MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৬

শেষ নাহি যে ......।
সলিল সরকার
আমাদের বাসার বারান্দাটাই আমার গ্যালারি।এখানে বসেই আমার দিন কাটে রাত কাটে যখন বাসায় থাকি।শান্তিনিকেতনে এখন আর আমার বারান্দা নেই।আছে উন্মুক্ত প্রান্তর।রবীন্দ্রনাথ যেমনটি ভালোবাসতেন বাড়ি আর বাইরের তলের কোনও ফারাক থাকবে না।দরজা খুললেই উন্মুক্ত প্রান্তর।ঘর আর বাইরের মাঝে শুধু এক চৌকাঠ।যদিও ভিকিরিপতি গ্রামের কোনও বাড়ি এমনটি ছিল না।থাকা সম্ভবও ছিল না।সাপখোপের বাসা,গোরু-ছাগলের না বলে কয়ে ঢুকে পড়া আর অতি বর্ষনে কি বানভাসি হোলে জল ঢুকে পড়বে ঘরে তাই সব বাড়িই বেশ উঁচুতে এবং কয়েক স্তরে।প্রথমে পাঁচিল ঘেরা উঠোন,তার পরে কোমর সমান উঁচু খোলা বারান্দা যা কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হোত।তার পরে আর এক ধাপ উঠে বৈঠক খানা।তার পরে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘর।পায়ে পায়ে অনেক প্তহ মাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে হোত।আমাদের বাড়িতে অবশ্য কোনও প্রাচীর ছিল না কোথাও।সব ছিল খোলামেলা।চুরি হয়ে যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারত না।কাঁসার-পিতলের বাসন-কোসন থেকে ধান-চালের বস্তা পড়ে থাকত বাইরে।মাটিতে পোঁতা থাকত কলসীতে ভরা সোনা-দানা নয় সারা বছরের নুন,যা আসত সুন্দরবন থেকে।এমনও কতবার হয়েছে জেঠিমা-মা-কাকিমায়েরা পুকুরঘাটে স্নান করতে নেমে কানের দুল,হাতের বালা,নাকের নাকছাবি হারিয়ে ফেলেছে জলে।আমরা নাইতে নেমে ডুব দিয়ে সেগুলো তুলে আন্তাম।আর না পেলে গ্রীষ্মকালের অপেক্ষায় থাকা।তখন পুকুরঘাটে জল কমে যেত।আমরা কবেকার হারিয়ে যাওয়া সোনাদানা কুড়িয়ে পেতাম।আর পেতাম পকেট থেকে পড়ে যাওয়া কবেকার খুচরো পয়সা।সিকি-আনা-আধুলি-নয়া পয়সা এমনকি ছ্যাঁদা পয়সাও।  
কলকাতার বাসায় থাকি চারতলায়।হারিয়ে যাবার মতো কিছুই নেই।আছে শধু মন যা থেকে থেকেই হারিয়ে যায়।বারান্দায় বসে ফিরে ফিরে পাই সেগুলোকেই।যে আবাসনে থাকি,আর যে বিল্ডিংয়ে থাকি তা একেবারে রাস্তার পাশেই।প্রতিদিন বাজার বসে।খেটে খাওয়া মানুষজনের খাওয়ার জন্যে সস্তার হোটেল আছে বেশ কয়েকটা।পানের দোকান থেকে মুদিখানা এমনকি ‘সাইবার কাফে’তাও আছে।আর আছে সারা দিন রাত যানবাহন আর মানুষের চলা চল।সারা দিন ধরে হুটার বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি থেকে হাসপাতালের রুগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যায়।অটো-টোটো থেকে রিক্সা আর উচ্চকিত বাইকবাহিনী।
রাজনৈতিক মিছিল থেকে বাবার মাথায় জল ঢালার মিছিল।শোভাযাত্রা থেকে মড়া পোড়ানোর শবমিছিল সব একাকার।কোনটা কীসের মাঝে মাঝে বোঝা দুষ্কর হোয়ে ওঠে।কী উল্লাস,কী চিৎকার!ঠাকুর দেখে ফেরা যুবক-যুবতীদের মধ্যরাতে কী অপূর্ব অশ্লীল ভাষা আর অঙ্গভঙ্গি!বাবা লোকনাথের কি বাবা তারকনাথের থানে জল দিতে যাওয়া পুণ্যার্থীদের ঘটে থাকে গঙ্গাজল আর পেটে থাকে কী জানি কী জল।তবে তাদের সম্মিলিত উল্লাসে পাড়ার বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদতেও ভুলে যায়!
বারান্দার বিপরীতেই আছে এক মান্ধাতা আমলের সিনেমাহাউস।তার রেশ থাকে সাড়ে নটা অব্দি।রাত বারোটা একটা অব্দি ঘরে ফেরার মানুষজন কাজ সেরে বাড়ি ফেরে।সাংবাদিকরা তারও পরে।ইনফরমেশন টেকনোলজির মানুষজন কেউ রাতে ফেরে কেউ রাতেই বেরোয়।
মোদো মাতালরা ফেরে একা একা রিক্সায়।ক্যাটারিংয়ের ছেলেরা ফেরে সাইকেলে চেপে গপ্পো করতে করতে।মোষ-গোরু নিয়ে হাটুরেরা যায় বেদম পেটাতে পেটাতে।আর একটু পরেই তো তারা কসাইখানায় ঢুকবে।ছাগলেরা যায় নাদি ফেলতে ফেলতে।টিন এজ ছেলেমেয়েরা যায় কানে এয়ারফোন গুঁজে,মাথা নীচু কোরে স্ক্রিনে চোখ রেখে।
কিছুকাল আগেও এই পথ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি যেত বাঁশ কি ধান-চালের বস্তা নিয়ে।চাকার ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ আর থেকে চালকের লাঠির বাড়ি ছাড়া আর কিছু শোনা যেত না।বারান্দায় দাঁড়ালেই শুধু দেখা যেত দুই গোরুর মাঝখানে একটা টেমি ঝুলছে যা আলোর থেকেও অন্ধকার ছড়াচ্ছে বেশি।
এই পথের পাশেই ছিল মার্টিন বার্ন কোম্পানির ছোটো রেল গাড়ির রেল পথ।এখনও স্থানে স্থানে তার চিহ্ন আছে।আর স্মৃতি হোয়ে আছে রেল পুকুর যেখান থেকে স্টীম ইঞ্জিন জল নিত।

এখানে অনেক পুকুর ছিল যেগুলোয় মাছ খেলা করত।মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হোত।আর জাল ফেলে মাছ ধরার পর সবার আগে পাড়ার লোকদের কাছে বাজারের থেকে কম দামে বিক্রি করা হোত তার পর বাকিটা বাজারে যেত।এখন বাজারটাই রাস্তার পাশে চলে এসেছে আর পুকুরগুলো হয়ে গ্যাছে আবাসন।অবশ্য খুব বৃষ্টি হোলে আবাসনগুলোই আবার হোয়ে যায় পুকুর যেখানে মাছ খেলা করে না।ভেসে বেড়ায় ডেঙ্গির লার্ভা আর পূজার ফুল।