তাম্রলিপ্তঃশহরে,বন্দরে
সলিল
সরকার
৭
দাদাঠাকুর
বলতেন-“বুড়োয় বুড়োয় দেখা হোলে কথায় কথায় কাসি,আর যুবায় যুবায় দেখা হোলে কথায় কথায়
ঘুষি!”তমলুকের হাটে-বাজারে কি চায়ের দোকানে যদি কোনও জটলা দেখেন আর সেখানে গিয়ে
যদি একটু কান পাতেন তাহলে আপনিও হয়ত দাদাঠাকুরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন।
চা
আর লেড়ো বিস্কুট খেতে খেতে আলাপ-আলোচনা থেকে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতিতে গড়ানোর
আগেই কেউ হয়ত বলে উঠলেন-“চলো খিরিষ তলায় দেখা হবে!”আপনি ভাবছেন সেটা আবার কী?তাহলে
খুলেই বলি-‘খিরিষ’ হোল শিরীষ গাছের আঞ্চলিক নাম আর শিরীষ তলা হোল জেলার আদালত
চত্বর।বহু যুগ ধরে আদালতের আশেপাশে এবং আজও অনেক প্রাচীণ শিরীষ গাছ রয়েছে।
এখানেই
প্রতিদিন কতো মানুষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য নিরুপণ হয়।আর সেখানে আপনাদের একবার
ঘুরে দেখতে বলব মামলা,মোকদ্দমা দেখার জন্যে নয়,ঐতিহাসিক স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক
স্থানের মাহাত্ম্যের জন্যে।
বলা
বাহুল্য আজকের তমলুক জেলখানা,আদালত,বার লাইব্রেরী,সেটেলমেন্ট অফিস,ডি এম এর বাংলো
এসবই ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য।বিশাল বিশাল থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীণ ইঁটের
চূণ-সুরকির গাঁথনির লাল রংয়ের বাড়িঘর।
এই
স্থানকে কেন্দ্র করে আশেপাশে কতো খাবার হোটেল চলে।এখনও বেশ কম টাকায় এখানে পেট ভরে
খাবার মেলে যেমন নানা ধরনের খবরও মেলে।মামলা-মোকদ্দমা করতে মানুষজন হয়ত এক হোটেলে
পাশাপাশি বসে খাওয়া-দাওয়া সারছেন।আবার আদালতের কাজের শেষে এখানে পসরা সাজিয়ে বসা
ব্যাপারীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় টুকি টাকি ঘর-গেরস্থালির জিনিসও কিনে বাড়ি ফিরছেন।
কী
না পাওয়া যায় এখানে?কাগজ-কলম-পেন-কার্বন-স্ট্যাম্প পেপার এসব তো মামলার প্রয়োজনে
আছেই তার সংগে মরসুমী ফুলের চারা,ঘটি-বাটি ঝাল দেওয়ার রাং,চাষের কাজে লাগে কি
ঘর-গেরস্থালির কাজের জন্যে কুড়ুল-কোদাল-দা-বটি-খুরপি থেকে ভাগ্য ফেরানোর
তাবিজ-মাদুলি-আংটি সব মেলে এখানে।
ওখানে
টিয়া পাখি নিয়ে বসে থাকা অবাংগালি মানুষটিও যেমন দু-পয়সা আয় করছে আবার জড়ি-বুটী
বিক্রী করেও গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরছে।যে জিপসি ছেলেটি বা মেয়েটিকে দেখছিলেন একটা
ছেঁড়া জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে মুহুর্তে সেই কোনও সাহায্য ছাড়াই একটা এলুমিনিয়মের
থালা নিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছে দড়ির উপর।পায়ের তলায় থালাটা রেখে দড়ির উপরে হাঁটছে
সবার বুকে শিহরণ জাগিয়ে।আর ওই শিহরণই সামনে পেতে রাখা গামছায় টপাটপ টাকা পয়সা
ফেলতে উদবুদ্ধ করছে মামলায় হেরে যাওয়া কি জিতে যাওয়া মানুষকে।নানান মানুষের
ব্যস্ততা আর কথাবার্তায় স্থানটি সরগরম হয়ে থাকে সারাক্ষণ।তারপর
দিন বিকেলের দিকে যত গড়িয়ে আসে মানুষের শব্দ কমে এসে ওইসব বিশাল গাছের ডালে ফিরে
আসা পাখিদের কল-কাকলিতে মনে হবে ওরা যেন মানুষের ব্যবহার শিখে ওখানেই আসর
বসিয়েছে।তার পর বিকেল সন্ধ্যের দিকে যত গড়াবে পাখিরাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসবে।শুধু
রাত নামলে হাজার হাজার মানুষের হাসি-কান্না বুকে নিয়ে একা শিরীষ গাছগুলি নীরবে
শ্বাস ফ্যালে!
এই
আদালত চত্বর এক কালে বিলাতি সাহেবদের দখলে ছিল।তার চিহ্ন হয়ে আজও ‘টেনিস কোট’
রয়েছে আদালতের পিছনে ‘বানপুকুরের’পাড়ে।এই বানপুকুর আরো অনেক সংগ্রাম আর
লড়াই,অসহযোগ আন্দোলন আর শহীদের সাক্ষী।
৮
১৯৪২এ
গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা ভারত,বাংলা এবং এই তাম্রলিপ্ত যখন অসহযোগ অহিংস
আন্দোলন শুরু করেছিল একদল জনতা তমলুকের প্রশাসনিক ভবন দখল করতে এসে ব্রিটিশ
পুলিশের লাঠিচার্জ আর বন্দুকের গুলির কাছে হার না মেনে এগিয়ে চলল।সেই জনতার মধ্যে
জাতীয় পতাকা হাতে ছিলে মাতঙ্গিনী হাজরাও।পুলিশের গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েও
আন্দোলনের পতাকাকে তুলে ধরে বলেছিলেন-“বন্দে মাতরম্ “।আভাসবাড়ির বানপুকুর এই
আন্দোলনের শহীদ স্মৃতি বহণ করে চলেছে আজও।মহাত্মা গান্ধী শহীদ মাতঙ্গিনীকে তার সাহসিকতা
আর দেশের জন্যে আত্মদানে তাকে “বীরাঙ্গনা” আখ্যা দিলেন।আর আজ
যে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সেইখানে তার মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
এই ঐতিহাসিক
স্থানের পাশ দিয়ে যে পাকা রাস্তা রয়েছে তা গিয়ে মিলেছে তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ে।এই মহাবিদ্যালয়
দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সবচেয়ে প্রাচীণ মহাবিদ্যালয়।
আন্দোলন
আর শহীদের কথা যখন উঠল তখন যাওয়া যাক আর এক ঐতিহাসিক ভবন ‘রক্ষিত বাটি’।
তমলুকের
মাটিতে যখন বিপ্লব আর আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভয় ধরাচ্ছে তখন এই রক্ষিত
বাড়িতেই চলত “অনুশীলন সমিতি” আর “গুপ্ত সমিতি”র গোপন কার্যকলাপ।এবাড়ির ইতিহাসবিদ
ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত এই বাড়িকে নতুন ভাবে নির্মাণ করেন।এই তমলুকের মাটিতেই
জন্মেছিলেন বিপ্লবী ও বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশ
চন্দ্র সামন্ত প্রমুখ অনেক গুণীজন।
ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা এইসব ইতিহাস দেখতে দেখতে যদি আবার নদীর কাছে যেতে চান তাহলে রূপনারায়ণ-এর
তীরের কাছে যে “ইরিগেশন বাংলো” আছে সেটিও দেখবার মতো।নদী এখান থেকে এক কিলোমিটার
দূরে হলেও জোয়ারের সময় দু-কুল ভেসে যাওয়া আর ভাটায় শান্ত হয়ে যাওয়া চারপাশ মনের শান্তি
আর চারদিকের চির সবুজ চোখের বিশ্রাম আনে।
রাত
কাটানোর জন্যে এখানে বেশ কিছু ছোটো ও মাঝারি হোটেল আছে।আর পুরসভার আয়োজনে
রূপনারায়ণ নদের তীরে “রূপনারায়ণ” নামের অতিথি নিবাস আছে।সারাদিন ঘোরাঘুরির পর
রূপশ্রী কি চলন্তিকায় সিনেমা কিম্বা কোনও নাট্যদলের নাট্যপ্রযোজনা দেখে এখানে এসে
বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন আমরা যাব তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালায়।যেখানে ইতিহাস কথা বলে।
৯
তমলুক শহরের অন্যতম দর্শনীয় হল পুরসভা অফিসের কাছে ‘তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র’।এই সংগ্রহশালায়
প্রবেশের আগে এই শহর আর তার আশেপাশে নানা কালে যে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় তাতে কী কী
পুরাতাত্ত্বিক বস্তু পাওয়া যায়,কারা এই কাজ করেন তা জানা থাকলে সংগ্রহশালা ঘুরে
দেখতে সুবিধে হবে তাই না?
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছিলেন –
“হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে!”
কবিকে আমরা ভুলতে পারিনি কিন্তু এই মানুষটিকে যিনি প্রাণাধিক ভালোবাসতেন সেই
প্রিয় বন্ধু সেকালের আই,সি,এস গৌরদাস বসাক কে কী আমরা ভুলে যাব?গৌরদাস বসাক প্রথম
তমলুকের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ‘প্রসিডিংস অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্য (কলকাতা, ১৮৮৯) তিনি তাঁর আবিষ্কারের কথা সংক্ষেপে প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে তমলুকের
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব উমাচরণ
অধিকারী একটি গ্রন্থে তমলুক নগরের প্রাচীন নির্দশন
সম্পর্কে বর্ণনা করেন।
তখন এই স্থানটিতে কমপক্ষে
দু-দুবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালানো হয় এবং বেশ কয়েকবার প্রত্নসম্পদের
সন্ধান করা হয়েছে।
১৯২০-১৯২১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ তমলুক-এর ওপর একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করে। ১৯৪০ সালে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক
খনন কাজ সম্পাদন করেন প্রখ্যাত স্যার গুরুসদয় দত্ত ,টি,এন,রামচন্দ্রন এবং কে,এন,দীক্ষিত।
এই উৎখনন থেকে যে সব
প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল পোড়ামাটির সামগ্রী, মৃৎপাত্র আর মুদ্রা। প্রাপ্ত নিদর্শনাবলির অনেকগুলিই ছিল খ্রিষ্টপূর্ব
তৃতীয় শতাব্দীর।এ.এস.আই ১৯৫৪-৫৫ সালে এম,এন,দেশপাণ্ডের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী প্রত্ন-উৎখননের
উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে চার স্তরের সাংস্কৃতিক পর্যায় উঠে আসে।
অবশ্য এ উৎখনন থেকে কোন
ধরনের কাঠামোগত অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কেবল পেটানো মেঝে এবং পাতকুয়ার সন্ধান
মিলেছিল।
১৯৭৩-৭৪ সালে এস,কে
মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে আরেক দফা উৎখননের উদ্যোগ চলে। এ উৎখনন থেকে চারটি পৃথক
সাংস্কৃতিক পর্বের সন্ধান পাওয়া গেল।
এগুলির মধ্যে প্রথম পর্বে
নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির অসম্পূর্ণভাবে পোড়ামাটির পাত্র , বিপুল পরিমানে মধ্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার, হাড়
দিয়ে তৈরি সূঁচ আর অল্প কিছুসংখ্যক তাম্রসামগ্রী পাওয়া গে্ল।
খ্রিষ্টপূর্ব
তৃতীয়-দ্বিতীয় শতাব্দী হলো দ্বিতীয় পর্বের কালসীমা।এ স্তরে ‘উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র’ এর কিছু টুকরা,পাথরের গুটিকা।আর পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণে ছাপাঙ্কিত ও ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা।
কেউ কেউ এ স্তরকে তথাকথিত
মৌর্য-শুঙ্গ যুগের বলে অনুমান করেন।এখানে ইঁটের তৈরী একটি জলাধার এবং পোড়ামাটির
কিছু পাতকুয়ার নিদর্শনও পাওয়া গেল। তৃতীয় স্তরটি কুষাণ-শুঙ্গ যুগের সমসাময়িক এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ বলে
মনে করলেন গবেষকরা।
এখানে মৃৎশিল্প, এবং প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির মূর্তি,যার কোন কোনটির সাথে হেলেনীয় রীতির
সুস্পষ্ট মিল পাওয়া যায়।এ সবই কী এক আধুনিক নাগরিক জীবনের ইঙ্গিত দেয় না? যেখানে
নাগরিকরা শিল্পকর্মে লিপ্ত থাকতো।
চতুর্থ স্তরটি গুপ্তযুগের
সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়।তবে এ পর্যায় থেকে পাওয়া প্রত্ন নিদর্শন তেমন একটা
আকর্ষণীয় ছিল না।
১৯৫৪-৫৫ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের
মধ্যে কয়েকজন গবেষকের ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁড়াখুঁড়ি করেন।এই উৎখননে তমলুকের
আশে-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন উঠে আসে।
প্রয়াত প্রফেসর পি,সি
দাশগুপ্ত ছিলেন গবেষণার এ অঙ্গনে পথিকৃৎ।এই প্রত্নস্থল থেকে তিনি অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন-নিদর্শনের সংগে পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৭৩-৭৪
সালের পর তাম্রলিপ্ত
গবেষণা ও জাদুঘর কেন্দ্র এই অঞ্চলে স্বাধীন গবেষণা সম্পাদন করে। জাদুঘরের কিউরেটর তমলুকের
প্রত্নতত্ত্বের উপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ মনোগ্রাফ প্রকাশ করেন।প্রত্নতাত্ত্বিক
উৎখননের ফলে এইসব অঞ্চলে আরও কয়েকটি প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হলো।
তমলুকের আদি ঐতিহাসিক যুগ
নানা ধরনের মৃৎপাত্র, যেমন ‘রুলেটেড’ (নক্শা করা) পাত্র, ধূসর মৃৎপাত্র, লোহিত মৃন্ময় পাত্র, কালো মসৃণ মৃৎপাত্র ও উত্তর
ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র।
মৃৎপাত্রের পাশাপাশি বিরল
সৌন্দর্যের কিছু পোড়ামাটির সামগ্রীও এই প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেল।
এবার চলুন মিউজিয়মের ভেতরে
যাওয়া যাক।এখানে আপনি দেখতে পাবেন নানা সময়ে পাওয়া আদি
প্রস্তর যুগ থেকে মধ্যপ্রস্তর যুগ অব্দি আদিম মানুষের ব্যবহৃত প্রস্তরীভূত হাড়, পাথরের অস্ত্র, হরিণের শিঙের উপর খোদাই করা
নকসাযুক্ত আসবাব, মৌর্য, শুঙ্গ যুগ
থেকে পাল-সেন আমল অবধি প্রাপ্ত পোড়া মাটির মূর্তি।
তমলুক জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে পোড়ামাটির তৈরি যক্ষী ও জীবজন্তুর মূর্তি এবং
সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের জীবন সম্পর্কিত পোড়ামাটির ফলক।
এই মিউজিয়ম যদি খুঁটিয়ে দেখতে হয় তাহলে সারা দিন লেগে যাবে।আর আপনি একটু একটু
করে চলে যাবেন অতীতের তাম্রলিপ্তে।
১০
যে
তাম্রলিপ্ত বন্দর-নগর আজকের তমলুক শহর এক কালে ছিল এমন সমৃদ্ধ আর সম্পদশালী
সেখানকার জ্ঞান চর্চা আর শিক্ষার হার যে হবে অনেক উন্নত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তমলুকের
শিক্ষার হার শতকরার হিসাবে ভারতের অনুপাতে অনেক বেশি।২০০১ এর সেন্সাস অনু্যায়ী এখানে
পুরুষ ৫২ভাগ আর নারী ৪২ ভাগ।এর মধ্যে শিক্ষার হার শতকরা ৭৭ভাগ।পুরুষ শিক্ষার হার
৮৩ নারী শিক্ষার হার শতকরা ৭২ ভাগ।
শিক্ষার
কারণেই এখানে শিল্প ও সংস্কৃতি একটা বড়ো জায়গা দখল করে আছে।এখানে নিয়মিত
নাট্যচর্চা হয়,পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং চলচ্চিত্র কেন্দ্র তাও রয়েছে।চলুন আজ
আমরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে একটু ঘুরে আসি।
এই
খানে একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোলো “তমলুক হ্যামিল্টন হাই স্কুল”।মেদিনীপুর
জেলার মধ্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোলো প্রাচীণতার দিক থেকে দ্বিতীয়।
এই
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মিস্টার রবার্ট চার্লস হ্যামিল্টন প্রতিষ্ঠা
করেন।যদিও এই হ্যামিল্টন সাহেব পেশায় ছিলেন নুনের কারবারী কিন্তু তিনি ছিলেন একজন
সমাজসেবী। তাই তমলুকের মানুষ তাকে ডেভিড হেয়ারের সংগেই এক আসনে বসান।তমলুকের
শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে তার অবদান ভোলার নয়।
এখান
থেকে সেকালে ও একালেও অনেক কৃ্তি ছাত্রের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে।আর এই স্কুলেই
কিছুদিন পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বসু।১৯০০
থেকে ১৯০৩ সাল অব্দি তিনি এখানে পড়েছিলেন।
এই
স্কুলের মাটিতে একটি প্রস্তরীভূত গাছের ফসিল রাখা আছে।এই স্কুলের মূল ভবণে একটি
সুন্দর সংগ্রহশালাও আছে।
এর
কিছু দূরে “রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যালয়”নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যার
বিরাট অবদান।
এছাড়াও
আছে তমলুক টাউন স্কুল।
বিদ্যাপীঠ
বালিকা বিদ্যালয়।
শালগেছিয়া
হাই স্কুল
রঘুনাথ
মেমোরিয়াল হাই স্কুল
তমলুক
সেন্ট্রাল স্কুল
আর
তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ের কথা তো আমরা আগেই বলেছি।যার সামনে এক বিশাল খেলার মাঠ।এই
ভবণটিও বেশ প্রাচীণ।
এই
শহরে যেমন পড়াশোনা হয় আবার মেলা পার্বণ তাও হয়।
এ
শহরে মকর সংক্রান্তিতে বারুণির মেলা প্রায় গংগাসাগরের মেলার মতোই প্রসিদ্ধ।
আবার
বাংলা মাঘ মাসের ১১ দিনে এখানে ভীম মেলা বসে।
কালীর
মেলা হয় চৈত্র্য মাসে
চৈত্র্যের
শেষে গাজন আর চড়ক মেলা।
আর
আষাঢ় মাসে হরির হাটে রথের মেলা বসে।
অবশ্য
এই রথযাত্রা মহিষাদলের রথযাত্রার মতো প্রসিদ্ধ নয়।তবে চাইলে আমরা এই শহর থেকেই
একবার মহিষাদল রাজবাড়ি,গেঁওখালি,সুতাহাটা,ময়না,রঘুনাথবাড়ি, রাধামনির হাট ঘুরে আসতে
পারি।
গেঁওখালিতে
গেলে গংগার আর এক রূপ দেখতে পাব।আর এখানে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পর্তুগীজদের এদেশে
আগমনের সাক্ষ্য।
পর্তুগীজরাই
এই শহরে আসা প্রথম খ্রিশ্চান।এরা বাণিজ্যের কারণে এই তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসে কালে
কালে এখানকার মানুষদের সংগে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করে।মোমের কারবার ছিল এদের
প্রধান ব্যবসা।
১৬৩৫এ
এই শহরে প্রথম চার্চ স্থাপিত হয়।১৬৯৫ এ তমলুক শহরে পর্তুগীজরাই রাজত্ব করত।
তমলুক
শহর থেকে সামান্য কয়েক ঘন্টায় ময়নায় ঘুরে আসা যায়।ময়নার রাজবাড়ি স্থাপত্যের দিক
ঐতিহ্যশালী।ময়নার মাদুর আর ময়নার গয়না বড়ি সেও বিখ্যাত।বিউলির ডালে তৈরি এই বড়ি
এতোটাই শিল্পসম্মত আর হাল্কা যে ছাঁকা তেলে ভাজার পর এই বড়ি শোনপাপড়ির মতো মুখে
দিলেই মিলিয়ে যায়।
শুধু
ময়না কেন তমলুক-এর প্রায় সবখানেই এই গয়না বড়ি তৈরি করেন বাড়ির মেয়েরা।শীতকালে
প্রায় ঘরে ঘরে ডাল বেটে বাঁশের পাটায় তেল মাখিয়ে আল্পনা দেবার ভঙ্গিমায় বড়ি দিয়ে
রোদে শুকানো হয়।আর গয়না বড়ি দেওয়া হয় পোস্তদানার উপর।থালায় পোস্ত ছড়িয়ে তার উপর
জিলিপি ভাজার মতো করে বড়ি দেওয়া হয়।
তমলুকের
আশেপাশে হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি ঠক ঠক শব্দ শুন্তে পান ত্বে জানবেন ওখানে তাঁতে
কাপড় বোনা চলছে।ঠক ঠক শব্দ হয় বলে আঞ্চলিক ভাষায় েই তাঁতকে ঠকঠকিও বলা হয়।
হাট
থেকে কিনে আনা সুতো রং করে বেচা এটাও এই অঞ্চলের প্রধান জীবিকা।আর ধান-চাল-বোনা
কাপড় তো আছেই।
তাই ফেরার
পথে রাধামনির হাট থেকে বাংলার তাঁতের গামছা-মশারি-চাদর-শাড়ি ছাড়াও বাংলা পাতা
পান,মিঠেপাতা পান কিনতে ভুলবেন না।এবার কোলাঘাটের কাছে এসে সেই বিখ্যাত ইলিশ মাছ
নিতে ভুলবেন কী?মাছের সংগে ফুল মানায় কী না বলা মুশকিল তবে ঘাটাল আর কোলাঘাটে
মাঠের পর মাঠ ফুলের চাষ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
আর
যদি কোলাঘাটের কাছে দেনান ডাকবাংলোতে রাত কাটানো যায় সেও বা মন্দ কী?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন