সরল জীবন জটিল রেখার মানিদা
শান্তিনেকেতনের কথা লিখতে বসে কেউ মানিদার কথা লিখবে না সে হয় মানিদা কে তাই
জানত না নয়ত মানিদার বকুনি বা স্নেহ পায়নি।এই উভয় সম্প্রদায়কেই বেচারা বলা ছাড়া আর
কীই বা বলা যায়!ভেবেছিলাম মানিদাকে নিয়ে লিখব কিন্তু সত্যি বলতে কি এত তাড়াতাড়ি
নয়।নব্বই বছর বয়সের কিশোর মানিদাকে নিয়ে লিখব কেন?একশ বছর পার করা তরতাজা যুবক
মানিদাকে নিয়ে কিছু লিখব আর মানিদা সেটা পড়ে কিছু না কিছু বলবেন তবেই না!
প্রথমেই কবুল করা উচিত আমি মানিদার কলাভবনের ছাত্র নয়।সে যোগ্যতাও আমার ছিল
না।আমি মানিদাকে জানতাম কে,জি,সুব্রহমনিয়ম এই নামের শিল্পী আর তার কাজকে।জানা ছিল
তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও মাস্টারমশায় আর এখন থাকেন বরোদায়।দু হাজার দশে যখন
অতিথি অধ্যাপক হয়ে গেলাম তখন থেকে এই সেদিন অব্দি মাত্র কয়েকটা বছরের মাত্র কয়েকটা
দিন তাকে পাওয়া কাজে,কথায়,আড্ডায়... কখনও কলাভবনের বটের ছায়ায়,কখনও বা শান্তিনিকেতনের
বাড়িতে।
মানিদা যখন দুহাজার এগারো বারোতে এলেন মাস্টারমশায়(নন্দলাল বসুর)এর ঐতিহাসিক ঘরটিকে
ম্যুরালে ভরিয়ে দিতে তখন সংগীত ভবনে আমার ক্লাস নেওয়ার কাজ শেষ করেই ছুটতাম
মানিদার ওই কাজের যে মিনিয়েচার বানাচ্ছিলেন তার কাজ দেখতে।এক হাতে কাঁচি,সাদা কাগজ
আর অন্য হাতে কখনও চায়ের গেলাস নয়ত ‘সরল চিত্রাংকন’ জাতীয় একটি বই।আমার কৌতুহল ওই
বইটির উপর দেখে কাছে ডেকে বললেন-‘এমন সহজ সরল ছবিই আঁকব মাস্টারমশায়ের দেওয়ালে।কেমন
হবে?’ আমি কী উত্তর দেব?শুধু পিলুকে বললাম(কৌস্তুভ দে।পিলু আমাকে নিয়ে একটা
প্রোজেক্ট করবে বলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে)কিছু ছবি তুলে রাখ পিলু।কাজটা যখন মডেল
থেকে মাস্টারমশায়ের দেওয়ালে টাইলস হয়ে সাজানো হোলো আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম সহজিয়া
সুরে কথায় কী জটিল গাণিতিক বিন্যাস।এটা আমার মনে হওয়া। অন্য কারও অন্য কিছু মনে
হতেই পারে।উনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।ওই কাজটা শেষ হবার পর কিছু ছাত্র-ছাত্রী
কাজটা নিয়ে অন্যস্বর প্রকাশ করেছিল এক সন্ধ্যায় পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে।অনেক
মাস্টারমশায় খেপলেন।কেউ কেউ খেপালেন। মানিদার কানে কথাটা গেল।মানিদা শুনলেন বরোদায়
বসেই কিন্তু একটি শব্দও ব্যয় করেননি।যদিও মানিদা ছিলেন আমার চোখে অসম্ভব ঠোঁটকাটা।
আমার ছাত্রজীবন থেকে আজ অব্দি বন্ধু সাগর(সাগরময় সাহা)শান্তিনিকেতনের বাড়িতে
নয় কৈখালির বাড়িতে কিছু শিল্পকাজ রাখতে চাইলে আমি তাকে সে বছরের নন্দন মেলায় কিছু
কাজ কেনার ব্যাপারে সাহায্য করলাম।তার মধ্যে একটা ছিল মানিদার কাজ লিথোতে
মুরগী।সাগর একটা কিনল আর সাগরের শ্যালক সোনা সেও কিনল মানিদার করা লিথো
মুরগী।মানিদার সহস্তে সাক্ষরিত কাজ যা যথেষ্ট মূল্যবান। মানিদাকে পরে দেখা হতে যখন
বললাম মানিদা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বললেন-“আজকাল মুরগীটা সবাই খাচ্ছে”?
একবার মানিদার সংগে আমরা কয়েকজন বসে চা খাচ্ছি চীনা বটের ছায়ায়।কে একজন এসেছেন
বাইরের থেকে মানিদার কাছে।মানিদা সামনে বসে থাকা আমাকে দেখিয়ে তাকে আমার পরিচয়
দিলেন(এর মধ্যে মানিদা আমার তৈরী দুটি চলচ্চিত্র কলাভবনের চাতালে দেখে ফেলেছেন)তখন
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলাভবনের এক অতীত ছাত্র ও এখন অধ্যাপক অভিমান সুরে বলে উঠল-‘মানিদা
আমার সংগে ওনার পরিচয় করিয়ে দিলেন না?’মানিদা তৎক্ষণাৎ বললেন-‘তার যথেষ্ট সময়
পাওয়া যাবে।এখানে ছাত্র ছিলে,মাস্টার হয়েছ এবার ফ্যামিলির সবাই ঢুকবে বংশ পরম্পরায়’।
মানিদার ছাত্র বলা বাহুল্য খুবই আঘাত পেয়েছিল কিন্তু মানিদাই পারতেন এমন নিষ্ঠুর সত্য
উচ্চারণ করতে।
আবার এই মানিদার উদ্যোগেই কলাভবনে মেয়েরা পড়াতে এলেন।তার আগে অব্দি কেবল
পুরুষেরাই রাজ্যপাট চালিয়েছেন।মানিদার উদ্যোগে পৌষ মেলা থেকে প্লাস্টিক ব্যবহার
নিষিদ্ধ হোল এক বছর।পরের বছর ‘পুনরমুষিকভব’।সে সময় যে মহামান্য উপাচার্য ছিলেন
তিনি প্রথমটায় মানিদাকে খুব খাতির করলেন পরের বার এই মহামান্য মহাশয় মানিদা
শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন একদিনের জন্যে দেখা করা তো দূরস্ত টেলিফোনেও কথা বলার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।তিনি যে তখন রসের সন্ধান পেয়েছেন অপ্রিয় সত্য শোনার সময়
কোথায়?আমি খুশি মানিদা এইটুকু দেখে যেতে পেরেছেন সেই মহামান্য ও তার স্তাবক ও তার
সাঙ্গোপাঙ্গ চুরির দায়ে ধরা পড়েছে।আমি ব্যথিত মানিদার মতো মানুষ কে দেখতে হোল
গুরুদেবের আশ্রমে নোবেল চুরির পর আবার সি বি আইয়ের প্রবেশ ঘটল কিছু অসাধু,ভণ্ড,অযোগ্য
ধান্দাবাজকে চিহ্নিত করার জন্যে।
মানিদা তার শিক্ষক জীবনে কম আঘাত পাননি।যার ফলে শান্তিনিকেতনে যেদিন তার অবসর
হোল সেইদিনই তার কাজের টেবিল কারা যেন অধিক তৎপরতায় সরিয়ে দিয়েছিল।তার পরেও তিনি
প্রতি বছর একবার হলেও শান্তিনিকেতনে আস্তেন।কাজের সুযোগ পেলে কাজ করতেন।অভিমান করে
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি।আজ বিকেলে গৌতমদাকে(চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ)সংবাদটা
দিতেই গৌতমদা চমকে উঠলেন। এই সেদিনও মানিদার সংগে গৌতমদার কথা হয়েছে।গৌতমদা
দুহাজার তেরো চোদ্দোতে মানিদাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে শান্তিনিকেতনে
এলেন।মানিদা ওই নব্বইয়েও তরতাজা কিশোর।তথ্যচিত্রের জন্য নয় নন্দনমেলার জন্যে মাটির
সরায় তুলির টান দিচ্ছেন।যেটা মেলায় বিক্রি হয়ে তার টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের তহবিলে
জমা পড়বে।মানিদা কত সহকর্মীকে নিজে সই করে শিল্পকাজ দান করেছেন।সেগুলি আজ অমূল্য।
মানিদা আমার কন্যা তিথিকে একটা কাজ দেবেন বলেছিলেন।চেয়ে নিতে বলেছিলেন। তার পরে
কয়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু আমি চেয়ে উঠতে পারিনি।অতিথি আমি অনেক কিছু
পেয়েছি,হারিয়েছিও নেহাত কিছু কম নয়।একটা শিল্পকাজ নাহয় না পাওয়াই থেকে গেল।এর পর
মানিদার যে শেষ কাজগুলি কোনও চিত্র প্রদর্শনীতে দেখব তখন ভাবব ওর মধ্যে কোনও একটি
অতিথি সলিলের কন্যা তিথির জন্যে রাখা ছিল।


Chayan Das Thakur ৪ বছর আগে আমি কলাভবন এ ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে গিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় এক স্যার প্রশ্ন ধরেছিল যে, একজন খ্যাতিনামা শিল্পীর নাম বল? আমি বলেছিলাম K.G. Subramanan , তার পরের প্রশ্নে-- উনি কি এখনও আছেন? আমি বলেছিলাম না নেই।। তখন প্রত্যেক টা স্যার হাসতে শুরু করল এবং বলল তুমি এবার আসতে পারো। আমি জানতাম না, চিনতাম না তিনি কে? শুধু জানতাম নামটাই। পরে চিনলাম, জানলাম, প্রদর্শনী তে ছবি দেখলাম। পরে বুঝতে পারলাম কেন হেসেছিল স্যারেরা ভাইভা তে, বুঝতে পারলাম কতবড়ো ভুল কথা আমি বলে ফেলেছিলাম...
উত্তরমুছুনযখন বলেছিলাম, তখন তিনি বরদা তে ছিলেন।
Like · Reply · 7 hrs
Palashranjan Bhaumick
Palashranjan Bhaumick ওঁনাকে সশ্রদ্ধ প্রনাম ও ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি!
মনে পড়ে, ১৯৮৮-র শেষাশেষি Illustrated Weekly of India-র একটা স্মারক সংখ্যার বিশেষ ছবি তুলতে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে যেতে হয়েছিলো। আমার সৌভাগ্য সেই একদিনের ঝড়ের বেগে ছবি তুলতে গিয়ে ঐ বিশাল মাপের শিল্পীর ছবি আমি তুলতে পেরেছিলাম!
Like · Reply · 6 hrs
Salil Sarkar
Write a reply...
Choose file
Salil Sarkar
Salil Sarkar পলাশ তুই মানিদার ছবি তুলেছিস জেনে খুব খুশি হলাম।সম্ভব হ লে ছবিগুলো আমাকে পাঠাস।তবে মানিদা যদি জানতেন তুই রবীন্দ্রভারতীতে পড়ার সময় একটা সামান্য ক্যামেরায় অসামান্য কিংকরদার বেশ কিছু সাদা কালো ছবি তুলেছিলি তাহলে মানিদা যে কী খুশি হতেন।তবে তার প্রকাশ ঘটাতেন কীভাবে বলা মুশকিল!
Like · Reply · Just now