বিশ্বজনের নগর বাউল লালন
সৈকতে রবীন্দ্রনাথ,সলিল স্রোতে বব ডিলান
সলিল সরকার
কাঙাল হরিনাথ তার “গ্রাম
বার্তা প্রকাশিকা” নামের সংবাদপত্রে ১৮৯০ এর অক্টোবরে একটি প্রয়াণ সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন।সংবাদটি
শোকের আবার সেটি বাঙালির চিরশ্লোকেরও বটে।
১৭৭৪এর কোনও এক মাসে সোনার বাংলার
কুষ্ঠে(কুষ্ঠিয়া)র ছেউরিয়া গ্রামে জন্মেছিল যে ছেলেটি চিরবসন্তের দেশ এই বাংলায়
ভয়াবহ জলবসন্তে(স্মল পক্স)মারাই যাচ্ছিল প্রায়।বাংলার বুক ভরা মধু,বংগের বধূ-জননী-মা
মান্দাসে ভেসে যাওয়া তাকে জল থেকে তুলে এনে শুধু প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন না,তাকে লালন
করলেন।শুধু বাংলা নয় বিশ্ব পেল চিরকালের শ্রেষ্ঠ বাউল লালন ফকিরকে।ফকির তবু জাতের
ফিকিরে তার রুচি নেই।সাধক তবু নেশা-ভাঙে চরম অনীহা।গৃহী সন্ন্যাসী,পুঁথির শিক্ষা
নেই তবু সে জ্ঞানী,শুনে শুনে শুন্যি।সিরাজ সাই তার গুরু।নাকি সে নিজেই নিজের সিরাজ
সাই?
১৭৭৪(মতান্তরে১৭৭২)এ জন্মে
১৮৯০এর ১৭ অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে দেহ লীলা সাঙ্গ করেছিলেন।বাংলার ১২৯৭এর ১লা
কার্তিক,শুক্রবার।কাল ১৪২৩এর ১লা কার্তিক তার ১২৬ তিরোধান দিবস।
জোড়াসাঁকোর বাবু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্ঠিয়ার জমিদারও বটে তিনি আর তার দাদা শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর মুখে মুখে ফেরা লালনের গানের সন্ধান পেয়েছিলেন। জ্যোতিদাদা তাকে বোটে কেদারায়
বসিয়ে একটা স্কেচ করেছিলেন।সেটাই আজ এক মাত্র প্রামাণ্য চিত্র।বাকি সব কল্পনা।আর
বাবু কবি রবীন্দ্রনাথ তার দেহপটের সাক্ষাৎ পেলেন না।পেলেন তার গানের কথা যা তার
শিষ্যরা হাতে হাতে লিখে রেখেছিলেন। কেউ কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথ না কি তার গান চুরি করেছিলেন।আমিও
বলি বটেই তো!তবে গান চোরা নয়, মন চোরা।ঠাকুরমশায়ের কতো গানেই না বাউল-ফকির-লালন-হরু-নিধুর
আসা-যাওয়া!সেইভাবে বলতে গেলে ১৯৪১এর ২৪ মে আমেরিকার মিনেসোটার মিনসে অ্যালেন
জিমারম্যানও তো লালন ফকিরের গানে প্রাণিত হয়েছেন।
জিমারম্যান বললে অনেকেই হয়ত
ইতিউতি চাইবেন কিন্তু যদি বলি বব ডিলান এ প্রজন্ম লাফিয়ে উঠবে।
আমেরিকার মানুষ প্রখ্যাত গায়ক,সুরকার,লেখক,গীতিকার ও
মানবতাবাদী বব ডিলান জন্মেছিলেন ১৯৪১ এর ২৪ মে।
বাংলার প্রখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক এই বছর আগস্ট
মাসে প্রয়াত হচ্ছেন।সেই হিসেবে এ বছর রবীন্দ্রনাথের ৭৫তম প্রয়াণ বৎসর আর ডিলানের
৭৫ তম জন্ম বর্ষ।
একজন কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে।তার
ঠিক ১০৩ বছরে আর এক প্রখ্যাত কবি,গায়ক,সুরকার বব ডিলান নোবেল পুরস্কার পেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও ডিলানের মধ্যে শুধু এইটুকুই মিল নয়,দুজনেই
বিশ্বশান্তির পক্ষে আজীবন লড়াই করেছেন।ডিলান এখনও জীবিত কিন্তু লড়াইটা চালিয়ে
যাচ্ছেন কী?প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
হয়ত একটু অসংগতি লাগবে।হয়ত মনে হবে মানব মনের মতোই আমার
চিন্তাটা বিক্ষিপ্ত ও চঞ্চল তবু যদি মনে পড়ে ডিলান অনুপ্রাণিত সুমন চট্টপাধ্যায়ের
গাওয়া “কতোটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়!”তাহলে কী মনে পড়বে না “আমার পথে পথে পাথর
ছড়ানো”?মনে পড়বে না “পথের শেষ কোথায়,কী আছে শেষে?” তার পরেই মনে পড়বে না “আমার এ পথ,তোমার
পথের থেকে অনেক দূরে”...।মনে পড়বেই “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ,আমার মন ভুলায়
রে”।আর সেই পথ ভুলানিয়ার থেকে কলম নিয়ে আর নাগরিক কবিয়াল লিখবেন “পথে এবার নামো
সাথী,পথে হবে এ পথ চেনা!”লিখবেন “পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি”।হ্যাঁ আমি সেই
বাঁশুরিয়া সলিল চৌধুরির কথাই বলছি।
হঠাৎ
করে মনে হতে পারে আমি হয়ত পথ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পথ হারিয়েছি। নয়ত কে কত পথ নিয়ে
গান বেধেছেন তারই খুড়সিনামা(কুরসিনামা)খুলে বসেছি। না।আসলে সব রাস্তাই রাস্তা এক
জায়গায় গিয়েই মেলে।পথের পথিক রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন।সলিল চৌধুরির নাম কখনও
কেউ ভাবেননি।লালনের কথা আজ উঠে আসছে বারবার বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তির
সূত্রে।কিন্তু আজ যদি সলিল চৌধুরি বেঁচে থাকতেন তাহলে কী বলতেন?
“আজ
তবে এইটুকু থাক
বাকি
কথা পরে হবে।
ধূসর
ধুলির পথ
ভেংগে
পড়ে আছে রথ
বহুদূর
দূর যেতে হবে......!”