MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

মন (খারাপ)খেরোর খাতা/রিও-পুচুং ও অন্যান্যরা
সলিল সরকার
ভেবেছিলাম লিখব না।আমার নিজের মন খারাপের কথা সবাইকে জানানোর কীই বা প্রয়োজন?ভেবেছিলাম ব ল ব না!আমার বুকের ক্ষতের ব্যথা সবাইকে দেখাব কেন? আবার এটাও ভাবলাম কোনও কিছুই কি আমার একার ?ব্যক্তি আমি যা ব্যক্ত করি তা কী কখনও একান্ত ব্যক্তিগত হোতে পারে ?
আমার শৈশবে অনেক পুষ্যি ছিল।তারা যে সব আমার পোষা ছিল তা নয়।আমাদের ভিকিরিপতির বাড়িতে গন্ডা গন্ডা বেড়াল সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত।তাদের কিছু বলা যেত না।তারা আমাদের মা-কাকিমাদের পায়ে পায়ে ঘুরত খাবারের জন্যে।রান্নাঘরে যখন তখন দুধের কড়ায় মুখ দিত।খড়ের চালে উঠে কাঠবিড়ালির ল্যাজ কেটে আনত।আর শীতকালে মশারি ছিড়ে আমাদের লেপের ভিতরে আরাম করতে ঢুকে পড়ত।কিচ্ছু বলা যেত না।বাবার বারণ ছিল।আমার ছোট বোন-এর ‘ডিপথরিয়া’ হোলো।বেলেঘাটা আই ডি তে থাকতে হয়েছিল তবুও ওদের কেউ তাড়ায়নি।ওরা আমাদের সংসারে ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন।ওরা পোয়াতি হোলে পরম যত্নে ঘি-চিড়ে খাওয়ানো হোতো নাগেদের দাদুর বাড়িতে।আমাদের বাড়িতে অতটা না হোলেও তাদের খাতির যত্নের কমতি ছিল না।মিথ্যে বলব না-ওরাও খাটা-খাটনি করত।
বাড়ির ধেড়ে মূষীকপ্রবরদের গুষ্টির তুষ্টি করত।বিষধর সাপেদের গিলে খেত আর বরষায় ডাঙ্গায় উঠে আসা জিওল মাছেদের আগলে রাখত এ কথা আমি আগেই লিখেছি।আমাদের বাড়িতে কোনও হুলো ছিল না।হুলো জন্মাবার পর বড়ো হোয়েই পালাত।কেন কে জানে ?কিন্তু সময়ে তারা হাজির হোতো।ফ্যাঁচ ফোঁচ করত আর কাজ মিটে গেলেই চলে যেত।কষ্ট হোতো বাচ্চা হবার পর কমজোরি বাচ্চাগুলো যখন মরত,নয়ত কাক-চিল ছোঁ মেরে নিয়ে যেত।বাচ্চা মরলে বেড়ালদের কাঁদতে দেখিনি।কাঁদতাম আমরা যারা ভালোবাসি পুষ্যি।আর আমরা যেটা ওদের কান্না ভাবতাম সেটা যে আসলে ওদের প্রজননের শ্যামের বাঁশি সেটা বুঝেছি অনেক পরে।
আমাদের কিছু পোষা মুরগী ছিল।আমি তাদের কেটে খেতে পারতাম না।আমার পোষা কয়েকটা খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস ছিল।তারা জলের চেয়ে ডাঙ্গায় থাকাটাই বেশি পচ্ছন্দ করত।তাদের পা খোঁড়া হোলে বা ভেঙে গেলে কেরোসিন তেল গরম কোরে লাগিয়ে কাপড় বেঁধে দিতাম।একবার একটা হাঁস মারা গেল।আমি তার শোকে সাতদিন কিছু না খেয়ে শুধু কাঁদলাম।আমার সেই ছোট্ট আমিকে আজও আমি ‘বোকা’ বলি না, বরং ভালোবাসি।
আমাদের দেশের বাড়ির পুকুরে অনেক মাছের মধ্যে একটা ঘেটো রুই পোষ মেনে গিয়েছিল।আম্রা তাকে গণেশ বলে ডাকতাম।বরষার জলে পুকুর ভেসে গেলে সব মাছ পালিয়ে যেত গণেশ পালাত না।সে আমাদের হাতে ভাত খেত।না খেলে বকুনি খেত।ছিপ ফেলার সময় সব মাছ তাড়িয়ে দিত।সে আমাদের বাড়ির এক সদস্য ছিল।
তার মারা যাওয়াটা তার হাতে ছিল না।আমার এক কাকার বিয়েতে তাকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল।আমরা ছোটোরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম।আর কেঁদেছিলাম।তখন আর কীই বা করতে পারতাম।সেই মাছ আমরা বাড়ির কেউ খাইনি।
কোলকাতায় এসে নিজেকে নিজেই পোষ মানাতে বেশ বেগ পেয়েছিলাম।তাই এখানে আমি কিছু পুষতে চাইতাম না।সল্ট লেক এ যখন থাকতাম একটা মাছবাসা (অ্যাকিউরিয়াম)করেছিলাম।সেখানে শীতকালে মাছ মারা গেলে ভোরবেলা মা সেই সংবাদ দিয়ে বলত-আর মায়া বাড়াস না।আমি তখন কাঁদতাম না ঠিকই তবে সকালবেলা মনটা ভার হোয়ে যেত।রাত্রে ফেরার পথে আবার প্যাকেটে মাছ নিয়ে আসতাম।
বাগুইআটির আবাসনে নিজের সংসারে মেয়ের জন্যে না কী নিজের জন্যেই একটা মস্ত মাছবাসা আনলাম।তাতে সমুদ্রের মাছ(মেরিন ফিস)থেকে দেশি মাছও পুষতাম। একবার মাছের বাজারে পুচুংকে পেয়ে গেলাম।ও আমাদের বাড়িতে এসে কী খুসি!ক্রোকোডাইল ফিস থেকে খলসে সবার সংগে ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে না পেরে সবাইকে খেয়ে ফেলেছিল।শুধু খলসেটা ওর বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।আমি যত রাত্রেই বাড়ি ফিরি ও জেগে থাকত।মাম্মামের সংগে লুকোচুরি খেলত।আমাদের বিছানায় লেপের তলায় উঁকি দিত।আমি শান্তিনিকেতনে চলে আসায় ও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিল।এক মহালয়ার রাত্রে ও সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল।তারপর থেকে আমি সব পোষা ছেড়ে দিয়েছি।
তবু আমার বারান্দায় পাখিরা আসে।জল খায়।আমার দেওয়া খাবার খায় আর উড়ে যায়।আমি তাদের ধরে রাখি না।
শান্তিনিকেতনে নীলাঞ্জনদের বাড়ির ‘কুরো’ আর ‘শিরো’ আর পাঁচজনের মতো আমাকেও চেনে এবং পাত্তাও দেয়।ওরা বেশ সেলিব্রেটি তবুও......!আমি যেন ওদের আগে যেতে পারি।
আমার বন্ধু সাগর তাদের পরিবারের একজন ‘রিও’ যে আমারও প্রিয় ছিল।ওদের বাড়িতে গেলে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত।পথের কুকুরদের দুবেলা খেতে দিতে বাধ্য করত।বাড়ির কেউ না ফেরা অব্দি দুঃশ্চিন্তা করত।সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হোয়ে চলে গেছে শুনে আমি স্মৃতিমেদুর হোয়ে উঠলাম।

আমি মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার পত্রে সাক্ষর করেছি আন্দোলনের শুরুতেই।যাতে আমার দেহটা মরার পরেই কাজে লাগে।আজ আমার শোকের কিছুটা বিলিয়ে দিলাম হয়ত বা অকারণেই।
 

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬








মন (খারাপ) খেরোর খাতা
আমার জীবনে বরষা এসেছে বাষট্টি বার।আমি 'মনসুন' এর কথা বলছি।
শৈশবের বরষা নিয়ে এর আগে লিখেছি কিন্তু শহরের বৃষ্টি নিয়ে লিখিনি।লিখতে মন চায়নি।আজ লিখছি।কেন?
পাইকপাড়ায় যখন থাকতাম ঘরগুলো এমন অন্ধকার ছিল চান ঘরে জল পড়লে মনে হোতো বৃষ্টি পড়ছে।শুধু ছুটির অবকাশে ছাদে উঠে গেলে আকাশে ঘুড়িদের কাটাকুটি খেলা দেখতে পেতাম।আর দেখতাম সময়ের কলে কারা যেন স্নান করে শরীরের আগল খুলে।
সল্ট লেকে করুণায়ীতে বরষা আসত আগল খুলে।দূর থেকে আকাশ ঝেঁপে।কাশফুলের বৈধব্য এনে।কাচের জানালায় ঝাপ্টা দিয়ে ডাকত- আয় আয় আয় আয়।বারন্দায় নাইট কুইন গাছে সাদা ফুল ফুটত মাত্র এক রাতের জন্যে।
তারপর যখন বাগুইআটি এলাম।বরষা সেখানে জল ঝপঝপ ঘরে ফেরা।তখন লিখেছিলাম- "না হয় ঈষৎ ভাঙাই ছিল সাঁকো/আবেগ মাখা গুল্ম লতার ফাঁদ/না হয় ছিল নিকষ কালো আঁধার।না হয় ছিল শ্রাবণ ধারাপাত......!"ওখানে পেয়ারা গাছে বসন্ত বৌরিরা পেয়ারা খেতে আসত।আর আসত টিয়া আর চন্দনা।সিড়ির কাছে উঠে আসা জলে খেলা করত মাছ আর ঢোড়া সাপ।
এখন যে বাসায় থাকি তাও হয়ে গেল ষোলো বছর।আবাসন হোলেও আন্তরিক।আমার বারান্দা থেকে উত্তরে এয়ারপোর্টের থেকে উড়োজাহাজের ওড়া।আর সারি সারি নারিকেল গাছ।পুব দিকে শোবার ঘরের জানালার পাশে পাকুড় গাছ।
সেখানে বরষায় আসত হলুদ পায়রা, বেনেবৌ,বসন্তবৌরি আর কাকের বাসায় ডিম পাড়া কোকিলছানা.........।
আজ ওরা কেউ আসে না।গাছটাই তো কেটে ফেলা হয়েছে।

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
কাল ছিল রবিবার।ছুটির দিন।যাদের অঢেল পয়সা তারা কাল নিশ্চয় মানিক তলা বাজার থেকে ইলিশ কিনে তার ভাপা কি ভাজা, সরষে ইলিশ কি ইলিশ পাতুরি খেয়েছেন কারণ কাল ভোর থেকেই ছিল দূর্যোগ আর দুর্ভোগ।আগের দিন বিকেলে আকাশের গায়ে ছিল সিঁদুরে মেঘ।চাষা-ভুষা মানুষেরা বুঝতে পারেন সাম্নেই বিপদ।আর শহুরে আর শিক্ষিত তারা বুঝতেও পারেন না।
রাতভোর বৃষ্টি আর থেকে থেকে মেঘের হুমকি।ভোর হতেই আমরা দুজন বেরিয়ে পড়েছিলাম নদির কাছে আর মেয়ের কাছে যাব বোলে।কাক ভেজা হয়ে যখন পৌঁছলাম রানিচকে টোটোর চালক হেসে জিগ্যেস করলে-"মেয়েকে দেখতে?চলুন।উঠে পড়ুন"।অপর্ণা 'লম্বু'র প্যাকেট কিনতে চাইলে চালক বল্লে-'লম্বুর প্যাকেট কিনতে হোলে আরো সকালে আসতে হবে!' আমি শৈশব থেকেই লম্বু খেতে ভালোবাসি।এখন অপর্ণারও প্রিয়।
কথায় কথায় হলদিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেলাম।ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে।ক্যাম্পাসটা বেশ সাজানো গোছানো লাগল!NAAC এসেছিল কিনা!এবারে নিশ্চয় এরা ভালো পয়েন্ট পাবে।কলেজ এবার ইউনিভারসিটি হয়ে যাবে শুনছি!জানি না ভালো হবে কী না!তবে ওরা বৃষ্টির জল বাঁচানোর প্রকল্পনা নিচ্ছেন।ভারমি কালচার করবেন শুনলাম।শীতকালে নাকি পুরো ক্যাম্পাসটাই মরসুমী ফুলে ভরে যাবে!
মেয়েকে নিয়ে আমরা চললাম টাউনশিপে।এখানে পড়ক্সে আসা ছেলে-মেয়েরা কেউ টাউনশিপে যায় না।তারা যায় 'সিটি সেন্টারে' আর 'বিগ বাজারে'।অথচ এই 'ডক' এই 'ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন' এদের জন্যেই তো বন্দর বেঁচে আছে!হিন্দুস্তান ফারটিলাইজার তো কবেই ডকে উঠেছে!
তিথিপর্ণা হলদি নদি দেখে খুব খুসি।মা মেয়ে এই প্রথম হলদি নদি দেখল ভালো করে।একদিকে হলদি নদি মিশেছে বংগপোসাগরে আর একদিকে গংগা।নদির ওপারটাই নন্দিগ্রাম।আমরা নদির কাছে যাব শুনে বাসের কন্ডাক্টর -"আপনারা কী ওপারে নন্দিগ্রামে যাবেন?"আচ্ছা আমাকে দেখে কী এখনও সাংবাদিক মনে হয়?বিপ্লবী নিশ্চয় নয় ?নন্দিগ্রামের ঘটনার পর নিরন্ন উপবাসে ছিলাম না হয়ত তবে কতো রাত যে ঘুমুতে পারিনি!আর লিখেছিলাম তারপর "ভাতজোছনা"।আমার যা কাজ!
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়।আমাদের রবিবারটা এভাবেই কাটল।
এবার ইচ্ছে আছে মেয়েকে একদিন মহিষাদলে নিয়ে যাব।




বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০১৬


এ মোহ আবেশ......প্রভু নষ্ট হয়ে যাই!

সলিল সরকার

আকাশে মেঘের নাভি ফাঁক করে কিছু তারা হয়ত এখনও।

জোনাকির ঝোপে ঝাড়ে চোখ টিপে উঁকি মারা স্বভাব গেল না!

ড্রয়ারে চরস আছে,হাতে গাঁজা,ল্যাপ টপে ল্যাংটো ললনা।

বাম হস্তে পুরুষাঙ্গ, দক্ষিণে মাউস টেপে

নারীর স্রাবের মতো প্রবাহিত নীলাভ পর্ণো.........!

কাল “এ কোন আবেশ......?” মন খেরোর খাতায় পোস্ট করার পর মাঝ রাতে এই লেখাটি ফুটে উঠল আমার মেসেজে।ভাবতে থাকলাম যে এটি আমাকে পাঠিয়েছে সে আমার খোলা পৃষ্ঠার সুযোগ নিয়েছে কিন্তু আমাকে পাঠানোর উদ্দেশ্য কী?আমার লেখাকে মান্যতা দেওয়া না কি অবমাননার এ আর এক প্রকাশ?

ভ্লাদিমির তখনও বেঁচে রাশায় জোর তর্ক উঠল সাহিত্যে যৌনতার সীমারেখা থাকবে কি থাকবে না?তর্ক তুলল যৌবন।মহাবিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাই আয়োজন করল আলোচনার। ভ্লাদিমির ইলিয়চ লেনিন আমন্ত্রিতউপস্থিতও হলেন।কোনও মীমাংসা হোলো না।

ফ্রান্সে সাহিত্য,চিত্রশিল্প ও চলচ্চিত্রে যৌনতার অবাধ প্রবাহ।দেশটা গোল্লায় যায়নি।গেল যুদ্ধেও নয়। গেল মূদ্রাস্ফীতি আর জঙ্গী আক্রমনে।আমেরিকা পিট সিগার আর পোল রবসনকে গাইতে বাধা দেয়। হ্যারিবেলা ফোন্টে আর জোয়ান বেইজকে চেনে তৃ্তীয় দুনিয়ার মানুষ।চে এর মুখ ওরা বুকে ছেপে দিয়েছে।লুকিয়ে পাঠাচ্ছে অস্ত্র আর গোপনে ভাইরাস।আমাদের ছেলেরা তাই দুপুরে টিটকিরি দেয়,বিকেলে ধর্ষণ।সন্ধ্যায় মদ্যপান,মাঝরাতে আত্মহণন।

গান্ধী ও রায়ের যৌথ উদ্যোগে এই বাংলায় সন্তোষী মা,সাট্টা-জুয়া ও জরুরী অবস্থা প্রবেশ করেছিল। জরুরী ব্যবস্থা উঠে গেল কালের যাত্রার ধ্বনিতে কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ক্যারাম ক্লাব আর সাট্টা-জুয়া পি এল ফোর এইট্টির সুবাদে আসা পারথেনিয়মের মতো স্থায়ী আসন করে নিল।হিপিদের হ্যাপা সাম্লাতে বেগ পেতে হোলো বাঙালি সমাজকে।কারণ ততদিনে তাদের হাত ধরে আমাদের ছেলেরা পেয়ে গেছে হেরোইন,চরস,ব্রাউন সুগার।সবার আগে চ্যাঁচাল ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স’ কারণ তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই প্রথমে উচ্ছন্নে যাচ্ছিল।বস্তির ছেলে-মেয়ে-বৌরা তখন বেচত।কিনত ধনীর দুলাল-দুলালীরা।কালে কালে ‘নাড়ু বানালে কুটো হাতে আসে’এর মতো তারাও নিতে থাকল এর সোয়াদ।জান্তে থাকল এর মহিমা।খাদ্যাভাসে জ্যান্ত থাকল বস্তির খুব কম ছেলেমেয়েই। হাতিবাগানের পেশাদার মঞ্চে এলো ‘এ” মার্কা পানশে না টক।ক্যাবারে ডান্সের নামে এলো বৃহন্নলা নৃ্ত্য।সবাই কি মিস শেফালি হয়?বিস্বাদ পানশে না টক তত ক্ষতি করতে পারল না যত ক্ষতি করে গেল বিষাক্ত চোলাই,চরস আর ফেন্সিডিল।

বামফ্রন্ট আসায় সাময়িক ভাবে তারা মুখ লুকালো কিছুদিনের জন্যে।পানাপুকুরের পানা উঠিয়ে নিলেও আবার যেমন সে ধীরে ধীরে গ্রাস করে পুকুরকে।মাছগুলো অক্সিজেনের অভাবে খাবি খেতে খেতে মরে, কোলকাতার অবস্থাও হোলো তাই।ধীরে ধীরে ফিরে এলো সব স্ব্মহিমায়।

মনোবিদ ও এ বঙ্গে প্যাভলভকে জনপ্রিয় করেছিলেন যিনি সেই সমাজ চিকিৎসক ধীরেন্দ্রনাথ গাংগুলি সেই কবে কার্ল মার্কস এর অবহেলিত চিন্তাকে পুনরুদ্ধার করে লিখেছিলেন “বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যত”। তিনি লিখলেন বীর্যক্ষরণে কোনও পাপ নেই।পাপ আছে অকারণ রক্তক্ষরণে।তিনি এই শেষবেলাতেও বারংবার নিষেধ করলেন টেলিভিশনে ক্রাইম আর ভায়োলেন্স দেখানোয়।“কা কস্য পরিবেদনা”

আজ যারা আবেশে আক্রান্ত তারা কারা?তারা তো আমরা!আজ যারা আবেশে ভীত তারা কারা? তারা তো আমরাই!আমরা যারা বস্তিতে বড়ো হয়েছি।আমরা যারা অজ গাঁয়ে কাটিয়েছি।আমরা যারা হাফ গেরস্ত ছিলাম।আমরা যারা বিপ্লবী হয়েও বাবা মা পাছে কষ্ট পান তাই পণ নিয়েছি। আমরা যারা বাবা মায়ের শ্রাদ্ধে বামুন ঠাকুরকে মূল্য ধরে দিয়েছি।আমরা যারা বৌ-ছেলে-মেয়েকে তুষ্ট করতে বাবা-মাকে পুরানো বাড়িতে ফেলে এসে মাসে মাসে মূল্য ধরে শান্তি খুঁজেছি।আমরা যারা গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্সের পরে ‘এ জীবনে কী করিলাম?’ ভেবে দেবদাস হয়েছি।আমরাই আজ মোহ আবেশে গ্রস্ত হয়েছি।তাই আমরাই স্বেচ্ছা অন্ধ গান্ধারী হয়ে উচ্চারণ করে চলেছি-“কার নিন্দা করো তুমি,মাথা করো নত!এ আমার,এ তোমার পাপ!?

গুরুদেব তোমার এই পচাত্তর প্রয়াণ বৎসরে.........বাই শে শ্রাবণ।

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬

এ কোন আবেশ......?
সলিল সরকার
আমাদের শৈশব অতি প্রাচীন এবং ফসিলসম প্রস্তরীভূত নিরুত্তাপ,নিস্তেজ,নিরা্সক্ত ন্যাকামো আজকের নিরিখে।আর আমাদের মনে হোতো এমন নিষ্পাপ নিরুপায় অনিশ্চয়তায় কী নিদারুণ নিষ্কলঙ্ক নিরুপদ্রব নিখিল নিরালা।
আমাদের উত্তেজনা ছিল নতুন সিলেবাসের পুরানো বইয়ের পেন্সিলের দাগ আর হাতে হাতে ফেরা বাসি গন্ধে। আমাদের কৌতুক ছিল সমবয়সী কারও বোতামখোলা পোস্ট অফিসে।আমাদের পাপ ছিল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আপন আপন অঙ্গ নিয়ে ডাংগুলি খেলায়।আমাদের পুন্য ছিল অলস দুপুরে কোনও বুড়ির পাকাচুল বেছে দিয়ে পয়সা রোজগারে যা দিয়ে পাওয়া যেত এক প্লেট দোকানের ঘুগনি কিম্বা একটি আইস্ক্যান্ডি নয়ত কয়েকটি বিশুদ্ধ সিগারেট লজেন্স!
গোঁফে চুলের হাল্কা রেখা,দাড়িতে মায়াবি আলগোছ আর নিষিদ্ধ গোপন ভূমিতে অমোঘ অসোয়াস্তি আমাদের পাপবিদ্ধ করত।কারও মুখে অশ্রাব্য গালাগাল আমাদের হাতের তালুকে শক্ত করে চড় কষানোর উপযুক্ত করে তুলত।কারও অশালীন অঙ্গভঙ্গি আমাদের পীড়িত করত।কোনও অকালপক্কের হস্তমৈথুন কি হাতের বিড়ি ও সিগারেট আমাদের হীণমন্যতায় ভুগতে সাহায্য করত না।এইটুকু পড়েই মনে হোতে পারে আমি আমার সময়টিকে সধবার একাদশীর মতো বর্ণময় বর্ণহীণতায় উন্মুখ।
আমাদের ছিল অপরিসীম কৌতুহল।আমাদের ছিল অপার বিস্ময়।আমাদের ছিল অহেতুক আগ্রহ।আমাদের ছিল অযাচিত উৎকণ্ঠার উৎসাহ।আমাদের ছেলেমানুষী ছিল ছেলেবেলার মতোই।বাজারের পয়সা মেরে তেলেভাজা খেয়ে সারা রাস্তা হা হা করে গন্ধ তাড়ানোর অক্লান্ত অধ্যবসায়।শেষে মরিয়া হয়ে তুলসী পাতা ভক্ষণ।এ যেন বৈষ্ণবকুলের পাঁঠার মাংসে তুলসীপাতা ব্যবহারে নিরামিষ করে তোলার প্রয়াস।আমাদের মধ্যে যারা অকালে পাল্লায় পড়ে সিগারেট খেয়েছে তাদের ধূমপানের স্থান ছিল মশার কামড় খাওয়া বাঁশবন।সদ্য বিবাহিত পুরুষটি যেমন উত্তেজনার নিরোধ ক্রয় করত দূরের কোনও ওষুধের দোকানেই।মেয়েদের মাসের যন্ত্রণা মেলা থাকত অন্দরের আড়ালে।আজকের মতো প্রকাশ্য রাস্তার ডাস্টবিনে মাড়িয়ে যেতে নয়।
আমাদের যৌনতা এসেছে কালের স্বাভাবিক গতিময়তায়।সদ্য বিবাহিত দম্পতির বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা বটতলা প্রকাশকের সস্তা ছাপা “জীবন যৌবন” বইয়ের পাতায়।নয়ত সদ্য কেনা গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার “শীঘ্র পতন?দ্রুত স্খলন?স্ব্প্নদোষ?ধাতু দৌর্বল্য?অনিয়মিত মাসিক?যৌবন ধরে রাখার অমোঘ বটিকা!”বিজ্ঞাপনে। পঞ্জিকার “মায়াদর্পণ” অর্ডার দিয়ে কেউ কাউকে বশ করেছিল কি না জানা নেই।তখন যদি আজকের মতো ‘স্ন্যাপডিল’ কি ‘ফ্লিপকার্ট’ থাকত কী হোতো জানি না!তবে জড়িবুটি,তাগা-তাবিজ,জল পড়া,বিপত্তারিণীর ডোর তখন ছিল এখন যেন একটু বেশিই আছে।
আমরা নিষিদ্ধ খাদ্যাভ্যাসে সিদ্ধ হয়েছি প্রয়োজনের তাগিদে,সারাদিনের অভূক্তির চেয়ে সস্তার পুষ্টিতে লাভ ছিল,লোকসান ছিল না।মদ্যপানের আসক্তি কি কৌতুহল উচ্চমাধ্যমিকের পর।আমার কবি বন্ধুরা কি চলচ্চিত্র চর্চাকারী চাকুরীজীবীরা চোলাই কি বাংলা খেত জাতে উঠতে।শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিম্বা ঋত্বিক ঘটক হোতে।উচ্ছন্নে যাবার সহজ পথে ধেঁধেছে অনেকেই।আবার দু একটি স্ফুলিঙ্গও যে জেগে ওঠেনি তা বলি কী করে?
আমরা নিষ্ঠুর হয়েছি মাছ কাটার কালে কি মুরগীর মাথায় ঠোনা মেরে ছাল ছাড়িয়ে আর পুজোর বলি দেখে।আজকের মতো হর্ষকাম ও মর্ষকাম প্রায় দুষ্প্রাপ্য ছিল তখন।গণ-টোকাটুকি,গণ-পিটুনি দেখেছি রাজনৈতিক অস্থিরতায়।গণ-হত্যাও দেখেছি রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দাদা ও পুলিশগিরিতে।বোতল ভাঙতে দেখেছি ল্যাম্পপোস্টের গায়ে নেশায়চুর মোদোমাতালকে।বৌ পেটানো বর দেখেছি।বর পেটানো বৌও দেখেছি খুব একটা কম নয়।সিফিলিস-গনেরিয়ার রোগী দেখেছি ডাক্তারের ডিস্পেন্সারিতে ঘরে ঘরে নয়।
মনোবিদ ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি বলেছিলেন সংবাদ মাধ্যম ও টেলিভিশনের কর্তাদের-“আপনারা যত ইচ্ছা যৌনতা দেখান।যৌনবিকৃ্তি দেখাবেন না।দোহাই আপনাদের ভায়োলেন্স দেখানো থেকে বিরত থাকুন।ওটাই সমাজকে ক্রাইম আর ক্রিমিন্যালের ডেরা করে তুলবে!”

হায় কবিরাই একা সত্যদ্রষ্টা হন না।