MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬

মায়া
সলিল সরকার
কিছুতেই পিছু ছাড়ে না সে
ভোর থেকে বিকেলের আলো
এমন নিলাজ প্রকাশে
জড়ায় না পুষ্যি বিড়ালও।
*
কিছুতেই পিছু ছাড়ে না সে
ছড়ানো খড়ের মাঠে
আগে পিছে ফকিরের বেশে
আমি হাঁটি,সেও সংগে হাঁটে।
*
কিছুতেই পিছু ছাড়ে না সে
জলের কিনারে আলোছায়া
দিনান্তের মাধুকরী শেষে
মুছে নেয় পথিকের মায়া।
*
কিছুতেই পিছু ছাড়ে না সে
একা মায়া প্রদীপের আলো
ফিরে আসে পুরানো অভ্যেসে
জানি হাসে স্থবির দেওয়ালও।

বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬

ওরা ডাকে-আয়......আয়
সলিল সরকার
শক্তি চাটুজ্যে লিখেছিলেন-যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?অথচ সেই তিনিই কিন্তু বারবার চলে যেতেন এখানে সেখানে।আমরা আদতে বোধহয় তাই।কতবার কত আত্মীয়ের বাড়ি যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি।আবার সামান্য চেনা বন্ধু যখন ডেকেছে একছুটে চলে গেছি পিঠে সামান্য জামাকাপড় গুছিয়ে হ্যাভারস্যাকে ভরে।
শরতকাল এলেই পাহাড় আমাকে ডাকে-আয় আয় আয় আয়।ডাকলেই তো আর যাওয়া যায় না।কতো পিছুটান থাকে।কতো বাধা এসে ন্যাওটা বেড়ালের মতো পায়ে লুটোয়।এর পরেও জেদী ডানপিটেদের মতো বেরিয়ে পড়তে পারলে-ব্যস!আর পায় কে?
সংসারে প্রবেশের আগে আমরা কয়েকজন বন্ধু সুযোগ পেলেই পালাতাম।পাহাড়েই গেছি বেশি।তবে সেগুলো অনেক দূরে দূরে।হিমালয়ের কোলে।দেরাদুন-মুসৌরি-হরদুয়ার-হৃষিকেশ-গঙ্গোত্রী-গোমুখ-যমদুয়ার-নৈনিতাল-বৈজুনাথ-টেহেরি গাড়োয়াল।পালানোর অনেক সুঁড়িপথ আর নেমে আসার পাকদণ্ডী ছিল।খুচরো টাকা পয়সাতেই হয়ে যেত।থাকা খাওয়ার কোনও বিলাস ছিল না।অবকাশও ছিল না ওসব জায়গায়। আমাদের আশেপাশে যেসব পাহাড় আর টিলা আছে সেগুলোয় আর কজন যায়?কিন্তু পৌঁছে গেলে অন্য মজা।এই তো হাতের কাছে গালুডি ওখানে আমাদের বন্ধু মিউজিকের গৌতম ঘোষেদের বাড়ি ছিল।বাড়ি মানে বাড়ির চৌহদ্দিতে একটা ছোট্ট টিলাও ছিল।আমরা সকাল-বিকাল ওটার উপর চড়ে চা খেতাম।প্রায় পাশ দিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন গুলো হিংসে করে ভোঁস ভোঁস করে ধোঁয়া ছেড়ে আর হুইসিল বাজিয়ে চলে যেত।শিমূলতলা গেছি সেখানে ছাতু পাহাড় আর লাটু পাহাড় ইউক্যালিপ্টাস জংগলের ভেতর থেকেই হাতছানি দিত।সেখানেও দূরপাল্লার ট্রেন কি লম্বা লম্বা মাল গাড়ি বেজায় শব্দ করে নিরুপায় হয়ে টানেলের মধ্যে হারিয়ে যেত।অযোধ্যা পাহাড়ে গেছি লাক্ষার চাষ হোত সেখানে।বাঁকুড়া-পুরুল্যা চষে বেড়িয়েছি শরতে-শীতে এমনকি বর্ষায়।তবে এসবই আইবুড়ো জীবনের বাউন্ডুলেপনা।
বিয়ের পর এভাবে না হলেও আমি আর অপর্ণা বাসায় রান্না ফেলে রেখে,জামাকাপড় দড়িতে মেলে বেরিয়ে পড়েছি হুট করে আর ফিরেছি দিন সাতেক পরে।ভাত আবার চাল হয়ে যেত।আর তরি-তরকারী নেংটি ইঁদুরে চেটেপুটে খেয়ে নিত।ওদেরও তো বাঁচার তাগিদ ছিল?
ত্রিপুরায় গেলাম রাজ্যের অতিথি হয়ে নাটকের কাজে।সেই যে গেলাম দুজনে প্রায় মাস খানেকের জন্যে ফিরে এলাম টাক্কাল(আদিবাসীদের চপার)বাঁশের হুঁকো,বুনো অর্কিড,ওদের দেওয়া অজস্র উপহার আর আন্তরিকতা ঝুলিতে ভরে।এমন কি যে মানুষটি আমাদের নিয়ম করে গাড়িতে নিয়ে ছুটে বেড়াতেন সার্কিট হাউস থেকে মঞ্চ আর সারা ত্রিপুরা তিনিও একবার নিয়ে এলেন দু-পেটি ওখানকার পাহাড়ি আনারস।আহা কী তার রং!কী তার আস্বাদন!
তিথি আসার পর আমাদের আর তেমন করে কোথাও অতিথি হওয়া হয়ে ওঠেনি। তিথি একটু বড়ো হতেই আবার ঝোলাঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়া শুরু হয়ে গেল।আর সেই সুযোগটাই করে দিয়েছিল শুসুনিয়ার সংহিতা।ওর বাবা একজন লোককবি।আর সংহিতা এই শহরে চাকরি সূত্রে থাকে।শরত এলেই ফিরে যায় উমার মতো মা-বাবার কাছে।সেবার আমরাও গেলাম।তিথিপর্ণা,অপর্ণা আর আমি।
শুসুনিয়ার অর্থ না কী ছোটো হাতি।দূর থেকে দেখতে সত্যিই অনেকটা ওই রকম।ঠিক যেন একটা পুচকে হাতির ছানা মস্ত হয়ে শুয়ে আছে শুঁড় গুটিয়ে।ওই পাহাড়ে একটা ঝোরা আছে।সারাক্ষণ কী মিষ্টি জল পড়ছে।ওখান কার মানুষ ওই জলই পান করে।আর আছে নরম পাথর।যা দিয়ে কত কিছু বানায় ওরা।ওই পাহাড়ের সব গাছই মেডিসিন।ওই পাহাড়ে ‘র‍্যাটল স্নেক’ও আছে।তাদের আমি দেখা পাইনি।পাহাড়ের একদিকে ‘ন্যাচার‍্যাল চিমনি’।শীতকালে সবাই পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের ট্রেনিং নিতে শিবির গড়ে।ওখানে বড়ো বড়ো মোষ আর মাকড়সা দিব্যি মিলেমিশে থাকে।ছাতিমফুল আর ছাতারে্র মতো আদিবাসী ছেলেরা কী অল্পেই খুসি থাকে।

সংহিতা,ওর বাবা,মা আর ওর কত্তা দেবরাজের আতিথেয়তা অতুলনীয়।ওদের বাড়িতে একটা চন্দন গাছ আছে।আর আছে ওর মায়ের হাতের অপূর্ব রান্না।ওখানে যে নদি আছে তার নাম গন্ধেশ্বরী।আছে নয় ছিল বলাই ভালো।সেটা এখন খাল হয়ে গেছে।যখন সারা বাংলায় অশান্তি তখন ওই জায়গাটা কী শান্ত ছিল।কী জানি এখন আবার যদি শুসুনিয়া আমাকে ডাকে আমি কী সেই আগের মতো শান্তি ফিরে পাব?
 

মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা এবং বুকের অ-সুখ
সলিল সরকার
আজ খেরোর খাতায় যা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হোলো তা নারীর স্তন নয়,স্তনের অ-সুখ।বেঁচে থাকার আদিকাল থেকেই স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীদের জন্মানোর পরের কয়েক মাস মায়ের দুধই এক মাত্র ভরসা।আগের কালে বুড়িরা বলতেন-“যার মা নেই তার মতো অভাগা আর কেউ নেই!”তখন কেউই নারীর স্তন নিয়ে যৌন চর্চা করত না।
আমি আমার শৈশবের কথা বলতে পারি সে সময় দেশ-গাঁয়ে একমাত্র অবিবাহিত মেয়েরাই বুক ঢেকে রাখত।বিয়ে হয়ে গেলে,বিশেষ করে সন্তানের জন্ম দেবার পর তারা আর বুকে অকারণ ঢাকা রাখতেন না।তার মানে তো এই নয় তাদের সৌন্দর্যবোধ ছিল না বা তারা শরীরচর্চা করতেন না।বরং পোয়াতি মেয়েদের বুকে দুধ আনার জন্যে দিদিমা-ঠাকুমারা নানান খাদ্য ও পাণীয়-এর সাহায্য নিতেন।কিশোরী ও যুবতী মায়েরা সামান্য আড়াল রেখেই সন্তানকে স্তন্যপান করাতেন।তখন পুরুষেরা হামলে পড়ে স্তনদায়িণীর স্তনের দিকে তাকিয়ে থাকত এমনটি সাহিত্যেও স্থান পায়নি।বরং সভ্যতা যত এগিয়েছে অসভ্যতা ও বিকৃ্তি ততই উইপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে সমাজটাকে।ভাবুন তো যে শিশুটির বয়স মাত্র ছয় কি সাত তাকে কেন যৌনবিকৃ্তির শিকার হতে হচ্ছে?এই উপমহাদেশে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি যৌনবিকৃ্তিতে আক্রান্ত হয়।এর পাশাপাশি অজ্ঞতা এক বিরাট প্রাচীর।
মনোবিদ ধীরেন্দ্রনাথ গংগোপাধ্যায় বলেছিলেন আপনারা টেলিভিশনে,সিনেমায় সেক্স দেখান তাতে সমাজ নষ্ট হবে না।কেন না সেক্স-এর একটা শেষ আছে।কিন্তু দোহাই আপনাদের আপনারা ভায়োলেন্স দেখানো বন্ধ করুন। প্রকাশ্যে পশুনিধন বন্ধ করুন।শিশু-কিশোরদের সামনে কোনও প্রাণীকে হত্যা করবেন না।এতে শিশু মনে ছাপ পড়ে।পরবর্তীকালে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।মনোবিদের কথা যে কী নির্মম সত্যি ছিল তা আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
আমরা কী তাহলে এই নিয়ে হা হুতাশ করব আর সোস্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তুলে আমাদের কর্তব্য সমাপন করব?না কী আমরা যারা সোস্যাল মিডিয়ার সংগে কোন না কোনও ভাবে যুক্ত তারা কিছু না কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করব ও এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলব?আমার এ সুযোগ এসেছে কয়েকবার।আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র একবার ‘স্তন্যপান’বিষয়ক প্রচারের জন্য নাটক লেখার অনুরোধ জানায়।সেবারে “অমৃতধারা” নামের একটি বেতার নাটক লিখেছিলাম যা “স্তন্যপান দিবস”এ প্রচারিত হয়।
অভিষেক গাংগুলি বহুদিন থেকেই নানা ধরনের প্রচারমূলক ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করে।তার নির্মিত একটি তথ্যচিত্র যা প্রবাদপ্রতিম মিস শেফালি র উপরে আমি বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে পরে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।অভিষেক যখন আমাকে অনুরোধ করল “স্তনের ক্যান্সার” বিষয়ে একটি চলচ্চিত্রের জন্যে আমাকে চিত্রনাট্য লিখে দিতে হবে যা নিছক তথ্যে ঠাসা নীরস চিত্র হবে না।শ্রীমতি বিজয়া মুখোপাধ্যায় যিনি এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর ও সেরে ওঠার পর একটি রোজনামচা লেখেন।আমি সেটাকে আশ্রয় করেই আমার লেখা শুরু করি ও শেষ করি।তাই নিয়ে অভিষেক এক চমৎকার চলচ্চিত্র বানিয়েছে।
আত্মকথন হলেও বলা প্রয়োজন আমি আমার শৈশবে বড়পিসেমশায়কে,পরে আমার মা কে,বড়জামাইবাবুকে,এক বৌদিকে,ভায়রাভাইকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে যেতে দেখেছি।সম্প্রতি আমার বন্ধুর স্ত্রী ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার’ আক্রান্ত হয়েও মনের জোরে ও চিকিৎসায় সেরে উঠে সুস্থ আছে।
এখন আমাদের কী করণীয়?প্রতিটি ছেলে ও মেয়েকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা।তাদের সংগে খোলা কথা বলে সমস্যাটা জানা ও সমাধান করা যার সামান্য পদক্ষেপ এই “কুইন অব রোজেস”।

সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৬

বিশ্বজনের নগর বাউল লালন সৈকতে রবীন্দ্রনাথ,সলিল স্রোতে বব ডিলান
সলিল সরকার

কাঙাল হরিনাথ তার “গ্রাম বার্তা প্রকাশিকা” নামের সংবাদপত্রে ১৮৯০ এর অক্টোবরে একটি প্রয়াণ সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন।সংবাদটি শোকের আবার সেটি বাঙালির চিরশ্লোকেরও বটে।

১৭৭৪এর কোনও এক মাসে সোনার বাংলার কুষ্ঠে(কুষ্ঠিয়া)র ছেউরিয়া গ্রামে জন্মেছিল যে ছেলেটি চিরবসন্তের দেশ এই বাংলায় ভয়াবহ জলবসন্তে(স্মল পক্স)মারাই যাচ্ছিল প্রায়।বাংলার বুক ভরা মধু,বংগের বধূ-জননী-মা মান্দাসে ভেসে যাওয়া তাকে জল থেকে তুলে এনে শুধু প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন না,তাকে লালন করলেন।শুধু বাংলা নয় বিশ্ব পেল চিরকালের শ্রেষ্ঠ বাউল লালন ফকিরকে।ফকির তবু জাতের ফিকিরে তার রুচি নেই।সাধক তবু নেশা-ভাঙে চরম অনীহা।গৃহী সন্ন্যাসী,পুঁথির শিক্ষা নেই তবু সে জ্ঞানী,শুনে শুনে শুন্যি।সিরাজ সাই তার গুরু।নাকি সে নিজেই নিজের সিরাজ সাই?
১৭৭৪(মতান্তরে১৭৭২)এ জন্মে ১৮৯০এর ১৭ অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে দেহ লীলা সাঙ্গ করেছিলেন।বাংলার ১২৯৭এর ১লা কার্তিক,শুক্রবার।কাল ১৪২৩এর ১লা কার্তিক তার ১২৬ তিরোধান দিবস।

জোড়াসাঁকোর বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্ঠিয়ার জমিদারও বটে তিনি আর তার দাদা শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মুখে মুখে ফেরা লালনের গানের সন্ধান পেয়েছিলেন। জ্যোতিদাদা তাকে বোটে কেদারায় বসিয়ে একটা স্কেচ করেছিলেন।সেটাই আজ এক মাত্র প্রামাণ্য চিত্র।বাকি সব কল্পনা।আর বাবু কবি রবীন্দ্রনাথ তার দেহপটের সাক্ষাৎ পেলেন না।পেলেন তার গানের কথা যা তার শিষ্যরা হাতে হাতে লিখে রেখেছিলেন। কেউ কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথ না কি তার গান চুরি করেছিলেন।আমিও বলি বটেই তো!তবে গান চোরা নয়, মন চোরা।ঠাকুরমশায়ের কতো গানেই না বাউল-ফকির-লালন-হরু-নিধুর আসা-যাওয়া!সেইভাবে বলতে গেলে ১৯৪১এর ২৪ মে আমেরিকার মিনেসোটার মিনসে অ্যালেন জিমারম্যানও তো লালন ফকিরের গানে প্রাণিত হয়েছেন।
জিমারম্যান বললে অনেকেই হয়ত ইতিউতি চাইবেন কিন্তু যদি বলি বব ডিলান এ প্রজন্ম লাফিয়ে উঠবে।
আমেরিকার মানুষ প্রখ্যাত গায়ক,সুরকার,লেখক,গীতিকার ও মানবতাবাদী বব ডিলান জন্মেছিলেন ১৯৪১ এর ২৪ মে।
বাংলার প্রখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক এই বছর আগস্ট মাসে প্রয়াত হচ্ছেন।সেই হিসেবে এ বছর রবীন্দ্রনাথের ৭৫তম প্রয়াণ বৎসর আর ডিলানের ৭৫ তম জন্ম বর্ষ।
একজন কবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে।তার ঠিক ১০৩ বছরে আর এক প্রখ্যাত কবি,গায়ক,সুরকার বব ডিলান নোবেল পুরস্কার পেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও ডিলানের মধ্যে শুধু এইটুকুই মিল নয়,দুজনেই বিশ্বশান্তির পক্ষে আজীবন লড়াই করেছেন।ডিলান এখনও জীবিত কিন্তু লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন কী?প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
হয়ত একটু অসংগতি লাগবে।হয়ত মনে হবে মানব মনের মতোই আমার চিন্তাটা বিক্ষিপ্ত ও চঞ্চল তবু যদি মনে পড়ে ডিলান অনুপ্রাণিত সুমন চট্টপাধ্যায়ের গাওয়া “কতোটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়!”তাহলে কী মনে পড়বে না “আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো”?মনে পড়বে না “পথের শেষ কোথায়,কী আছে শেষে?” তার পরেই মনে পড়বে না “আমার এ পথ,তোমার পথের থেকে অনেক দূরে”...।মনে পড়বেই “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ,আমার মন ভুলায় রে”।আর সেই পথ ভুলানিয়ার থেকে কলম নিয়ে আর নাগরিক কবিয়াল লিখবেন “পথে এবার নামো সাথী,পথে হবে এ পথ চেনা!”লিখবেন “পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি”।হ্যাঁ আমি সেই বাঁশুরিয়া সলিল চৌধুরির কথাই বলছি।
হঠাৎ করে মনে হতে পারে আমি হয়ত পথ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পথ হারিয়েছি। নয়ত কে কত পথ নিয়ে গান বেধেছেন তারই খুড়সিনামা(কুরসিনামা)খুলে বসেছি। না।আসলে সব রাস্তাই রাস্তা এক জায়গায় গিয়েই মেলে।পথের পথিক রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন।সলিল চৌধুরির নাম কখনও কেউ ভাবেননি।লালনের কথা আজ উঠে আসছে বারবার বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তির সূত্রে।কিন্তু আজ যদি সলিল চৌধুরি বেঁচে থাকতেন তাহলে কী বলতেন?
“আজ তবে এইটুকু থাক
বাকি কথা পরে হবে।
ধূসর ধুলির পথ
ভেংগে পড়ে আছে রথ
বহুদূর দূর যেতে হবে......!”





বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৬

শেষ নাহি যে ......।
সলিল সরকার
আমাদের বাসার বারান্দাটাই আমার গ্যালারি।এখানে বসেই আমার দিন কাটে রাত কাটে যখন বাসায় থাকি।শান্তিনিকেতনে এখন আর আমার বারান্দা নেই।আছে উন্মুক্ত প্রান্তর।রবীন্দ্রনাথ যেমনটি ভালোবাসতেন বাড়ি আর বাইরের তলের কোনও ফারাক থাকবে না।দরজা খুললেই উন্মুক্ত প্রান্তর।ঘর আর বাইরের মাঝে শুধু এক চৌকাঠ।যদিও ভিকিরিপতি গ্রামের কোনও বাড়ি এমনটি ছিল না।থাকা সম্ভবও ছিল না।সাপখোপের বাসা,গোরু-ছাগলের না বলে কয়ে ঢুকে পড়া আর অতি বর্ষনে কি বানভাসি হোলে জল ঢুকে পড়বে ঘরে তাই সব বাড়িই বেশ উঁচুতে এবং কয়েক স্তরে।প্রথমে পাঁচিল ঘেরা উঠোন,তার পরে কোমর সমান উঁচু খোলা বারান্দা যা কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হোত।তার পরে আর এক ধাপ উঠে বৈঠক খানা।তার পরে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘর।পায়ে পায়ে অনেক প্তহ মাড়িয়ে ঘরে ঢুকতে হোত।আমাদের বাড়িতে অবশ্য কোনও প্রাচীর ছিল না কোথাও।সব ছিল খোলামেলা।চুরি হয়ে যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারত না।কাঁসার-পিতলের বাসন-কোসন থেকে ধান-চালের বস্তা পড়ে থাকত বাইরে।মাটিতে পোঁতা থাকত কলসীতে ভরা সোনা-দানা নয় সারা বছরের নুন,যা আসত সুন্দরবন থেকে।এমনও কতবার হয়েছে জেঠিমা-মা-কাকিমায়েরা পুকুরঘাটে স্নান করতে নেমে কানের দুল,হাতের বালা,নাকের নাকছাবি হারিয়ে ফেলেছে জলে।আমরা নাইতে নেমে ডুব দিয়ে সেগুলো তুলে আন্তাম।আর না পেলে গ্রীষ্মকালের অপেক্ষায় থাকা।তখন পুকুরঘাটে জল কমে যেত।আমরা কবেকার হারিয়ে যাওয়া সোনাদানা কুড়িয়ে পেতাম।আর পেতাম পকেট থেকে পড়ে যাওয়া কবেকার খুচরো পয়সা।সিকি-আনা-আধুলি-নয়া পয়সা এমনকি ছ্যাঁদা পয়সাও।  
কলকাতার বাসায় থাকি চারতলায়।হারিয়ে যাবার মতো কিছুই নেই।আছে শধু মন যা থেকে থেকেই হারিয়ে যায়।বারান্দায় বসে ফিরে ফিরে পাই সেগুলোকেই।যে আবাসনে থাকি,আর যে বিল্ডিংয়ে থাকি তা একেবারে রাস্তার পাশেই।প্রতিদিন বাজার বসে।খেটে খাওয়া মানুষজনের খাওয়ার জন্যে সস্তার হোটেল আছে বেশ কয়েকটা।পানের দোকান থেকে মুদিখানা এমনকি ‘সাইবার কাফে’তাও আছে।আর আছে সারা দিন রাত যানবাহন আর মানুষের চলা চল।সারা দিন ধরে হুটার বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি থেকে হাসপাতালের রুগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যায়।অটো-টোটো থেকে রিক্সা আর উচ্চকিত বাইকবাহিনী।
রাজনৈতিক মিছিল থেকে বাবার মাথায় জল ঢালার মিছিল।শোভাযাত্রা থেকে মড়া পোড়ানোর শবমিছিল সব একাকার।কোনটা কীসের মাঝে মাঝে বোঝা দুষ্কর হোয়ে ওঠে।কী উল্লাস,কী চিৎকার!ঠাকুর দেখে ফেরা যুবক-যুবতীদের মধ্যরাতে কী অপূর্ব অশ্লীল ভাষা আর অঙ্গভঙ্গি!বাবা লোকনাথের কি বাবা তারকনাথের থানে জল দিতে যাওয়া পুণ্যার্থীদের ঘটে থাকে গঙ্গাজল আর পেটে থাকে কী জানি কী জল।তবে তাদের সম্মিলিত উল্লাসে পাড়ার বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদতেও ভুলে যায়!
বারান্দার বিপরীতেই আছে এক মান্ধাতা আমলের সিনেমাহাউস।তার রেশ থাকে সাড়ে নটা অব্দি।রাত বারোটা একটা অব্দি ঘরে ফেরার মানুষজন কাজ সেরে বাড়ি ফেরে।সাংবাদিকরা তারও পরে।ইনফরমেশন টেকনোলজির মানুষজন কেউ রাতে ফেরে কেউ রাতেই বেরোয়।
মোদো মাতালরা ফেরে একা একা রিক্সায়।ক্যাটারিংয়ের ছেলেরা ফেরে সাইকেলে চেপে গপ্পো করতে করতে।মোষ-গোরু নিয়ে হাটুরেরা যায় বেদম পেটাতে পেটাতে।আর একটু পরেই তো তারা কসাইখানায় ঢুকবে।ছাগলেরা যায় নাদি ফেলতে ফেলতে।টিন এজ ছেলেমেয়েরা যায় কানে এয়ারফোন গুঁজে,মাথা নীচু কোরে স্ক্রিনে চোখ রেখে।
কিছুকাল আগেও এই পথ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি যেত বাঁশ কি ধান-চালের বস্তা নিয়ে।চাকার ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ আর থেকে চালকের লাঠির বাড়ি ছাড়া আর কিছু শোনা যেত না।বারান্দায় দাঁড়ালেই শুধু দেখা যেত দুই গোরুর মাঝখানে একটা টেমি ঝুলছে যা আলোর থেকেও অন্ধকার ছড়াচ্ছে বেশি।
এই পথের পাশেই ছিল মার্টিন বার্ন কোম্পানির ছোটো রেল গাড়ির রেল পথ।এখনও স্থানে স্থানে তার চিহ্ন আছে।আর স্মৃতি হোয়ে আছে রেল পুকুর যেখান থেকে স্টীম ইঞ্জিন জল নিত।

এখানে অনেক পুকুর ছিল যেগুলোয় মাছ খেলা করত।মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হোত।আর জাল ফেলে মাছ ধরার পর সবার আগে পাড়ার লোকদের কাছে বাজারের থেকে কম দামে বিক্রি করা হোত তার পর বাকিটা বাজারে যেত।এখন বাজারটাই রাস্তার পাশে চলে এসেছে আর পুকুরগুলো হয়ে গ্যাছে আবাসন।অবশ্য খুব বৃষ্টি হোলে আবাসনগুলোই আবার হোয়ে যায় পুকুর যেখানে মাছ খেলা করে না।ভেসে বেড়ায় ডেঙ্গির লার্ভা আর পূজার ফুল।
 

মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬

হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব......
সলিল সরকার
এখনও বঙ্গে শরত আসে।
কেউ উৎসবে,কেউ মেঘের আকাশে।।
*
এখনও বঙ্গে ফোটে কাশফুল।
কেউ লাট খায়,কেউ নির্মূল।।
*
এখনও বঙ্গে মানুষের দাম।
মাথা থেকে পড়া পায়ে টুপ ঘাম।।
*
এখনও বঙ্গে বীভৎস মজা।
কারও প্রস্থান,কারও রাজা সাজা।।
*
এখনও বঙ্গে হোলিখেলা হয়।
কেউ দেখে ছয়,কেউ কিছু নয়।।
*
এখনও বঙ্গে সুখের বিলাসে।
কার ঘরখালি,কী বা যায় আসে!
যদিও সন্ধ্যা ......
সলিল সরকার
এখনও সন্ধ্যা আসেনি মন্দ মন্থরে
সব সংগীত আছে সিগন্যালে আটকে
এখনও বঙ্গে রঙ্গশালায় নাটকে
দিবারাত্রির কাব্য ঘুমায় অন্তরে
*
এখনও শিউলি পোড়ে পাঁচিলের একধারে
গন্ধ ছড়ায় আবর্জনার স্তূপে
তোমার আরতি মালা-চন্দন-ধূপে
অন্ধ-বাউল তোমার স্তবের গান ধরে
*
এখনও কবিতা বাড়ি ফেরে রোজ প্রাণ হাতে
তুলি ও কলম লেখে ফরমাসি গান
তবুও মানুষ নদিতেই শুচি স্নান
করে জেনেশুনে বিষ পান দিন বদলাতে
*
যদিও সন্ধ্যা এসেছে মন্দ-মন্থরে
স্তব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর
গানের পাখিরা বন্ধ করেনি পাখা


শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬

যেখানেই সম্ভাবনা সেখানেই উৎসব...।যেখানেই উৎস সেখানেই শব...।।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে “DEAD LIKE DODO”কালের নিয়মে নয়,মানুষের লোভ আর হ্যাংলামোপনায় ডোডো পাখিরা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।এভাবে অনেক প্রাণ,অনেক প্রজাতি হারিয়ে গেছে এই দুনিয়া থেকে যদিও তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।যেমন করে তিমি,ডলফিন,কচ্ছপ,বাঘ,সিংহ,পান্ডা,ভালুক,বেজি,বাঘরোল,ভোঁদড়, গন্ধগোকুল,গোসাপ,সাপ,শংখচিল,ঈগল,ভদ্রলোক ইত্যাদি,প্রমুখ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সময় আর সমাজ থেকে।যদিও আমার ধারণা এ দুনিয়া থেকে কিছুই হারাবে না(মানুষ যতই মরিয়া হোয়ে এদের মেরে ফেলুক)যদি প্রকৃ্তি চায় একদিন তারা আবার ফিরে আসবে।আর এদের কেউ কেউ লুকিয়ে বেঁচে আছে।এরা ফিরে আসবে।আসবেই।
এরা যেমন মানুষের লোভ আর হত্যালীলায় ফুরিয়ে যাচ্ছে আবার এই মানুষই কালের নিয়মে হারিয়ে যাওয়া,প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া বিষয়-আশয় ফিরিয়ে আনছে।আমার ছোটোবেলায় দেখা কতো উৎসব(আনন্দ নয়)প্রয়োজন ফুরিয়ে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।আজ তারা আবার কী অদম্য প্রচেষ্টায় ফিরে ফিরে আসছে।অযোধ্যায় অতি প্রাচীণ ও বিস্মৃতপ্রায় ‘বাবরি মসজিদ’ ক’জন মানুষেরই বা জানা ছিল সেটা ১৯৯২ এর ৬ডিসেম্বর মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা হোলও ‘রাম বনে ফুল পাড়ে’ না।রাম মনেই বাসা বেঁধে আছে।সেইদিনের ঘটনার আগে পরে কতো জান ও জীবিকা নিঃশেষ হোলো।কতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিরে এলো।কতো ধর্মীয় উন্মাদনা(দুই সম্প্রদায়েই)মাথা চাড়া দিল।বিপুল বেগে রক্তের স্রোত বইতে থাকল নদি-গিরি-উপতক্যায়।আমরা ফিরে পেলাম কতো উৎসব...।কতো রক্তের স্নান।কতো ধর্মের জিহাদ।
আমাদের ভিকিরিপতি গ্রামে উৎসবের খামতি ছিল না।বারো মাসে তেরো পার্বণ সে তো ছিলই।পাঁজি-পুঁথিতে লেখা আচার-বিচার-পুজোআচ্চা আর চড়ক-গাজন,ঈদ-মহরম।এ বাদেও যে কোনও ছুতো-নাতায় মেতে উঠতে ভিকিরিপতির জুড়ি মেলা ভার ছিল!রথযাত্রা দিয়ে যেমন চিৎপুর যাত্রাপাড়ায় বায়না শুরু হয় গ্রামেও রথযাত্রা ছিল বেশ বড়োসড়ো উৎসব।রথের পরেই ঘরে ঘরে ‘বিপত্তারিণী’।এর মাঝে অমাবস্যা অম্বুবাচী তো আছেই।এর পরেই বিশ্বকর্মা।তখন ওটা বারোয়ারি ছিল না।ঘরে ঘরে ঠকঠকি(তাঁত)ছিল আর ছিল লোহার কারবার।নাপিত,কামার,কুমোর এরাও পুজো সারত নমো নমো করে।ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়।শরতে দুর্গাপুজো ছিল সব বাড়িতে নয়,তবে সবার জন্যে।বিজয়ায় প্রণাম আর মিষ্টি খাওয়াটা ছিল লোকাচার।ধর্মাচার নয়।
এইখানে একটা কথা না বলে পারছি না।ইদানীং যেমন সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা বেড়েছে আবার কিছু মানুষ যখন সোচ্চারে ‘আমি নাস্তিক’, ‘আমি নাস্তিক’ বলে সদ্য গজানো শিং উচিয়ে নরম কাদা থেকে শক্ত পাথরে শিং ঠোকে সেটাকেও আমার সমান মৌলবাদী না হোলেও উন্মাদনার প্রকাশ মনে হয়।সেকালে যারা হাজার ধর্মভীরু মানুষের পাশে বসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হোয়েও ঠাকুরের প্রসাদ খেতে অনীহা দেখাত না কিন্তু পায়ের জুতো খুলে ঠাকুরকে প্রণামও করত না।প্রণাম নিতও না।কিন্তু সম্মানীয়দের প্রণাম করতে কুণ্ঠিত হোত না।আবার মা-বাবা মারা যাবার পর মাথা কামিয়ে শ্রাদ্ধ করা কি চুল না কামিয়ে বামুন ঠাকুরকে মূল্য ধরিয়ে দেওয়া এই ভন্ডামিটা তারা করতেন না।যদিও বাকি ভাই-বোন কি আত্মীয়-পরিজন তার জন্য তাকে দূরাচারী দুর্বৃত্তও আখ্যা দিত না।কিছুটা এক ঘরে হোয়ে থাকতে হোত এটাও সত্যি।ঠিক যেমন অনেক আস্তিক মানুষও তার পরিবারে একা।বাকিরা নাস্তিক বলে নয়।বাকিরা ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতে মাথা খুঁটে মরে বলে।
গ্রামের ঘরে ঘরে মনসা পুজো আর সেই সূত্রে ‘অরন্ধন’ ছিল অবশ্য করণীয় লোকাচার।যেদিন যার বাড়িতে ‘অরন্ধন’ হবে সেদিন তাদের আমন্ত্রণে গ্রামের সব বাড়িরই এই বাড়িতে ‘হাঁড়ি বন্ধ নেমন্তন’!কারও বাড়িতে সেইদিন উনুন জ্বলবে না।সেদিন গ্রামের সব বাড়িতে মাটির উনুন গোবর জলে ধুয়ে মুছে আলপনা দিয়ে তার মাঝখানে একটা ফণীমনসার পল্লব রেখে দেওয়া হবে।আয়োজকদের বাড়িতে আগের দিন সব রান্না করে ঠাণ্ডা ভাঁড়ার ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখা থাকবে।কী কী রান্না হোতো?তাহলে বলি শুনুন – পান্তভাত,লালশাক,সজনে শাক,পিড়িং শাক,শুষনি শাক,গিমে শাক,নটে শাকএতো গেল শাকের কথা।এবার আসি ভাজাভুজিতে-লাউভাজা,কুমড়োভাজা,ওল ভাজা,শশাভাজা,ঝিঙেভাজা,আলুভাজা,উচ্ছেভাজা,বাংলা করলা,পটলভাজা,বেগুনভাজা,ঢ্যাঁড়সভাজা,বরবটিভাজা ইত্যাদি ইত্যাদি।এবার শুক্তো, কুমড়োর ছ্যাচড়াঁ,মুগডাল সেদ্ধ,খ্যাসারি ডাল সেদ্ধ,ছোলারডাল সেদ্ধ,মটরডাল সেদ্ধ, পুঁইশাকের চচ্চড়ি।নারকেল দিয়ে চাল কুমড়োর ‘কুমড়ি’ ছিল অনবদ্য রান্না।এবার মাছ-চিংড়ি মাছ,ইলিশ মাছ(বাড়ির যারাই শহর থেকে গ্রামে আসত তারা জোড়া ইলিশ না নিয়ে বাড়িতে ঢুকত না)।নিরামিষ টক ও অম্বল হোতো বেশ কয়েক রকমের।কাঁচা তেঁতুলের টক,লাউয়ের টক,ইলিশের টক,চিংড়ির টক।নিয়ম যেমন ছিল তেমনি তার পাশ কাটানো বেনিয়মও ছিল বৈকি।সবাই কতো ঠাণ্ডা ভাত খাবে?তাই উঠোনের বাইরে তোলা উনুনে গরম ভাত করা হোতো।আর ইলিশ মাছ গরম গরম ভেজে মাছ ভাজা আর ইলিশের তেল।ষাট/সত্তর অব্দি জোড়া ইলিশের দাম ছিল দুই থেকে চার টাকা(ওজন করে নয়)যারা এক একটি হোতো দেড়-দুই সের।
ঘেঁটু পুজোয় যেমন বাড়ির সব দেওয়ালে ঘুঁটে দিয়ে সীমারেখা টানা হোতো আর দরজার উপরে গোবরের ড্যালায় কড়ি গেঁথে সেঁটে দেওয়া হোতো।আর ঘেঁটু ফুলের গন্ধে আমোদিত হোতো সারা গ্রাম।ঘেঁটুপুজোর মতো ‘ইতু পুজো’ও হোত, ‘শীতলা পুজো’ও হোত।গ্রামের লোক বলত ‘শয়লা পুজো’।দক্ষিণ প্রদেশ থেকে ‘সন্তোষী’ বাংলায় আসার আগে গ্রামের কালী মন্দিরের পাশে ‘শনি’পুজো হোত।সিদ্ধার্থশংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী হবার পর সাট্টা জুয়ার পাশাপাশি সন্তোষী এলো।আর বামফ্রন্টের কালে পাড়ায় পাড়ায়,অলিতে গলিতে ফিরে এলো ফি শনিবার শনিপুজো।তার সংগে গুরুপুজো।আর এলো বাবার মাথায় জল ঢালার ঢল।সবাই হয়ে পড়ল “বাবা তারকনাথ” সিনেমার সন্ধ্যা রায়।রাস্তাজুড়ে বাঁক কাঁধে ছুটে চলা চ্যালা-চেলীর উন্মত্ত উল্লাস আর স্থানে স্থানে তাদের উৎসাহ দিতে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে যুবাদের অপেক্ষা।ব্যস্ত পথ ঘিরে “সার্ব্বজনীন”(সর্বজনীন লেখা দেখেছি ক্বচিৎ,কদাচিৎ)বিশ্বকর্মা থেকে কার্তিক-গণেশ, জয় মা মঙ্গলচণ্ডী থেকে জগদ্ধাত্রী সবের রম রমা হোলো বামফ্রন্টের কালেই।সাতদিন জুড়ে দুর্গাপূজা করপোরেটশ্রী হোলো।আজ পুজোর চেয়ে পুরস্কার বেশি।আকাশবাণী কলকাতার মহালয়া অনুষ্ঠানে ধর্মের চেয়েও বেশি ছিল গানের ধর্মপালন।তার কথা-সুর-গায়ন আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত আবেগ তাকে জনপ্রিয় করেছে।হিন্দু পৌত্তলিকতার মৌলবাদ নয়।এ বাংলায় বসবাসকারী এমন কোনও বাঙ্গালি আছেন যিনি বা যারা কোনো না কোনও ভাবে আকাশবাণীর উদ্ভাবন মহালয়া শোনেন নি?
ষাট-সত্তর দশকেও সারা গ্রামে একটি-দুটি বাড়িতে রেডিয়ো ছিল।অনুরোধের আসর থেকে থেকে শুক্রবারের রাত আটটার আর রবিবারের দুপুরের নাটক শুনতে মানুষ যেমন হাজির হোত ভোর চারটেয় মহালয়া শোনার জন্যেও মানুষ গুটি গুটি পায়ে জড়ো হোতেন।ঠিক যেমন পাড়ায় কোনও বাড়িতে যাত্রার আসর বসলে মাইক বাজিয়ে কাউকে ডাকতে হোত না।আপনা থেকেই জড়ো হোত মানুষ।কিন্তু কোনো পালা বা পার্বণে কাঙ্গালিভোজন করাতে চাইলে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হোত।বিনা আমন্ত্রণে এক পেশাদার ভিখারি ছাড়া আর কেউ আসত না।কিন্তু কোনো হুজুগ এলে মানুষ এক লহমায় হাজির হোয়ে যেত।
কোনও বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে মেয়েরা ছেলে কোলে,কলসী কাঁখে হাজির।পাড়ায় নতুন জামাই এসেছে বুড়ো-বুড়ি,কচি-কাচা থেকে বাড়ির বৌ-ঝি হাজির।কেউ বরকে ছেড়ে পালাচ্ছে-সবাই হাজির।কেউ বৌকে পেটাচ্ছে কি বৌ পরম সুখে কান্নাজুড়ে বরকে পেটাচ্ছে সেখানেও হাজির সব্বাই।রাত-বিরেতে চেনা চোর ধরা পড়েছো ঘুম চোখে সবাই হাজির।আর যেবার চোর খুঁজে পাওয়া যেত না তখন গ্রামের স্থায়ী চোর ভজাকে ঘুম থেকে তুলে এনে পেটানো হোত।ভজার ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগত।বোঝার পর শরীরটাকে ছেড়ে দিত। কাঁচাঘুম ভাঙা মানুষ হাতের সুখ মিটিয়ে ভজাকে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত।ভজা তার পরে চুরি করতে বেরোত।কারণ ভজা নিজের প্রয়োজনে চুরি করত না।কারও না কারও গোপন ইশারা থাকত সেই চুরিতে।আর চুরির দ্রব্য যেত তার বাড়িতেই।যদিও ভজা কোনদিন মার খেয়ে আধ মরা হয়ে গেলেও‘এথিক্স’ ভেঙে প্রকৃ্ত বাটপাড়টির নাম ফাঁস করে দিত না।এও ছিল এক নৃশংস উৎসব।
শীতকালেব ভিন্ন প্রদেশের মানুষজন মেষ-ভ্যাড়া-শুয়োর চরাতে আসত।গ্রামের বাচ্চাকাচ্চা তাদের পিছনে দৌড়ত।একবার একটা বাচ্চা শুয়োর কচুবনে ঘুমিয়ে পড়েছিল।রাতেরবেলা সে যখন ঘুম থেকে উঠে তার মাকে খুঁজতে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে আর গ্রামের উৎসাহীরা তাকে ধরতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে সেই সময় মেষপালক এসে কৌশল খাটিয়ে ধরে ফেলল।গ্রামের মানুষের এবার ঘরে ফেরার পালা।সেই সময় তাদের কথোপকথন ছিল এই রকম-
-উফ কী বাঁচছি!
-কেন শুয়োরের বাচ্চাটা তোরে কী করছিল?
-আর বোলোনি মুই তাল বুঝে তাকে ধরতে গেছি যেই অম্নি শুয়ারটা আমার এঁড়তল দিয়ে পালাল।আর একটু হোলে মোর বিচিটা
কথাটা শেষ করতে পারল না উৎসাহী ছেলেটি।এক বয়স্ক মানুষ আমাদের দেখে চাপা স্বরে বল্লে
-এই কচি চুপ মার।
-কেন?কী হচে?
-সরকার বাড়ির ছ্যানাপুনারা শুনলে কী কইবে?এঁড়তল না কয়ে পোঁদতল ক।
এও ছিল গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক হঠাৎ উৎসব।
সবচেয়ে মর্মান্তিক উৎসব হোতো যখন কেউ মারা যেত।বিশেষ করে প্রচণ্ড শীতে কি অঝোর বর্ষায় কেউ মারা গেলে মড়াপোড়ানোর দলবল উদোম গায়ে কোমরে গামছা জড়িয়ে পৌঁছে যেত।তাদের হাতে পোড়ানোর কাঠ কাটার কুড়াল আর মাটি খোঁড়ার কোদাল ওঠার আগে তুলে দিত হোত বোতল বোতল চোলাই।একটি জনপ্রিয় ছড়া সবার মুখে মুখে ফেরে
“বিদ্যাসাগরের মেন্নিপুর/ভাকু তেলে ভরপুর”
দাহের শব শ্মশানে পৌঁছনোর পর প্রায়শই মৃতদেহ সৎ্কারের কাজটি বাড়ির লোকজনকেই সম্পূর্ণ করতে হোত।কারণ তারা তখন মৃতের মতো শায়িত মৃতের কাছেই।এও ছিল আর এক শোক উৎসব!এরকম আরও অনেক শোক ও সখের উৎসব ছিল সেই ভিকিরিপতি গ্রামে।যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
এবার যেমন উৎসবের দিনগুলোয় ব্যাংক বন্ধ কিন্তু খোলা থাকছে মদের দোকান আমোদের জন্যে।এখন যেমন অনেক আগে থেকেই অকাল বোধন উৎসব বাংলার কিছু মানুষের মনে খুশির তুফান আনে।আর বাকিরা? “ছাগলছানা লাফিয়ে চলে/জাহাজ ভাসে সাগর জলে”!

   

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

কার ঘরে জ্বলেনি দীপ...।চির আঁধার
সলিল সরকার
পাড়ায় পাড়ায়,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে,আবাসনে গৃহপ্রাঙ্গণে এখন উৎসব।মাইকে অমায়িক উল্লাস।এখন সেই গান আর শোনা যায় না-“জিনিসের দাম বেড়েছে,মানুষের দাম কমেছে,হায় রে কপাল করব কী?” মাইকে না বাজলেও রেডিয়োয় এখনও শোনা যায় জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই গান
“কেউ বলে ফাল্গুন,কেউ বলে পলাশের মাস।
আমি বলি আমার সর্বনাশ”
ঠিক এইভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলা ও বাঙ্গালির উৎসবের মাস আবার প্লাবনেরও মাস।কোথাও মানুষ আনন্দে-উৎসবে ভাসছে আবার একই সময়ে বাংলার মানুষ বরষনে প্লাবনে ভাসছে।উৎসবে ভাসা মানুষজনকে এখনও সবাই ‘পল্লীবাসি’ বলে আর ভেসে যাওয়া জীবনকে ডাকা হয় ‘বানভাসি’ বলে।
উনপঞ্চাশ(১৯৪২)সালের ঝড়ের কথা লিখতে গিয়ে নিজের কালের ৭৮এর দুর্বিপাকের কথা ঝড়ের মতো উড়ে এলো স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ত্রাস-সন্ত্রাস-কারাবাস-রক্তের স্নানের পর বাংলায় এসেছে বামফ্রন্ট মানুষের অদম্য প্রয়াসে।বাংলা নাটকে তার আগে থেকেই এসেছিল প্লাবন।বাংলায় প্লাবন এলো শারদীয় উৎসবের কিছু আগে।তখনও মানুষ সে শহর হোক কি গ্রাম ত্রাস ও সন্ত্রাসের দিন গুলো মন থেকে মুছে উঠতে পারেনি।তখনও রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পায়নি।তখনও ‘জমানা বদল হোলে দেখে নেবার’হুমকি দিয়ে চলেছে দেবী ও দেবের পারিষদরা। তখনও বাসে পেট্রোল বোমা পড়ে।খোলা রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ও চপার নিয়ে ঝন্টু-মিন্টু-পিন্টু-কাল্টু(কল্পিত)রা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে না হোলেও রাতের অন্ধকারেই।
পেশাদার থিয়েটারে তখন নাভিঃশ্বাস।‘এ’মার্কা থিয়েটার বিদায় নিচ্ছে কালের নিয়মেই। গ্রুপ থিয়েটার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আক্ষরিক অর্থেই।লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল,টি,জি)থেকে পিপলস লিটল থিয়েটার তৈরি হয়ে গেছে।“দুঃস্বপ্নের নগরী” তখনও যায়নি।চলছে “টিনের তলোয়ার”, “এবার রাজার পালা”।থিয়েটার ইউনিট করছে “পন্তু লাহা” আবার শেখর চট্টোপাধ্যায় বাণিজ্যিক থিয়েটারে করছেন “শ্রীমতি ভয়ংকরী”।নান্দীকার করছে “ফুটবল”।থিয়েটার ওয়র্কশপ করছেক “চাক ভাঙা মধু”, “রাজরক্ত”।চার্বাক করছে “কর্ণিক”।থিয়েটার কমিউন “কিং কিং”,“দানসাগর”।চেতনা করছে “জগন্নাথ”। বহুরূপী কুমার রায়ের পরিচালনায় নিয়ে এলো “মৃচ্ছকটিক”।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন “পাপ পুণ্য” নিয়ে।সুন্দরম্ করছে “সাজানো বাগান”।আর কিছু তরতাজা যুবক নির্মাণ করল নতুন সংগঠন শূদ্রক।এলো সময়ের প্রকাশ্য প্রতিভাস “অমিতাক্ষর”।বাদল সরকার প্রসেনিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কার্জন পার্কের ঘাসে,অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর লনে করছেন “ভোমা”, “মিছিল”, “সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস”।কেউ করছেন “লাল লন্ঠন”।কেউ করছেন “পদ্মা নদির মাঝি” আবার “গোরুর গাড়ির হেডলাইট”ও চলছে রমরমিয়ে।গ্রামে,মফঃস্বলে নাট্যকর্মী্রা কোমর বেঁধে নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার মঞ্চেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর,ঝরিয়ায়,কুলটিতে সুনীল রায়,সুনীল মুখোপাধ্যায়,বংশী মুখোপাধ্যায়, দুর্গাপুরে গোপাল দাস,বোকারোয় নিমু ভৌমিক,বালুরঘাটে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করছেন “দেবাংশী”।বহরমপুরে প্রদীপ ভট্টাচার্য লড়ে যাচ্ছে নাটক নিয়ে।চাকদহে নাট্যকার চন্দন সেন নাটক লিখছেন,পরিচালনা করছেন।দক্ষিণেশ্বরে কালী মা নয় গোর্কির “মা” করছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।কথায় কিছু এলোমেলো হোলো যদিও লুটেপুটে খাওয়ার দিন ছিল না সেইসব দিন।বন্যায় ভেসে যাওয়া আবার ভেসে ওঠার পরে ছয় ছয়টি নাট্যদল দলাদলি না করে নয় ছয় না করেই ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রকে নিয়ে করল বারটোল্ট ব্রেষটের নাটক “গালিলেওর জীবন”।সুব্রত নন্দী এর আগেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সেটিই “বহুরূপী” করল “গালিলেও” নামে।সবটাই সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তা বলব না তবে আজকের ক্যান্সারের মতো তা নিঃশব্দ প্রকট ব্যাধি হোয়ে ওঠেনি।
বাংলায় বন্যা নতুন কিছু নয়।উপ সাগরীয় অঞ্চল,খাল-বিল-নদি-নালার দেশ।ঝড়-তুফান সে তো উঠবেই।মা-মাটি সে তো ভাসবেই।একটু হাল্কা চালেই বলি-আমার বাবা কবি ছিলেন না,জ্যাঠাবাবুর মতো রসিকও ছিলেন না।ছিলেন খাজনা আদায়ের ‘তহশিলদার’।নিজেদের নাম দেব-দেবীর নামে হোলেও আমাদের নাম রেখেছিলেন-মলয়
মিলন,সলিল।কী আশ্চর্য আমার জন্মের ঠিক পরের বছর বাংলায় বন্যা হয়েছিল।১৯৪২ এর পরে ১৯৫৬ আর ১৯৫৯।এই দুই বারে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু এর পরে ১৯৭৮ এ এই সময়ে বিপুল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল বাংলার প্রায় সব জেলা।এমনকি কলকাতাও।
আমরা তখন সারা রাজ্যজুড়ে মঞ্চে-খোলা মাচায় নাটক করে বেড়াই।সেবার নাটক ছিল বর্ধমান রাজ কলেজে।তখনও দাপুটে বাহিনী “অমিতাক্ষর” করার সময় নাটক থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোলো।সেই রাতে আমাদের ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল।আমরা না থেকে বাস নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।রাস্তায় নেমে বুঝলাম আমরা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বড়ো রাস্তার উপরেই জল বইতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে নামলাম এক হাঁটু জলে।
মা-বাবা-জ্যাঠা-কাকা-কাকিমা-ভাই-বোনেরা সবাই তখন ভিকিরিপতি গ্রামে।অনেক বন্যা হয়েছে কিন্তু তাম্রলিপ্ত বন্দর কখনও জলে ভাসেনি।কাঁথি-দীঘায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে কিন্তু আমরা কখনো ভাসিনি।এবার কোলাঘাট,বাগনান,রাধামনি,হাকোল্লা,ব্যবত্তা সব ভেসে গেল।গ্রামের ডাকঘরে ট্রাংককল করা যাচ্ছে না।স্থানীয় সংবাদ রেখে ঢেকেও যা জানাচ্ছে তা ভয়ংকর।রূপনারায়ণ বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।রেললাইন জলের তোড়ে ভেসে গেছে বাগনানে।বাড়ির সবাই,গ্রামের মানুষ সব ফেলে রেখে উঠছে স্থানীয় স্কুলে।সেই প্রথম ভিকিরিপতি গ্রাম দেখল লঙ্গরখানা।
আমার দাদা আর আমি কলকাতা থেকে ডাল-চাল-চিঁড়ে-বাতাসা-গুড়-মুড়ি-কেরোসিন তেল নিয়ে নূরপুর থেকে নৌকায় গেঁওখালি হয়ে মহিষাদল,সেখান থেকে কীভাবে যে তমলুক হয়ে মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিলাম তা মনে করতেও ভয় পাই।কাতারে কাতারে মানুষ জলেডোবা গ্রামে যাচ্ছে স্বজন-পরিজনকে উদ্ধার করতে।ঠিক ৪২এর দুর্বিপাকের বিপরীত।পথে ঘাটে মরা পশু।জলে ভাসছে মরা মাছ।রাতেরবেলা ভরা মাঠের থেকে ভেসে আসছে গুম গুম শব্দ!বাবা বল্লে-“মাটির বাড়ি জল নামার সংগে সংগে জলের উপরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!তারই শব্দ ভেসে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে!”

আটাত্তরের সেই দুর্বিপাক কাটিয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ আর বামফ্রন্ট।তার কতো বছর পরে গ্রীষ্মকালে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল বামফ্রন্ট।একেই বলে “বিধি বাম?” না কী এরই নাম সিঙ্গুর,খেজুরি,নন্দীগ্রাম?

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬







আমার যে দিন ভেসে গেছে......!
সলিল সরকার
বাংলার উনপঞ্চাশ সালের উপকুলীয় ঝড় আর জলোচ্ছাস,পঞ্চাশের মন্বন্তর আমার জন্মের তেরো-বারো বছর আগের দুর্বিপাক।আমার জন্মের কালে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে দেশভাগ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,উদ্বাস্তু উদ্বে্গ আর “এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” কমিউনিস্ট আন্দোলনে।যদিও রেখে গিয়েছিল তার রেশ শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্পকলায়,গীতিকার-সুরকারদের সুর আর কথায়,গায়িকা-গায়কের গানে যা ভিকিরিপতি গ্রামেও ছাপ ফেলেছিল।আর ছিল জলবসন্তের দাগের মতো গভীর সামাজিক ক্ষত যা সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনও মুছে দিতে পারেনি।
কবুল করতে লজ্জা নেই রবীন্দ্রানুরাগী জ্যাঠাবাবুর কণ্ঠে কোন দিন “নব জীবনের গান” শুনিনি।শুনিনি ইকবালের “সারে জাঁহাসে আচ্ছা......”কিন্তু রেডিয়োতে কি বাড়ির ‘কলের গানে’ শুনেছি “অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি” কি “পথে এবার নামো সাথী” আর শুনেছি ‘রানার’।শুনেছি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পুত্র কাজী সব্যসাচীর উদাত্ত কণ্ঠে “কারার এই লৌহ কপাট”, “কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই” কি “বিদ্রোহী রণক্লান্ত......”।
তবে বাবার কাছে,জ্যাঠাবাবুর আর ঠাকুমার কাছে উনপঞ্চাশ সালের ঝড়ের বিবরণ শুনেছি যখনই সাইক্লোন এসেছে কি অতি বর্ষনে ভেসে গেছে সারা গ্রাম।সেই সময়ের সাময়িক সংকটের কথা শুনেছি কিন্তু “ম্যান-মেড ফেমিন”এর ভয়াবহতা,শহরের পথে পড়ে থাকা সারি সারি লাশ, ‘প্রাণ দাও,ফ্যান দাও’ আর্ত চিৎকারের বিবরন দেখেছি,শুনেছি, পড়েছি তৃপ্তি মিত্রের লেখায়, বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” নাটকে,নিমাই ঘোষের“ছিন্নমূল”সিনেমায়,চিত্তপ্রসাদের,জয়নুল আবেদীনের স্কেচে, সুনীল জানার স্থিরচিত্রে,সোমনাথ হোড়ের পেন্টিংয়ে আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কবিতা আর ‘নব জীবনের গান’এ,সলিলদার কথায়-সুরে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দপ্তরে নিয়মিত কাজের মধ্যেই শুনেছি রেবা রায়চৌধুরির বলিষ্ঠ স্বরে “প্রাণের দেউলে যত বধূরা প্রদীপ জ্বালাবেই” তার পরেই নরেনদার(মুখোপাধ্যায়)ব্যারিটোন ভয়েসে “ঝড়ে ভাঙা ঘর যত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবেই”।তার বেশ কিছু আগেই পড়ে জেনেছি ১৯৪২-এ পূর্ব মেদিনীপুরের প্রায় ৪৫০ স্কোয়ার মাইল ভেসে গিয়েছিল সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে।প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৪০০ স্কোয়ার মাইলেরও বেশি অঞ্চল।৩২০০ স্কোয়ার মাইল বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঝড় আর লাগাতার বৃষ্টিতে।মানুষ মরেছিল চোদ্দ-পনের হাজার।গবাদি পশু মরেছিল কমপক্ষে এক লক্ষ নব্বই হাজার কি তারও বেশি।গ্রাম থেকে শহরে বাঁচবার আশায় পালিয়ে এসেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে লুটপাট করেনি,কেড়ে খায়নি।খেটে খাওয়া মানুষেরা শহরের রাস্তায় খুঁটে খেয়েছে।উৎসব-আনন্দের ভোজসভায় প্রবেশ না করে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে নেড়ি কুকুরের সংগে লড়াই করেই।ব্রিটিশ সরকার নীরব থেকেছে।কালোবাজারীরা দু-হাতে টাকা লুটেছে। আড়তদারেরা চড়া দামে মাল বেচেছে সম্পন্ন শহরবাসীদের কাছে।একমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গান গেয়ে,নাটক মঞ্চস্থ করে টাকা,জামাকাপড়,খাদ্য সংগ্রহ করে রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজ চিত্তপ্রসাদের মুদ্রিত চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে দিয়েছে।অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বেড়াজালে ফেলে নাটকের গতি স্তব্ধ করতে চেয়েছে,পারেনি। রবীন্দ্রনাথের গান দেখিয়েছে পথের দিশা।সুচিত্রা মিত্র,দেবব্রত বিশ্বাস এর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠল বিদ্রোহের গান।কালের অমোঘ নিয়মে মানুষ না খেতে পেয়ে যত মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মারা গেল অনেক দিনের না খাওয়ার পর খেয়ে।মাঠে মাঠে ফসল।ফসল কাটার কেউ নেই।ঘরে ঘরে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ।গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।রেংগুনে বোমা পড়ল কলকাতা শহরের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালাল গ্রামে।কালের পরিহাসে গ্রামের মানুষ আশ্রয় দিল শহরবাসীদের,যে শহুরে বাবুরা পথে পথে পড়ে থাকা অভুক্ত মানুষদের মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে অন্ন তুলেছে মুখে।তারাই প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিল গ্রামে।জন্ম নিল ‘ড্যাংচি বাবু’রা যারা কথায় কথায় বলত “ড্যাম চিপ”।
আমার শৈশবেও এই ‘ড্যাংচি বাবুদের’ আমি দেখেছি।তারা পালা-পার্বণে,দোল-দুর্গোৎসবে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সপরিবারে দেশে যেতেন।বাস থেকে নেমেই সামনে যাকেই পেতেন (সে চাষি হোক কি মুনিষ)তাকে ধমকে তার মাথায় বাক্স-প্যাঁটরা চাপিয়ে দিতেন।এই দেখে একবার আমার এক জাঠতুতো দাদা মাথায় কাঁধে-পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে তাদের বাড়ি অব্দি যাওয়ার পর বাড়ির মানুষজন দুলুদাকে চিনতে পেরে কোথায় মুখ লুকোবে ভেবে পায় না।শেষে দুলুদার কাছে ক্ষমা চেয়ে পুজোর মিষ্টি খাইয়ে নিস্তার চেয়েছিল।
গ্রামের পুজোয় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় কুটুম্ব দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে ফিরে আসবে এটাই ছিল রেওয়াজ।যার যা সংগতি তাই দিয়েই গ্রামের মানুষ অতিথি আপ্যায়ণে ত্রুটি রাখত না।সহজলভ্য শাক-সব্জি,খাল-বিলের মাছ,বাড়ির ধানের খৈ-মুড়ি,ক্ষেতের আখের আখিগুড় আর পুকুর পাড়ের তালের সারির তাল গুড় দিয়ে মুড়কি।ঘরের গাই-গোরুর দুধের ছানা-দৈ-ঘি।গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে আর বাড়ির গাছের নারকেলের নাড়ু-চিত্রকূটে পাড়া জুড়ে মিঠে সুবাস।খাল-বিলের মাছ ভাজা হোলে বিশেষ করে বেলে মাছ,গুলে মাছ,গুড় জাউলি মাছ,পারষে মাছ,নোনা চিংড়ি মাছের গন্ধ পেয়ে অবারিত দ্বা্রের বৈঠকখানায় বসে পড়ত যে কেউ বিনা আমন্ত্রণেই।পেট পুরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তবে তার নিস্তার মিলত।ষষ্ঠীতে নিরামিষ সোনা মুগের ডাল,আলুভাজা,বেগুনভাজা,শাক,শুক্তো,আলুপোস্ত,ছানার ডালনা,আলুবখরার চাটনি।সপ্তমীতে মাছ ভাত।অষ্টমীতে নুচি(লুচি)-কুমড়োর ছক্কা,ছোলার ডাল আর ধোঁকার ডালনা,প্লাস্টিক চাটনি।নবমীতে বলির পাঁঠার মাংস পাড়ায় বিলিয়ে যা পড়ে থাকত তার সংগে বাজার থেকে কিনে এনে তাই দিয়ে সবার পাতে দু-টুকরো মাংস আর চার-টুকরো আলু দিতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর উঠত।যার পাতে মেটে পড়ত সে ভাগ্যবান।সে সময় কেউ অসুস্থ হলে সে পেত ‘টেংরির জুস’।
যাদের এই সংগতি ছিল না তারাও হীণমন্যতায় না ভুগে এই কয়েকটা দিন আউস ধানের পায়েস তৈরি করত বাড়ির আখের গুড় দিয়ে।মাঠে ‘মুগরি’(বাঁশের তৈরি মাছ ধরার খাঁচা)বসিয়ে কুচো মাছ আর নোনা চিংড়ি ধরত।জলভরা আমন ধানের ক্ষেতে বঁড়শিতে আরশোলা,ঘুরঘুরে পোকা কি জ্যান্ত চিংড়ি টোপ দিয়ে বড়ো বড়ো ট্যাংরা,শোল,ভেটকি ধরত।শোলাকে ছোট ছোট করে কেটে তাতে সুতো বেঁধে কাঁটাতে কেঁচো লাগিয়ে ভাসিয়ে দিত ধান ক্ষেতে।ভোরবেলা সেগুলোকে তুলে দেখত কী মাছ গেঁথেছে সেই ভাসা বঁড়শিতে।প্রায় সব বাড়িতেই কচু,মান কচু,ওল,চুপড়ি আলু, বিচিকলা,নটে শাক,পালং শাক,কাটোয়ার ডাঁটা,বেগুন,লংকা,ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,চিচিঙ্গে,কুদরি, কাঁচা আর পাকা কুমড়ো অঢেল না হোলেও অপ্রতুল ছিল না।এই সময়টা শাপলা-শালুক,গেঁড়ি-গুগলি,কলমি শাক,সজনে পাতা,শুষনি শাক অঢেল ছিল।গুগলির তরকারী কম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ছিল না।কুমড়োফুল,বকফুলের বড়া আহা কী লোভনীয় যে ছিল।গ্রামের মানুষ এইসব খেয়েই অষ্টমীর সারারাত কয়েক ক্রোশ-মাইল পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখত।কী অফুরান প্রাণশক্তি!কী অনাবিল উচ্ছ্বলতা!
আমাদের বাড়িটাই ছিল একটা ক্লাবের মতো।ছোটোরা সারাদিন-রাত চোর-পুলিশ, ক্যারাম,ব্যাগাডুলি,সাপ-লুডো,রং-মিলান্তি,বাঘবন্দী খেলা খেলতাম।বড়োরা ব্রীজ,ব্রে আর মা-জেঠিমা-কাকিমা-ঠাকুমা খেলত টুয়েন্টি নাইন।শুধু ন’পিসেমশায় একা একা তাসের পেশেন্স খেলতেন আর জর্দা-পান খেতেন।ছোটো কাকা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেত। মেজপিসি আর চমৎকারী গুড়াকু দিয়ে সময়ে অসময়ে দাঁত মাজত।কেউ কেউ ভাঁড়ার থেকে চুরি করে পুকুর পাড়ে গিয়ে লুকিয়ে খেত আর পেটের ব্যথায় কাৎরাতো। কাড়াকাড়ি পড়ত শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে।হুড়োহুড়ি পড়ত বাড়িতে হঠাৎ কোনও অতিথি এলে।আর ঢাকের আওয়াজ থেমে গেলে অলস দুপুরে সবাই দিনের খাওয়ার পাট চুকিয়ে মাদুরে গা এলিয়ে চুপ করে শুনত রেডিয়োয় পুজোর গান-“প্রান্তরের গান আমার,মেঠো সুরের গান আমার”, “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”, “একটা গান লিখো আমার জন্যে”, “আকাশ-প্রদীপ বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার আগুনে গান গেয়ে” এসব গান শুনতে শুনতে কখন যে ঝুপ্ করে সন্ধ্যে নেমে আসত।পশ্চিম আকাশে সাঁঝতারার একটু ওপরে ঝুলত ফালি চাঁদ।হাল্কা হিমে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা আজকের এল,ই,ডি আলোর মতো টিমটিম করে আলো ছড়াত।শিউলি ফুলের আর হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে যেত বাতাসে।আকাশের উত্তরে ভাসত সপ্তর্ষি,দক্ষিণে কালপুরুষ।আর আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে রমণীয় ছায়াপথ।
দশমীর ভোরে আকাশবাণীর গানে “শুকতারা গো,নিও না বিদায়,নিও না......”আজও কানে বাজে।দশমীর দিন শুধু দিনের বেলায় রান্না হোত। দেবীমূর্তি জলে পড়লেই দশমী শুরু হোত না।ঘরের ঠাকুমা পুজোর দালান থেকে শান্তিজল আর অপরাজিতার লতা নিয়ে আসবে।বাড়ির সবাই পা ঢেকে বৈঠকখনায় বসবে।শান্তিজল ছেটানো হবে।তারপর অপরাজিতার বালা পরানো হবে এই মন্ত্র আউড়ে-“জয়দে বরদে দেবি,দশম্যে অপরাজিতে......”।এবার ছোটোরা প্রণাম করবে।বড়োরা করবে কোলাকুলি(পরে জেনেছি এই কোলাকুলি প্রথাটি এসেছে ঈদের থেকে)আর শুরু হবে মিষ্টি বিতরণ।ডানহাত বাড়িয়ে মিষ্টি নেওয়াটাই ছিল সৌজন্য।কিন্তু অধিকের আশায় হাতপাতা কারও পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে এমন ভাবে হাত বাড়াতাম যেন দুই মানুষের ভিন্ন হাত।বাড়ির প্রণাম সারা হোলে বেরিয়ে পড়া পাড়ার প্রণামে।আমাদের জানা ছিল প্রণামের পর কোন বাড়িতে নিমকি দেবে,কোন বাড়িতে ঘুগ্নি।যে বাড়িতে বয়স্ক-প্রবীণ মানুষজন থাকতেন তারা নিজের হাতে কিছু তৈরি করতে পারতেন না তাই ময়রার দোকান থেকে দরবেশ-সন্দেশ-মিহিদানা-সীতাভোগ আনিয়ে রাখতেন।সেই রাত্রে সবার বাড়িতে যেতাম না।পেট ভরে যাওয়ার কারণে পরের দিনের জন্যে ওই বাড়িগুলো রাখা থাকত। 
এইভাবেই কেটে যেত কটা দিন।এবার আমাদের পড়ায় মন বসাতে হবে আর যারা এসেছিল আবার তারা বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে ফিরে যাওয়া ঢাকির দলের প্রায় সংগে সংগেই চাল-নারকেল-নাড়ু ব্যাগে ভরে ফিরে গেলে গ্রামগুলো শোকে মলিন হয়ে পড়বে।এবার অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মী স্থাপন করে দীপাবলীর প্রদীপ জ্বালিয়ে মরা গ্রামের প্রাণ ফিরিয়ে আনার কাজ।সে আর এক উৎসব।