MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

মন (খারাপ)খেরোর খাতা/রিও-পুচুং ও অন্যান্যরা
সলিল সরকার
ভেবেছিলাম লিখব না।আমার নিজের মন খারাপের কথা সবাইকে জানানোর কীই বা প্রয়োজন?ভেবেছিলাম ব ল ব না!আমার বুকের ক্ষতের ব্যথা সবাইকে দেখাব কেন? আবার এটাও ভাবলাম কোনও কিছুই কি আমার একার ?ব্যক্তি আমি যা ব্যক্ত করি তা কী কখনও একান্ত ব্যক্তিগত হোতে পারে ?
আমার শৈশবে অনেক পুষ্যি ছিল।তারা যে সব আমার পোষা ছিল তা নয়।আমাদের ভিকিরিপতির বাড়িতে গন্ডা গন্ডা বেড়াল সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত।তাদের কিছু বলা যেত না।তারা আমাদের মা-কাকিমাদের পায়ে পায়ে ঘুরত খাবারের জন্যে।রান্নাঘরে যখন তখন দুধের কড়ায় মুখ দিত।খড়ের চালে উঠে কাঠবিড়ালির ল্যাজ কেটে আনত।আর শীতকালে মশারি ছিড়ে আমাদের লেপের ভিতরে আরাম করতে ঢুকে পড়ত।কিচ্ছু বলা যেত না।বাবার বারণ ছিল।আমার ছোট বোন-এর ‘ডিপথরিয়া’ হোলো।বেলেঘাটা আই ডি তে থাকতে হয়েছিল তবুও ওদের কেউ তাড়ায়নি।ওরা আমাদের সংসারে ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন।ওরা পোয়াতি হোলে পরম যত্নে ঘি-চিড়ে খাওয়ানো হোতো নাগেদের দাদুর বাড়িতে।আমাদের বাড়িতে অতটা না হোলেও তাদের খাতির যত্নের কমতি ছিল না।মিথ্যে বলব না-ওরাও খাটা-খাটনি করত।
বাড়ির ধেড়ে মূষীকপ্রবরদের গুষ্টির তুষ্টি করত।বিষধর সাপেদের গিলে খেত আর বরষায় ডাঙ্গায় উঠে আসা জিওল মাছেদের আগলে রাখত এ কথা আমি আগেই লিখেছি।আমাদের বাড়িতে কোনও হুলো ছিল না।হুলো জন্মাবার পর বড়ো হোয়েই পালাত।কেন কে জানে ?কিন্তু সময়ে তারা হাজির হোতো।ফ্যাঁচ ফোঁচ করত আর কাজ মিটে গেলেই চলে যেত।কষ্ট হোতো বাচ্চা হবার পর কমজোরি বাচ্চাগুলো যখন মরত,নয়ত কাক-চিল ছোঁ মেরে নিয়ে যেত।বাচ্চা মরলে বেড়ালদের কাঁদতে দেখিনি।কাঁদতাম আমরা যারা ভালোবাসি পুষ্যি।আর আমরা যেটা ওদের কান্না ভাবতাম সেটা যে আসলে ওদের প্রজননের শ্যামের বাঁশি সেটা বুঝেছি অনেক পরে।
আমাদের কিছু পোষা মুরগী ছিল।আমি তাদের কেটে খেতে পারতাম না।আমার পোষা কয়েকটা খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস ছিল।তারা জলের চেয়ে ডাঙ্গায় থাকাটাই বেশি পচ্ছন্দ করত।তাদের পা খোঁড়া হোলে বা ভেঙে গেলে কেরোসিন তেল গরম কোরে লাগিয়ে কাপড় বেঁধে দিতাম।একবার একটা হাঁস মারা গেল।আমি তার শোকে সাতদিন কিছু না খেয়ে শুধু কাঁদলাম।আমার সেই ছোট্ট আমিকে আজও আমি ‘বোকা’ বলি না, বরং ভালোবাসি।
আমাদের দেশের বাড়ির পুকুরে অনেক মাছের মধ্যে একটা ঘেটো রুই পোষ মেনে গিয়েছিল।আম্রা তাকে গণেশ বলে ডাকতাম।বরষার জলে পুকুর ভেসে গেলে সব মাছ পালিয়ে যেত গণেশ পালাত না।সে আমাদের হাতে ভাত খেত।না খেলে বকুনি খেত।ছিপ ফেলার সময় সব মাছ তাড়িয়ে দিত।সে আমাদের বাড়ির এক সদস্য ছিল।
তার মারা যাওয়াটা তার হাতে ছিল না।আমার এক কাকার বিয়েতে তাকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল।আমরা ছোটোরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম।আর কেঁদেছিলাম।তখন আর কীই বা করতে পারতাম।সেই মাছ আমরা বাড়ির কেউ খাইনি।
কোলকাতায় এসে নিজেকে নিজেই পোষ মানাতে বেশ বেগ পেয়েছিলাম।তাই এখানে আমি কিছু পুষতে চাইতাম না।সল্ট লেক এ যখন থাকতাম একটা মাছবাসা (অ্যাকিউরিয়াম)করেছিলাম।সেখানে শীতকালে মাছ মারা গেলে ভোরবেলা মা সেই সংবাদ দিয়ে বলত-আর মায়া বাড়াস না।আমি তখন কাঁদতাম না ঠিকই তবে সকালবেলা মনটা ভার হোয়ে যেত।রাত্রে ফেরার পথে আবার প্যাকেটে মাছ নিয়ে আসতাম।
বাগুইআটির আবাসনে নিজের সংসারে মেয়ের জন্যে না কী নিজের জন্যেই একটা মস্ত মাছবাসা আনলাম।তাতে সমুদ্রের মাছ(মেরিন ফিস)থেকে দেশি মাছও পুষতাম। একবার মাছের বাজারে পুচুংকে পেয়ে গেলাম।ও আমাদের বাড়িতে এসে কী খুসি!ক্রোকোডাইল ফিস থেকে খলসে সবার সংগে ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে না পেরে সবাইকে খেয়ে ফেলেছিল।শুধু খলসেটা ওর বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।আমি যত রাত্রেই বাড়ি ফিরি ও জেগে থাকত।মাম্মামের সংগে লুকোচুরি খেলত।আমাদের বিছানায় লেপের তলায় উঁকি দিত।আমি শান্তিনিকেতনে চলে আসায় ও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিল।এক মহালয়ার রাত্রে ও সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল।তারপর থেকে আমি সব পোষা ছেড়ে দিয়েছি।
তবু আমার বারান্দায় পাখিরা আসে।জল খায়।আমার দেওয়া খাবার খায় আর উড়ে যায়।আমি তাদের ধরে রাখি না।
শান্তিনিকেতনে নীলাঞ্জনদের বাড়ির ‘কুরো’ আর ‘শিরো’ আর পাঁচজনের মতো আমাকেও চেনে এবং পাত্তাও দেয়।ওরা বেশ সেলিব্রেটি তবুও......!আমি যেন ওদের আগে যেতে পারি।
আমার বন্ধু সাগর তাদের পরিবারের একজন ‘রিও’ যে আমারও প্রিয় ছিল।ওদের বাড়িতে গেলে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত।পথের কুকুরদের দুবেলা খেতে দিতে বাধ্য করত।বাড়ির কেউ না ফেরা অব্দি দুঃশ্চিন্তা করত।সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হোয়ে চলে গেছে শুনে আমি স্মৃতিমেদুর হোয়ে উঠলাম।

আমি মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার পত্রে সাক্ষর করেছি আন্দোলনের শুরুতেই।যাতে আমার দেহটা মরার পরেই কাজে লাগে।আজ আমার শোকের কিছুটা বিলিয়ে দিলাম হয়ত বা অকারণেই।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন