MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭

ান, পাঁচালি, কীর্তন, বাউল,ফকিরী,ভাটিয়ালি, পদাবলী।এই ভাটিয়ালি ভাটের হোলো ব্রিটিশ আমলে মুৎসুদ্দী আর মুর্শিদাবাদ থেকে বেইমানির ধন রাতারাতি নৌকায় করে কোলকেতায় এসে সাহেবি খেতাব পাওয়া বাবুদের অকল‍্যাণে।খেউড়,ঢপ,তরজা,কবির লড়াই তখনই তো জমে উঠল বাগান বাড়ির ফুর্তিতে।হারিয়ে গেল বাংলার নাটপালা।জাত খোয়াল যাত্রা।এ আমার কথা নয়।হুতোমের বর্ণনামালা। জমিদার, জোৎদার,মফঃস্বল,মুৎসুদ্দী, মধ‍্যস্বত্বভোগী,চাপলুসি(স্তাবকতা), রিস ওয়াৎ(ঘুষ),বে ইমানি,বে শরমি,বে হায়া, বে আদবি এমনকি পরশ্রী ও পরস্ত্রীকাতরতা সবই এলো সাহেবদের হাত ধরে।আজকের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, পরের বউ ফুসলানো,কথায় কথায় ডুয়েল লড়াই, জানালা গলে ঘরে ঢুকে পরকীয়া তাও এলো ওদের থেকেই। মনে হবে ধান ভানতে শিবের গাজন গাইছি।একটুও না।গাজন আমাদের ছিল কিন্তু ছুঁচোরকেত্তন ওদের দেওয়া।
এইভাবে থ‍্যাটারটাও যদি ওদের থেকে না নিতাম "রক্তকরবী","শর্মিষ্ঠা","চাঁদ বণিকের পালা","কীত্তনখোলা","যৈবতী কইন‍্যার মন","প্রাচ‍্য" আমরা পেতাম না?
ময়মনসিংহ গীতিকা ছিল।গীতগোবিন্দ ছিল।রবীন্দ্রনাথ গান লিখতেন বিদেশি সুর ছাড়াই।আর লালন,হাসান রোজা, পটের গান হোতো আমাদের চলচ্চিত্র।
শুধু নিন্দে করি কেন ওরা আমাদের সনেট দিয়েছে, সেক্সপিয়র দিয়েছে।প্রসেনিয়ম দিয়েছে বলেই না করে কম্মে খাচ্ছি।রোবিন থিয়েটার করে খেতে পেত কি না জানি না,তবে থিয়েটারেই বাঁচত।বিশেষ করে মফস্বলের প্রতিযোগিতা মঞ্চে আর নাট‍্য সভায়।এই সেদিনও মফস্বল ছিল একাংক নাটকের উদ্গাতা।সুস্থ বিনোদনের মিলন ক্ষেত্র।শহরের থিয়েটার কল শো করতে যেত নিজের তাগিদে, রসদ জোগাড়ের প্রয়োজনে। আজ আর্থ সামাজিক কারণে বাম আমলেই চিত্র পাল্টেছিল।আবার পাল্টাল।আগে ছিল শহরের নাট‍্যদাদা মফস্বলের ভাই।এখন সবাই।খড়দহর কনক রায় ওখানেই "চাঁদ বণিকের পালা" করেছিলেন।তার ছেলে দেবাশিস এই শহর দাপিয়ে থিয়েটার করে। গোবরডাঙার আশিস রবীন্দ্রভারতীর শিক্ষা কাজে লাগিয়েছে বাংলার মঞ্চে।তার মেয়ে ভূমিসুতা বাংলার গৌরব।এমন কতো নাম আছে।উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণ।রবীন্দ্রনাথ দাস কিন্তু একটাই ছিল।আর কেউ যদি থাকেন যা আমার অজানা আমাকে জানাবেন।
অকাল প্রয়াণের আগে তার কথা যেন লিখে যেতে পারি।
রবি বাউল নাট‍্য দাস
সলিল সরকার
ভেবেছিলাম কিছুই লিখব না।কী হবে লিখে?কী হয় লিখে!বরং না লিখতে পারলে অনেক কিছু প্রাপ্তি হয়।আর লিখতেই যদি চাও তাদের নিয়ে লেখো যারা তোমাকে দিলেও দিতে পারে কিছু টুকরো সম্মান, খুচরো অনুপান।তবু
"হাওয়া বয় সনসন্ তারারা কাঁপে
হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে!"
মানুষটিকে দেখেছিলাম ছেষট্টি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের গ্রুপ থিয়েটার, গণনাট‍্য দপ্তরে।ফেলোশিপ পেয়ে বাংলা নাটক নিয়ে গবেষণা শেষে ঠাঁই হোলো সাড়ে সাতশো টাকার দপ্তর সম্পাদক।এক চিলতে ঘুপচি ঘরে গ্রাহক চাঁদা,বিজ্ঞাপন সংগ্রহ থেকে পত্রিকা বিক্রি সব করতে হোতো।দূর দূরান্ত থেকে যারা আসতেন তারা স্বাভাবিক চোখেই দপ্তরের কেরানি ভাবতেন আর কলকাতার থিয়েটারের লোকেরা করুণার চোখে তাকাতেন।
এর মধ‍্যেই একমুখ সাদাদাড়ি,সাদা কেশ,সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর রঙিন ঝোলা যাতে সারা রাজ‍্যের নাটকের তত্ত্ব তালাশ নিয়ে যে মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন- আমি রোবিন দাস নাটকের কাজ করি।আপনার লেখা আমার ভালো লাগে।আপনাকে আমি আলোচনা সভায় নিয়ে যেতে এসেছি।
তার বাড়ি কোথায় জানতাম না।কখনও মনে হয়েছে কসবা,কখনও বা কাঁকিনাড়া।কখনো আমোদপুর কখনো আসানসোল।কখনো কল‍্যাণীতে, কখনও বা কাটোয়ায়।
মফস্বল থিয়েটারের তত্ত্ব তালাশ শুধু নয়, শহরের থিয়েটারের নাড়ী নক্ষত্র তার নখদর্পণে।বস্তুত বাংলা নাট‍্য তার আনখশিরে।
একবার আমাকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন খিদিরপুর ডক পেরিয়ে কোন প্রত‍্যন্ত গঙ্গার ধারে যেখানে যখন তখন নদীর পাড় ভেঙে মানুষ বসতি হারায়।আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছি আর ভাবছি এখানেও নাটকের কাজ হয়?মানুষ নাটক করে, আলোচনা শোনে?আর রবীন্দ্রনাথ দাস একসঙ্গে উদ‍্যোক্তা, বক্তা এমনকি স্পনসর তার জোগাড় করে দেওয়া।শিল্পী ও শিল্পকে সম্মান জানানো তার মজ্জায়, শিরায় শিরায়। তখন সারা বাংলায় অনুদান, অনুকম্পা,অনুগ্রহ,অনুশাসন ছাড়াই থিয়েটার হোতো।যার যা সামর্থ‍্য,যার যা দক্ষতা তার সংগে আন্তরিকতা মিশিয়ে ঘরের খেয়ে নাট‍্যবনের মোষ তাড়ানোয় গর্ববোধ করত।নিজের চোখে দেখেছি বাড়ির মানুষ জন কী আন্তরিকতায় আমাদের আপন করে নিতেন।ওরা কাউকে সেলিব্রেটি ভাবতেন না।কোনো বাজারেই নাটকের কোনও প্রচার স্টল ছিল না।কাঁচরাপাড়ার নাটকের দল কুলটিতে ভালো নাটক করে পুরস্কৃত হলে,রিষড়ার গ্রুপ রূপনারায়নপুরে নাটক করে মন জয় করলে মানুষ সারা বছর আলোচনা করত।নাটকের কাজে সারা বাংলা ঘুরতেন রবীন্দ্রনাথ।নাটকের জন‍্যেই চাকরি ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নেই তাও কি হয়?
ছিন্নমূল শোভা সেন
সলিল সরকার
-তুইই সলিল
-হ্যা।কেন?
-উৎপল তোর কথা বলত।তোর লেখা পড়ত।আমাদের বাড়িতে আসিস
এই কথোপকথন উৎপল দত্তের মৃত্যুর কয়েকমাস পরের অবশ্যই শোভাদির সংগে তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরে এক বিকেলে।উপলক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে কলকাতা শহরের তিনশ বছর পূর্তিতে এই শহরের অবলুপ্ত নাটমঞ্চগুলি যা চিহ্নিত করেছিলাম সেগুলিতে ফলক বসানো।এই কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার, অধ্যাপক বিষ্ণু বসু, নাট্যব্যক্তি ও অধ্যাপক কুমার রায়, শোভা সেন ও সলিল সরকার।
এই শহরে ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৫ তে রাশা দেশের এক ভয়লাবাদক পরিব্রাজক গেরাসিম স্তেপানোভিচ লিয়েবেদেফ ডোমটোলা স্ট্রিটে ব্রিটিশদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে প্রসেনিয়ম মঞ্চেই বাংলার লোকাচারে বাঙালি নট-নটী নিয়ে নিজের প্রযোজনা “কাল্পনিক সংবদল” বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ করে ব্রিটিশদের কাঠিবাজিতে ফতুর হয়ে আগুনে পোড়া মঞ্চের মায়া ত্যাগ করে জাহাজে উঠেছিলেন সেই পোড়া মঞ্চের নির্দিষ্ট স্থানটি ছিল সবার অজানা।ডোমটোলা কেও সবাই বলত ডোমতলা কি ডুমতলা.১৯৯০ এ নানা কাণ্ড করে জায়গাটির হদিশ করি।সরকারের কাছে অনুরোধ করি কিছু না হোক একটা ফলক যদি বসানো যায়।সেই সময় উৎপল দত্ত লিয়েবেদেফ নিয়ে কিছু কাজ করছিলেন সেই সূত্রেই হয়ত নাট্য আকাদেমিতে প্রকাশিত আমার লেখা পড়ে থাকবেন।কথাটার উল্লেখ এই জন্যেই উৎপল দত্তের নাড়ি নক্ষত্রের হিসেব ছিল শোভাদির কাছেই।সংসার নয় নাটকের যাবতীয়ও শোভাদিই জানতেন।
শোভাদির জন্ম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুরে ১৯২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর।কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন।বিয়েও হয় খুব অল্প বয়সে কলেজে পড়াকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য দেবপ্রসাদ সেনের সংগে।সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন।নবান্ন নাটকে তার অভিনয় আজ সবার জানা।যে নাটক বাংলার বানভাসি দুর্গত গ্রামের মানুষের দুর্দশা নিয়ে সেখানে দামি শাড়ি গয়না পরে তো অভিনয় করা যাবে না জেনেও তৃপ্তি ভাদুড়ি পরে মিত্র আর শোভা সেন শতচ্ছিন্ন,মলিন শাড়ি পরেই অভিনয় করেছিলেন।সমাজ চেতনা, সামাজিক দায়বোধ না থাকলে তখনকার দিনে এ প্রায় অসম্ভব।সুধীদার(প্রধান)মুখে শুনেছি ওই নাটকেই অনেক মহিলা দুর্গত পীড়িতের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দামি শাড়ি গয়না পরেই মঞ্চে নেমেছিলেন।সংঘে শুধু অভিনয় করতেন না।সাংগঠনিক কাজও করতেন।আর সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছিলেন সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে উৎপল দত্তের সংগে হাত মিলিয়ে নতুন নাটকের দল “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” গড়ার সময়।একে একে “অংগার”, “কল্লোল”,”তিতাস একটি নদির নাম”,”তীর” সব নাটকে অভিনয় করছেন আবার সংগঠন সামলাচ্ছেন।এর পর যখন “পিপলস লিটল থিয়েটার” হোলো সেখানেও একই ভূমিকায়।“টিনের তলোয়ার” এ শোভা সেনের অভিনয়ের কথা সবাই জানেন।খুব কম মানুষই জানেন তার নেপথ্যের দায় দায়িত্বের কথা।“এপিক থিয়েটার” পত্রিকার পাই পয়সার হিসেব শোভা সেনকেই রাখতে হোতো।
১৯৫৪ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল.টি.জি)যখন নিয়মিত অভিনয়ের জন্য মিনার্ভা লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন তাঁর দাম্পত্য জীবনের চরম অশান্তির সময়।সেই সময়েও স্বামীকে লুকিয়ে বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেনতিনি বিবাহ বিচ্ছেদ করতে বাধ্য হন ১৯৬০ সালের ১০ মার্চ আর নাট্যসহকর্মী ও সহযোদ্ধা উৎপল দত্তকে রেজিস্ট্রি করে বিবাহ করেন ১৯৬১ সালের ২৯ মার্চ।
উৎপল দত্ত খন সাউথ পয়েন্টের শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোপুরি নাটকের কাজে নিজেকে যুক্ত করে ফেলছেন সংসার চালানোর জন্য শোভা সেনকে তখন নির্বিচারে প্রচুর ছায়াছবিতে অভিনয় করতে হচ্ছে।সংসার ও নাটকের ঘর গেরস্থালি সামলাতে অনেকের কাছেই তাকে অপ্রিয় হতে হয়েছে।অপ্রিয় কাজও করতে হয়েছে।
জরুরি অবস্থার সময় কলকাতার রাজভবনে ইন্দিরা গান্ধী যখন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সংগে বসে ছিলেন সেখানে শোভা সেনকেই যেতে হয়েছিল।কংগ্রেস আমলে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অনুদান আর হলের বন্দোবস্ত করতে শোভা সেনকেই ছুটতে হোতো।
এসব করেও তিনি থিয়েটারটাই করতেন।"নবান্ন","বাস্তুভিটা","বিসর্জন","দলিল","তরঙ্গ","নীলদর্পণ","ইন্সপেক্টর জেনারেল","কলঙ্ক"এবং পরে এল.টি.জি এবং পি.এল.টির প্রায় সব নাটকেই তিনি অভিনয় করেছেন।    
প্রচুর বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশী থিয়েটার আত্মস্থ করার পর সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন বার্লিনের আন্সম্বল-এর হেলেন ভাইগেলের অভিনয়ে।অভিনয় জীবনে নির্দেশক রূপে পেয়েছেন উৎপল দত্ত ছাড়া বিজন ভট্টাচার্য,শম্ভু মিত্র,ঋত্বিক ঘটক,দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,তুলসি লাহিড়ি প্রমুখকে।জার্মান নাট্যপরিচালক ফ্রিৎস বেনেভিৎস এর তত্বাবধানে কাজ করেছেন বারটোল্ট ব্রেখটের “মাদার কারেজ” এর বাংলা অনুবাদ "হিম্মৎবাঈ" নাটকে ১৯৮৭ তে।ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য নির্বাচিত হলেন।
১৯৭৪ সালে শোভাদি পেয়েছিলেন সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার।পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি তাঁর এক ভিডিও সাক্ষাৎকার সংরক্ষণ করেছেন ১৯৯০ সালেতিনি দীনবন্ধু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে এবং প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবর্ধনা পেয়েছিলেন ১৯৯৭ সালেশোভা সেনের অভিনয় জীবনের ৫০ বছর সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে য়ার ২০০০ সালে অন্য থিয়েটার আয়োজিত নাট্যস্বপ্নকল্প অনুষ্ঠানে তিনি সংবর্ধিত হন।
চলচ্চিত্রেও তার অবদান নেহাত কম নয়।১৯৫৫ তে প্রফুল্ল চক্রবর্তীর “ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ” তে অভিনয় করলেও ওই বছর নিমাই ঘোষের “ছিন্নমূল”এ অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন শোভাদি।ঋত্বিক ঘটকের “বেদেনী” ছবি যা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি সেই ছবিতেও শোভা সেন অভিনয় ক্রেছিলেন.১৯৭২ এ করেছিলেন “এক অধুরি কাহানি”,উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১৯৭৯ তে “ঝড়”।ওই বছরেই মৃণাল সেন এর “একদিন প্রতিদিন”.১৯৮১ তে আবার উৎপল দত্তের “বৈশাখী মেঘ” এ অভিনয়.১৯৮৩ তে বসু চ্যাটারজির হিন্দি ছবি “পসন্দ আপনি আপ্নি”.২০০১ এ এসে গৌতম ঘোষের “দেখা”।আর ২০০৪ এ জার্মান চলচ্চিত্র “শ্যাডোজ অব টাইম” এ অভিনয় যার পরিচালক ছিলেন ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবারগার।এবাদেও তিনি বহু বাণিজ্যিক ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
থিয়েটারের মানুষজন শোভাদি বলেই ডাকতেন তাকে আর আড়ালে কেউ কেউ বলতেন “শোভাদা” তা তিনি নিজেও জানতেন।
২০১৭ র ১৩ আগস্ট শোভা সেন বাংলা নাট্যচর্চা ও এদেশকে এক গভীর সংকটের ইতিহাসে রেখে গেলেন।আমাদের অনেককেই আর “তুই” বলে ডাকার নাট্যজন রইল না।  


সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭

অগোছালো বর্ণমালা
সলিল সরকার
এটি একটি অণু নাটক।পারফরমেন্সের জন্যেই লেখা।এটি যে কোনও পরিসরে যে কোনও পদ্ধতিতে উপস্থাপন সম্ভব।শুধু একটু অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন।
আলো,ধ্ব্নি,সংগীত,রূপসজ্জা,পোশাক ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যেতে পারে।
(একটা হলঘর।কিম্বা মঞ্চ।ছড়ানো ছিটানো বাক্স প্যাঁটরা,চেয়ার টেবিল,বই-কাগজের স্তূপ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু যুবক যুবতী।এদের সবার ভালো নাম,ডাক নাম আছে কিন্তু আমরা জানি না।যার যা নাম বাস্তবে তাকে তাই বলেই ডাকবে।কে কোন চরিত্রের সংলাপ বলবে সেটা তারা নিজেরাই ঠিক করে নেবে।)
ঃ হবে না।
ঃ কী?
ঃ এভাবে হয় না।
ঃ কী হয় না?
ঃ বাজে বকিস না।এভাবেই হয়।
ঃ বলছি হবে না।
ঃ আলবাত হবে।
ঃ কীভাবে হবে শুনি?
ঃ যেভাবে হয়।
ঃ ওটাকে হওয়া বলে না।
ঃ তো কী বলে?
ঃ গোঁজামিল।
ঃ বাহ এক্সেলেন্ট।
ঃ এবারের নাটকের নাম তাহলে “গোঁজামিল”?
ঃ নাটক?
ঃ হ্যাঁ নাটক।
ঃ তোরা কী এবারে নাটক করবি ভাবছিলি?
ঃ কেন তুই কী আর কিছু ভাবছিলি?
ঃ সব বছরেই তো নাটক হয়।
ঃ তো?
ঃ এবারে যদি পোস্টমর্টেম
ঃ বোঝো আমরা কী মেডিকেল স্টুটেন্ট যে মড়া কাটব?
ঃ যদি কাটি।
ঃ মানে?
ঃ এখন আমরা কী মৃত নয়?
ঃ মৃত মানে ম্রা?মড়া?
ঃ ভাটাস না।দিব্যি খাচ্ছি দাচ্ছি হাগছি মুতছি হাম্মা চুম্মা সুকম্মো কুকম্মো
ঃ অপ কম্মও
ঃ প্র পরা অপসম নি অব অনু নীর দূর ভি অধি সু উত পরি প্রতি অভি অতি অপি উপ আ
ঃ যা টাটকা টাটকা টিউশনি করে এলি বোধহয়?
ঃ একটা ফাটকা খেলে দিলাম।
ঃ মটকা গরম করে দিস না তো।কী হবে তাই বল?
ঃ নাটক ফাটক আর নয়।
ঃ এখন নাটক করলে ফাটকে যেতে হয় না রে।উল্টে অনুদান নয় সম্মান নয় এম এল এ এম পি
ঃ মাম্পি হাম্পি।খিল্লি করিস না তো।
ঃ দিল্লি চলো।
ঃ কী করতে?
ঃ পাতি নাটক নিয়ে যাব।থিয়েটার করব।
ঃ কোন থিয়েটার?ফার্সট,সেকেন্ড,থার্ড,ফোর্থ,অন্তরংগ,বহিরংগ,ইন্টিমেট
ঃ ফাক শালা আল্টিমেট কী হবে বল না হলে আমি চল্লাম।
ঃ এবার আমি খাপ খুললাম
ডোন্ট সে চল্লাম
যে যা ভাট বকলাম
আব্বুলিস পাশবালিশ কোলবালিশ ছেড়ে
কিছু একটা কর যত ধেড়ে
ঃ বেড়ে দিলি মাইরি।এবারে তুইই লেখ।
ঃ তুই নয় তোরা।
ঃ হু হু বাবা যৌথ পোচেষ্টা
ঃ এই পোচেষ্টা নয় প্রচেষ্টা।
ঃ থাম তো সবাই জানে
ঃ তাহলে বললি কেন?
ঃ র ফলা বাদ দিয়ে উচ্চারণ করে দেখিস বেশ একটা ল্যাদ ল্যাদ পেজার পাওয়া যায়।
ঃ পেজার নয় রে প্লেজার প্লেজার
ঃ উফ একটু ল্যাদ খেতেও দিবি না।
ঃ হয়েছে হয়েছে এবার সবাই মিলে ভাবো।
ঃ কী রে কী হোলো?
ঃ ভাবছি কী ভাবা যায়।
ঃ খিল্লি করিস না।
ঃ সবাই মিলে ভাবা যায় না কী?
ঃ চেষ্টা করতে দোষ কী?
ঃ সবাই ভাবব? তারপর?
ঃ ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভাবতে
ঃ যা শালা এ যে দেখি বিশ্ব ভারতী ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে যাচ্ছে যাচ্ছে যাচ্ছে
ঃ পাব্লিক ল্যাদ খাচ্ছে খাচ্ছে খাচ্ছে খাচ্ছে
ঃ সরি ভাবছে ভাবছে ভাবছে ভাবছে
ঃ অনেক ভেবেছ চাদু এবার একটু নামাও।
ঃ কী?
ঃ তোমার ভাবনাটাকে বাস্তবে নামাও।পয়দা করো।
ঃ (থেমে) ধরো
ঃ কী?
ঃ ধরো
ঃ আরে কী ধরব?নোটবুক না পেন্সিল?
ঃ আজ কতো তারিখ?
ঃ তাতে কী?
ঃ সভ্যতার শুরু থেকে এই আজ অব্দি এইদিনে কতো কিছু ঘটেছে
ঃ তো?সব দিনই তো কিছু না কিছু ঘটছেই সারা বিশ্বে।কিছু না হোক সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাচ্চা পয়দা হচ্ছে।মিনিটে মিনিটে রেপ হচ্ছে।সিভিল ওয়ার হচ্ছে।বোমা পড়ছে।লোক কোমায় যাচ্ছে।বিয়ে করছে।মরছে।চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ
ঃ তো?
ঃ ধরে নে আজ ছয়ই আগস্ট
ঃ ধরলাম
ঃ সারা বিশ্বে কী হচ্ছে?
ঃ সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাচ্চা পয়দা হচ্ছে।মিনিটে মিনিটে রেপ হচ্ছে।সিভিল ওয়ার হচ্ছে।বোমা পড়ছে।লোক কোমায় যাচ্ছে।বিয়ে করছে।মরছে।চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ,গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব,মধুর ভান্ড
ঃ তোমার মুণ্ড
ঃ আজ যদি বাংলার বাইশে শ্রাবণ হয় তাহলে কেল্লা ফতে।সোনার বাংলার সোনার টুকরো রবি ঠাকুর বাংলার অধঃপতন দেখে দেহত্যাগ করে ছবি হয়ে যাচ্ছেন।
ঃ যাহ বাঙালি অনাথ হয়ে গেল।
ঃ ইস এর কটা দিন আগেই মহানায়ক বাংলার শিল্পকে বানভাসি করে চলে গ্যাছেন।
ঃ কাম টু দ্য পয়েন্ট বানভাসি।
ঃ যাচ্চলে সে তো সমবচ্ছর লেগেই আছে।নতুন কিছু বল।
ঃ আমেরিকা হিরোশিমায় বোমা ফাটাচ্ছে।দেড়লাখ লোক মরছে।বিকলাংগ শিশু পয়দা হচ্ছে।
ঃ সিক্সথ আগস্ট ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ চালু হচ্ছে উনিশশো একানব্বইয়ে।বিশ্বজুড়ে বিপ্লব এসে গেল বিনা রক্তপাতে।
(এই সময় এক যুবতী ছুটে এলো)
ঃ তোরা এখানে বসে আছিস?
ঃ কেন উঠে দাঁড়ানোর কথা ছিল?
ঃ তোরা আমার কথায় খিল্লি ওড়াচ্ছিস?
ঃ ত্বে কী পায়রা ওড়াব?
ঃ আহ তোরা ওকে বলতে দে।ও কিছু বলতে চাইছে।
ঃ হ্যাঁ দেখছিস না ওর মুখ চোখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গ্যাছে।ও হাপাচ্ছে।
ঃ ও লাফাচ্ছে।
ঃ প্লিজ ওকে বলতে দে।তুই বল।
ঃ বল বল
ঃ (হাফাতে হাফাতে)খোয়াইয়ের কাছে
ঃ সোনাঝুরি গাছ আছে।সেখানে ভূত পেত্নি নাচে
ঃ আহ কী হচ্ছে।তুই বল
ঃ একটা ছেলে
ঃ পড়ে গ্যাছে জলে?
ঃ না না ডাংগুলি খ্যালে
ঃ তোরা ওকে বলতে দিবি?তুই বল
ঃ একটা মেয়ে
ঃ ধরে ফেলেছি প্রেম করছিল।আর তাই দেখে পারমিতার
ঃ না
ঃ আরো কিছু?আরও ইন্টিমেট সিন?
ঃ না
ঃ তাহলে?
ঃ রক্ত
ঃ রক্ত?ব্লাড?
ঃ মার্ডার?অনার কিলিং?
ঃ জানি না।
ঃ যদি মার্ডার কেস হয়?
ঃ তুই ওদের ফেলে পালিয়ে এলি?
ঃ ঠিকই তো করেছে।এমন কেসে কেউ জড়ায়?
ঃ আহা খুন ভাবছিস কেন?
ঃ তো কী?
ঃ হয়তো এক্সিডেন্ট?
ঃ তাহলেই তো সেই পুলিশ কেস।আর জানিস না পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা।ও জড়াবে কেন?
ঃ না চাইতেও জড়িয়ে পড়েছি।
ঃ কেলো করেছিস।
ঃ কী করব আমিও তো একটা মেয়ে।
ঃ তো?
ঃ আমারও যদি কোনদিন এমনটা হয়।তখন আমাকেও তো
ঃ তুই বলছিস সুইসাইড?
ঃ হয়তো হয়তো নয়
ঃ খুন?
ঃ হয়তো হয়তো নয়
ঃ কী বলছিস যা তা।ঠিক করে বল কেস্টা কী?
ঃ লেখাটা শেষ না হলে বলব কী করে?
ঃ তার মানে?
ঃ আমিও চেষ্টা করে দেখলাম ভাবতে পারি কী না!
ঃ উরে কী দিলি রে।লে তাহলে লেগে পড়।
ঃ আমি একা কেন তোরা সবাই মিলে আয়
ঃ ওরে ল্যাপটপটা দে
ঃ না না নো ল্যাপটপ মুখে মুখে
ঃ মুখে মুখে সুখে দুখে
ঃ নো রেখে ঢেকে
ঃ বেশ আয় শুরু করি – ওরা মেয়েটাকে মেরে ফেলে রেখেছে
ঃ ওরা মেরেছে
ঃ ওরা কারা?
ঃ ওরা আমরা আপনি তুমি তুই
(এইভাবে চলতে থাকে)
অসমাপ্ত
MON KHEROR KHATA(LIFE n ART)
sarkarsalil.blogspot.com

শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭

আমি ঠিক কার মতো?
সলিল সরকার
কথাটা নেহাৎ খেলাচ্ছলে লিখিনি।ইদানিং এটা আমাকে ভাবাচ্ছে।আজ শান্তিনিকেতনে আসার সময় দ্বারোন্দার পার্থ,অনুপম আর চব্বিশ পরগণার বিভাসের সংগে দেখা হোলো।অনুপম আমার সাম্প্রতিক "মন খেরোর খাতা"র লেখার উল্লেখ করল যেখানে লিখেছিলাম "আমি কোনদিনই সাপ ও ব‍্যাঙের মুখে চুমু খাইনি"।পার্থ বলল যারা এটা প্রকাশ‍্যে বলে তারাই তার উল্টোটা করে।
আমার মনে হোলো সত‍্যিই তো।ওর দোষ কী!কতো মানুষ সারাজীবন তৈল মর্দন করেই কী বলে আমি কোনদিন কাউকে তেল মারিনি।পুরস্কার হাতে নিয়ে বলে এটার জন‍্যে কোনদিন তদ্বির করিনি।অনুদান নিয়ে বলে আহা আমাকে দিলে আমি কী করব।না পেলে বলে সব স্বজনপোষণ চলছে।
একবার (১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ অব্দি যে নাট‍্য সংগঠনে ছিলাম)আমরা কেন্দ্রীয় অনুদান পেলাম আগের প্রযোজনার খ‍্যাতিতে।পরের প্রযোজনা অসাধারণ হয়ে উঠতে গিয়েও হোলো না।দলে নানান টালমাটাল চলছে।আমি নাটক নিয়ে পড়তে গিয়ে দুটি নাটক লিখে ফেললাম।"আবরণ"ও "প্রবহতি"।প্রায় বিনা বিজ্ঞাপনে বেশ কয়েকটি শো হোলো।আমার মাস্টারমশায় তরুণ রায় একদিন ক্লাসের শেষে বললেন-হ‍্যাঁ রে এবারও অনুদানের জন‍্যে আবেদন করে দে।আমি আছি কমিটিতে।পেয়ে যাবি।
আমি বললাম-ভালো নাটক লেখা হচ্ছেনা টাকা নিয়ে কী করব?
তরুণ বাবু অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সামনে কুমারদাকে পেয়ে-কুমার এ ছেলে কী বলে শুনুন।
আমি দলের ঘরে এসে সে কথা বলতে কেউ আমাকে সেদিন তিরস্কার করেননি, বরং সস্নেহে তাকিয়ে ছিলেন।সেটা ছিল আশি বিরাশি সাল।আজকের কোনোও ছেলে যদি এ কাণ্ড ঘটায় তাকে দল বহিষ্কার করবে তৎক্ষণাৎ।নয়ত ওই ছেলেটিই নতুন দল গড়ে অনুদান নিতে আকুল হয়ে উঠবে।
এসব শুনে মনে হতে পারে ওই সময় দলাদলি ছিল না,খাওয়া খাওয়ি ছিল না।হলের ডেট নিয়ে কাঠি ও কাটাকুটি খেলা ছিল না।সবাই সবাইকে দেখলেই গেয়ে উঠত-আবার দেখা যদি হোলো সখা প্রাণের মাঝে আয়"।না।
তখনও ছিল তবে কিঞ্চিৎ ঘোমটার আড়ালে।কল শোয়ের জন‍্যে কেউ এলে সবাই সবার নাম বলত।সাতদিন নাটকের উৎসব হোতো।ছোট বড়ো মাঝারি যে কোনোও দলের জন্মদিনে দলের ঘর ফুলের স্তবক আর শুভেচ্ছায় ভরে যেত।শ‍্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আড্ডা, রাসবিহারীর আড্ডা অনেক অনেক ভালো নাটকের জন্ম দিয়েছে।কোনও দল বিজ্ঞাপনের টাকা জোগাড় করতে না পারলে আর এক দল সাহায্য করেছে।হলের টাকা, হলের ডেট ভাগাভাগি করেছে।সব দলের ছেলে মেয়ে দল বেঁধে সব দলের নাটক টিকিট কেটে দেখতে গেছে।এ দলের টিকিট ও দল বেচেছে।সুব্রত পালের মতো কিছু নাট‍্যসর্বস্ব মানুষ উপযাচক হয়ে সাহায্য করেছে।শম্ভু দা ঘুপচি ঘরে ঘামতে ঘামতেই নাটক আর নাট‍্য নিয়ে আলোচনা করছেন।মোহিত দা নতুন নাটক পড়ে শোনাচ্ছেন।সত‍্যজিৎ রায়,মৃণাল সেন নাটক দেখতে আসছেন।কতো বিখ্যাত শিল্পী চুপিসাড়ে নাটক দেখে গেছেন জেনেছি অনেক পরে।
সম্প্রতি স্বাগতালক্ষ্মী রবীন্দ্রনাথ এর গানে সুর দিয়ে গেয়ে শোনাল
"আমার হারিয়ে যাওয়া দিন,আর কী ফিরে পাব তারে"।সুর করেছে ভৈরবী রাগে।আমি সেই ভোরের দিকে তাকিয়ে আছি রাত্রির অন্ধকারেই।