MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

গুটিপোকার বিনি সুতোর মালা
(এই লেখাটি মূলতঃ অধ্যাপিকা পিয়ালী পালিত, চিত্রগ্রাহক সৌগতুলিশ ও গায়িকা মৌ গাংগুলির জন্যে)
আমার শৈশবের বাগানে কদম গাছ ছিল গড়খাইয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে।‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ কি না মনে নেই।‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ কোনও কিশোরীকে দিয়েছিলাম কিনা তাও মনে করতে পারছি না তবে মস্ত গাছ এই বর্ষায় ফুলে ভরে যেত।সুবাস ছড়াত।মৌমাছিও জুটত।আমরাও জুটতাম সেই সুবাসে নয় ফুল কুড়োতে। কোনও কিশোরীর হাতে তুলে দিতে নয়।ওগুলো ছিল আমাদের বিনি পয়সায় কুড়িয়ে পাওয়া ক্রিকেট বল।
একটা বিশাল নিম গাছ ছিল গড়খাইয়ের পূর্ব পাড়ে।আমার দিদিমা সারা বছর নিম পাতা ভাজা খেতেন।সেই নিম গাছেও ফুল আসত।শুধু সেই গাছে কেন বড়ো রাস্তার ওপরে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো নিম গাছ ছিল।গরম কালে কচি পাতায় ভরে যেত সে গাছ আর তার পরে গাছ ভরে আসত সাদা নিম ফুলে।সেই সব গাছে মৌমাছি যত দেখেছি তার চেয়েও বেশি দেখেছি নানা জাতের পাখি।যখন ফুল থেকে ফল হোতো আর সেগুলো পেকে সবুজ থেকে হলুদ হয়ে উঠত তখন সেই পাকা নিম ফল খেতে কতো পাখি যে আসত।গাছের তলা পাখিদের খেয়ে ফেলে দেওয়া বীজে ভরে যেত।বর্ষার পর সেই বীজগুলোই গাছ হয়ে যেত।বেশ মনে আছে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির নিম গাছটার ডালপালা কেটে দেওয়া হোতো।সেই ডালপালা শুকনো হলে আমাদের বাগানের আর পাঁচটা শুকনো ডালপালার মতো বাড়ির কাঠের উনুনে জ্বালানির কাজে লাগানো যেত না।ওগুলো ব্রাহ্মণদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা নিয়ে যেত তাদের বাড়ির জন্যে।
আমাদের বাড়ির বাগান ছিল একটা ছোটোখাটো ভেষজ উদ্যান।উত্তর দিকে খিড়কি পুকুরের তিন দিক ঘিরে ছিল বাঁশের বন।সেখানে ছিপ তৈরির কাঁটা বাঁশ থেকে কুলো,চুপড়ি,ঝুড়ি,খালুই,চাঙারি,ধুচুনি তৈরির তলতা বাঁশ যেমন ছিল আবার বেড়া দেবার কি খড়ের চালের কাঠামো তৈরির বাঁশও ছিল।সেই বাঁশের ঝাড়েও ক্বচিৎ কখনও ফুল আসতে দেখেছি তবে মড়ক আসেনি।বাঁশের বনে লুকিয়ে থাকত মস্ত ধেড়ে ইঁদুর,নেউল আর গোসাপ।তার মধ্যে কিছু কিছু কালকেতু-ফুল্লরা উপাখ্যানের স্বর্ণগোধিকাও ছিল।আমাদের বসত বাড়িতে তাই কোন দিন বিষধর সাপ থাকত না।বিশাল বিশাল ঢ্যামনা(দাঁড়াস)সাপ অবশ্য ছিল।তারা সময় সুযোগে আমাদের ভয় দেখাতেও ছাড়ত না।আর ছিল শেয়াল- ভুড়ো শেয়াল আর খ্যাঁকশেয়াল।তারা প্রহরে প্রহরে ‘হুক্কা হুয়া’ বলে ডাকত।আমরা ওদের ডাকের উত্তরে ‘কেয়া হুয়া’? বলে সাড়া দিতাম।ওরাও সুযোগ পেলেই সদ্য চোখ না ফোটা কুকুর ছানা আর হাস-মুরগির ঘরে হানা দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যেত।একবার পোষার জন্যে বাদামি রঙের দুটো বুনো খরগোস এনে দিয়েছিলেন বড় জামাইবাবু শালের বন থেকে।তারা বুনো বলেই তাদের ঘরের মধ্যে না রেখে বাগানে সুড়ঙ্গ তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছিলাম।সকালবেলা তারা সারা বাগান ঘুরে বেড়াত আর কচি কচি ঘাস খেত।রাতের বেলা ওই সুড়ঙ্গে ঘুমোত।বেশ পোষ মেনে গিয়েছিল তারা।একদিন ধূর্ত শেয়াল দুটোকেই তুলে নিয়ে গেল।তার পর আর কোনও খরগোস পুষিনি।তবে পোষার মতো প্রাণীর অভাব ছিল না।সে কথায় পরে আসছি।এখন বাগানে ফিরে যাই।
বাঁশ বনের মধ্যেই ছিল বটগাছের মতো বিশাল বিশাল খিরিশ(শিরীষ)গাছ।তাদের ফুলও গন্ধে মাতাত।লম্বা তেঁতুলের মতো পাকা ফলগুলো ছাগল আর গোরু আরাম করে চিবোত।বাবলা গাছও ছিল।তার ফলও ছাগল গোরু খেত।আর ছিল খেজুর গাছ।দেশি খেজুর।আমার কলকাতার বারান্দায় নিজের হাতে তৈরি আরবের খেজুর গাছ নয়।পশু-পাখির খেয়ে ফেলে দেওয়া বীজ থেকে আপনা-আপনি গজিয়ে ওঠা। খেজুরগুলো পেকে গাছের তলায় পড়লে আমরা যেমন খেতাম শেয়াল গোরুও খেত।আর ছিল তেঁতুল গাছ।তেঁতুলের ফুলেরও বেশ সুন্দর গন্ধ হয়।তাল-নারকেল ফুলেরও গন্ধে একটা মাদকতা আছে।লেবুর ফুলের গন্ধের মতো না হলেও। বাড়ির পিছনে যে ঝাঁকড়া মাথার কারি পাতার গাছ ছিল(আমরা ওইকালেই উপমা খেতাম কারিপাতা দিয়ে।জ্যাঠাবাবু লাগিয়েছিলেন)তাতেও ফুল আসত।তার পাশেই ছিল মস্ত কাগজি লেবুর গাছ।খাওয়ার পরেও কতো লেবু যে পেকে পড়ে নষ্ট হোতো।তেঁতুল গাছের পাশেই ছিল হোর্তকি(হরিতকী)গাছ।আশ্বিনে সেই গাছে ফুল আসত।পুজোর সময় হাল্কা সবুজ ফল ধরত।শীতকালে ওই ফল পেকে মাটিতে পড়লে আমরা এম্নিই কুড়িয়ে খেতাম আর মা-ঠাকুমা ওর বীজ যাঁতি দিয়ে কেটে হাতে সুতোর ডোর দিয়ে পরিয়ে দিত।তাতে নাকি বসন্ত হবে না।আমরা খুব ছোটোবেলায় ‘জল বসন্তের’ রোগী দেখেছি।বলা উচিত শুনেছি।কেন না তাদের ঘরের বাইরে আসতেই দেওয়া হোত না। পরে মুখ ভরা দাগ নিয়ে তারা যখন বেরোত আমরা ভয় পেতাম।এর পর সারা বিশ্ব থেকে জল বসন্ত উধাও করে দেওয়া হয়েছে(ল্যাবরেটরি ছাড়া)ঠিক যেমন কালা জ্বর আর ম্যালেরিয়া উধাও করে দেওয়া হয়েছিল ডিডিটি স্প্রে করে।
আমাদের বাড়িতে জ্যাঠামশায় ডাক্তার হলেও আমরা উঠতে বসতে মেডিসিন নিতাম না।সম্বচ্ছর নানান ভেষজ ওষুধ আমাদের উপর প্রয়োগ করা হোতো।ভাদ্রকালে পিত্ত বিনাশের জন্যে আমাদের শুকনো পাটপাতার জল আর কাঁচা হলুদ বাটা খেতে হোতো। একটু শীত পড়লেই রবিবার খালি পেটে চিরতার জল।আশ্বিনে ভাতের পাতে বাড়ির বাগানের ওল সেদ্ধ আর কাঁচা তেঁতুলের টক খেতে হোতো।আখের গুড় আর ভেজা ছোলা সেও খেতে হোতো।নিম পাতা বাটাও খেতে হোতো একদিন।তবে তার সংগে আমরা গজড় খেতাম।‘গজড়’ হোলো তালের ফেলে রাখা আঁটির ভেতরের সাদা ফোপরা।শাঁস নয় কিন্তু।নারকেল যখন গাছ হবার অবস্থায় আসে তখনও এমন ফোপরা হয়।ওটা খেতে তেমন মিষ্টি লাগে না যতটা মিষ্টি তালের ফোপরা।আর ঝড়ে পড়ে যাওয়া নারকেল গাছের মাথাটা চিরে যে শাঁস বেরোত সেটা এতোই মিষ্টি যে একটু খেলেই গা গুলিয়ে যেত।পাকা বহেড়া আর ডুমুরও বেশ মিষ্টি।পাকা বহেড়া ফলের আঠা দিয়ে আমরা কাগজ সাঁটতাম।আর ছিল যজ্ঞডম্বুরের গাছ।ডুমুরগুলো পাকলে লাল হয়ে যেত।গোয়াল আর ধানের গোলার কাছেই ছিল শতাব্দ প্রাচীণ আমলকী গাছ।তার শরীরটা ছিল ফাঁপা।তার ভেতরে ছিল পাহাড়ি মৌমাছির চাক। আমরা কোনদিন তার মধু খাইনি।বলা ভালো পাইনি।কেন না ওটা গাছের অনেক গভীরে ছিল।কিন্তু মধুর জন্যেই হয়তো গাছ ভরা আমলকী অমৃতফল হয়ে যেত। মহালয়ার ভোরে আমরা কুষি আমলকী কুড়োতাম।আর ছিল করঞ্জ গাছ।তার ফল ছিল তেতো।ছিল অর্জুন গাছ।তেজপাতা গাছ ছিল।দারুচিনি গাছও ছিল।জ্যাঠাবাবু ওটা লাগিয়েছিলেন কিন্তু পরে গাছটা বড়ো হোতে দেখা গেল গাছটা কেমন করে যেন কাবাব চিনি গাছ হয়ে গেছে।ঠিক যেমন ছোটো এলাচের গাছে কুড়ি আসত কিন্তু এলাচ পাইনি কোন দিন।ছোট এলাচের গাছ অনেকটা দোলনচাঁপা গাছের মতো।গুলঞ্চ গাছও ছিল।তারাও ফুলে ভরিয়ে রাখত গাছ।জবা ফুলের গাছে যখন ফুল আসত আমরা সেই ফুলের ভেতরের মধু চুষে খেতাম।
আনারস গাছ ছিল যেখানে সেখানে।বলা ভালো সারা বাড়ি জুড়ে আনারসের ঝোপ ছিল।যেমন চুপড়ি আলুর লতা আমগাছ জড়িয়ে উঠত আর মাটির তলায় হোতো মস্ত আলু।ঘৃতকুমারী গাছ ছিল বাগানের এক কোণে। বাগানের কোণ গুলোয় ছিল কলার ঝাড়।কাঁঠালি,চাঁপা,কাঁচকলা,মর্তমান আর বিচিকলা।ওগুলো এম্নিই হোতো।বাবা পরে লাগিয়েছিল সিঙ্গা্পুরী কলার গাছ।কী মিষ্টি ছিল সেই গাছের কলা।একবার একটা কলা গাছের কাঁদি হোলো গাছটার শরীরের ভেতরে।বেশ মনে আছে আমরা অপারেশন করে কাঁদি বের করেছিলাম।ওই অঞ্চলে আমাদের মতো হুজুগে বাড়ি আর একটাও ছিল না।জ্যাঠাবাবু একবার আমাদের নিয়ে খালের জলে পানিফলের চাষ শুরু করলেন।দুদিন পরে সে সখ মিটে গেল।শুরু হোলো নতুন হুজুগ মৌমাছির চাষ।
আমলকী গাছের চাকের মধু তো আমরা পেতাম না কিন্তু তবুও টাটকা মধু খেতাম। বাগানের লাল হলুদ রঙ্গন গাছের ঝোপে যেমন বুলবুলি আর টুনটুনি বাসা বাঁধত। আমাদের একটুও ভয় করত না।মাছিমৌমাছিও চাক বাঁধত।মধু জমলে আমরা সেই চাকে পাটকাঠি ঢুকিয়ে নিচে একটা থালা কি বাটি পেতে দিতাম।টপ টপ করে তাতে টাটকা খাঁটি মধু পড়ত।আর আমাদের নিজের হাতে চাষ করা মৌমাছির ব্যাপারটা ছিল আরও মজার।
সরকারি প্রকল্প থেকে দু-দুটো কাঠের ‘বি-বক্স’ আনা হোলো।তাদের দুটি তলা। নীচেরটায় মৌমাছির সংসার আর উপরের তলায় তারা নিজেরাই মধু রাখার ধপধপে সাদা চাক বানাত।প্রতি রবিবার আমরা সেই বাক্স খুলে দেখতাম মধু জমলো কি না। তার জন্যে দুহাত দিয়ে মৌমাছিদের নিয়ে উড়িয়ে দিতাম।ওরা সারা আকাশ ভরে উড়ে বেড়াত তখন।শুধু খেয়াল রাখতে হোতো রাণী মৌমাছি যেন উড়ে না যায়। তাহলেই গল্প শেষ।রাণীকে ঘিরেই তো ওদের সংসার।বাকি মৌমাছিদের নিয়ে কোনও চিন্তা ছিল না।ওরা একটুও হুল ফোটাত না।ফোটালেও আমরা তেমন গা করতাম না। এর ফলে শান্তিনিকেতনে একদিন হনুমানের বাঁদরামিতে শ-খানেক মৌমাছি ছেঁকে ধরায় রাত্রে জ্বর এসেছিল শুধু।একবার কলকাতার বাসায় ভীমরুলের কামড়ে পিঠে ঘা হয়েছিল।যদিও সেটা আমাদের দেশের বাড়ির ভীমরুলের মতো মারাত্মক ছিল না। জবার ডালে চাক বাঁধা বোলতার মতোও নয়।ওদের ডিম দিয়ে আমরা মাছ ধরতাম। পিপড়ের ডিম দিয়েও মাছ ধরতাম।ওরা বাসা বাঁধত আম গাছে।ঠিক যেমন উই বাসা বাঁধত মাটির তলায় আর ঘরের বইয়ের তাকে।তবে মেদিনীপুরের উই আর যাই হোক শান্তিনিকেতনের মতো নিঃশব্দ প্রাণঘাতী নয়।সংগীত-ভবনের কাঠ পিঁপড়ের মতোও জ্বালাময়ী নয়।কখন ঢুকে পড়বে খেয়ালই হবে না।পরে তাদের সুচারু কামড়ে বোঝা যাবে।
দেশের বাড়িতে এমন কামড় খেলে আমরা বাগানের ঘৃতকুমারীর রস মেখে নিতাম। কিম্বা বিছের কামড় খেলে সেই বিছেটাকেই মেরে তার রস লাগিয়ে নিতাম।কিন্তু শান্তিনিকেতনে সে সুযোগ কালে ভদ্রে জোটে।শুনেছি শান্তিনিকেতনে নাকি সাপে কাটলে মানুষ মরে না সাপটাই মুহুর্তে প্রাণত্যাগ করে।মেদিনীপুরের খরিশ,কেউটে কিন্তু মারাত্মক।ওরা উইয়ের মতো ভিটেমাটিতেই থাকে।আর ঘুঘু বাসা করত ঘরের দর দালানে।কামিণী গাছে বাবুই পাখির বাসার মতো বাসা করত বাউল টুনটুনি।রঙ্গন গাছে বাসা বানাত বুলবুলি।আমরা রঙ্গন ফুল তোলার সময় তাদের দেখতাম।রঙ্গন ফুলের মালা গাঁথতাম এক অদ্ভূত প্রক্রিয়ায়।আমরা বলতাম এগুলো ‘বিনি সুতোর মালা’।প্রথমে ফুলের ভেতরের মধুটা চুষে খেতাম তারপর একটা ফুলের ডাঁটি আর একটা ফুলের পাপড়ির দিকে ঢুকিয়ে দিতাম।এইভাবেই হয়ে যেত আমাদের বিনি সুতোর মালা।কাঠচাঁপা ফুলেও এমন মালা গাঁথা যায়।
আমাদের দেশের বাড়িতে মুচকুন্দ ফুলের গাছ ছিল না।অমলতাসও ছিল না।বেল ছাড়াও কঁদ বেল আর কেন্দুপাতার গাছ ছিল।ওখানে সবাই ওর ফলকে গাব বলে।আর ছিল নোনাআতা গাছ।আতাগাছ সেতো ছিলই।আঁশফলের গাছও ছিল।এখন আঁশফফল কিনে খেতে হয়। আশশ্যাওড়া গাছও ছিল।তাতে পেত্নী থাকতে দেখিনি তবে সোনাপোকা থাকত।আমরা দেশলাই বাক্সে তাদের পুষতাম।যেমন হোমিওপ্যাথির ছোটো শিশিতে জোনাকি ভরে রাখতাম।হরলিক্স কি ভিভার খালি কাচের শিশিতে খলসে মাছ পোষাটাও ছিল এক নেশা। আর কাচপোকা ধরে জমানো ছিল মজার খেলা।জ্যোৎস্না রাতে গাছে গাছে লুকোচুরি খেলাটাও কম মজার ছিল না।কিম্বা মাঝ রাতে চাঁদের সঙ্গে কথা বলা।একলা মাঠে একটা একটা করে তারা গোনা আর উল্কার ছুটে যাওয়া দেখে মন খারাপ হয়ে যাওয়া।সে দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল......।?নাকি এখনও কোথাও না কোথাও আছে আমরাই কেবল হারিয়ে ফেলেছি?

ঠিক যেমন এখনও ডাকঘর আছে।কারও কারও কাছে হয়ত রাজার চিঠিও আসে। তবে পোস্ট অফিস থেকে সুন্দর খামে আমার কাছে যে চিঠি আসে তাতে কারও হাতের লেখা থাকে না।থাকে মোবাইল কি ক্রেডিট কার্ডের প্রিন্টেড বিল যার পেমেন্টের শেষ তারিখ আগেই শেষ হয়ে গেছে হয়তো।    
সকলেই কবি নয়......
জীবনানন্দ দাশ কথাটা যেন আগামীর আমার জন্যেই লিখেছিলেন।আমার তাম্রলিপ্ত বন্দরের কাল থেকে নোঙরবিহীন একাল অব্দি কবিতা লিখেছি যত তার চেয়ে বোধ হয় অন্য কবিদের কবিতার বইয়ের ও কবিতা পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছি বেশি এমনকি আমার নাটকেও কবিতা ফিরে ফিরে আসে কিন্তু কবি হয়ে উঠতে পারিনি কখনোই। কবি হতে বিশেষ কিছু লাগে যা আমার নেই।আমার মনে হয় কবি হয় দুই রকমের সেয়ানা কবি আর দিওয়ানা কবি।বলা বাহুল্য দিওয়ানা কবি চিরকালই মাইনরিটি। আমি সেই সৌভাগ্যবান যে সেয়ানা কবির পাশাপাশি দিওয়ানা কবিদেরও সাক্ষাৎ পেয়েছি,সখ্যও।তাদের মধ্যে একজন আদ্যোপান্ত কবি হয়েও বাংলা নাটকের সংগে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন এই সেদিনও।আমার সে প্রিয়জনের কথায় আসব একটু পরে। আপাতত ফিরে যাই বন্দরের কালে যেখানে শুধু সন্ধ্যায় নয় দুপুরেও মজে ছিলাম কবিতায়।
অশোকতরু কবিতা লেখার পাশাপাশি কবিতা পত্রিকার প্রকাশকও ছিল।সেটা নিজের কবিতা ছাপার জন্যে নয়।অন্যদের প্রকাশিত করার জন্যে।একাই কবিদের কবিতা সংগ্রহ করে প্রেসে যেত।কবিতা কম্পোজ হোতো।তার প্রুফ দেখতে হোতো বার কয়েক তারপর কাগজ কিনে প্রেসে দিয়ে প্রিন্ট অর্ডার দেওয়া তার পর ছাপা।সে যে কি ঝক মারির কাজ ছিল তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।আবার ছাপাখানার কালি,সীসের গন্ধ, ভেজা কাগজের প্রুফ,হাতে গরম প্রিন্ট এ যে গরম ভাতের চেয়েও সুস্বাদু।আবার ভাতে যেমন বালি কি কাঁকড় পড়লে মেজাজ খিচড়ে যায় সেইভাবে ছাপাতে ভুল থাকলে ওই এক অসোয়াস্তি হোতো।কম্পোজিটরদের নিয়ে ঝক্কিও পোয়াতে হোতো বেশ। মফস্বল টাউনের প্রেসের এক চিলতে ঘরের সংগে শহর কলকাতার এক চিলতে গলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা মস্ত ছাপাখানার এ ব্যাপারে কোনও তফাত চোখে পড়েনি আমার।
একবার অশোক ঠিক করল কবিতা পত্রিকা শুধু শিক্ষিত মানুষ কিনবে আর পড়বে তা হবে না।যারা খেটে খায়,মাঠে ঘাটে কাজ করে তাদের কাছেও কবিতা নিয়ে হাজির হব।এমনকি গ্রামের মেলাতেও পত্রিকা নিয়ে হাজির হব।কবিতা বেচব।যেমন ভাবা তেমন কাজ।সামনে রথের মেলা।মহিষাদলের রথের মেলা বিখ্যাত।আমরা সেই মেলাতেই যাব স্থির হোলো।শুরু হোলো প্রেসে গিয়ে কবিতা দেওয়া আর প্রুফ দেখা। এর মধ্যে একদিন গিয়ে শুনলাম আজ কোনও প্রুফ পাওয়া যাবে না।কারণ? কম্পোজিটর কিছু কবিতা কম্পোজ করতে চাইছে না।কারণ কী?জানা গেল এক কবির কবিতায় বহুল পরিমাণে ‘স্তন’ আর ‘যোনি’ শব্দ আছে।প্রেসের মালিকও তাকে দিয়ে ওই কবিতা কম্পোজ করাতে পারেননি।শেষমেশ আমি আর অশোক তাকে বোঝালাম এটা নিছক কবিতা।কবিতার প্রয়োজনেই এই শব্দ......এখানে আর কোনও শব্দ ব্যবহার করা গেলে কবি তাই করতেন।কম্পোজিটর নিমরাজি হোলো তবে একটি শর্তে।এখন স্তন-যোনি ছাড়াই প্রুফ দেখতে হবে।প্রিন্ট অর্ডারও ওইভাবে দিতে হবে।ম্যাটার মেশিনে ওঠার সময় সে শব্দগুলি বসিয়ে দেবে যথাস্থানে।এ যে কী যন্ত্রণা!বিস্তর সময় ভুগেছি এ নিয়ে যা সবিস্তারে বলতে গেলে সে এক মহাভারত হয়ে যাবে।সেবার তাই বহু শ্রমের পর আমরা স্তন-যোনির দেখা পেয়েছিলাম।
তমলুক থেকে মহিষাদল বেশ কয়েক কিলোমিটার।যখন মেলায় পৌঁছলাম সবে রথের দড়ি টানা শুরু হয়েছে আর মানুষজন কেউ বা দড়ি টানায় ব্যস্ত কেঊ বা অস্থায়ী নিষিদ্ধ পল্লীর ঘরে ঠায় অপেক্ষায়।আবার কেউ বা ঘুরে ঘুরে পাপড় ভাজা খাচ্ছে।এর মধ্যে এক দল লোক কুড়ি বাইশ কিলোগ্রাম ওজনের খাজা কাঁঠাল কিনে পাকা রাস্তার ওপরে বসে পড়ে হাতে তেল না মেখেই কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে।আমরা সেই সব মানুষদের কাছেও পত্রিকা নিয়ে গেলাম।বিক্রীও হোলো।আমাদের কবিতা বেচা হোলো কিন্তু রথ দেখা হোলো না।
একবার কালোবরণ পাড়ুই তার গ্রামে কবি সম্মেলনের আয়োজন করল।আমরা দল বেঁধে চললাম কবিতা পড়তে।মাটির দাওয়ায় বিশাল জাজিম পেতে দেওয়া হয়েছে। পৌঁছতেই প্রায় এক লিটার জল ধরে এমন সাইজের কাচের গ্লাসে শরবত দেওয়া হোল।এবার হ্যারিকেনের আলোয় কবিতা পাঠের শুরু।ছোটোরা উঁকি ঝুকি দিয়েই পালালো।বড়রা কেউ কেউ চুপ করে বসে থাকলেও অধিকাংশ বয়স্ক মানুষ আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।মেঝেতে পাত পেড়ে এলাহি খাওয়া হোলো।আর একবার সুচরিতা দাশ তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ে কবিতা পাঠের আয়োজন করলেন। সুচরিতা দাশ ছিলেন ওই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।জীবনানন্দ দাশের বোন।অপর্ণা সেন তমলুকে “কোলকাতার হ্যামলেট” নাটকে অভিনয় করতে এসে ওনার কাছেই উঠেছিলেন সেবার।অসিত বসু ছিলেন এই নাটকের নাট্যকার ও পরিচালক।এই নাটকে সুনীল মুখোপাধ্যায় অভিনয় করত।কী দক্ষ অভিনেতা।অভিনয় দেখে চমকে গিয়েছিলাম।পরে সুনীলদার সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে তখনও সুনীলদা ঢাকুরিয়ার বস্তিতেই থাকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘নিম অন্নপূরর্ণা’ কি গৌতমদার(ঘোষ) ‘পাড়’ ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি।
আর এক সুনীলদাও(গঙ্গোপাধ্যায়)সুচরিতা দাশের আমন্ত্রণে তাঁর সেই ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে কলকাতা থেকে তমলুকে এসে কবিতা পড়ে ফিরে গেলেন কলকাতায়।এই আমিও কলকাতায় যখন পাকাপাকি থাকছি, মঞ্চের কাজে জড়িয়ে পড়েছি তখনও কবিদের ডাকে ফিরে ফিরে গেছি ওখানে।সেবার তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় কবি সম্মেলনের আয়োজন করল।আমন্ত্রণ পেয়ে আমিও হাজির হয়েছিলাম।কবিতা পাঠের পর অধ্যাপকদের ‘কমন রুমে’ আলোচনা ও চা পান।তর্ক উঠল রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজ কতটা প্রাসঙ্গিক?সবাই যখন চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলতে ব্যস্ত আমি তখন দিনান্তের শেষ আলোয় বলে উঠেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতার কী দশা হবে জানিনা তবে তার গান বেঁচে থাকবে কালাকাল পার করে।তার গান দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের গানের এপারেই......ওপারে নয়।

ঠিক তখন তখনই স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়মে সুর তুলে এক কিশোরী গেয়ে উঠেছিল-“ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি”।এর পর আর কোনদিন আর কোনও কবি সম্মেলনে কবিতা পাঠ করিনি।কবিতাকে ছুটি দিয়ে এক ছুটে ফিরে এসেছিলাম মোকাম কলিকাতায় নাটকের মহড়া কক্ষে।গুটিপোকা কখন যে খোলস কেটে বেরিয়ে পড়েছিল সকলের দৃষ্টির অগোচরেই।    
গুটিপোকা
আমার দেশের বাড়ির বাগানে আম-জাম-নারকেল-কাঁঠাল-তাল-সুপুরির পাশাপাশি সদর রাস্তার দু-পাশে বাবার হাতে তৈরি ফুলের বাগানও ছিল।সেখানে এই গ্রীষ্মে ভুঁইচাপা ফুটত।সামারলিলিও ফুটত।আর ফুটত বেলফুল,জুঁইফুল,রংগন,টগর,গন্ধরাজ আর রজনীগন্ধা।বর্ষা এলে বেলফুল তার মান হারাত কিন্তু জুঁই আর রজনীগন্ধা কী অপূর্ব সুবাস ছড়াত।হয়ত একটু চড়া তবু এই দুই ফুলের সংগে বাসরশয্যার অনুষংগ মিলে মিশে থাকে।কৈশোরে দাদা-দিদিদের বিয়ের গাড়ি কি বাসরঘর আমরাই সাজাতাম।রজনীগন্ধার শিকলি আর ঝাউ-গোলাপ।বিছানায় ছড়াতাম গোলাপের পাপড়ি।একটা উগ্র গন্ধের পারফিউম স্প্রে করে দেওয়া হোতো।বর-বউ সারারাত ওই গন্ধে কী করে ঘুমোত কে জানে!কোনও কোনও পূর্ণিমা রাতে আমরাও ঘুমোতে পারতাম না সারারাত।আমাদের বৈঠকখানার রোয়াকের পাশে যে কামিণী গাছ ছিল তাতে যখন ফুল আসত পুরো গাছটাই জ্যাঠাবাবুর মাথার মতো সাদা হয়ে যেত। আমরা যেমন দুপুরবেলা জ্যাঠাবাবুর পাকাচুলে হাত বোলাতাম মৌমাছিরাও সারাদিন ওই গাছ জুড়ে উড়ে বেড়াত।সারাক্ষণ একটানা বিনবিন শব্দ কেমন ঝিম ধরাত।এই সাউন্ড পরে শুনেছি তারকভস্কির আর আন্তোনিওনির চলচ্চিত্র-এ।এই ঝরাফুল বহু পরে পেয়েছি উত্তরবঙ্গে তারও পরে শান্তিনিকেতনে।উত্তরবংগে ছবির কাজ করতে গিয়ে মৌমাছি নয় হাতির পালের সামনে পড়েছি ঠিকই কিন্তু বৃষ্টির পর সারা পথ জুড়ে ছিল জারুলফুল।আর শান্তিনিকেতনে অমলতাস,ফাগুনবউ,রুদ্রপলাশ আর কুর্চিফুল। ছাতিমের কথা বললাম না এই জন্যে বৃষ্টিঝরা ছাতিম ফুল দেখেছি শুশুনিয়া পাহাড়ের নিচে।ঝরাফুল নিয়ে ছোটোরা অক্ষর লেখে পথে।যেমন আগুন রঙের পলাশ অবহেলায় ঝরে থাকতে পুরুলিয়া আর চান্ডিলে।শান্তিনিকেতনের মতো ওখানে কাউকে পলাশের মালা গেঁথে পরতে দেখিনি।ওরা এখন খোঁপায় গোঁজে সস্তার প্লাস্টিকের ফুল।মালা গেঁথে পরবার সময় কোথায়?ভোর হলেই যে ছুটতে হবে স্টোন ক্রাসারে কি স্পঞ্জ আয়রনের কারখানায়।মালা গাঁথি আমরা।কখনও কল্পনার কখনও কেনা ফুলের।
আমাদের যে বিশাল টগর গাছ ছিল তার ফুলে মালা গেঁথে যেমন রবিঠাকুরকে পরানো হোতো আবার ঝুলন পূর্ণিমায় রাধা-কৃষ্ণকেও সাজানো হোতো। কার বাড়ির গোড়ের মালা কতো বড়ো তাই নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা চলত।এক্টুও বাড়িয়ে বলছিনা আমার দিদিদের হাতের গোড়ের মালা সব বারেই জিতে যেত।হলুদ কল্কে ফুলের গাছও ছিল।তার মালাও বেশ শোভা পেত।তবে কল্কে গাছের বিচির থেকে আমরা সযত্নে দূরে থাকতাম।ওই বীজ বেটে খেয়ে অনেক মানুষ যে মরার চেষ্টা করেছে বিশেষ করে মেয়েরা।খালের পাড়ে ছিল কল্কে ফুলের গাছ আর পুকুর পাড়ে ছিল শিউলি ফুলের গাছ।শরৎ এলে সন্ধ্যের শিশির পড়ে শিউলি তার সুবাসে পাড়া মাৎ করত।সবাই বলেন ভোরের শিউলির কথা কিন্তু আমি ওই মাঝ রাতেই তাকে ভালোবাসতাম।ভোরেরবেলা ভালোবাসতাম স্থলপদ্ম আর শিশির ভেজা কুমড়োফুল। বকুলফুল আর স্বর্ণচাঁপা আর এক মাধুরী ছড়াত।এর ফাঁকে তেমন গন্ধ ছড়াত না কিন্তু শ্বেতকরবী আর রক্তকরবীর পাশে সাদা কাঞ্চনফুল বেশ লাগত।সকালের রোদে করবীর পাতায় নানা রঙের খেলা চলত কেন না ওখানে প্রজাপতি আর মথ গুটি মেলেছে।সেই গুটিতে রোদ পড়ে সাত রঙের খেলা চলত।পরে জেনেছিলাম রক্তকরবী বিষাক্ত।তখন শিখেছিলাম গুটিপোকা হতে।খুব খেয়াল করলে দেখতে পেতাম গুটির ভেতরের পোকাদের নড়াচড়া।তারপর একদিন গুটি কেটে বেরিয়ে পড়া।
আমি তখনও গুটি হয়েই আছি।পড়ার খাতার সাদা পাতায় নয়ত ফেলে দেওয়া ডায়েরিতে কাটছি আকিবুকি আর ফাউন্টেন পেনে কবিতা।এক গনগনে দুপুরে লিখেছিলাম-‘ব্যস্ত ছিলাম জ্যোৎস্না থেকে ফুল কুড়োতে’.........আমার কবিতা তখন নানা জেলার লিটল ম্যাগাজিনে বেরোচ্ছে এমন কি কলকাতাতেও।পোস্টকার্ড কি খামে লেখা পাঠিয়ে দিতাম ঠিকানা লিখে।কোনও কোনও ভোরে পোস্টমাস্টার কি পিওন ডেকে আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন বুকপোস্ট-এ পত্রিকা যেখানে থাকত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গংগোপাধ্যায়,তারাপদ রায়,তুষার রায়ের পাশাপাশি আমার কবিতাও।কেউ কেউ বিক্রির জন্যে আমার সৌজন্য সংখ্যার সংগে আরো কিছু কপি পাঠাতেন।আমি সেগুলো নিয়ে যেতাম ‘রীডার্স কর্নার’এ।উনিও সানন্দে সেই পত্রিকা সাজিয়ে রাখতেন।কী আশ্চর্য সেগুলো বিক্রিও হোতো।উনি ওনার কমিশন রেখে বাকি টাকা আমাকে দিলে আমি মানি অর্ডার করে সে টাকা পাঠিয়ে দিতাম সম্পাদককে। এই সুযোগে বিনম্র অহংকারে জানিয়ে রাখি কোনদিন কোনও বহুল প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় ছাপার আশায় লেখা পাঠাইনি।পরেও লেখার বরাত পেলে তবেই লিখেছি।আসলে তেমন গুছোনো কবি ও লেখক হয়ে উঠতে পারিনি কোনদিনএই কলকাতা শহরে যখন নাট্যচর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি পত্র-পত্রিকায় অর্থ উপার্জনের কারণে ধারাবাহিক রচনা কি সমালোচনা লিখছি সে সময় কিছু কবি ও দম্পতিকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা সম্পাদকের দপ্তরে বসে থাকতে।পরের সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে তাদের একগুচ্ছ কবিতা।তাদের কিন্তু পয়সার অভাব ছিল না।নামও হয়েছিল। পরে জেনেছি বিদেশ যাওয়ার তাগিদ ছিল।আমার আবার তাগিদটা ছিল নামের নয় মাণের।নাটক লিখেছি মঞ্চে প্রযোজনার প্রয়োজনে।প্রবন্ধ আর কবিতা লিখেছি স্রেফ ভালোবেসে।নামের জন্যে কাঙালপনা করিনি কোনদিনই।
আমি খুব চিঠির কাঙাল ছিলাম।সকালবেলার ডাকে আমার চিঠি আসবে এটা আমার এক মস্ত কাঙালপনা।পত্র-পত্রিকা হলে তো কথাই নেই।সে আমার লেখা থাকুক আর নাই থাকুক।পুজো সংখ্যায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারে আমার কোনদিন কোনও কাঙালপনা ছিল না।একবার কলকাতার এক শারদ সংখ্যায় আমার কবিতা প্রকাশ পেল।আমি তখনও হাতে পাইনি কিন্তু কবিতা পড়ার ডাক পেলাম তমলুকে কবি সম্মেলনে নিখিল বংগ সাহিত্য সভায়।বেশ কয়েকদিন ধরেই নানা অনুষ্ঠান চলছে।বেশ মনে আছে রুমা গুহঠাকুরতা তাঁর গান নাচের ট্রুপ নিয়ে এলেন।তিনি মঞ্চ থেকেই নিজে গাইতে গাইতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নেমে সবাইকে দিয়ে গাওয়ালেন-“চিও চিও চি”।সেই প্রথম উদয়শংকর ব্যালে ট্রুপের কয়েকজনকে নাচতে দেখলাম “ধিনাক নাতিন তিনা”গানের সংগে।আমি উত্তেজনায় কাঁপছি।এই মঞ্চেই আমি পরের দিন স্বরচিত কবিতা পাঠ করব?আক্ষরিক ভাবেই প্রায় সারারাত জেগেছিলাম।ভোর হতে রেডিওতে শুনলাম রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদ এর প্রয়াণ হয়েছে।সকাল থেকে আকাশবাণীতে সারেংগী আর এস্রাজ-এ একঘেয়ে বিলম্বিত।অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছে শুনলাম আমার আশংকা সত্যি করে সাতদিনের শোক পালন হবে।ওটা সরকারি অনুষ্ঠান ছিল তাই।এই প্রথম আমি এভাবে ফকির হয়েছিলাম।
স্থানীয় কবিরা সবাই আমার মতো এসে পড়েছেন সংবাদটা জেনে বা না জেনেই। সবার ঘরে তখন রেডিও ছিল না।শুধু কলকাতার কবিরা আসেননি।তারা জানতেন বা আসতে বারণ করা হয়েছে তাই।আমরা যখন হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরব ভাবছি ঠিক তখন কবি বাসুদেব দেব তার বাংলোয় আমাদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানালেন।আমরা হাতে চা নয় চাঁদ পেলাম।বাসুদেববাবু তখন ওখানকার সরকারি প্রশাসক।ওনার বাংলোটা ছিল নদীর কাছে কিছুটা নির্জনে।আমরা সবাই হাঁটা দিলাম।হাঁটতে হাঁটতে ফেলে আসা একটা কথা বলে নেওয়া যাক।
‘রীডার্স কর্ণার’এ যখন পড়ি আর কবিতার পত্রিকা রেখে আসি তখন আসা যাওয়ার পথে বর্গভীমা মন্দিরের কাছে দেখলাম আরো একটি বইয়ের দোকান ‘লিপিকা’।এক শান্ত মানুষ বসে থাকেন তার সহকারীকে নিয়ে।একদিন সাহস করে গিয়ে পত্রিকা রাখার কথা বললাম।ভেবেছিলাম উনি মুখ বাঁকাবেন কেন না ওখানে কবিতা-গল্পের চেয়ে পাঠ্যপুস্তক বেশি থাকত।উনি কিন্তু আমাকে অবাক করে বললেন-‘আমি তো ওসব ঠিক বুঝি না।তুমি বরং আর একদিন এসো যেদিন আমার বড়ো ছেলে থাকবে। ওর নাম অশোকতরু।আমার ছেলেও তো কবিতা টবিতা লেখে’।
অশোকতরু মিশ্র এক সৌম্যকান্তি যুবক।একমুখ দাড়ি গোঁফ,লম্বা চুল,মুখে প্রশান্তি আর ভাষায় মেদিনীপুরের আঞ্চলিকতা।বাড়ির ঠিকানায় লেখে ‘তমোলোক’।আমার স্বভাবের একেবারে বিপরীত।বাড়ির নীচেই দোকান।বাড়িটা রাস্তার ওপরে তিনতলা।অসম্ভব ধার্মিক।কালীর ভক্ত এবং সমস্ত শুকনো ও ভেজা নেশাতেই অভ্যস্ত।আমি কোনদিনই বাহ্যিক নেশায় বিশ্বাসী ছিলাম না।পান-বিড়ি-গাঁজা-সিগারেট আমার কাছে অসহ্য চিরকাল।কিন্তু আমি কাউকে নাও করতাম না।যার ফলে আমার কোনদিন কারো সংগে ওই কারণে বন্ধু হওয়াটা বাধা হয়নি।তাই বিপরীত মেরুর আমরা দুজন শুধু কবিতার কারণেই নিবিড় বন্ধু হয়ে গেলাম।কালে কালে দুজনেই দুই পরিবারের খুব কাছে চলে এলাম।এর ফলে আমার ‘রীডার্স কর্ণার’এর পড়াশোনাটা উঠে এলো ‘লিপিকা’য়।দুপুর থেকে রাত আটটা দোকানে।তারপর দোকান বন্ধ করে বাসস্ট্যান্ডের কাছে চায়ের দোকানে।ওখানে আমি আর অশোকতরু ছাড়া কালোবরণ পাড়ুই আসত। কালোবরণের একটি লাইন আমার আজও মনে আছে-“নীল পাখি উড়ে গেছে দূরে/গাছ তাকে বাঁধতে পারেনি”।আর এক খ্যাপা মল্লিনাথ যার সংগে আলাপ হয়েছিল কলেজেই সেও ছিল কবি।এই কয়েকজন থাকতাম প্রায় প্রতিদিন।এবার তার সংগে আসা শুরু হোলো রতনতনু ঘাটি,শোভন মহাপাত্র,শ্যামলকান্তি দাস,শাস্ত্রবিরোধী কবি বাবলু আর ক্বচিৎ কখনো অনুরাধা মহাপাত্র।আর একজনও আসত যার নাম ছিল দুরন্ত কুমার বিজলী।
বাসুদেব বাবুর বাংলোয় জমিয়ে আড্ডা হোলো।কবিতা,গান,রসালো কথা আর কোন শারদ সংখ্যায় কোন লেখা প্রকাশিত হোলো।কলকাতার পত্রিকা যাদের হাতে সেখানে আমার নাম দেখে সবাই একটু সমীহের চোখে তাকালেও আমার নিজেকে তেমনভাবে কবি কবি মনে হচ্ছিল না।মনে হবেই বা কেন?কবিতা লেখার অনেক আগে থেকেই যে নাটকের ভূত আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছে।

গুটিপোকা আমি তাই খোলসের ভেতরেই কখনো কবিতা, কখনও ছবি আর কিছু কিছু নাটক নিয়ে নড়াচড়া করছি।জোনাকি না প্রজাপতি হব তখনও জানি না।শুধু জানতাম এ জীবন আমার নয়।এ পরবাসে আমি থাকব না।আমি নিজভূমে যাব।হায়!মিলন হবে কতোদিনে......? 
নিশিদিন ভরসা রাখিস......
অধ্যাপনা(অতিথি)করার জন্যে কলকাতার শিল্প ছেড়ে ছুটে ছিলাম শান্তিনিকেতনে। যাওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই যদিও কোনও কোনও আমার অতি হিতাকাংখী বিষয়টাকে প্রলম্বিত করে যাওয়াটাকেই আটকে দিতে চেয়েছিল।কিন্তু আমি যে তার আগেই শুনেছিলাম তার গান...... ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে/ওরে মন হবেই হবে।/যদি পণ করেই থাকিস সে পণ যে তোর রবেই রবে......।ওরে মন......’।
পৌষ মেলার ভাঙা হাটে যখন বউ মেয়ে নিয়ে পৌছলাম আচম্বিতে হাতে এলো কাংখিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যা ইস্যু হয়েও কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না কেউ।সেই তিনিই লেটার হাতে ধরিয়ে আমার বউ মেয়েকে ভাঙা মেলার বাসি জিলিপি খাইয়ে বলেছিলেন-“সলিল এলে যখন ভবনে আমার হাতটাকে শক্ত কোরো” তার উত্তরে আমি বলেছিলাম-‘ভাই গো আমার হাত তো আগেই মুচড়ে ভেঙে দিয়েছ। এখন এই ভাঙা হাতে তোমার হাত কী করে শক্ত করি ভাই’?তার পর থেকে প্রতি ভোরে শুরু হোলো যুদ্ধ......ছেলেদের পড়ায় মন বসানো।সাকসেসফুল হলাম কিন্তু তেনাদের মন জোগানোর কাজটা পারলাম্না সেই হেতু তাড়া খাওয়ার বীজটা নিজেই পুতলাম।তাতে জল ঢাললাম নিজেই ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নানান প্রযোজনার কাজ করে। কে যে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?ভুল বললাম সেই কোন শৈশব থেকেই পায়ের তলায় পড়েছিল সরষে আর হাতের তালুতে হাতুড়ি-বাটালি-তুলি।শীতের ভোরে শালবীথি দিয়ে চলার কালে পাঠ ভবনের ছেলে-মেয়েদের দেখতে দেখতে ভাবতাম আমার শৈশব যদি এমন হোতো?কলা-ভবনের চীনা বটের বেদিতে বসে ভেবেছি এখানে কি আমার এই ভাবেই আসার ছিল?
আগে যখন এসেছি বর্ষা কি বসন্তে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে কাজ করতে দেখেছি। কিংকরদাকে দেখেছি।শান্তিদেব ঘোষ কে নাচতে গাইতে দেখেছি।কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেলা স্বরে আর নিলীমা সেনের কন্ঠের আবিলতায় আবিষ্ট হয়েছি ঠিকই কিন্তু কলকাতার কাজ ছেড়ে এখানে আসব এমনটা মনে জাগেনি।ভাগ্যিস মনে হয়নি তাহলে তো এতদিনে ভবনের শতাব্দ প্রাচীন জামগাছের মতো মৌরসীপাট্টার শিকড় গেড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আশ্রমিক হয়ে যেতাম।তালধ্বজের তাল গাছের মতো এক ঠ্যাংয়ে খাড়া থাকতাম হয়তো কিন্তু সে তাল গোরুতেও চিবোত না।সে সময় গোয়াল পাড়ার গোরু আর ধোপাদের গাধার মতো চরে বেড়াতাম পায়ে হেঁটে কি সাইকেলে ভুবন ডাঙা থেকে পারুল ডাঙা।ওখানকার ভূমিপুত্রদের জমি ছলে-বলে-কৌশলে হস্তগত করে বাড়ির নাম রাখতাম “ছল-চাতুরী” কি “ছত্রছায়া”।আমার মেয়ে পড়ত ওখানেই। আমার ছেলে প্রতিভা হয়ে জন্ম নিয়ে নিষিদ্ধ নেশায় ডুবে ভুবন ডাঙাকেই ভাবত বিশ্ব ভুবন।আমার স্ত্রী বছরে একবার সখের থিয়েটার করত নয়ত নৃত্যশ্রী হয়ে খুন্তি নাড়ত আর হনুমান তাড়াত।মেয়ের নাম রাখতাম ‘বনবীথি’ ছেলের নাম ‘পুণ্যবান’ আর স্ত্রীকে আদর করে ডাকতাম ‘মেঘমালিকা’।অহো কী সুখের জীবন!যে জীবন আমার নয়।তাই ‘না’য়ের খাতায় নাম লিখিয়ে নানান নায়ে পাল তুলে কাজ করলাম ইচ্ছে মতো।
গ্রীষ্মের দাব দাহে সবাই যখন ছুটি কাটাতে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে শান্তিতে কলকাতার বাসায় ফেরেন আমি তখন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রোডিউসারের টাকায় ‘অনার কিলিং’ ছোট ছবি বানালাম।সাংবাদিক ভাইয়েরা সে সংবাদ প্রকাশ করলেন। আমি বেশ কিছু শত্রু বানিয়ে ফেললাম ট্রাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রিয়ের মতো।কলা ভবনের চাতালে স্ক্রিনিং হোলো আমার দুটি ছোটো ছবি ‘অনার কিলিং’আর ‘লিটিল এঞ্জেল’ কলা ভবনের অধ্যাপক বন্ধু ও ছাত্র-ছাত্রীদের সৌজন্যে।মানিদার মতো শিল্পী স্থির হয়ে বসে দেখলেন।আরো কিছু শত্রু প্যানেলে নাম লেখালেন।কাজের ফিরিস্তি দেবার বাসনায় বলছি না।থেমে না থাকার গোয়ারতুমির কথা কবুল করছি মাত্র।
এক শীতে বকখালি,ফ্রেজারগঞ্জ,হেনরি আইল্যান্ড গিয়ে বানালাম ‘লিটিল মারমেড’ তার জন্যে কথাকলি নৃত্যের মুকুন্দন কে তুলে নিয়ে গেলাম।মুকুন্দন বিনা পারিশ্রমিকে কি অপূর্ব কাজটা করেছিল।এই শান্তিনিকেতনেই জন্ম হোলো আমার সন্তান “পোস্টমর্টেম পারফরমেন্সে”র......... ‘ভাতজোছনা’, ‘উৎসারিত বর্ণমালা’,‘অজাতক’,‘অজহলিংগ’, ‘চর্যাশ্রম’.........হায় কাকে দোষ দেব!আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। শান্তিনিকেতনের বহু মানুষ আমাকে আপন করে নিলেন।শান্তিনিকেতনের কিছু ‘রাবীন্দ্রিক মুটে’ আমাকে আপন না করার পণ নিয়ে দিন-রাত না ঘুমিয়ে ফলপট্টি আর ফার্স্ট গেটে প্ল্যান কষতে থাকল।আমি তখন দিনের শেষে খুদ-কুড়ো খেয়ে পরম তৃপ্তিতে নিদ্রা যেতাম।

শৈশবে শান্তিনিকেতন ছিল আমার স্বপ্ন।যৌবনে ছিল দূরের পথিক আর এই পড়ন্তবেলায় শান্তিনিকেতন হোলো অন্যের দুরারোগ্য ব্যধি চিকিৎসার স্যানেটোরিয়াম যেখানে আমি ওয়ার্ডবয়।    
কেবলই স্বপন করেছি বপন......
“বহুদিনের সাধ ছিল, তাই কইতে কথা বাধছিল/দুয়ার খুলে দেখিনি ওই একটি পরমাদ ছিল” শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পংক্তিগুলো বড়ো বেশি মিশে ছিল ধুলো খেলার ছত্রে ছত্রেস্কুলে পড়ার সময় যারা বাসে কি সাইকেলে চড়ে তমলুকের কলেজে পড়তে যেত তাদের দেখে আমার কী যে উদাস হতো মন।পরে নিজে যখন পড়তে গেলাম আর এক উদাসপনা খেলে বেড়াতে থাকল।বাড়ির থেকে বাসে চড়ে শিরীষতলায়(কোর্ট চত্বর)নামতাম।হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যেতে গিয়ে ‘বার লাইব্রেরি’ পেরিয়ে, শহীদ মাতঙ্গিনীর রক্তাত শরীরটা(যেখানে উনি লুটিয়ে পড়েছিলেন)সম্ভ্রমে পাশে রেখে ক্লান্ত মনে যখন ক্লাস রুমে ঢুকতাম ফ্যানের তোবড়ানো ব্লেডগুলো আমার হয়ে ঘ্যাসঘ্যাস শব্দ করে চলেছে এক টানা।এক স্কেলে এক টানা মাত্র কয়েকটি স্বরের ওঠানামায় স্ট্যাটিস্টিক্সের লেকচার আমার কাছে তখন গ্রীক কিম্বা হিব্রু।চাহিদা ও জোগানের অর্থনীতির অর্থহীন পাঠক্রম আমার কাছ থেকে চাইছে ছুটি।
আমি এক ছুটে পালিয়ে যেতাম পিছনের রূপনারায়ণ নদের কাছে।সেখানে কেউ নেই শুধু জলের জোয়ার ভাটা,গাংশালিখ আর কাদাখোঁচাদের মাছ খুঁজে বেড়ানো।আবার ফিরে আসা ক্লাস রুমে।আবার জোর করে মন বসানো রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে নিম্নমানের নাটক ‘রাজা ও রানি’তে......সেখান থেকে ছুটকারা মিললেই একছুটে দল বেধে ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনির ‘রাজাজানি’ কি ডিম্পল কাপাডিয়ার ‘ববি’।এগুলো হিন্দি সিনেমা তাই দেখতে হোলে ছুটতে হতো ‘চলন্তিকা’য় আর বাংলা ছবির জন্যে ‘রূপশ্রী’।‘ববি’ দেখেছি কতবার গুনে রাখিনি।বন্ধুদের অনুরোধ রাখতে বাংলা ‘বই’ দেখেছি কয়েক’শ তাও মনে রাখার প্রয়োজন আছে কী?
আমাদের সিনেমা দেখা শুরু হয়েছিল স্কুলের মাঠে কি পাড়ার ক্লাবে ফিল্ম ডিভিসন-এর সৌজন্যে।“পথের পাঁচালি” প্রথম দেখেছি ওইখানে।একটা করে রীল শেষ হয় আর ফিলামেন্ট বাল্ব জ্বলে উঠে সব মায়া কাটিয়ে রীল গোটানো শেষ করে আবার একটা রীল......।যত বিখ্যাত খেলার তথ্যচিত্র...... পেলে,ইউসোবিও,পতৌদি,ব্র্যাডম্যান...... নাদিয়া কিমোনোভিচ-এর প্রথম জিমন্যাস্টিকে দশে দশ, সের্গেই বুবকার পোল ভল্টে আকাশ ছোঁয়া আরো কত। ইউরি গ্যাগারিন আর লাকিকে দেখেছি।আফ্রিকার অরণ্যে ব্যাং কে দেখেছি মস্ত সাপ খেতে। অ্যানাকোন্ডা দেখেছি ঘাষের মাঠে বসেই। ওলিম্পিকের খেলা দেখেছি চটের উপর পা ছড়িয়ে আধভাজা বাদামের আধকাঁচা দানা চিবোতে চিবোতে।
এসব আমার শৈশবের দিনযাপন।তখন তো এমন বড় হইনি যে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখব!ইচ্ছে খুশি সিনেমা দেখা শুরু হলো কলেজে ওঠার পরে।ইন্টারভ্যালে বেরিয়ে রঙিন শরবত কি লস্যি আর সিনেমা শেষ-এ মিষ্টিপাতা পান যাবতীয় মশলা সহযোগে খাওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক।ওটাই যে ছিল প্রাপ্তবয়স্ক হবার প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু ভালো সিনেমা কটাই বা আসত?আর এলেও থাকতই বা কদিন?তাই তপন সিংহ,মৃণাল সেন আর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা এলেই প্রথম দিনেই ছুটতাম।তরুণ মজুমদারের ছবি দেখেছি ভুরি ভুরি।দীনেন গুপ্তের ছবিও দেখেছি অনেক।পরে যখন এদের সংগে কাজ করেছি কি ইন্টারভিউ নিয়েছি শুরুতেই একটু স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়তাম।
একবার দীনেনদার সংগে কাজ করার সুযোগ এলো।আমার বন্ধু রাজা সেন(তখন নিয়মিত রাজার সব কাজের চিত্রনাট্য সংলাপ লিখছি)আমাকে ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলল ফোন করতে।এই কথার আগে একটা কথা বলা ভালো কাহিনি আছে।যখন টেলিভিশন বলতে কেবল দূরদরশন সেই সময় বাংলায় একটি প্রাইভেট চ্যানেল এলো। তারা বাংলার ক্লাসিক নিয়ে কাজের জন্যে রাজাকে আমন্ত্রণ জানালো।স্থির হলো শংকরের কালজয়ী উপন্যাস ‘চৌরংগী’ নিয়ে কাজ হবে।আমি আর রাজা ছুটলাম এস্প্ল্যানেডের ভিক্টোরিয়া হাউসে লেখকের সংগে দেখা করতে।উনি তখন ওখানকার পাব্লিক রিলেশন অফিসার।এক বিশাল ঘরের এক প্রান্তে বিশাল টেবিলের মাঝখানে রাখা এক রিভলবিং চেয়ারে বসে আছেন ‘কত অজানারে’, ‘ঘরের মধ্যে ঘর’, ‘এক ব্যাগ শংকর’ সবচেয়ে বড় কথা আমাদের প্রয়োজনের চৌরংগীর লেখক তখন আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।বসতে না বসতেই সুদৃশ্য পিরিচ পেয়ালায় সুগন্ধী চা এলো।উনি সম্মতি দিতে রাজি এক বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে।টেলিভিশন নিয়ে অনেক কথা হোলো।আমরা টাকার অংক মাথায় নিয়ে উঠে এলাম।কাজটা হোলো না। টাকার অংকে চৌরংগী কেনা গেল না।আমার চিত্রনাট্য হয়ে গেছে অনেকটাই।তাতে কি?আমার সারাজীবনে এমন অনেক সন্তানের জন্ম দিয়েছি যারা আজও আতুড় ঘরে গোঙাচ্ছে।কিম্বা ইনকিউবেটরে তা নিচ্ছে।‘সিরাজ-উদ-দৌল্লা’ তেমনি এক তথ্যনাটক চৌরংগী তেমনি এক চিত্রনাট্য।
তখন আমার আর রাজার প্রতিদিন সকালে চায়ের মগ হাতে ল্যান্ডফোনে কথা হোতো। একদিন রাজা বললে চ্যানেল দীনেন গুপ্তকে কাজটা দিয়েছে।দীনেনদা তাই রাজাকে ফোন করেন।রাজা আমার কথা বলেছেন দীনেনদাকে।আমি ফোন করে একদিন ওনার কথা মত নারকেল ডাঙায় অরোরা স্টুডিয়োয় হাজির হলাম।সেখানে তিরিশ পয়ত্রিশ কিলোগ্রামের ভারী ক্যামেরা চালাচ্ছেন নিজেই।শটের মাঝে এক পলক আমার দিকে তাকালেন।প্রোডাক্সনকে একটা চেয়ার দিতে বল্লেন।কাজের মাঝে মাঝে কথা হোলো।কী জানি আমার সংগে কথা বলে ওনার কী মনে হোলো উনি আমাকে গলফ গ্রীনের বাড়িতে ডাকলেন।চিত্রনাট্য পড়লেন।খুশি হলেন।চোখ তুলে বল্লেন-“এতোদিন কোথায় ছিলে?তোমরা ইন্ডাস্ট্রিতে আসোনা কেন?”নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে নিয়ে ছুটলেন স্ক্রিপ্ট ফটো কপি করতে।আমি সত্যি বলতে এমন ভদ্রলোক পরিচালক ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেছি তবে খুব সামান্য।এ কাজটাও হোলো না।টাকায় পোষালো না। একদিন আক্ষেপ করে বললেন-“সলিল আর কাজের পরিস্থিতি নেই” তারপরে যে কথাটা বল্লেন-“আমি আজো পরিচালনার থেকেও ক্যামেরা চালাতেই বেশি ভালোবাসি। তুমি কোন দিন যদি কাজ করো আমি তোমার ক্যামেরার কাজ করব”।হতভাগা আমি।যখন পরিচালনার কাজ শুরু করলাম দীনেনদা তার কয়েক মাস আগেই আচমকা ‘কাট’ বলে জীবনে ‘প্যাক আপ’ করে চলে গেলেন।আমার কলেজ জীবনের ‘বসন্ত বিলাপে’র পরিচালক ‘অযান্ত্রিক’এর চিত্রগ্রাহক অকারণে ফ্রেম হয়ে গেলেন।আমার প্রিয় মানুষদের আমি বহুবার এইভাবে হারিয়েছি যেমন আবার আচম্বিতে ফিরেও পেয়েছি।তাদের কেউ কেউ আজও রয়েছেন।
আমার প্রিয় নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা সেন,সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়,সন্ধ্যা রায়,মাধবী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেনদুই সেন ছাড়া বাকি তিন জনের সংগেই পরে কাজ করেছি। যার মধ্যে সাবুদি(সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়)আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।মঞ্চ,চলচ্চিত্র, টেলিভিশন তিন মাধ্যমেই আমি তাকে কাছে পাবার মতো ভাগ্যবান।সাবুদির আতিথেয়তা যিনি না পেয়েছেন তিনি বা তারা অভাগা।আমার এই জীবনের কথা আর এক সময় বলব যার মধ্যে সুখ-বেদনা-হতাশা-উত্তেজনা সব মিলে মিশে আছে।
আমার এ জীবনেও সুখ-বেদনা-হতাশা-উত্তেজনা ছিল তবে হতাশা মাঝে মাঝেই আমার ঘরে বসত করত।সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরে মনে হোতো এ আমি কী করছি?এ জীবন আমার নয়।আমি সিনেমা হাউসে যাবার পথে একদিন বই কেনার অছিলায় ‘রিডার্স কর্ণার’ এ ঢুকে পড়লাম।এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে ঝুপ করে দুটো বই কিনে ফেললাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ আর ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি এক পোস্টম্যান’কবিতার বই কিনছি দেখে মালিক কি খুশি। আমি কে,কী করি,কেন বই ভালোবাসি জানতে চাইলেন।আমি তো এটাই চাইছিলাম। আলাপ যখন উঠল জমে আমি সুড়ুৎ করে বলে বসলাম-আমার তো পয়সা নেই।আমি যদি আপনার দোকানের এক কোণে বসে বই পড়ি কিছুক্ষণ আপনি অনুমতি দেবেন?কী আশ্চর্য উনি রাজি হয়ে গেলেন আর আমারও হিল্লে হয়ে গেল।ক্বচিৎ কখনও দুটাকা চারটাকার বই কিনি আর ঘন্টার পর ঘন্টা নিত্য নতুন সদ্য প্রকাশিত বই পড়ি।এক সময় আমার কলেজের ক্লাস রুম হয়ে গেল ‘রিডার্স কর্ণার’
বাড়ির আলমারি লাইব্রেরি কবেই শেষ করেছি।এবার বইয়ের দোকান।তমলুক টাউন লাইব্রেরি ছিল,সেখানেও যেতাম কিন্তু মন ভরত না।কুমোরগঞ্জ-এ জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজে যা সংগ্রহ ছিল তাও শেষ করে ফেলেছিলাম।ওখানেই সন্ধান পাই ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’-র।অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ওই বক্তৃতা রবীন্দ্রনাথ শুনেছিলেন মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন শ্রোতার সংগে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সেনেট হলে। আর আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে চললাম লাইব্রেরিয়ান জন্মেজয় বাবুর একলা পাঠাগারে। জন্মেজয়বাবু ছিলেন সংসারী মানুষ আবার পড়ার নেশা।আমাকে পেয়ে বি এ পাশ করার ইচ্ছে জাগল।আমি তখন এক্সাম দেব আর ওনাকেও এক্সামের জন্যে প্রস্তুত করতে থাকলাম।আজ বলতে দ্বিধা নেই অনেক বছর ধরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছি কিন্তু ওনার মতো এমন সিনিয়র বাধ্য ছাত্র পাইনি।খুব ভালোভাবেই উনি পাশ করেছিলেন পার্ট ওয়ান ও পার্ট টু।একটা কথা আজ বুঝতে পারি বাংলার গ্রাম-গঞ্জের নিভৃতে কত যে সিরিয়াস পাঠিকা-পাঠক রয়েছে যারা কোনও দেখন্দারি না করেই জ্ঞান অর্জন করে চলে।এমন ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে বহুবার।

বাগবাজারে গংগার ধারে একটা বাড়িতে শ্যুটিং ছিল।সৌমিত্রদা করছেন গিরিশ ঘোষ। কাজের অবসরে কবিতার কথা উঠল।তারও একটা কারণ ছিল।সৌমিত্রদাকে চরিত্রের কারণেই গৈরিশ ছন্দের কবিতা মুখস্থ করতে হচ্ছিল।সৌমিত্রদা কি অসম্ভব মনযোগী হয়ে মুহুর্তে আয়ত্ত করে ফেলে স্ক্রিপ্টের পাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে বলে যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় আমি বললাম –‘দাদা আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে” বেরোতেই কিনে পড়েছি’।উনি স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ না তুলেই বল্লেন-‘ও’।আমি বললাম –প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়।লাল রংয়ের উপর কালো কালিতে ক্যালিগ্রাফি।এবার উনি চমকে স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ তুলে-“সে তো কবেকার কথা!আপনার মনে আছে?” উনি সবাইকেই আপনি সম্বোধন করেন।–“কোথায় কিনেছিলেন?” বললাম-‘তমলুকে।চার টাকা দিয়ে রীডার্স কর্ণারে।’আরো বললাম আপনার ও নির্মাল্যবাবুর সম্পাদনায় “এক্ষণ” নিয়মিত পড়েছি।বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ আপনাদের পত্রিকায় প্রথম পড়া......।আমি বলে চলেছি......।উনি উদাস হয়ে ঘরের দেওয়াল জানালা ছাড়িয়ে নদির দিকে তাকিয়ে তখন।নাকি উনি তখন এ শহর,এ কোলাহল থেকে অনেক দূরের কবিতার জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?     
স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন
আমাদের সময়ে আজকের কালের মতো রেজাল্ট কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবত না।যারা ভালো রেজাল্ট করত কি ফেল করত সবাই স্কুলের শিক্ষাকেই যথেষ্ট মনে করত।বাবা-মাও পয়সা থাকলেও ছেলের পিছনে(মেয়ের পিছনে টাকা খরচ সে তো বিয়ের সময়)টাকা খরচ অহেতুক ভাবতেন।তাহলে স্কুলের মাস্টাররা কী করালেন?আর স্কুলের টিচাররাও সের(ক)ম মনে করলে সেই সেই ছেলেদের বাড়িতে ডেকে আলাদা করে পড়াতেন বিনি পয়সায়।এখন এক একটি ছাত্র বা ছাত্রী পিছু এক একটি সাব্জেক্টে এক থেকে দু-জন শিক্ষক বাধ্যতামুলক।তা বাদে টিউটোরিয়াল হোম।আচ্ছা তাহলে স্কুলে কি পড়ানো হয়?কী পড়ানো হয়?আর ছেলে মেয়েরাই বা এতো পড়াশোনা মগজে রাখছে কী করে?এখন শুনেছি ‘আই কিউ’ বেড়েছে।বেচারা রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন,ডারউইন আর অমর্ত্য সেন।
আমাদের কালে থার্ড ডিভিসনে পাশ করে ডাক্তারি পড়া যেত।ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হতে আলাদা সাধের প্রয়োজন হোতো সাধ্যের নয়।এখন জয়েন্ট এক্সাম দিতে হয়।তার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষন নিতে হয়।বিশেষ টোকাটুকিও শিখতে হয়।
টোকাটুকির টেকনোলজিটা এখন যেভাবে উন্নত হয়েছে আমাদের কালে সে রকম ছিল না।তখন থিন এরারুট বিস্কুট,জাপানি পাখার স্টাইলে টুক্লি,গ্রামে-গঞ্জে শালপাতা-বটপাতা আর সারা বাঙলায় মেয়েদের শাড়ির ভাঁজ,শীতকাল হলে অতিরিক্ত সুবিধা শীতের রাপার(নক্সা কাটা হোক নাই হোক)।সাতের দশকে তার সংগে যোগ হয়েছিল (ছেলে হলে)টেবিলে একটা মস্ত ছোরা গেঁথে রাখা আর(মেয়ে হলে)টেবিলে ঝুঁকে পড়ে লেখা যাতে মাস্টারমশায়ের চিত্তে চাঞ্চল্য জাগে।এর মধ্যে আমার মতো ক্যাবলাদের আর যথার্থ ভালো ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়াটা যে কী কঠিন কাজ ছিল ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
আমি উচ্চ-মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছিলাম বাহাত্তরের উত্তাল সময়ে।তখন দেশজুড়ে গণ-এর কাল।গণহত্যা,গণকৃষ্টি পাশাপাশি গণচেতনা,গণনাট্য আন্দোলন,নবনাট্য ধারা।তখনও গণপিটুনি,গণধর্ষণ,গণ-দলদাস প্রক্রিয়া চালু হয়নি।যদিও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রহসন চালু হয়ে গেছে।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন “ছেলে গেছে বনে”,কবি শংখ ঘোষ লিখছেন “হাস পাতালে বলির বাজনা”সমর সেন “ফ্রন্টিয়ার” পত্রিকা প্রকাশ করছেন ইংরাজিতে কিন্তু কবিতা লেখায় চরম অনীহা তার।এর মাঝে সরোজ দত্ত উধাও হয়ে গেলেন এক উত্তম ভোরে।কবি বিষ্ণু দে লিখছেন “এ অন্ধকারে কী দেখ সুরঙ্গমা”।এনকাউন্টারে নিহত লাশ পাচার হচ্ছে রাতের অন্ধকারে।মকবুল ফিদা হুসেন ভারত মাতারূপী ইন্দিরা গান্ধি।কলকাতার যুব নেতারা তাকে বলছেন “এশিয়ার মুক্তিসূর্য”দেওয়ালে দেওয়ালে “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” কিম্বা ভুল বানানে বন্দুকের নল থেকে ক্ষমতা বেড়িয়ে আসছে।
তখন মুখে মুখে চারমিনার,মূর্তিতে আলকাতরা কি হাতুড়ির ঘা।স্লোগানে চারু মজুমদার।সারা বাংলা তখন নকশাল বাড়ি,সারা দেশ তখন ডেবরা,গোপীবল্লভপুর আর শ্রীকাকুলাম।সকালে “যুগান্তর”, “অমৃত বাজার পত্রিকা”, “আনন্দ বাজার পত্রিকা” “স্টেটসম্যান” আর “কালান্তর”।সন্ধ্যেবেলা “গণশক্তি”হাতে হাতে “দেশহিতৈষি”।চুপিচুপি “দেশব্রতী”।
যে ভিখিরিপতি গ্রামে এতোদিন দিনে রাতে মিটিং করেছেন অজয় মুখার্জি কি বিশ্বনাথ  মুখার্জি এখন সেখানেই নাকি হঠাৎ হঠাৎ আসছেন সন্তোষ রাণা কি কানু সান্যাল। কতোটা সত্যি কতোটা অতিরঞ্জন কেউ জানে না।যারা জানে তারা গোপন আস্তানায়গুজব ছড়াচ্ছে আগুনের চেয়েও দ্রুত গতিতে।ঠিক যেমন পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই ওই ভিখিরিপতি গ্রামে চলে এলো উচ্চ-মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র।মুখে মুখে সারা পাড়া,সারা গ্রাম রটে গেল সেই বার্তা।আর আমরাও পড়া ছেড়ে সব্বাই ছুটে বেড়ালাম সেই গুজবের পিছন পিছন।কেউ দেখেনি,শুধু শুনেছে।
সত্যি বলতে কি আমি একটু কম ছুটেছিলাম কারণ আমি নিশ্চিত জানতাম এই উচ্চ মাধ্যমিক আমার শেষ পরীক্ষা।এই আমার শেষ পড়াশোনা।পরীক্ষার শেষ হতেই আমার গলা ধরে গেল, পড়ে নয় আর পড়তে হবে না এই আনন্দে।আমার যে তখন আর্ট কলেজে যাবার সব প্রস্তুতি সারা।তখন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে পড়াতেন আমাদের গ্রামের বিনয়(ঘোষ)জেঠু।তিনি আমার ছবি আঁকা দেখে বাবাকে এই প্রস্তাব দিলেন।বাবা নিমরাজি।আমি নিয়মিত বিনয় জেঠুর বাড়ি যাচ্ছি,শিখছি,ভুল শুধরে নিচ্ছি.........কিন্তু বিধাতা(!)যে তখন অলক্ষ্যে হাসিতেছেন কে জানত?কাগজে ভর্তির বিজ্ঞাপন বেরোতেই সক্কাল সক্কাল হাতে পেপার কাটিং নিয়ে বিনয়জেঠু হাজির। বাবা বল্লে –“হবেনা বিনয়দা,এতোবড় সংসারে এতো ছেলের পড়াশোনার খরচ সাম্লে ওর খরচ কুলিয়ে উঠতে পারব না”।বিনয়জেঠু চা না খেয়ে হাতে কাগজের টুকরোটা নিয়ে বিড়বিড় করে “ভুল করলে নিরঞ্জন,বড়ো ভুল করলে” বলতে বলতে ফিরে গেলেনআমি ভর্তি হয়ে গেলাম মান্তুদি,শংকরীদার তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ে।বিষয় নিতে বাধ্য হলাম ইকনমিক্স-এ অনার্স।

যারা চির-উন্মাদ তারা কি নতুন করে পাগল হয়?শংকরীদা ভুল করেছিল। যারা চির-প্রেমিক তারা কি প্রেমে ঘা খেলে আত্মহত্যা করে?আমি মান্তুদির মতো তাই সুইসাইড করলাম নাআমি পালিয়ে বাঁচতেও চাইলাম না।পালিয়ে বাঁচা যায় না।আমি তাই কিছুদিনের জন্যে ওই ভিখিরিপতি গ্রামের বৃক্ষ-লতায় গুটিপোকা হয়ে গেলাম।
আমার জন্মের কোনও শেষ নেই......।
আমার শৈশব ভিখিরিপতির যে বাড়িতে কেটেছে সেখানে বারো মাসে তেরো পাব্বন যেমন লেগেই থাকত তার অনুষঙ্গে তেত্রিশ কোটি না হলেও তেত্রিশের বেশিই দেব-দেবীর পুজো আচ্চা হতো সম্বচ্ছর।কবুল করতে দ্বিধা নেই আমি সে সময় সেই সব দেব ও বিশেষ করে দেবীদের স্মরণ না করে জলস্পর্শ করতাম না।উপবাস করার আমার অভ্যাস ছিল।পরে অভাবের কারণে উপবাস করেছি।তারও পরে স্বভাব কৌতুহলে বাংলাদেশে থাকাকালীন রোজাও রেখেছি।আমার উপবাস আজও ঘোচেনি যদিও তার ভিন্ন রূপ।নাস্তিক তকমা পাবার পরে বুঝেছি উপবাসের একটা নেশাও থাকে।আমার এক ভ্রাতৃপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক একবার আমাকে বলেছিল “সলিলদা আপনি তো প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্ট আর আমি কয়েক প্রজন্মের” সত্যি বলতে কি কমিউনিস্টদেরও যে বংশগরিমা থাকতে হয় ও আছে সেটা বাংলায় না জন্মালে বুঝতেই পারতাম না।কায়েত-বদ্যি-বাউন(বামুন)রাই যে জাত কমিউনিস্ট,বাকি সব এলেবেলে সে ধারা আজও বহমান।আবার এইসব ব্র্যান্ডেড কমিউনিস্টরা যে মা বউয়ের দোহাই দিয়ে পুজোর পরের স্নান জল পান আর প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকাতে দ্বিধা করেন না তাও কম দেখলাম কোথায়?এমনকি অতি বামপন্থীদের শক্তির প্রতি ভক্তি(কালী মা থেকে কালীমাতা ধেনো)সেকাল থেকে একালেও বিরাজমান।আমার আবার নাস্তিক হবার পরে দেব-দ্বিজে ভক্তি উধাও হলেও এক ঠাকুর গুরুদেবের প্রতি ভক্তি ও নিষ্ঠা কিছুতেই কাটল না।
কবি বিষ্ণু দের ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?’ পড়ার পরেও শৈশবের ওই দিনটা আমার কাছে বিশেষ অর্থবহ ছিল।আগেই লিখেছি জ্যাঠাবাবুর দৌলতে সারা বছর আমরা রবি ঠাকুরের সাধনায় মগ্ন থাকতাম।যে কোনও কথায় তার কবিতা আর গান চলে আসত আমাদের আলোচনায়।তাই সেদিন ভোরে বৈঠকখানায় টাঙানো তার ছবিটা নামিয়ে ভালো করে ধুয়ে মুছে চন্দন পরিয়ে একটা জলচৌকির উপর সাদা চাদর পেতে তাতে রাখা হতো তাঁকে।বৈশাখের ভোরে ফোটা জুঁই-বেলি-টগর -রজনীগন্ধা দিয়ে দিদিরা মস্ত বড়ো গোড়ের মালা গেঁথে পরিয়ে দিত তাঁর গলায়। আমরা গোল করে ছবি ঘিরে বসতাম।কবিতা আবৃত্তি করতাম,গান গাইতাম এমনকি প্রবন্ধও পাঠ করা হোতো।জোড়াসাঁকো নয় যেন এই ভিখিরিপতি গ্রামটাই ছিল তাঁর জন্মভূমি।একবার আমরা সকালে নয় সন্ধ্যেবেলায় অনুষ্ঠান করব ঠিক করলাম। আমাদের সেদিনের বিশেষ গায়ক অতিথি এলেন খেজুরি থেকে।তিনি ছিলেন সাগর সেনের ছাত্র।আর তবলা সংগত করার জন্যে এলেন উস্তাদ কেরামত্তুল্লা খাঁ সাহেবের শিষ্য ত্রম্ব্যক কর।ত্র্যম্বকদা ছিলেন আবার অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য।আমিষ খেতেন না কিন্তু বিস্তর দুধ-ঘি খেতেন।আর খেতেন পান।বাজানোর হাতটি ছিল ভারি সুন্দর। সেদিনের সন্ধ্যা আমার কাছে আর এক পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যার মতোই স্মরণীয়। যেবার জোড়াসাঁকোয় রাতের ঘরোয়া আসরে শুনেছিলাম অমিয়া ঠাকুর,মেনকা ঠাকুর শুভো ঠাকুর আর শৈলেন দাসের গান।তার কিছু পরে শৈলেনদার সংগে আড্ডা দিয়েছি গণনাট্য আর গ্রুপ থিয়েটার দপ্তরে।মুখোমুখি বসে গান শুনেছি কতো।দমদমের মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান হবার পরেও।বলেছিলেন ঘুঘুর বাসা ভাঙবেন।একদিন ঘুঘুর ডিমের সাইজের গুলির দানাগুলো তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে আমাদের বুক ভেঙে দিয়ে চলে গেল।আমার পঁচিশে বৈশাখ সেই থেকে পঁচিশে ডিসেম্বর হয়ে গেল।পরে উপাসনা মন্দিরে যখন খৃস্টোৎসবে শুনেছি “একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে/এযুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি/ঘাতক সৈন্যে ডাকি ‘মারো’ ‘মারো’ ওঠে হাঁকি/গর্জনে মেশে পূজা মন্ত্রের স্বর/মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন ‘হে ঈশ্বর....”(না না শৈলেন দা নাস্তিক ছিলেন।তিনি একাধারে মার্ক্সসিস্ট আর রবীন্দ্র ভক্ত ছিলেন)আমার বার বার মনে হয়েছে আমাদের ছাত্ররা নয় শৈলেন দা গাইছেন।শৈলেন দা ভীষণ আশাবাদী ছিলেন।“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” এটা মনে প্রাণে মান্তেন।কিন্তু শৈলেনদা কারা মানুষ?সেদিন যারা আপনাকে মেরেছিল তারা?আজ যারা শান্তিনিকেতনকে আশ্রমকে গোচারণভূমি করে তুলে গুরুদেবকে নিত্য ঘাষের মতো মুড়িয়ে মেরে চলেছে তারাও মানুষ?এ শহর কলকাতায় ‘রবি ঠাকুর মূর্তি গড়া’ হয়ে রইলেন আর আমার জন্মের গ্রামে রবি ঠাকুর নিত্যসেবার বিগ্রহ ছিলেন না।ছিলেন প্রাণের মানুষ।
বিষ্ণু দে লিখেছিলেন “বড়োতেই দাও যদি ছোটো উপমা......”আমিও এই সুযোগে রবি ঠাকুরের জন্মের কথা বলার অবসরে আমার জন্মের খুড়সিনামা(কুর্সিনামা)টা খুলে বসি।চার অধ্যায় উপন্যাসে অন্তু এলাকে বলছে মানুষের জন্ম হয় জন্মদিনে না জন্মতিথিতে?আমারও সেই দশা।আমার জন্ম ২৯ জ্যৈষ্ঠ সোমবার কিন্তু আমার কখনো জন্মদিন পালন হয়নি।আমাদের পালিত হোতো জন্মতিথি।আমাদের বললাম এই কারণে আমার জন্মের ঠিক সাতদিন আগে জন্মেছিল আমার খুড়তুতো ভাই ছোট্টু।যেহেতু একান্নবর্তী পরিবার তাই পালনটা এক সাথেই হোতো।
সময়টা গরম কাল হলেও আমাদের সামার ভ্যাকেশন হোতো জুন-জুলাই মিলিয়ে।বেশির ভাগ ছেলে চাষির বাড়ি থেকেই আসত তাই ধান চাষের সময়টাকেই গুরুত্ব দেওয়া হোতো।আমাদের জন্মতিথিটা তাই স্কুল খোলা থাকতেই হোতো।স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম সদর পুকুর আর খিড়কি পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছে।সদর পুকুর থেকে বাটা মাছ,রুই মাছ আর চিংড়া(গলদা চিংড়ি)খিড়কি পুকুর থেকে কাতলা মাছ সবার খাবার জন্যে।শুধু বাড়ির লোকই চল্লিশ পঞ্চাশজন এতো মাছ তো লাগবেই।আর দুই সন্তানের পাতে দিতে হবে একটি করে রুই মাছের মাথা।কাতলা মাছের মাথা আর তেল দিয়ে ছ্যাঁছড়া হবে।বাটা মাছ ভাজা সবার পাতে পড়বে।গলদা চিংড়ির মালাইকারিও সবাই পাবে।কী কী থাকত ব্যঞ্জন?
কাঁসার থালা আর গ্লাস বাটিতে ছিলেট(সিলেট)ধানের ভাত,ঘি,শাক ভাজা,আলু ভাজা,পটল ভাজা,বাটা মাছ ভাজা,শুক্তো,ছ্যাঁছড়া,চিঙড়ির মালাইকারি,পোনা মাছের কালিয়া,আলুবক্রার চাটনি,পায়েস আর আম-মাখা সন্দেশ।দুপুরবেলা নেওয়াপাতি ডাবের জল।রাত্রেবেলা লুচি আলুর দম।মুরগির মাংস তো দূরের কথা খাসি বা পাঁঠার মাংস নিষিদ্ধ ছিল শুভকাজে।শেষ কবে এভাবে আমার জন্মতিথি পালিত হয়েছে মনে করতে পারি না।কলকাতায় চলে আসার পর বাবা-মা বেঁচে থাকতেও হয়নি।তখন যে সব টুকরো টুকরো......।ইংরাজি তারিখটা খুঁজে বের করেছিলাম বংগীয় সাহিত্য পরিষদে পঞ্জিকার পাতা ঘেঁটে......১৩ জুন ১৯৫৫।
এখন মন খেরোর খাতায়(ফেসবুক)বহু মানুষ শুভেচ্ছা জানান।কেক-মোম বাতিও পাঠান তারা।আমার দিন কাটে সে সব শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দিয়ে আর নাটক চলচ্চিত্রের কাজে।মেয়ে বউয়ের কাছেও কিছু না কিছু উপহার প্রাপ্তি হয়।পঞ্চ ব্যঞ্জন না হলেও কিছু পদ অপর্ণা নিজের হাতে করে।
শুধু রাত্রিবেলা যখন আমি এসেছিলাম বাইরে মায়ের গর্ভ থেকে ঠিক সেই রাত সাড়ে দশটায় নিজের মধ্যে চিৎকার করে বলি.........আমি এসেছিলাম তোমাদের চাওয়া থেকে কিন্তু আমার যাওয়াটা যেন ইচ্ছামৃত্যু হয়।       


পায়ের চিহ্ণ নিয়ে পড়ে থাকা পথ......
যদিও বাড়ির সামনেই গড়খাই আর গড়খাইয়ের পরেই পাকা সড়ক তবু খোয়া-মোরামের লাল রাস্তা নয়ত এঁটেল মাটির পথেই ছিল আমাদের চলাচল।কোন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন পায়ে চলা পথ হেঁটে এসে আমাদের বাড়ির সামনে বাস রাস্তায় এসে বাস ধরত।কতো রকমের মানুষ তাই আমরা দেখেছি তখন।নতুন জামাই,ফিরে আসা বাড়ির বউ, পালিয়ে যাওয়া ছেলে,হারিয়ে যাওয়া মেয়ে.........ডুবকালুয়া গ্রামের জানাদের বাড়ির একটি মেয়ে একটা করে বিয়ে করত আর কিছুদিন পরেই পালিয়ে আসত।তার কোনও শ্বশুরবাড়িই ঠিক পচ্ছন্দ হোতো না।আমি তার চার থেকে পাঁচবার বিয়ে হতে দেখেছি।ভিতর বাড়ির একজন বারবার চাকরি ছাড়ত সেও ফিরে আসত ওই পথেই।আর নিশুত রাতে ফিরত বাসের ড্রাইভার যতীনদা, মাইতি বাড়ির কানাইদা।কানাইদা পুলিশের জিপ চালিয়ে ছিল কিছুদিন।অনেক রাতে সে অনেক কিছুর সাক্ষী।সে সব ভুলতেই সে রাত্রে নেশায় চুর হয়ে থাকত।তার হাতে ছিল দামি ঘড়ি। অনেকদিনই সেটাকে জমা রেখে সে নেশা করে ফিরত আর সকালে গিয়ে ছাড়িয়ে নিত।যতীনদা ওসব কিছু করত না।নেশা করে বাড়ি ফেরার সময় মোরামের পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলাগাছগুলোকে জড়িয়ে ধরে মান্না দের বিরহের গান গাইত। ওই পথ দিয়ে যাওয়া বা আসার সময় আমাদের বাড়ি থেকে হাঁক উঠত......
-কে?অ্যাতো রাতে কে যায়?
- আজ্ঞে আমি কাঁঠাল।(কাঁঠাল তার পদবি।সে দুধ-ঘি ছানার ব্যবসা করত)বাবু রাত কতো হোলো?
- আট টা।
তখন সবার হাতে ঘড়ি থাকত না।স্কুল মাস্টার মশায় বা ডাক্তার বা অফিসের বাবু ছাড়া খুব একটা ঘড়ি পরতই না।টাকার অভাবে নয়,প্রয়োজন নেই তাই।তারা সময় মাপত দিনেরবেলা সূর্য দিয়ে আর রাতেরবেলা শেয়ালের হাঁকে।তখন চার প্রহরে চারবার শেয়াল ডাকত নিয়ম করে।(সল্টলেকেও আটের দশকে কাশের বনে শেয়ালের ডাক শুনেছি কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল বলে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।তখনো পরিবেশবিদরা অ্যাতো সোচ্চার ছিলেন না।) আর ভোরের বেলা হাঁস-মোরগ।মানুষজন ওই শুনেই ঘুমোতে যেত আর জাগত।ভুল হোতো না।ভুল বললাম......সচরাচর ভুল হোতো না কিন্তু ক্বচিৎ কখনো বিভ্রম হোতো।একবার আশ্বিনের রাত্রে এমন ঘটনা ঘটেছিল।
মেদিনীপুরে পানের চাষ হোতো খুব।ওখান থেকে সারা ভারতে সেই পান যেত।তমলুকে ছিল পানের আড়ৎ।চাষীরা বিকেল বেলা বরজ থেকে পান তুলে একপন দু-পন করে গুনে(পরে শ কিম্বা হাজার)রাত্রে কলাপাতায় মুড়ে ভোর বেলায় আড়তে যেত ভোরের প্রথম বাস ধরে তমলুক শহরে ‘রূপশ্রী’ সিনেমা হলের উল্টোদিকের আড়তে।সেদিন ছিল পূর্ণ জ্যোৎস্না আর আকাশে ছিল ছেঁড়া মেঘ।কাকেরা ভুল করে ভোর হয়েছে ভেবে ডাকাডাকি করে উঠতেই হাটুরেরাও ভোরের বাস ধরতে বেরিয়ে পড়েছিল।তারা যখন মাটির পথ দিয়ে গপ্পো করতে করতে বাস স্ট্যান্ডে আসত আমরাও ঘড়ি দেখতাম। কিন্তু সেদিন শোয়ার পরে পরেই হাটুরেদের কথোপকথনে বিছানা ছেড়ে উঠে হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে বাড়ির দেওয়ালে থাকা সুইস দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে আর কাকেদের ডাকাডাকিতে বুঝেছিলাম এটা কাকজ্যোৎস্নার কারসাজি।আমরা বিছানা ছেড়ে উঠে তাদের ডেকে নিলাম বাড়ির দাওয়ায়।রাত তখন মাত্র বারোটা। তারা বাকি রাত আমাদের সংগে কথা বলে,গল্পো করে কাটিয়ে সত্যি ভোরে ছুটল ভোরের বাস ধরতে।কাকভোর আর কাকজ্যোৎস্না বড়োই মায়াময়।
আমরা কিন্তু ভুল করে নয়,জেনে বুঝেই কতোবার মাঝ রাতে বেরিয়ে পড়েছি পথে। একবার খবর এলো মেচেদা থেকে হলদিয়া যে ন্যাশানাল হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে সেটায় ফাটল ধরেছে।ছুটলাম.......শীতের দুপুরে যারা শুয়োর চরাতে আসত আর আমরা সেই শুয়োরদের চলার পথে গাছের ডাল কি কঞ্চি ফেলে রাখতাম।ওরা ওটা মাড়িয়ে গেলেই ছুট্টে গিয়ে সেটাকে লাউ বা সিমের মাচায় রেখে দেওয়া।ওতে নাকি ফসল ভালো হবে। সেবারে ওনেক শুয়োরের মধ্যে একটা শুয়োর বুনোকচুর বনে কচু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।রাত্রে হিসাব মেলাতে গিয়ে একটা কম পড়াতে শুরু হোলো ছোটাছুটি।শুয়োর ও ছোটে আমরাও ছুটি তাকে ধরতে।গ্রামের সব লোক জুটে গেল শুয়োর ধরতে।এটা ছিল নেহাৎ শুয়োরের গোঁয়ারতুমি আর আমাদের বিনোদন।চোর ধরার জন্যেও আমরা মেঠো পথে ছোটাছুটি করেছি অনেকবার।বিশেষ করে ভজাকে ধরতে আমাদের বিস্তর বেগ পেতে হোতো।কিন্তু ভজা ছিল ব্র্যান্ডেড চোর আর আমরা যে কতোবার আলপথে হাঁটতে হাঁটতে আখের খেত থেকে আখ,শাঁকালুর খেত থেকে শাঁকালু তুলে যাত্রা দেখতে ছুটেছি।কালীপূজার রাত্রে কালীঠাকুর আর ছাগবলি দেখব বলে আলতো শীতে মাঝ রাতে গায়ে কাঁথা কি বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে মেঠোপথে তারার আলোয় এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম ছুটে গেছি ভাই-বোনেরা।অনেক পরে যখন গেয়েছি “তারার আলোর প্রদীপখানি,প্রাণে আমার জ্বালবে আনি/আমার যত কথা ছিল......”আমার শৈশবের স্মৃতি ভেসে উঠেছে।
পৃথক অন্ন হবার আগে তো বটেই পরেও আমরা ভাই-বোনেরা আমাদের রাধাবল্লভ পুরের মামাবাড়িতে দিদিমার কাছে যাব বলে আমরা মাঠ পেরিয়ে,ঘাট পেরিয়ে তিন চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতাম।দিদিমার হাতের পিঠে-পুলি সব্বাই ভালোবাসতো। দিদিমা সবচেয়ে সুন্দর রান্না করতেন নিরামিষ পদ।ছোট্টো রান্নাঘরে কাঠ-পাতা জ্বাল দিয়েই শুক্তো থেকে টক সব কি পরিপাটি করে তৈরি করে পরিবেশন করতেন। শীতকালে দিদিমার হাতের সজনে ফুলের বড়ি দিয়ে তরকারি,বড়ি পোস্ত এমনকি বান মাছের কালিয়া,পাঁকাল মাছের টক......।নিজের হাতে লাগানো সূর্যমুখী লংকা দিয়ে কী সুন্দর আলু ভাতে মাখতেন!আল্টুসি শীতের রোদে মাটির দাওয়ায় বাঁশের পাটায় তেল মাখিয়ে বিউলি ডালের বড়ি দিতেন।থালায় তেল মাখিয়ে তার উপরে ভাজা বড়ি আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় সাজাতেন।আর সাদা কাপড়ে পোস্ত ছড়িয়ে গয়না বড়ি দিতেন।আমরা পাশে বসে এক একটা ডিজাইন বলতাম আর উনি হাসিমুখে সেইরকম গয়না বড়ি তৈরি করতেন। তবে ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলামেশা উনি ভালো চোখে দেখতেন না।আমি আর রিনি সেই নিয়ে ওনাকে খুব ব্যতিব্যস্ত করতাম।আমার মা কিন্তু ছিল তার মায়ের বিপরীত।মা আহামরি কিছু রান্না পারত না।রোগীর পথ্য আর পোরের ভাত বানাত চমৎকার।অসুখ করলে নরম হাতে সেবা করত।পড়ালেখা নিয়ে একটুও বকাবকি করত না।মা কাউকে কখনো মেরেছে দুঃস্ব্পনেও ভাবতে পারিনি। কেউ মাকে অসম্মান কি অপমান করলে মা হেসে উড়িয়ে দিত।আমরা তাই নিয়ে কিছু বল্লে মায়ের যুক্তি ছিল “আমি অপমানিত না হলে আমাকে অপমান করবে কে?”মায়ের মতো এমন আধুনিক নারী আমি খুব কম দেখেছি।মা প্রশ্রয় না দিলে আমার সারাজীবনের চলাচলের পথে এতো রোদ-বৃষ্টির সংগে দ্যাখা হোতো না।এক বার লোডশেডিংয়ের রাত্রে সল্ট লেকে চাঁদ-তারার আলোয় কবিতার লড়াই বসেছিল। বাবা বলে উঠল রবি ঠাকুরের কবিতা।মা বলল স্বরচিত কবিতা-“এখনি উঠিবে চাঁদ নীল গগনে”।আমরা স্তম্ভিত।বাবা কুপোকাৎ......।
আমি মেঠোপথে বৃষ্টিতে হেঁটেছি বহুবার।আমি ধুলো ওড়া শুকনো মাঠে ঝড়ের কাছে নতজানু হয়েছি বহুদিন।আমার কাঙালপনার চিহ্ন আজো হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে ভিখিরিপতির লালসুরকির রাস্তায় কি রাধাবল্লভপুরের বৃষ্টিমাখা কাদা পথে।তখন বৃষ্টির ঝাপ্টায়,উতল হাওয়ায়,কখনো হঠাৎ খুশির ঝোরায় গা ডুবিয়ে ক্ষ্ণণিকের জন্যে হয়তো বা ভুলে থেকেছি মাকে কিন্তু মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই শহর কলকাতার নার্সিং হোমে কিছুদিন কোমায় পড়ে থেকে বোধনের আগে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরে আর কোনদিন মাকে ভুলে থাকিনি।

আমার দীর্ঘশ্বাস দিনে রাতে একবার না একবার আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেবেই –“মা” “মা গো”।   
বসুধৈবকুটুম্বকম্
ছোটোবেলায় জ্যাঠাবাবুর কাছে শুনতাম-“ভূমায় সুখম্ নাল্পে সুখম্ নাস্তি”।বহুতেই সুখ, অল্পে সুখ নাই।তিনি আরো বলতেন –এই পৃথিবীর সবাই আমার আত্মার আত্মীয়,সবাই আমার কুটুম্ব।একটুও অতিরঞ্জন নয়,বাস্তবেও তাই ছিল।
আমাদের বাড়িটা যেহেতু ছিল একান্নবর্তী পরিবার জ্যাঠা-বাবা-কাকা-দাদা-দিদি-ঠাকুমা-ঠাকুরদা-জেঠিমা-খুড়িমা আমরা ভাই বোনেরা মিলে কম্-সে-কম্ তিরিশ পয়ত্রিশজন সদস্য।তা বাদে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো আত্মীয় ও তার পরিবার আর নিয়মিত মাঠে খাঠা মুনীষ।সব মিলিয়ে রোজ দু-বেলা কজন হয়?চার-পাঁচজন বটি নিয়ে বসে গেল আনাজ কুটতে,দু-জন বসল বাটনা বাটতে......হলুদ,লংকা,জিরে, আদা,ধনে আর পোস্ত।আর একজন মস্ত উনুনে মস্ত হাঁড়িতে চার পাঁচ সেরের চাল পুকুরে ধুচুনিতে ধুয়ে এনে বসিয়ে দিত।তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হোত আলু,বেগুন,উচ্ছে কখনো পুঁটলি করে ডাল বাটা,দিদিমা খাবে।দিদিমা বিধবা হবার পর বাড়িতে অনেক নিয়ম কানুন চালু হয়েছিল।আমাদের দিদিমা কিন্তু দিদিমা নয়,ঠাকুমা,বাবার কাকিমা। আমরা দিদিমা বলতাম কেন না আমাদের যে পিসিরা বহুদিন সপরিবারে বাপের বাড়ি থাকত তাদের ছেলেমেয়েরা পিসিমার মা বা কাকিমাকে তো দিদিমাই বলবে?আমরা তাদের ছোটো তাই তাদের শুনে আমরাও দিদিমা বলতাম।কিন্তু আমাদের যারা সত্যিকারের দিদিমা তাদের কী বলা হবে?চালু হোলো ঘরের দিদিমা,মামাবাড়ির দিদিমা,নাগেদের ঠাকুমা,ঘোষেদের ঠাকুমা......।যাদের আমি ঠাকুমা বল্লাম তারা আবার দিদিমাও।কী করে?
কায়েতদের আত্মীয়টা ছিল বড়ো বেশি লতায় পাতায়।আমার ঠাকুমার(বাবার কাকিমা)তিন বোন ওই গ্রামের তিন পরিবারের বউ হয়েছিল।সরকার,ঘোষ,নাগ। নাগেদের ঠাকুমার মেয়ে আমার সেজকাকিমা হয়েছিলেন।আবার আমার মায়ের দূর সম্পর্কের মামার সংগে আমার আপন ছোটোপিসির বিয়ে হয়েছিল কল্যাণপুরে।ছোট পিসেমশায়ের ভাই থাকতেন লক্ষ্ণৌয়ে।তাকে আমরা বলতাম লক্ষ্ণৌয়ের দাদু।ওনার ছিল ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা।উনি যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন সংগে আনতেন নানা রকমের মশলা।তাই দিয়ে বিরিয়ানি,পাঁঠার মাংস,নানা রংয়ের পোলাও বানাতেন আর মায়ের হাতে তৈরি সমুদ্র কাঁকড়ার কালিয়া খেতেন।তার কোনো দাঁত ছিল না।মাড়ি দিয়েই তিনি কড়মড়িয়ে কাঁকড়া চিবোতেন।তার ছিল বিশাল ভুঁড়ি।আমরা ছোটোরা ওই ভুঁড়িতে চড়ে নাচতাম।আমি বড় হয়ে যখন লক্ষ্ণৌ গেছি তখন উনি ছিলেন না কিন্তু ওনার প্রতিপত্তি তখনো বেঁচে ছিল।আমাদের বাড়ির বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে উনি আসতেন কিন্তু রান্নার তদারকি করতেন না।সেটা করতেন ঘোষেদের দাশুজেঠু। দাশুজেঠুর বাড়িতেই প্রথম হেডফোন কানে দিয়ে রেডিয়ো শুনেছি।তখনও ট্র্যাঞ্জিস্টরের আবিষ্কার হয়নি।হলেও আমাদের গ্রামে আসেনি।তখনো কানে হেডফোন দিয়ে একা একা রেডিয়ো শুনতে হোতো।আমাদের বাড়িতে কিন্তু ট্রাঞ্জিস্টর রেডিয়োই এসেছিল।যেটায় সারা পাড়া শুনতে পেত।
দাশু জেঠুর বাড়িতে অনেক পাখি ছিল।মস্ত কাকাতুয়া আর ময়না।আমরা ওই বাড়িতে গেলে কাকাতুয়া জেঠুর কন্ঠ নকল করে জেঠিমাকে ডাকত।“কে এসেছে?””কে?” “কে?” আর ময়না সারাক্ষণ ডাকত –“শংকরী” “শঙ্করী”......।শঙ্করী দাশু জ্যাঠার দত্তক ছেলের নাম।শংকরীদা তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ে পড়তখুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। দেখতেও ছিল সুপুরুষ।সেই শংকরীদা একদিন উন্মাদ হয়ে গেল একটি অহিন্দু মেয়ের জন্যে।বাড়ির লোক সম্পর্কটা মেনে নিতে চায়নি।তারপর থেকে সেই শংকরীদা হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠত।সারা ঘর পায়চারি করত।জেঠিমার কথা ছাড়া আর কারো কথা শুনত না।জেঠিমা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী।অনেকটা অয়েল পেন্টিংয়ের মতো। সারাক্ষণ গলায় মুক্তোর হার ঝুলত।কী আদর করে আমাদের খেতে দিতেন।গাছ,পাখি আর ছেলের যত্ন করতেন।সেই জেঠিমা অনেক ক্লেশ আর কষ্ট চেপে রেখে পাগল ছেলে আর রাশভারী নিঃস্ব দাশুজ্যাঠাকে রেখে মারা গিয়েছিলেন।একেও কি স্বাভাবিক প্রয়াণ বলে?
দাশু জ্যাঠা আমাদের কেউ ছিলেন না।কালোকাকাও আমাদের কেউ ছিলেন কী?কিন্তু এরা বাবার বন্ধু ছিলেন।আমাদের পরিবারের সুখে,দুঃখে এরা পাশে থাকতেন।দাশুজ্যাঠা কারো বাড়িতে খেতেন না।জেঠিমা আসতেন।একটা দামি শাড়ী কি অলংকার উপহার নিয়ে।দাশুজ্যাঠার শখ ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরার।বিশাল ডোরের হুইল ছিপ ছিল কয়েকটা।(আমার বাবারও ছিল)যে পুকুরে মাছ ধরতেন সেই বাড়ির মানুষ জ্যাঠাকে সবচেয়ে বড়ো মাছটা দিয়ে দিত।ওটাই যে ছিল দস্তুর।আর সম্পর্কও ছিল আষ্ঠে পৃষ্ঠে বাঁধা।না হলে আমার আপন পিসতুতো দাদার সংগে কখনো আমার আপন মাসতুতো দিদির বিয়ে হয়?আমার দুই মাসির বিয়ে হয়েছিল সেনেদের বাড়ির দুই ছেলের সংগে। আমি আমার পিসিদের বিয়ে দেখিনি কিন্তু আমার ছোটো কাকা,রাঙা কাকা আর ছোটো মাসির বিয়ে দেখেছি।
আমার এই দুই মেসোমশায় চাকরির জন্যে থাকতেন পাইকপাড়ায়।দেশে সেনেদের বিশাল প্রাসাদ কিন্তু কলকাতায় থাকতেন প্রায়ান্ধাকার বাসায়।পাইকপাড়া থেকে ডালহৌসি যেতেন ট্রামে,ফিরতেন গংগার পাড় ধরে হেঁটে।অফিস থেকে ফেরার পথে এক ছেলেকে দেখলেন একা বসে আছে।সে আশ্রয় চায়।মেসোমশায় তার নাম,ধাম,গোত্র কিছুই জানতে চাইলেন না।তাকে মাসিমার হাতে তুলে দিলেন।সেদিন থেকে সেই দাদা মাসিমার ছেলে।তার খাওয়া থাকা পড়াশোনা সব করলেন তারাই।পরে জানা গেল সে ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে।তার বিয়ে দেওয়া হোলো জাত মেনেই।এই মেসোমশায় খুব নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন।দুভাই খেতে বসে দু-সের আটার রুটি আর ডাল খেয়ে নিতেন।এই মেসোমশায় শেষ বেলায় খুব আঘাত পেয়েছিলেন।খুব নির্মমভাবে আত্মহণন করেছিলেন।এ ঘটনার কিছু মাস আগে উনি নিজের বাসা ছেড়ে,নিজের দেশ ছেড়ে আমাদের দেশের বাড়িতে বাবা মায়ের অনুরোধে এসেছিলেন।পরম তৃপ্তিতে গ্রামে কাটিয়েছিলেন।কোনদিন কারো সেবা তিনি গ্রহণ করেননি।কিন্তু এখানে এসে আমার মা আর আমার সেবা যত্ন তিনি নিয়েছিলেন।তিনি ফিরে যেতে চাননি যান্ত্রিক প্রাণহীণ শহর কলকাতায়।যেদিন ফিরে যেতে বাধ্য হলেন তার কয়েক দিন পরেই তিনি মুক্তি নিলেন।যে চলে যেতে চায় তাকে কেউ আটকে রাখতে পারে?
ডাক্তার জ্যাঠামশায়কে কিন্তু আমার বাবা কাকারা আটকে রাখতে পেরেছিলেন।ডাক্তার জ্যাঠামশায়ের নাম ছিল কালীপদ বাগচি আর আমরা ছিলাম সরকার।ডাক্তার জ্যাঠামশায় আমাদের গ্রামের হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন।ওখানেই যেদিন তার সরকারি ভাবে অবসর হোলো তার পরেই তার দেশের বাড়ি নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় চলে যাওয়ার কথা কিন্তু আমার কাকারা বললেন আপনার এখান ছেড়ে যাওয়া চলবে না।জ্যাঠামশায় এখানে একা থাকতেন হাসপাতালের কোয়ার্টারে,ফলে থাকার মধ্যে ছিল কয়েকটা টিনের প্যাঁটরা আর একটা কাঠের টেবিল,কাঠের চেয়ার। আমার এক কাকা ওই চেয়ারটা হাতে তুলে নিল,আর এক কাকা টেবিলটাবাড়ির জন মজুর খাটা ঝড়ুদা কি চণ্ডীদা নিল বাক্স প্যাঁটরা।সোজা আমাদের দাওয়ায়।জ্যাঠামশায় পিছু পিছু এসে আমাদের বাড়ির বাহির ঘরে থেকে গেলেন।এসব আমার জন্মের অনেক আগেই।আমি জন্মেছি ডাক্তার জ্যাঠামশায়ের হাতেই মামাবাড়িতে।আমার মতো অনেকেই।আমরা জ্ঞান হওয়া থেকেই ওনাকে আমাদের নিজেদের জ্যাঠামশায় বলেই জানতাম।আমাদের বাড়ির ঠিকানায় জ্যাঠামশায়ের নামে অনেক বিদেশি মেডিক্যাল জার্নাল আসত।অন্য ইংরাজি ম্যাগাজিনও আসত।একবার এলো রুমানিয়ার ম্যাগাজিন।এ বাদে সোভিয়েত রাশিয়ার ম্যাগজিন আসত।ডাক্তার জ্যাঠামশায় আমাদের সংগে চিকিৎসা থেকে বাড়ির কথা,ছেলেমেয়ের কথা তাও আলোচনা করতেন।ওনার সব ছেলেমেয়ে আমাদের বাড়িকেই নিজের বাড়ি জানত।আমি কিন্তু কোনদিন জেঠিমাকে আমাদের বাড়িতে দেখিনি যদিও তার ছেলে-মেয়ে,জামাই,নাতি, নাতনি সব্বাই বিয়ের আগে পরে আমাদের বাড়িতে এসেছে থেকেছে।জ্যাঠামশায়ের দুই ছেলে।বড়ো স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চিকিৎ্সক,ছোটো মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।জেঠিমা মারা যাবার পর বাবা,জ্যাঠাবাবুর পরামর্শে জ্যাঠামশায় ছোটো ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে নিয়ে এলেন ঠিক সেইদিন যেদিন তার একটু আগে আমাদের বাড়ির বাগানে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বিষ্টুদা বউয়ের সংগে ঝগড়া করে গায়ে আগুন লাগিয়ে ঝলসে মারা গেল।
বিষ্টুদার মতো প্রাণবন্ত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।আমরা সবাই তখন ওই পোড়া মানুষটাকে হাসপাতালে শোওয়া দেখে ফিরছি আর দেখলাম এক ছটফটে দুরন্ত কিশোর আমাদের উঠোনে জড়ো করা ধানের গাদায় লাফ দিচ্ছে।এই সুনন্দদা আমাদের স্কুলেই পড়াশোনা শুরু করল।বাষট্টির ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় এই সুনন্দদাই ভূগোলের ক্লাসে স্যারকে বলেছিল-‘স্যার ম্যাপ থেকে চীন কেটে বাদ দিয়ে দিন’।তার পর পার্টি ভাগ হোলো।যারা ছিল এক ঠাঁই তারা দুই দুই হয়ে গেল।যারা এতদিন কংগ্রেসের সংগে আদর্শের সংগ্রাম করেছে আজ তারাই দুই ভাই হয়ে এক আদর্শের দু পিঠ নিয়ে লড়ছে।
আমরা একদিন এক হাঁড়ির ভাত খেয়ে স্কুলে গেলাম।ফিরে এসে দেখলাম রান্নাঘরটা এক আছে কিন্তু বাসন-কোসন আলাদা হয়ে গেছে।রাত নামল।আলাদা আলাদা হাঁড়িতে আলাদা রান্না হোলোডাক্তার জ্যাঠামশায় কিন্তু জানতেও পারলেন না।কেউ না কেউ তাদের খাইয়ে আসছে।জ্যাঠামশায় জেনেছিলেন অনেক পরে।তখন থেকে মায়ের কাছেই খেতেন। তারও পরে সেজকাকিমার কাছে।একদিন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সল্ট লেকে বড়ো ছেলের কাছে চলে এলেন।তার পরেও সল্ট লেকে আমাদের বাসায় চলে আসতেন।আমরাও যেতাম।জ্যাঠামশায় এ শহরে নিজেকে পরবাসী ভাবতেন।তার মন পড়ে থাকত ওই ভিখিরিপতি গ্রামের সরকার বাড়ির উঠোনে।তার টেবিল-চেয়ার,কাঠের আলমারি আর ওষুধ মাপার নিক্তিতে।আমরা তার ঘরের সামনের খোলা দাওয়ায় যেসব অপারেশন দেখেছি বিনা রক্ত,বিনা অক্সিজেনে শুধুমাত্র স্যালাইন দিয়ে আর যেসব দুরারোগ্য ব্যধির তিনি চিকিৎসা করেছেন আজকের মতো হাজার একটা টেস্ট না করেই তা এখন ভাবতেও কেমন লাগে।উনি এম্নিতে ছিলেন ভোলাভালা হাসিখুশি মানুষ কিন্তু ট্রিটমেন্টের সময় অন্য মানুষ।আবার অন্য সময়ে সেই তিনিই সেক্স থেকে শাক সব্জি সব বিষয়ে খোলা মনে আলোচনা করতেন।আমাদের পৃথক অন্ন তিনি খোলা মনে মেনে নিতে পারেননি।ঠিক যেমন আমরা ছোটোরাও মানতে পারিনি।
আর তাই আমরা ভাই-বোনেরা যার যার খাওয়ারটা নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে এক সংগে খেলতে দৌড় দিতাম।এক সংগে এক বিছানায় শুতাম।বই ভাগাভাগি করে পড়তাম।এ ঘরের রান্না ও ঘরেও যেত।এ বাড়ির ছেলে মেয়ে ও বাড়িতেও খেত।তার পরেও ভাগটা গলায় লাগা মাছের কাঁটার মতো সারাক্ষণ খচখচ করত।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘একান্নবর্তী’ গল্পে যৌথ খামারের কথা লিখেছিলেন আর আমরা সেই থেকে শুধু ভাগ-ভাঙা-টুকরো হওয়া দেখে চলেছি।কোনো ফেভিকুইকের সাধ্য কী?এ খণ্ডিত মলিকিউল জীবন আমাদের এ শতাব্দের শহুরে সিনড্রোম।