MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬

নিঃস্ব সুরের বিশ্ব দিবস......।
“কে জানে মন
গুরু আমার কয় জনা?
(আমার) অথিক গুরু,পথিক গুরু
(করি) শতেক গুরুর ভজনা।
কে না জানে গুরু আমার কয় জনা।
দূরের গুরু,সুরের গুরু
কাছের গুরু অজানা।
সেই জানে মন
সুজন গুরু নয় জনা”।
ভিকিরিপতি গ্রামে আমাদের বাড়িতে সুরের কোনও যন্ত্র ছিল বলে আমার মনে পড়ে না।না ছিল হারমোনিয়ম,না ছিল ঢোল-খোল,থাকার মধ্যে ছিল একটা ‘খত্তাল’নাকি ‘খঞ্জনি’?সেটা নিয়ে আমরা কীর্তণে তালে বেতালে নাচতাম।হারমোনিকা আর তবলা বাড়িতে এসেছিল অনেক পরে।আমার খুড়তুতো বোন সুজাতা যখন গান শেখা শুরু করল।আর তবলা এলো খুড়তুতো ভাই অতনুর জন্যে।সুজাতা ওই গ্রাম থেকে শিখেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীতে এম মিউজিক করে এখন সে বাণীপুর বেসিক ট্রেনিং কলেজের গানের দিদিমনি।
আমার শৈশবে ভিকিরিপতি গ্রামে সুর ছিল আকাশে বাতাসে।শ্বাসে-প্রশ্বাসে,বিভাবে বিভাসে।পাখির ডাক ছাড়াও সুর ছিল ছাতপেটাই গানে,নলকূপ তৈরির সুরে, ফেরিওয়ালার ডাকে,মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতকথায়,পুন্যিপুকুরের সুরে,বিয়ের বাসরে এমনকি প্রয়াণের বিষাদেও।
আমার শৈশবে হেমন্তের ভোরের কুয়াশায় বিছানায় মায়ের শরীরের পাশে লেপ্টে বোষ্টমীর আগমনী গান শুনতাম।খর রৌদ্রে কাগমারাদের বিদ্ঘুটে ভাষার গানে ছিল অন্য মাদকতা।এই কাগমারাদের দেখলে আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম।তাদের শরীরে থাকত বিদ্ঘুটে পোশাক।কপালে মস্ত লাল টিপ।কালো কুচকুচে চেহারায় লম্বা চুল তার উপরে লাল ফেট্টি।হাতে স্টীলের বালা আর ধারালো ছুরি।সেই ছুরি বালায় ঘা দিয়ে সুর তুলত।ওরা নাকি দিনের বেলা গান আর রাতেরবেলা ‘গান’ নিয়ে ডাকাতি করত।কিন্তু শীতের দুপুরে যখন পটুয়ারা পট নিয়ে আসত আমাদের মন ভরে যেত। কতো পট,কতো কথা,কথকতা আর পটচিত্র।মা ঠাকুমা থলি ভরে চাল চিড়ে আর পয়সা দিত তাদের।যে অন্ধ ভিখারি সপ্তাহে একদিন গান গেয়ে ভিক্ষা নিতে আসত তার গানের গলাও খুব খারাপ ছিল না।আর সাধনদা গাড়ি গ্যারাজ করে নেশায় চুর হয়ে মধ্যরাতে যখন পাড়ায় ফিরত তখন তার গানে সুরের থেকেও আবেগ থাকত বেশি।এরা সবাই আমার গানের গুরু।কিছু পরে ঘরে রেডিয়ো এলে আমার গুরু পালটে গেল।
আমার গানের গুরু তখন পঙ্কজ মল্লিক।প্রতি রোববার তিনি বে-তারে প্রতিটি পংক্তি ধরে শেখান।রাত গভীর হলে শিখি রাগ।সন্ধ্যায় শিখি পাশ্চাত্য সংগীত।শিখি মানে কি আর তানসেন হওয়া?পণ্ডিত রবিশঙ্কর এর ভাষায় ‘কানসেন’।শুনে শুনে শুন্যি।পরে সেই রবিশঙ্করজীর সেতার শুনলাম সামনে থেকে আর তার রাগালাপ শুনলাম সামনে বসে।উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সরোদ শুনলাম আর তার সংগে আলাপচারিতার সুযোগ পেলাম আমার পরম সুহৃদ গৌতম ঘোষের কল্যাণে।শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরির আকাশদীপ বাড়িতে বসে সারা দুপুর সুরের জাদুকরের সংগে সুর আর কথার আলাপ সেও গৌতমের কল্যাণেই।
মানিকতলায় রামমোহন লাইব্রেরি আর মঞ্চের পাশের ১০,রামমোহন রায় রোডে গৌতমদের পৈতৃক আবাস।রবীন্দ্রভারতীতে যখন ড্রামায় এম,এ তে ভর্তি হলাম গৌতম তখন মিউজিকে বি,এ পড়ছে।যদিও বয়সে সামান্য বড়ো।গৌতম যেমন লম্বা,তেমন রোগা,তেমনি ফর্সা,তেম্নি ঠোঁটকাটা।আবার সরোদে তার হাত ততোধিক সুরেলা।অসুর আমির সংগে সুরের গৌতমের কেমন করে সখ্য গড়ে উঠল আজ আর তা তেমন করে মনে করতে পারি না।
গৌতমদের চিলেকোঠার ছাদের ঘরটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন আর সুরের কারখানা।কতো দুপুর,কতো রাত আমাদের ওখানে কেটেছে যেখানে আমি,গৌতম,সরোদ কি ম্যাণ্ডোলিন আর ঠিক সময়ে মাসিমার প্রবেশ চা নিয়ে কি খেতে ডাকার জন্যে।ভিকিরিপতিতে যে সব সুর শুনেছিলাম সেইসব সুরের ব্যাখ্যা শুনতাম নিবিষ্ট মনে বাধ্য ছাত্রের মতো গৌতমের কাছে।কী করে রাগ চিনতে হয়।কী করেই বা সিম্ফনির চরিত্র বুঝতে হয়।‘কর্ড’ কী?’স্কেল” কী?’সোপ্রানো’ কি,’স্ট্যাকাটো’ই বা কী?ধরে ধরে শেখাত।হঠাৎ হঠাৎ সরোদে স্ট্রোক দিত আর আমি পাশে পড়ে থাকা বইয়ে তাল ঠুকে ঠেকা দিতাম।আর স্বপ্ন দেখতাম একদিন এইসব সব আমাদের নাটকে কাজে লাগাব।
গৌতমকে নাটকের কাজে টেনে আনলাম আমি।তার আগের নাটকে শ্রীপতিদার স্টক মিউজিক দিয়েই কাজ চালানো হয়েছিল।তখন অধিকাংশ দলেই শ্রীপতিদাই ছিল সুরের কাণ্ডারী।সত্যজিৎ রায়ও শ্রীপতি দাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।উৎপল দত্তের সব নাটকে শ্রীপতিদাই টেপ চালাত নেপথ্যে।‘সমাবর্তন’ নাটকে গৌতমের প্রবেশ।তার পর বহু নাটকে গৌতম তার প্রতিভার ছাপ রেখেছে।আমার ‘আবরণ’, ‘প্রবহতি’ আর ‘বাস্তুভিটে’ নাটকের মিউজিক স্কোর গৌতমেরই।
একদিন গৌতম আর আমার সম্পর্কটা সরোদের তারের মতো ছিঁড়ে গেল।হাতের জবার মতো হারিয়ে গেল আচমকাই।সেটা একদিনে ঘটেনি।বহু মৈত্রী, বহু মনান্তরের, বহু মলিনতা,সাংসারিক জীর্ণ দৈন্যে ‘কোন হাহারবে তার ছিঁড়ে গিয়েছিল’।আবার দেখা হোলো শান্তিনিকেতনে সংগীত ভবনে।গৌতম পরীক্ষক আর আমি অতিথি অধ্যাপক। আবার তারটা জুড়লাম আমরা দুজনে মিলেই।কী আশ্চর্য!যে রাগটা আমাদের প্রিয় ছিল সেই ইমন রাগই বাজছে আমার অ্যাতোদিন ঠুকে যাওয়া তালেই।


৪টি মন্তব্য:

  1. Samir Mitra Moner shanti gurudev r shantiniketan aajo mane biswajan..........
    Unlike · Reply · 1 · 3 hrs
    Ramita Sengupta
    Ramita Sengupta তোমার লেখার মৌন রেখার
    অতল থেকে কি উদ্ভাসে
    জেগে ওঠে শব্দহারা সুরগুলো সব ----
    সময় হারায় প্রাণ বিভাসে ।
    Unlike · Reply · 1 · 1 hr
    অরূপ রতন দাশগুপ্ত
    অরূপ রতন দাশগুপ্ত ব্লগের layoutটা খুব ছিমছাম হয়েছে👍
    Unlike · Reply · 1 · 1 hr

    উত্তরমুছুন
  2. Piyali Palit কি আশ্চর্য কাণ্ড, তাই না ? মনে হল যেন সুরের আবর্তে আকাশের সব তারা ঘুরে চলেছে, ইঙ্গিত পাঠাচ্ছে একে অপরকে...
    Unlike · Reply · 1 · 8 hrs

    উত্তরমুছুন
  3. আপনাদের সবার এই প্রচেষ্টাকে প্রশ্রয় দেবার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  4. Goutam Ghosh Darun lekha..Eta thik ekok bhabe kauke chenay na sobai ke ak songe chenaay.Purono din gulor aNka chobi dhusor holeo sobai je jar moner ronge miliye ney.Ekhanei to swarthokota..
    Like · Reply · 3 mins
    Salil Sarkar

    Write a reply...

    Choose file
    Salil Sarkar
    Salil Sarkar ধ ন্যবাদ গৌতম আমাদের ফেলে আসা দিন গুলোও যে ইতিহাস।আজ সে গুলো প্রকাশ করার সময় এসেছে।

    উত্তরমুছুন