বাদল বাউলের একতারা
সলিল সরকার
৬
অন্তিম পর্ব
বাদল সরকার যখন বেশ কিছু কৌতুক নাটক লিখে ১৯৬৩ তে বাংলা নাটককে ধাক্কা দিলেন “এবং ইন্দ্রজিৎ“ দিয়ে ঠিক সেই বছরেই কবিতার প্রাঙ্গণ থেকে বাংলা নাটকে পা রাখলেন কবি মোহিত চটোপাধ্যায় “কণ্ঠনালীতে সূর্য” নিয়ে। কবি মোহিত এসেছিলেন কলকাতায় ৪৭এ বরিশাল থেকে ১৪ বছর বয়সে। নতুন প্রজন্মের কবিতা পত্রিকা কৃত্তিবাসের কবি সুনীল শক্তি তুষারের পাশে মোহিত এক আলোচিত নাম।ঠিক তখন আর এক নাট্যকার সাতক্ষীরা জেলার ধুলিহর গ্রাম থেকে এলেন। ১৯৫৭তে কলকাতার মঞ্চে অভিনয় করা শুরু করে ১৯৫৯এ ছোট নাটক “মৃত্যুর চোখে জল” লিখলেও বাংলা নাটকের দর্শক চমকে উঠল ৭২এ তার “চাক ভাঙা মধু” বিভাস চক্রবর্তী র পরিচালনায় থিয়েটার ওয়রকশপ এর ব্যানারে। মনোজ মিত্রের কথাই বলছিলাম। আমরা যারা সে নাটক দেখেছি অশোক মুখোপাধ্যায়, মায়া ঘোষ আর বিভাসদার অভিনয় সমৃদ্ধ বাংলা মঞ্চে অনুভব করেছি নাট্যকার আর পরিচালকের সম্পর্কটা যদি দোসরের হয় তবেই সার্থক প্রযোজনা সম্ভব। যেমন মোহিত ও নক্ষত্রের শ্যামল ঘোষের মেলবন্ধন বাংলা নাটককে দিল মুক্তি।
এর আগে বাংলা নাটকে কিন্তু ঘোর দুর্দিন চলছিল। বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, শচীন সেন গুপ্ত, বিধায়ক ভট্টাচার্য,মন্মথ রায় হাংরি জেনারেশনকে তুষ্ট করতে পারছেন না। বাংলা নাটকের সেই ক্ষুধার রাজ্যে এলেন নাটকের তরবারি হাতে বাদল মোহিত মনোজ। এর মধ্যে আবার বাদল মোহিতকে নিয়েই ইন্টেলেকচুয়ালদের আলোচনা তর্কাতর্কি তুঙ্গে।কফি হাউসে বসে তারা মজা করে বলছেন মোহিতের নাটক দেখতে গেলে একটা অভিধান ঝোলায় রাখিস।আর বাদল বাবুর নাটক আমাদের শুকনো গলায় বারদুয়ারির কারণবারি।
মোহিতদা লিখছেন “চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড”, “মৃত্যুসংবাদ”,”নীল রঙয়ের ঘোড়া”, “গন্ধরাজের হাততালি”,”বাঘবন্দী”,”নিষাদ",“ক্যাপ্টেন হুররা”,”রাজরক্ত”,” স্বদেশী নক্সা”। এই ধারাটাই সাতের দশক থেকে আটের দশকে এসে পাল্টে ফেলছেন। আর বাদল সরকার পালটাচ্ছেন অন্ধকার মঞ্চ থেকে আলোর অঙ্গনে নিয়ে এসে নিজেকে। তাহলে লিখলাম কেন বাউল ও একতারা কথাটি? আসি সেই কথায়।
বাদল সরকার যে থার্ড থিয়েটার শুরু করলেন সেখানে ধনী ও পেশাদার মঞ্চের দর্শক পা মাড়ালেন না।কাউন্টারে এসে টিকিট কাটা নেই। দেখার জন্যে দীর্ঘ লাইন নেই। সাজগোজ করে এসে গাড়ি থেকে নামা নেই। কমপ্লিমেন্টারি নেই।কায়েত বামুন চাষা কৈবর্ত শ্রমিক মধ্যবিত্ত সব মেঝেতে কি ঘাসে বসবে এ কেমন ধারা? তাও বা যদি কৌতূহল মেটাতে যাওয়া গেল ও বাবা না আছে আলোর কারিকুরি, না সাজপোশাক,না আছে বিশাল বিশাল সেট আর নটনটীর চাকচিক্য। যদিও তাতে থার্ড থিয়েটারের কিছু এলো গেল না।তারা চাইলেনও না এইসব শ্রেণী গোষ্ঠীকে। তারা চাইলেন নাটক শেষে মুগ্ধতা নয়, উঠুক তর্ক, উঠুক প্রশ্ন,জিজ্ঞাসা।
তবু একটা দূরত্ব ও এই ধরনের নাট্য ধারার প্রতি ছুঁৎমার্গ রয়েই গেল। ফলে থার্ড থিয়েটার আপামর বাঙালিকে আনতে পারল না তার অঙ্গনে। এই সুযোগটা নিল গ্রুপ থিয়েটার। তারা আত্মরক্ষায় “থার্ড থিয়েটারের” বিরুদ্ধে কোমর বাঁধল।এর মধ্যে গণনাট্য ধারার সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীরা কিন্তু একটু একটু করে এই ধারায় পা বাড়াতে শুরু করে দিয়েছে ততদিনে। যদিও তারা থার্ড থিয়েটারের আঙ্গিককে গ্রহণ করলেন। বিষয়কে নয়। থার্ড থিয়েয়ারে যে অতি বামপন্থার ছোঁয়াটা আছে সেটা বামফ্রন্টের আমলের সংসদীয় গণতন্ত্রবাদীরা মেনে নেবেন কী রে? বাদল সরকার ও তার থিয়েটার আবার একলা হোল।
এ বাদে যে সব নাট্যদল বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটারের থিয়োরি ও ফিলজফি না বুঝে কেবলমাত্র এর নিরাভরণ ছিমছাম সহজিয়া ধারাকেই প্রকৃত নাট্য ভাবলেন তারা এই ধারার সবচেয়ে ক্ষতিকারক অংশ। এর মধ্যে এক সমালোচক যিনি শম্ভু মিত্র ছেড়ে বাদল সরকার নিয়ে পড়েছিলেন তিনি আচমকাই থার্ড থিয়েটার ছেড়ে অল্টারনেটিভ থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলেন। ফলে সাতের দশকের শেষ থেকে খড়দহের প্রবীর গুহ র “সমুদ্র অস্থির” খড়দহ থেকে ম্যাক্সমুলার ভবন ছাড়িয়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলার গ্রুপ থিয়েটার ধারাকে অস্থির করে তুলেছিল বৈকি। পোল্যান্ড থেকে জর্জি গ্রোতস্কি এসে সে ধারার নাটক দেখছেন। অবনী বিশ্বাস প্রবীর গুহ এদের পোল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছেন।অবনী বিশ্বাস গুরুর শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছেন ইতালি। সেখান থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলছেন “থিয়েটার হাউস”। আর প্রবীর খড়দহ থেকে মধ্যমগ্রামে এসে নির্মাণ করল “আখড়া"।বস্তুত প্রবীরের হাত ধরেই এসেছে আজকের “অন্তরঙ্গ থিয়েটার”।
ইতোমধ্যে দিল্লীর ছেলে সফদর হাসমি তার বাংলা থিয়েটারের প্রতি অনুরাগ আর শ্রদ্ধার কারণেই বাংলার নাট্যকর্মীদের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল সহজেই। তার সঙ্গে চাকরি সূত্রে দিল্লীতে বাংলার তথ্য ও জন সংযোগের অফিসার হিসাবে বেশ কয়েক বছর বাংলা নাটকের উৎসব এর আয়োজন করে।বাংলার প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠিত নাট্যগোষ্ঠী সেই উৎসবে যোগ দিয়েছিল। সেই হাসমিকে আটের দশকের শেষে নাটক চলাকালীন আক্রমণ করে খুন করা হলে বাংলা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। ইতিহাসের কারণেই জানিয়ে রাখা প্রয়োজন প্রয়াণ সংবাদ পাবার পরেই স্বজন হারানোর ব্যথা ও ক্ষোভে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি,কুমার রায় ও আরও কয়েকজন অধ্যাপক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শোকসভার আয়োজন করি। বিকেলবেলা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার,গণতান্ত্রিক লেখক ও কলাকুশলী সংগঠন এর আয়োজনে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে স্মরণ সভার আয়োজন করলে নাট্য কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েত হয়ে এই হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেদিন উৎপল দত্ত এক তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষায় বক্তব্য রাখেন। সেদিনের একটি কথা আজো ভুলতে পারিনি। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন শাসকরা যেভাবে অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এরপর দেখব তারা কোন নাটককেই মঞ্চস্থ হতে দেবে না আর দূরদর্শনে বিনোদনের জন্যে সংবাদ পাঠের মধ্যেই বিজ্ঞাপন গুঁজে দেবে।আমাদের বাধ্য করবে রবিশঙ্করের সেতার বাদন থামিয়ে সাবান আর গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখতে। সেদিন হাসমির জন নাট মঞ্চের জীবিত সহযোদ্ধারা করেছিল “হল্লা বোল”। যে নাটক চলাকালীন আক্রমণ নেমে এসেছিল ও প্রয়াণ হয়েছিল প্রিয় বন্ধুর। বাংলায় এবার জোয়ার এলো নুক্কড় নাটকের। ১২ এপ্রিল সফদরের জন্মদিনকে সামনে রেখে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল মাঠ পাথার বন্দরের নাটক। হাসমির নির্দেশিত সবকটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হোল।আবার জানিয়ে রাখি হাসমির জীবদ্দশাতেই শূদ্রক নাট্য দলের ভারতীয় নাট্য সংখ্যায় নাট্যকার দেবাশিস মজুমদারের অনুবাদে মুদ্রিত হয়েছিল “আওরৎ”। বাদল সরকার প্রসঙ্গে এই কথাগুলি বলার কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেই বাদল সরকারের জীবদ্দশাতেই থার্ড থিয়েটার একটা গণ্ডীর মধ্যে আবর্তিত হতে থাকল। বাদল সরকার নিজেও কিন্তু তখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন।
বাদল সরকার তখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তার দর্শনকে তুলে ধরতে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ওয়রকশপ করাচ্ছেন।এই ভাবেই ১৯৯৪ তে তিনি এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে। ছিলেন কয়েকমাস। ঠিক যেভাবে এসেছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কুমার রায় প্রমুখ নাট্য ব্যক্তিত্ব। তবে বাদল সরকারের সান্নিধ্য যারা পেয়েছিল সে সময় তারা সবাই যে আজ নাটকের সঙ্গে জড়িত তা না হলেও চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে একটা নতুন দিশার সন্ধান পেয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। আবার প্রতিকূলতাও কম পেতে হয়নি।এখানেও অনেকটা একলা বাউল তিনি।
জীবনের উপান্তে এসে বাদল সরকার নাটক পাঠ করছেন। কোলাজ করছেন। একটা গুটিপোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন একটু একটু করে।
২০১১এর এপ্রিলে কোলনে ক্যান্সার ধরা পড়ল।একা মানুষ বাদল সরকার ১৩ মে, ২০১১, ৮৫ বছর বয়েসে নিঃশব্দে চলে গেলেন।বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের কিংবদন্তী এই নাট্যব্যক্তিত্ত্ব সাতের দশকের উত্তাল সময়ের শুরু থেকে ‘থার্ড থিয়েটার’ নামক ভিন্ন এক নাট্য আঙ্গিক ও দর্শনের এর উদ্গাতা, নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বর্ণময় নাট্যজীবনে কালের রাখালের মতোই কাটিয়েছেন।
আজ পড়ে আছে তার ফেলে যাওয়া একলা একতারা। হাজার নাট্য উৎসব আর আলোচনা সেই একাকীত্বকে কাটিয়ে নিকানো অঙ্গনে টঙ্কার তুলবে না কি সযত্নে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখবে সেটাই দেখার।