MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬

যেখানেই সম্ভাবনা সেখানেই উৎসব...।যেখানেই উৎস সেখানেই শব...।।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে “DEAD LIKE DODO”কালের নিয়মে নয়,মানুষের লোভ আর হ্যাংলামোপনায় ডোডো পাখিরা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।এভাবে অনেক প্রাণ,অনেক প্রজাতি হারিয়ে গেছে এই দুনিয়া থেকে যদিও তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।যেমন করে তিমি,ডলফিন,কচ্ছপ,বাঘ,সিংহ,পান্ডা,ভালুক,বেজি,বাঘরোল,ভোঁদড়, গন্ধগোকুল,গোসাপ,সাপ,শংখচিল,ঈগল,ভদ্রলোক ইত্যাদি,প্রমুখ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময় আর সমাজ থেকে।যদিও আমার ধারণা এ দুনিয়া থেকে কিছুই হারাবে না(মানুষ যতই মরিয়া হোয়ে এদের মেরে ফেলুক)যদি প্রকৃ্তি চায় একদিন তারা আবার ফিরে আসবে।আর এদের কেউ কেউ লুকিয়ে বেঁচে আছে।এরা ফিরে আসবে।আসবেই।
এরা যেমন মানুষের লোভ আর হত্যালীলায় ফুরিয়ে যাচ্ছে আবার এই মানুষই কালের নিয়মে হারিয়ে যাওয়া,প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া বিষয়-আশয় ফিরিয়ে আনছে।আমার ছোটোবেলায় দেখা কতো উৎসব(আনন্দ নয়)প্রয়োজন ফুরিয়ে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।আজ তারা আবার কী অদম্য প্রচেষ্টায় ফিরে ফিরে আসছে।অযোধ্যায় অতি প্রাচীণ ও বিস্মৃতপ্রায় ‘বাবরি মসজিদ’ ক’জন মানুষেরই বা জানা ছিল সেটা ১৯৯২ এর ৬ডিসেম্বর মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা হোলও ‘রাম বনে ফুল পাড়ে’ না।রাম মনেই বাসা বেঁধে আছে।সেইদিনের ঘটনার আগে পরে কতো জান ও জীবিকা নিঃশেষ হোলো।কতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিরে এলো।কতো ধর্মীয় উন্মাদনা(দুই সম্প্রদায়েই)মাথা চাড়া দিল।বিপুল বেগে রক্তের স্রোত বইতে থাকল নদি-গিরি-উপতক্যায়।আমরা ফিরে পেলাম কতো উৎসব...।কতো রক্তের স্নান।কতো ধর্মের জিহাদ।
আমাদের ভিকিরিপতি গ্রামে উৎসবের খামতি ছিল না।বারো মাসে তেরো পার্বণ সে তো ছিলই।পাঁজি-পুঁথিতে লেখা আচার-বিচার-পুজোআচ্চা আর চড়ক-গাজন,ঈদ-মহরম।এ বাদেও যে কোনও ছুতো-নাতায় মেতে উঠতে ভিকিরিপতির জুড়ি মেলা ভার ছিল!রথযাত্রা দিয়ে যেমন চিৎপুর যাত্রাপাড়ায় বায়না শুরু হয় গ্রামেও রথযাত্রা ছিল বেশ বড়োসড়ো উৎসব।রথের পরেই ঘরে ঘরে ‘বিপত্তারিণী’।এর মাঝে অমাবস্যা অম্বুবাচী তো আছেই।এর পরেই বিশ্বকর্মা।তখন ওটা বারোয়ারি ছিল না।ঘরে ঘরে ঠকঠকি(তাঁত)ছিল আর ছিল লোহার কারবার।নাপিত,কামার,কুমোর এরাও পুজো সারত নমো নমো করে।ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়।শরতে দুর্গাপুজো ছিল সব বাড়িতে নয়,তবে সবার জন্যে।বিজয়ায় প্রণাম আর মিষ্টি খাওয়াটা ছিল লোকাচার।ধর্মাচার নয়।
এইখানে একটা কথা না বলে পারছি না।ইদানীং যেমন সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা বেড়েছে আবার কিছু মানুষ যখন সোচ্চারে ‘আমি নাস্তিক’, ‘আমি নাস্তিক’ বলে সদ্য গজানো শিং উচিয়ে নরম কাদা থেকে শক্ত পাথরে শিং ঠোকে সেটাকেও আমার সমান মৌলবাদী না হোলেও উন্মাদনার প্রকাশ মনে হয়।সেকালে যারা হাজার ধর্মভীরু মানুষের পাশে বসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হোয়েও ঠাকুরের প্রসাদ খেতে অনীহা দেখাত না কিন্তু পায়ের জুতো খুলে ঠাকুরকে প্রণামও করত না।প্রণাম নিতও না।কিন্তু সম্মানীয়দের প্রণাম করতে কুণ্ঠিত হোত না।আবার মা-বাবা মারা যাবার পর মাথা কামিয়ে শ্রাদ্ধ করা কি চুল না কামিয়ে বামুন ঠাকুরকে মূল্য ধরিয়ে দেওয়া এই ভন্ডামিটা তারা করতেন না।যদিও বাকি ভাই-বোন কি আত্মীয়-পরিজন তার জন্য তাকে দূরাচারী দুর্বৃত্তও আখ্যা দিত না।কিছুটা এক ঘরে হোয়ে থাকতে হোত এটাও সত্যি।ঠিক যেমন অনেক আস্তিক মানুষও তার পরিবারে একা।বাকিরা নাস্তিক বলে নয়।বাকিরা ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতে মাথা খুঁটে মরে বলে।
গ্রামের ঘরে ঘরে মনসা পুজো আর সেই সূত্রে ‘অরন্ধন’ ছিল অবশ্য করণীয় লোকাচার।যেদিন যার বাড়িতে ‘অরন্ধন’ হবে সেদিন তাদের আমন্ত্রণে গ্রামের সব বাড়িরই এই বাড়িতে ‘হাঁড়ি বন্ধ নেমন্তন’!কারও বাড়িতে সেইদিন উনুন জ্বলবে না।সেদিন গ্রামের সব বাড়িতে মাটির উনুন গোবর জলে ধুয়ে মুছে আলপনা দিয়ে তার মাঝখানে একটা ফণীমনসার পল্লব রেখে দেওয়া হবে।আয়োজকদের বাড়িতে আগের দিন সব রান্না করে ঠাণ্ডা ভাঁড়ার ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখা থাকবে।কী কী রান্না হোতো?তাহলে বলি শুনুন – পান্তভাত,লালশাক,সজনে শাক,পিড়িং শাক,শুষনি শাক,গিমে শাক,নটে শাকএতো গেল শাকের কথা।এবার আসি ভাজাভুজিতে-লাউভাজা,কুমড়োভাজা,ওল ভাজা,শশাভাজা,ঝিঙেভাজা,আলুভাজা,উচ্ছেভাজা,বাংলা করলা,পটলভাজা,বেগুনভাজা,ঢ্যাঁড়সভাজা,বরবটিভাজা ইত্যাদি ইত্যাদি।এবার শুক্তো, কুমড়োর ছ্যাচড়াঁ,মুগডাল সেদ্ধ,খ্যাসারি ডাল সেদ্ধ,ছোলারডাল সেদ্ধ,মটরডাল সেদ্ধ, পুঁইশাকের চচ্চড়ি।নারকেল দিয়ে চাল কুমড়োর ‘কুমড়ি’ ছিল অনবদ্য রান্না।এবার মাছ-চিংড়ি মাছ,ইলিশ মাছ(বাড়ির যারাই শহর থেকে গ্রামে আসত তারা জোড়া ইলিশ না নিয়ে বাড়িতে ঢুকত না)।নিরামিষ টক ও অম্বল হোতো বেশ কয়েক রকমের।কাঁচা তেঁতুলের টক,লাউয়ের টক,ইলিশের টক,চিংড়ির টক।নিয়ম যেমন ছিল তেমনি তার পাশ কাটানো বেনিয়মও ছিল বৈকি।সবাই কতো ঠাণ্ডা ভাত খাবে?তাই উঠোনের বাইরে তোলা উনুনে গরম ভাত করা হোতো।আর ইলিশ মাছ গরম গরম ভেজে মাছ ভাজা আর ইলিশের তেল।ষাট/সত্তর অব্দি জোড়া ইলিশের দাম ছিল দুই থেকে চার টাকা(ওজন করে নয়)যারা এক একটি হোতো দেড়-দুই সের।
ঘেঁটু পুজোয় যেমন বাড়ির সব দেওয়ালে ঘুঁটে দিয়ে সীমারেখা টানা হোতো আর দরজার উপরে গোবরের ড্যালায় কড়ি গেঁথে সেঁটে দেওয়া হোতো।আর ঘেঁটু ফুলের গন্ধে আমোদিত হোতো সারা গ্রাম।ঘেঁটুপুজোর মতো ‘ইতু পুজো’ও হোত, ‘শীতলা পুজো’ও হোত।গ্রামের লোক বলত ‘শয়লা পুজো’।দক্ষিণ প্রদেশ থেকে ‘সন্তোষী’ বাংলায় আসার আগে গ্রামের কালী মন্দিরের পাশে ‘শনি’পুজো হোত।সিদ্ধার্থশংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী হবার পর সাট্টা জুয়ার পাশাপাশি সন্তোষী এলো।আর বামফ্রন্টের কালে পাড়ায় পাড়ায়,অলিতে গলিতে ফিরে এলো ফি শনিবার শনিপুজো।তার সংগে গুরুপুজো।আর এলো বাবার মাথায় জল ঢালার ঢল।সবাই হয়ে পড়ল “বাবা তারকনাথ” সিনেমার সন্ধ্যা রায়।রাস্তাজুড়ে বাঁক কাঁধে ছুটে চলা চ্যালা-চেলীর উন্মত্ত উল্লাস আর স্থানে স্থানে তাদের উৎসাহ দিতে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে যুবাদের অপেক্ষা।ব্যস্ত পথ ঘিরে “সার্ব্বজনীন”(সর্বজনীন লেখা দেখেছি ক্বচিৎ,কদাচিৎ)বিশ্বকর্মা থেকে কার্তিক-গণেশ, জয় মা মঙ্গলচণ্ডী থেকে জগদ্ধাত্রী সবের রম রমা হোলো বামফ্রন্টের কালেই।সাতদিন জুড়ে দুর্গাপূজা করপোরেটশ্রী হোলো।আজ পুজোর চেয়ে পুরস্কার বেশি।আকাশবাণী কলকাতার মহালয়া অনুষ্ঠানে ধর্মের চেয়েও বেশি ছিল গানের ধর্মপালন।তার কথা-সুর-গায়ন আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত আবেগ তাকে জনপ্রিয় করেছে।হিন্দু পৌত্তলিকতার মৌলবাদ নয়।এ বাংলায় বসবাসকারী এমন কোনও বাঙ্গালি আছেন যিনি বা যারা কোনো না কোনও ভাবে আকাশবাণীর উদ্ভাবন মহালয়া শোনেন নি?
ষাট-সত্তর দশকেও সারা গ্রামে একটি-দুটি বাড়িতে রেডিয়ো ছিল।অনুরোধের আসর থেকে থেকে শুক্রবারের রাত আটটার আর রবিবারের দুপুরের নাটক শুনতে মানুষ যেমন হাজির হোত ভোর চারটেয় মহালয়া শোনার জন্যেও মানুষ গুটি গুটি পায়ে জড়ো হোতেন।ঠিক যেমন পাড়ায় কোনও বাড়িতে যাত্রার আসর বসলে মাইক বাজিয়ে কাউকে ডাকতে হোত না।আপনা থেকেই জড়ো হোত মানুষ।কিন্তু কোনো পালা বা পার্বণে কাঙ্গালিভোজন করাতে চাইলে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হোত।বিনা আমন্ত্রণে এক পেশাদার ভিখারি ছাড়া আর কেউ আসত না।কিন্তু কোনো হুজুগ এলে মানুষ এক লহমায় হাজির হোয়ে যেত।
কোনও বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে মেয়েরা ছেলে কোলে,কলসী কাঁখে হাজির।পাড়ায় নতুন জামাই এসেছে বুড়ো-বুড়ি,কচি-কাচা থেকে বাড়ির বৌ-ঝি হাজির।কেউ বরকে ছেড়ে পালাচ্ছে-সবাই হাজির।কেউ বৌকে পেটাচ্ছে কি বৌ পরম সুখে কান্নাজুড়ে বরকে পেটাচ্ছে সেখানেও হাজির সব্বাই।রাত-বিরেতে চেনা চোর ধরা পড়েছো ঘুম চোখে সবাই হাজির।আর যেবার চোর খুঁজে পাওয়া যেত না তখন গ্রামের স্থায়ী চোর ভজাকে ঘুম থেকে তুলে এনে পেটানো হোত।ভজার ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগত।বোঝার পর শরীরটাকে ছেড়ে দিত। কাঁচাঘুম ভাঙা মানুষ হাতের সুখ মিটিয়ে ভজাকে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত।ভজা তার পরে চুরি করতে বেরোত।কারণ ভজা নিজের প্রয়োজনে চুরি করত না।কারও না কারও গোপন ইশারা থাকত সেই চুরিতে।আর চুরির দ্রব্য যেত তার বাড়িতেই।যদিও ভজা কোনদিন মার খেয়ে আধ মরা হয়ে গেলেও‘এথিক্স’ ভেঙে প্রকৃ্ত বাটপাড়টির নাম ফাঁস করে দিত না।এও ছিল এক নৃশংস উৎসব।
শীতকালেব ভিন্ন প্রদেশের মানুষজন মেষ-ভ্যাড়া-শুয়োর চরাতে আসত।গ্রামের বাচ্চাকাচ্চা তাদের পিছনে দৌড়ত।একবার একটা বাচ্চা শুয়োর কচুবনে ঘুমিয়ে পড়েছিল।রাতেরবেলা সে যখন ঘুম থেকে উঠে তার মাকে খুঁজতে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে আর গ্রামের উৎসাহীরা তাকে ধরতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে সেই সময় মেষপালক এসে কৌশল খাটিয়ে ধরে ফেলল।গ্রামের মানুষের এবার ঘরে ফেরার পালা।সেই সময় তাদের কথোপকথন ছিল এই রকম-
-উফ কী বাঁচছি!
-কেন শুয়োরের বাচ্চাটা তোরে কী করছিল?
-আর বোলোনি মুই তাল বুঝে তাকে ধরতে গেছি যেই অম্নি শুয়ারটা আমার এঁড়তল দিয়ে পালাল।আর একটু হোলে মোর বিচিটা
কথাটা শেষ করতে পারল না উৎসাহী ছেলেটি।এক বয়স্ক মানুষ আমাদের দেখে চাপা স্বরে বল্লে
-এই কচি চুপ মার।
-কেন?কী হচে?
-সরকার বাড়ির ছ্যানাপুনারা শুনলে কী কইবে?এঁড়তল না কয়ে পোঁদতল ক।
এও ছিল গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক হঠাৎ উৎসব।
সবচেয়ে মর্মান্তিক উৎসব হোতো যখন কেউ মারা যেত।বিশেষ করে প্রচণ্ড শীতে কি অঝোর বর্ষায় কেউ মারা গেলে মড়াপোড়ানোর দলবল উদোম গায়ে কোমরে গামছা জড়িয়ে পৌঁছে যেত।তাদের হাতে পোড়ানোর কাঠ কাটার কুড়াল আর মাটি খোঁড়ার কোদাল ওঠার আগে তুলে দিত হোত বোতল বোতল চোলাই।একটি জনপ্রিয় ছড়া সবার মুখে মুখে ফেরে
“বিদ্যাসাগরের মেন্নিপুর/ভাকু তেলে ভরপুর”
দাহের শব শ্মশানে পৌঁছনোর পর প্রায়শই মৃতদেহ সৎ্কারের কাজটি বাড়ির লোকজনকেই সম্পূর্ণ করতে হোত।কারণ তারা তখন মৃতের মতো শায়িত মৃতের কাছেই।এও ছিল আর এক শোক উৎসব!এরকম আরও অনেক শোক ও সখের উৎসব ছিল সেই ভিকিরিপতি গ্রামে।যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
এবার যেমন উৎসবের দিনগুলোয় ব্যাংক বন্ধ কিন্তু খোলা থাকছে মদের দোকান আমোদের জন্যে।এখন যেমন অনেক আগে থেকেই অকাল বোধন উৎসব বাংলার কিছু মানুষের মনে খুশির তুফান আনে।আর বাকিরা? “ছাগলছানা লাফিয়ে চলে/জাহাজ ভাসে সাগর জলে”!

   

1 টি মন্তব্য: