MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭

শম্ভু উৎপল অজিতেশ এবং বাদল সরকার
সলিল সরকার

শুরুর প্রথম তিনটি নাম বাংলা থিয়েটারে একসময় একসাথে উচ্চারিত হোত।ঠিক যেমন এর আগে গিরিশ, অর্দ্ধেন্দু, অমৃতলাল কিম্বা শিশির, অহীন্দ্র।শিশির অহীন্দ্র নিয়ে "নাচঘর" পত্রিকায় হেমেন্দ্র কুমার রায় নিয়মিত একটা লড়াই জারি রাখতেন।শিশির ভাদুড়ির দিকেই পাল্লাটা ভারি থাকত।কিন্তু ম‍্যাগসাইসাই পাওয়ার পরে পরে আমাদের চোখের সামনে যে পত্র পত্রিকা বাংলা থিয়েটারের নাম উচ্চারণ করতে নাক সিঁটকাতো তারাই জয়গানে মাতল আর উৎপল দত্ত মানেই কমিউনিস্ট হিন্দি সিনেমার ভিলেন।অজিতেশ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ও তাই "হাটে বাজারে"র খলনায়ক।কজন বাংলা গ্রুপ থিয়েটার কে সমাদর করতেন কমিটেড মধ‍্যবিত্ত ছাড়া?আর সেখানে বাদল নামটির কোনও স্থান ছিল কী?শম্ভুদা তার যে নাটক করেছেন সেগুলি নিয়ে সেসময় তেমন আলোচনা বা মাতামাতি হয়েছে বলে জানা নেই বরং থার্ড থিয়েটার নিয়ে একটা তাচ্ছিল্য ছিল বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটারের আটের দশকের নাট‍্যকার পরিচালক দের মধ‍্যে।আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না "থিয়েটার বুলেটিন" পত্রিকায় বাদল সরকার ও তার থিয়েটার নিয়ে ঠিক কতটা শিথিল সরসতা ও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছিল।এই তারা এই পত্রিকায় অজিতেশ কে নিয়েও পড়েছিলেন।অজিতেশ নীলকণ্ঠ হয়ে তা পান করে এক নবীন নাটককার কে বলেছিলেন বাংলায় ভালো নাটকের খুব অভাব।ওটাই করো।ওটাই থাকবে।কেচ্ছা নয়।
বাদল সরকার অবশ‍্য নির্বিকার থেকে নিজের কাজ করে যেতেন।অবশ‍্য কিছু ছেলেমানুষীও নিজের চোখে দেখেছি।একবার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তাকে তার থিয়েটার নিয়ে বলতে আমন্ত্রণ জানান হোল।তিনি শুরু করলেন ডায়াসে মাইক হাতে।হঠাৎ বলে উঠলেন আমি তো এই মঞ্চ বিরোধী।বলেই মাইক রেখে ডায়াস থেকে নেমে এসে আমাদের সামনে খালি গলায় তরতরিয়ে বলতে থাকলেন তার নাট‍্যভাষা ও ভাবনার কথা।তিনি মিডিয়া কে সযত্নে এড়িয়ে যেতেন।একসাথে আড্ডা দিয়েছি, তর্ক করেছি সেই আমি নাট‍্য আকাদেমির উৎসবে তার ছবি তুলতে গেলে আপত্তি জানিয়েছেন।আবার "দেশ" পত্রিকার জন‍্য বিভাস চক্রবর্তী এক লম্বা সাক্ষাৎকার ক‍্যাসেটবন্দী করে আমার হাতে দিয়েছিলেন অনুলিখন করতে।এতো ছাপোষা ভঙ্গিতে নিজের কথা কাউকে বলতে শুনিনি।রাগ পুষে রাখতেও দেখিনি।নিজের প্রতি আস্থাই কি তাকে এমন করে তুলেছিল?
শম্ভুদার স্বাভিমান দেখেছি, উৎপল দত্তের ক্রোধ,অজিতেশদার অভিমান আর বাদলদার জেদ।অনেকের হেঁসেলি চাল ও চলন তাও দেখেছি কিন্তু আজ ১৫ জুলাই জন্ম নেওয়া মানুষটির কথাই বলা হোক।
বাদল বাউলের একতারা 
সলিল সরকার 
বাদল সরকার তার নতুন নাট্য ধারাকে শুরুতে “অঙ্গন মঞ্চ” বললেও পরে একে অভিহিত করছেন “থার্ড থিয়েটার” নামে। বাংলায় তথা ভারতে জন্ম নিল এক নতুন নাট্য ধারা। কী সেই ধারা এখন সেটাই দেখার। 
বাদল বাবুর মতে বাংলার লোকনাট্য হোল “ফার্স্ট থিয়েটার”, পাশ্চাত্যের অনুকরণে যে নাটক যা ব্রিটিশদের হাত ধরে এলো তা “সেকেন্ড থিয়েটার” আর তিনি তৈরি করলেন “থার্ড থিয়েটার” যেখানে প্রসেনিয়মের আড়াল থাকবে না। আলো আঁধারের মায়া থাকবে না। প্রযোজনার বাহল্য থাকবে না। প্রসেনিয়মের হাতি পোষা ব্যয় বিড়ম্বনায় ফেলবে না নাট্য দল গুলিকে। প্রযোজনা হবে নিরাভরণ, বাহুল্য বর্জিত, ছিমছাম। যেখানে টেক্সট ও অভিনয় প্রকাশ্য দিবালোকে কিম্বা ফিলামেন্টের আলোয় দর্শককে ভাবাবে, জারিত করবে, তাড়িত করবে। 
বাদল সরকার দাবি করলেন এখন থেকে দর্শক আর নিরাপদ দূরত্বে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে না। নাট্য মুহূর্তরা হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলবে। রাজা বাদশা আর হরিপদ কেরানি একই পোশাকে সামনে মূর্তমান। তফাৎ সামান্য কিছু উপকরণে। মিউজিকের ব্যবহার সেও মুখে মুখে। রূপসজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। 
প্রথমে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস এর চিত্র প্রদর্শন কেন্দ্র সেকান থেকে এখানে ওখানে কিছু অন্তরঙ্গ স্থানে সেখান থেকে একেবারে সরাসরি কার্জন পার্কের ঘাসে। ১৯৭৬ এ শতাব্দী প্রতি শনিবার কার্জন পার্ক আজকের সুরেন্দ্রনাথ পার্কে খোলামেলা ভাবে নাট্যের আসর বসাল। টিকিট বিক্রির বালাই নেই। বিজ্ঞাপনের ব্যয় নেই। নাটক দেখার জন্যে মানুষের হাতে পায়ে ধরা নেই।শুধু প্রযোজনা শেষে কলাকুশলীরা একটা কাপড় নিয়ে সমবেত দর্শকদের সামনে হাজির হবে।তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা দেবেন সেটাই। এই ধারার নাটক প্রযোজনা বাংলার মধ্যবিত্তকে নাড়া দিল, রাজনৈতিক অস্থিরতার আবহে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ দিল।বলা ভালো গুমরে মরা মনের কথাগুলো প্রাণ পেতে থাকল। 
১৯৭৬ থেকে ২০০৩ কার্জন পার্ক থেকে থিয়োজফিক্যাল সোসাইটি, ওয়াই এম সি আই সারা ভারতের নানান প্রান্তে “থার্ড থিয়েটার” তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে চলল। 
"His plays reflected the atrocities that prevailed in the society, the decayed hierarchical system and were socially enlightening. He is a proponent of the "Third theatre" movement that stood ideologically against the state. Third theatre involved street plays, with actors being attired no differently than the audience. Also the formal bindings of the proscenium theatre was given up. Sarkar's "Bhoma" is an example of a third theatre play, set as always, in an urban background. Starting with Sagina Mahato, which marked his advent into arena stage, his subsequent plays, Michhil (Juloos), Bhoma, Basi Khobor, Spartacus based on Howard Fast's historical novel by the same name, were performed in parks, street corners and remote villages with the audience sitting all around.”
নাট্যকার বাদল সারকার,প্রযোজক অভিনেতা বাদল বাবু নিছক নাটকের জন্যে নাটকে কখনই বিশ্বাসী ছিলেন না। বস্তুত বিশ্বের কোথাও কোনও নাট্যজনই তার সময় সমাজ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। 
৬৪ তে কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়েছিল।৬৯ এ আর এক ভাগ হোল। নকশাল বাড়ি থেকে সারা বাংলা ভারতে ছড়িয়ে গেল সে বিপ্লব। এর পাশে প্রতিবেশী বাংলায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এর আঁচ এসে পড়ল এ বাংলাতেও। মিছিল, ভোমা, হট্টমালার ওপারে, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, দ্বৈরথ, বাসি খবর, স্পারটাকাস, জন্মভূমি আজ, গণ্ডী এই নাটকগুলিও বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। 

১৯৬৮ তে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সম্মান। ১৯৭১ এ পেলেন জহরলাল নেহেরু ফেলোশিপ, ১৯৭২ এ পেলেন পদ্মশ্রী,১৯৯৭ এ পেলেন “রত্নসদস্য" আর ২০১০ প্রয়াণের এক বছর আগে পেয়েছিলেন কেরালা সঙ্গীত নাটক আকাদেমির থেকে “আম্মান্নুর পুরস্কারম”। এ তো গেল পুরস্কারের কথা। বাদল সরকার শুধু পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছিলেন? তিরস্কার পাননি? সে কথায় যাব পরের পর্বে।