডিয়োয় পুজোর গান-“প্রান্তরের গান আমার,মেঠো সুরের গান আমার”, “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”, “একটা গান লিখো আমার জন্যে”, “আকাশ-প্রদীপ বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার আগুনে গান গেয়ে” এসব গান শুনতে শুনতে কখন যে ঝুপ্ করে সন্ধ্যে নেমে আসত।পশ্চিম আকাশে সাঁঝতারার একটু ওপরে ঝুলত ফালি চাঁদ।হাল্কা হিমে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা আজকের এল,ই,ডি আলোর মতো টিমটিম করে আলো ছড়াত।শিউলি ফুলের আর হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে যেত বাতাসে।আকাশের উত্তরে ভাসত সপ্তর্ষি,দক্ষিণে কালপুরুষ।আর আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে রমণীয় ছায়াপথ।
দশমীর ভোরে আকাশবাণীর গানে “শুকতারা গো,নিও না বিদায়,নিও না......”আজও কানে বাজে।দশমীর দিন শুধু দিনের বেলায় রান্না হোত। দেবীমূর্তি জলে পড়লেই দশমী শুরু হোত না।ঘরের ঠাকুমা পুজোর দালান থেকে শান্তিজল আর অপরাজিতার লতা নিয়ে আসবে।বাড়ির সবাই পা ঢেকে বৈঠকখনায় বসবে।শান্তিজল ছেটানো হবে।তারপর অপরাজিতার বালা পরানো হবে এই মন্ত্র আউড়ে-“জয়দে বরদে দেবি,দশম্যে অপরাজিতে......”।এবার ছোটোরা প্রণাম করবে।বড়োরা করবে কোলাকুলি(পরে জেনেছি এই কোলাকুলি প্রথাটি এসেছে ঈদের থেকে)আর শুরু হবে মিষ্টি বিতরণ।ডানহাত বাড়িয়ে মিষ্টি নেওয়াটাই ছিল সৌজন্য।কিন্তু অধিকের আশায় হাতপাতা কারও পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে এমন ভাবে হাত বাড়াতাম যেন দুই মানুষের ভিন্ন হাত।বাড়ির প্রণাম সারা হোলে বেরিয়ে পড়া পাড়ার প্রণামে।আমাদের জানা ছিল প্রণামের পর কোন বাড়িতে নিমকি দেবে,কোন বাড়িতে ঘুগ্নি।যে বাড়িতে বয়স্ক-প্রবীণ মানুষজন থাকতেন তারা নিজের হাতে কিছু তৈরি করতে পারতেন না তাই ময়রার দোকান থেকে দরবেশ-সন্দেশ-মিহিদানা-সীতাভোগ আনিয়ে রাখতেন।সেই রাত্রে সবার বাড়িতে যেতাম না।পেট ভরে যাওয়ার কারণে পরের দিনের জন্যে ওই বাড়িগুলো রাখা থাকত।
এইভাবেই কেটে যেত কটা দিন।এবার আমাদের পড়ায় মন বসাতে হবে আর যারা এসেছিল আবার তারা বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে ফিরে যাওয়া ঢাকির দলের প্রায় সংগে সংগেই চাল-নারকেল-নাড়ু ব্যাগে ভরে ফিরে গেলে গ্রামগুলো শোকে মলিন হয়ে পড়বে।এবার অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মী স্থাপন করে দীপাবলীর প্রদীপ জ্বালিয়ে মরা গ্রামের প্রাণ ফিরিয়ে আনার কাজ।সে আর এক উৎসব।
বাংলার বানভাসি নাটকের বান
২
“কেউ বলে ফাল্গুন,কেউ বলে পলাশের মাস।
আমি বলি আমার সর্বনাশ”
ঠিক এইভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলা ও বাঙ্গালির উৎসবের মাস আবার প্লাবনেরও মাস।কোথাও মানুষ আনন্দে-উৎসবে ভাসছে আবার একই সময়ে বাংলার মানুষ বরষনে প্লাবনে ভাসছে।উৎসবে ভাসা মানুষজনকে এখনও সবাই ‘পল্লীবাসি’ বলে আর ভেসে যাওয়া জীবনকে ডাকা হয় ‘বানভাসি’ বলে।
উনপঞ্চাশ(১৯৪২)সালের ঝড়ের কথা লিখতে গিয়ে নিজের কালের ৭৮এর দুর্বিপাকের কথা ঝড়ের মতো উড়ে এলো স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ত্রাস-সন্ত্রাস-কারাবাস-রক্তের স্নানের পর বাংলায় এসেছে বামফ্রন্ট মানুষের অদম্য প্রয়াসে।বাংলা নাটকে তার আগে থেকেই এসেছিল প্লাবন।বাংলায় প্লাবন এলো শারদীয় উৎসবের কিছু আগে।তখনও মানুষ সে শহর হোক কি গ্রাম ত্রাস ও সন্ত্রাসের দিন গুলো মন থেকে মুছে উঠতে পারেনি।তখনও রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পায়নি।তখনও ‘জমানা বদল হোলে দেখে নেবার’হুমকি দিয়ে চলেছে দেবী ও দেবের পারিষদরা। তখনও বাসে পেট্রোল বোমা পড়ে।খোলা রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ও চপার নিয়ে ঝন্টু-মিন্টু-পিন্টু-কাল্টু(কল্পিত)রা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে না হোলেও রাতের অন্ধকারেই।
পেশাদার থিয়েটারে তখন নাভিঃশ্বাস।‘এ’মার্কা থিয়েটার বিদায় নিচ্ছে কালের নিয়মেই। গ্রুপ থিয়েটার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আক্ষরিক অর্থেই।লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল,টি,জি)থেকে পিপলস লিটল থিয়েটার তৈরি হয়ে গেছে।“দুঃস্বপ্নের নগরী” তখনও যায়নি।চলছে “টিনের তলোয়ার”, “এবার রাজার পালা”।থিয়েটার ইউনিট করছে “পন্তু লাহা” আবার শেখর চট্টোপাধ্যায় বাণিজ্যিক থিয়েটারে করছেন “শ্রীমতি ভয়ংকরী”।নান্দীকার করছে “ফুটবল”।থিয়েটার ওয়র্কশপ করছেক “চাক ভাঙা মধু”, “রাজরক্ত”।চার্বাক করছে “কর্ণিক”।থিয়েটার কমিউন “কিং কিং”,“দানসাগর”।চেতনা করছে “জগন্নাথ”। বহুরূপী কুমার রায়ের পরিচালনায় নিয়ে এলো “মৃচ্ছকটিক”।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন “পাপ পুণ্য” নিয়ে।সুন্দরম্ করছে “সাজানো বাগান”।আর কিছু তরতাজা যুবক নির্মাণ করল নতুন সংগঠন শূদ্রক।এলো সময়ের প্রকাশ্য প্রতিভাস “অমিতাক্ষর”।বাদল সরকার প্রসেনিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কার্জন পার্কের ঘাসে,অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর লনে করছেন “ভোমা”, “মিছিল”, “সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস”।কেউ করছেন “লাল লন্ঠন”।কেউ করছেন “পদ্মা নদির মাঝি” আবার “গোরুর গাড়ির হেডলাইট”ও চলছে রমরমিয়ে।গ্রামে,মফঃস্বলে নাট্যকর্মী্রা কোমর বেঁধে নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার মঞ্চেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর,ঝরিয়ায়,কুলটিতে সুনীল রায়,সুনীল মুখোপাধ্যায়,বংশী মুখোপাধ্যায়, দুর্গাপুরে গোপাল দাস,বোকারোয় নিমু ভৌমিক,বালুরঘাটে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করছেন “দেবাংশী”।বহরমপুরে প্রদীপ ভট্টাচার্য লড়ে যাচ্ছে নাটক নিয়ে।চাকদহে নাট্যকার চন্দন সেন নাটক লিখছেন,পরিচালনা করছেন।দক্ষিণেশ্বরে কালী মা নয় গোর্কির “মা” করছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।কথায় কিছু এলোমেলো হোলো যদিও লুটেপুটে খাওয়ার দিন ছিল না সেইসব দিন।বন্যায় ভেসে যাওয়া আবার ভেসে ওঠার পরে ছয় ছয়টি নাট্যদল দলাদলি না করে নয় ছয় না করেই ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রকে নিয়ে করল বারটোল্ট ব্রেষটের নাটক “গালিলেওর জীবন”।সুব্রত নন্দী এর আগেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সেটিই “বহুরূপী” করল “গালিলেও” নামে।সবটাই সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তা বলব না তবে আজকের ক্যান্সারের মতো তা নিঃশব্দ প্রকট ব্যাধি হোয়ে ওঠেনি।
বাংলায় বন্যা নতুন কিছু নয়।উপ সাগরীয় অঞ্চল,খাল-বিল-নদি-নালার দেশ।ঝড়-তুফান সে তো উঠবেই।মা-মাটি সে তো ভাসবেই।একটু হাল্কা চালেই বলি-আমার বাবা কবি ছিলেন না,জ্যাঠাবাবুর মতো রসিকও ছিলেন না।ছিলেন খাজনা আদায়ের ‘তহশিলদার’।নিজেদের নাম দেব-দেবীর নামে হোলেও আমাদের নাম রেখেছিলেন-মলয়
মিলন,সলিল।কী আশ্চর্য আমার জন্মের ঠিক পরের বছর বাংলায় বন্যা হয়েছিল।১৯৪২ এর পরে ১৯৫৬ আর ১৯৫৯।এই দুই বারে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু এর পরে ১৯৭৮ এ এই সময়ে বিপুল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল বাংলার প্রায় সব জেলা।এমনকি কলকাতাও।
আমরা তখন সারা রাজ্যজুড়ে মঞ্চে-খোলা মাচায় নাটক করে বেড়াই।সেবার নাটক ছিল বর্ধমান রাজ কলেজে।তখনও দাপুটে বাহিনী “অমিতাক্ষর” করার সময় নাটক থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোলো।সেই রাতে আমাদের ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল।আমরা না থেকে বাস নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।রাস্তায় নেমে বুঝলাম আমরা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বড়ো রাস্তার উপরেই জল বইতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে নামলাম এক হাঁটু জলে।
মা-বাবা-জ্যাঠা-কাকা-কাকিমা-ভাই-বোনেরা সবাই তখন ভিকিরিপতি গ্রামে।অনেক বন্যা হয়েছে কিন্তু তাম্রলিপ্ত বন্দর কখনও জলে ভাসেনি।কাঁথি-দীঘায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে কিন্তু আমরা কখনো ভাসিনি।এবার কোলাঘাট,বাগনান,রাধামনি,হাকোল্লা,ব্যবত্তা সব ভেসে গেল।গ্রামের ডাকঘরে ট্রাংককল করা যাচ্ছে না।স্থানীয় সংবাদ রেখে ঢেকেও যা জানাচ্ছে তা ভয়ংকর।রূপনারায়ণ বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।রেললাইন জলের তোড়ে ভেসে গেছে বাগনানে।বাড়ির সবাই,গ্রামের মানুষ সব ফেলে রেখে উঠছে স্থানীয় স্কুলে।সেই প্রথম ভিকিরিপতি গ্রাম দেখল লঙ্গরখানা।
আমার দাদা আর আমি কলকাতা থেকে ডাল-চাল-চিঁড়ে-বাতাসা-গুড়-মুড়ি-কেরোসিন তেল নিয়ে নূরপুর থেকে নৌকায় গেঁওখালি হয়ে মহিষাদল,সেখান থেকে কীভাবে যে তমলুক হয়ে মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিলাম তা মনে করতেও ভয় পাই।কাতারে কাতারে মানুষ জলেডোবা গ্রামে যাচ্ছে স্বজন-পরিজনকে উদ্ধার করতে।ঠিক ৪২এর দুর্বিপাকের বিপরীত।পথে ঘাটে মরা পশু।জলে ভাসছে মরা মাছ।রাতেরবেলা ভরা মাঠের থেকে ভেসে আসছে গুম গুম শব্দ!বাবা বল্লে-“মাটির বাড়ি জল নামার সংগে সংগে জলের উপরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!তারই শব্দ ভেসে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে!”
আটাত্তরের সেই দুর্বিপাক কাটিয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ আর বামফ্রন্ট।তার কতো বছর পরে গ্রীষ্মকালে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল বামফ্রন্ট।একেই বলে “বিধি বাম?” না কী এরই নাম সিঙ্গুর,খেজুরি,নন্দীগ্রাম?