বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬
সরল জীবন জটিল রেখার মানিদা
শান্তিনেকেতনের কথা লিখতে বসে কেউ মানিদার কথা লিখবে না সে হয় মানিদা কে তাই
জানত না নয়ত মানিদার বকুনি বা স্নেহ পায়নি।এই উভয় সম্প্রদায়কেই বেচারা বলা ছাড়া আর
কীই বা বলা যায়!ভেবেছিলাম মানিদাকে নিয়ে লিখব কিন্তু সত্যি বলতে কি এত তাড়াতাড়ি
নয়।নব্বই বছর বয়সের কিশোর মানিদাকে নিয়ে লিখব কেন?একশ বছর পার করা তরতাজা যুবক
মানিদাকে নিয়ে কিছু লিখব আর মানিদা সেটা পড়ে কিছু না কিছু বলবেন তবেই না!
প্রথমেই কবুল করা উচিত আমি মানিদার কলাভবনের ছাত্র নয়।সে যোগ্যতাও আমার ছিল
না।আমি মানিদাকে জানতাম কে,জি,সুব্রহমনিয়ম এই নামের শিল্পী আর তার কাজকে।জানা ছিল
তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও মাস্টারমশায় আর এখন থাকেন বরোদায়।দু হাজার দশে যখন
অতিথি অধ্যাপক হয়ে গেলাম তখন থেকে এই সেদিন অব্দি মাত্র কয়েকটা বছরের মাত্র কয়েকটা
দিন তাকে পাওয়া কাজে,কথায়,আড্ডায়... কখনও কলাভবনের বটের ছায়ায়,কখনও বা শান্তিনিকেতনের
বাড়িতে।
মানিদা যখন দুহাজার এগারো বারোতে এলেন মাস্টারমশায়(নন্দলাল বসুর)এর ঐতিহাসিক ঘরটিকে
ম্যুরালে ভরিয়ে দিতে তখন সংগীত ভবনে আমার ক্লাস নেওয়ার কাজ শেষ করেই ছুটতাম
মানিদার ওই কাজের যে মিনিয়েচার বানাচ্ছিলেন তার কাজ দেখতে।এক হাতে কাঁচি,সাদা কাগজ
আর অন্য হাতে কখনও চায়ের গেলাস নয়ত ‘সরল চিত্রাংকন’ জাতীয় একটি বই।আমার কৌতুহল ওই
বইটির উপর দেখে কাছে ডেকে বললেন-‘এমন সহজ সরল ছবিই আঁকব মাস্টারমশায়ের দেওয়ালে।কেমন
হবে?’ আমি কী উত্তর দেব?শুধু পিলুকে বললাম(কৌস্তুভ দে।পিলু আমাকে নিয়ে একটা
প্রোজেক্ট করবে বলে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে)কিছু ছবি তুলে রাখ পিলু।কাজটা যখন মডেল
থেকে মাস্টারমশায়ের দেওয়ালে টাইলস হয়ে সাজানো হোলো আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম সহজিয়া
সুরে কথায় কী জটিল গাণিতিক বিন্যাস।এটা আমার মনে হওয়া। অন্য কারও অন্য কিছু মনে
হতেই পারে।উনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।ওই কাজটা শেষ হবার পর কিছু ছাত্র-ছাত্রী
কাজটা নিয়ে অন্যস্বর প্রকাশ করেছিল এক সন্ধ্যায় পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে।অনেক
মাস্টারমশায় খেপলেন।কেউ কেউ খেপালেন। মানিদার কানে কথাটা গেল।মানিদা শুনলেন বরোদায়
বসেই কিন্তু একটি শব্দও ব্যয় করেননি।যদিও মানিদা ছিলেন আমার চোখে অসম্ভব ঠোঁটকাটা।
আমার ছাত্রজীবন থেকে আজ অব্দি বন্ধু সাগর(সাগরময় সাহা)শান্তিনিকেতনের বাড়িতে
নয় কৈখালির বাড়িতে কিছু শিল্পকাজ রাখতে চাইলে আমি তাকে সে বছরের নন্দন মেলায় কিছু
কাজ কেনার ব্যাপারে সাহায্য করলাম।তার মধ্যে একটা ছিল মানিদার কাজ লিথোতে
মুরগী।সাগর একটা কিনল আর সাগরের শ্যালক সোনা সেও কিনল মানিদার করা লিথো
মুরগী।মানিদার সহস্তে সাক্ষরিত কাজ যা যথেষ্ট মূল্যবান। মানিদাকে পরে দেখা হতে যখন
বললাম মানিদা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বললেন-“আজকাল মুরগীটা সবাই খাচ্ছে”?
একবার মানিদার সংগে আমরা কয়েকজন বসে চা খাচ্ছি চীনা বটের ছায়ায়।কে একজন এসেছেন
বাইরের থেকে মানিদার কাছে।মানিদা সামনে বসে থাকা আমাকে দেখিয়ে তাকে আমার পরিচয়
দিলেন(এর মধ্যে মানিদা আমার তৈরী দুটি চলচ্চিত্র কলাভবনের চাতালে দেখে ফেলেছেন)তখন
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলাভবনের এক অতীত ছাত্র ও এখন অধ্যাপক অভিমান সুরে বলে উঠল-‘মানিদা
আমার সংগে ওনার পরিচয় করিয়ে দিলেন না?’মানিদা তৎক্ষণাৎ বললেন-‘তার যথেষ্ট সময়
পাওয়া যাবে।এখানে ছাত্র ছিলে,মাস্টার হয়েছ এবার ফ্যামিলির সবাই ঢুকবে বংশ পরম্পরায়’।
মানিদার ছাত্র বলা বাহুল্য খুবই আঘাত পেয়েছিল কিন্তু মানিদাই পারতেন এমন নিষ্ঠুর সত্য
উচ্চারণ করতে।
আবার এই মানিদার উদ্যোগেই কলাভবনে মেয়েরা পড়াতে এলেন।তার আগে অব্দি কেবল
পুরুষেরাই রাজ্যপাট চালিয়েছেন।মানিদার উদ্যোগে পৌষ মেলা থেকে প্লাস্টিক ব্যবহার
নিষিদ্ধ হোল এক বছর।পরের বছর ‘পুনরমুষিকভব’।সে সময় যে মহামান্য উপাচার্য ছিলেন
তিনি প্রথমটায় মানিদাকে খুব খাতির করলেন পরের বার এই মহামান্য মহাশয় মানিদা
শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন একদিনের জন্যে দেখা করা তো দূরস্ত টেলিফোনেও কথা বলার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।তিনি যে তখন রসের সন্ধান পেয়েছেন অপ্রিয় সত্য শোনার সময়
কোথায়?আমি খুশি মানিদা এইটুকু দেখে যেতে পেরেছেন সেই মহামান্য ও তার স্তাবক ও তার
সাঙ্গোপাঙ্গ চুরির দায়ে ধরা পড়েছে।আমি ব্যথিত মানিদার মতো মানুষ কে দেখতে হোল
গুরুদেবের আশ্রমে নোবেল চুরির পর আবার সি বি আইয়ের প্রবেশ ঘটল কিছু অসাধু,ভণ্ড,অযোগ্য
ধান্দাবাজকে চিহ্নিত করার জন্যে।
মানিদা তার শিক্ষক জীবনে কম আঘাত পাননি।যার ফলে শান্তিনিকেতনে যেদিন তার অবসর
হোল সেইদিনই তার কাজের টেবিল কারা যেন অধিক তৎপরতায় সরিয়ে দিয়েছিল।তার পরেও তিনি
প্রতি বছর একবার হলেও শান্তিনিকেতনে আস্তেন।কাজের সুযোগ পেলে কাজ করতেন।অভিমান করে
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি।আজ বিকেলে গৌতমদাকে(চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ)সংবাদটা
দিতেই গৌতমদা চমকে উঠলেন। এই সেদিনও মানিদার সংগে গৌতমদার কথা হয়েছে।গৌতমদা
দুহাজার তেরো চোদ্দোতে মানিদাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাতে শান্তিনিকেতনে
এলেন।মানিদা ওই নব্বইয়েও তরতাজা কিশোর।তথ্যচিত্রের জন্য নয় নন্দনমেলার জন্যে মাটির
সরায় তুলির টান দিচ্ছেন।যেটা মেলায় বিক্রি হয়ে তার টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের তহবিলে
জমা পড়বে।মানিদা কত সহকর্মীকে নিজে সই করে শিল্পকাজ দান করেছেন।সেগুলি আজ অমূল্য।
মানিদা আমার কন্যা তিথিকে একটা কাজ দেবেন বলেছিলেন।চেয়ে নিতে বলেছিলেন। তার পরে
কয়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু আমি চেয়ে উঠতে পারিনি।অতিথি আমি অনেক কিছু
পেয়েছি,হারিয়েছিও নেহাত কিছু কম নয়।একটা শিল্পকাজ নাহয় না পাওয়াই থেকে গেল।এর পর
মানিদার যে শেষ কাজগুলি কোনও চিত্র প্রদর্শনীতে দেখব তখন ভাবব ওর মধ্যে কোনও একটি
অতিথি সলিলের কন্যা তিথির জন্যে রাখা ছিল।
মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬
যদি হয়
সুজন,কলাপাতায়......
আমার এই বাউল জীবনে অনেক
পাগলের দেখা পেয়েছি শান্তিপুর থেকে শান্তিনিকেতন, কোলাঘাট থেকে কোলকাতায় কিন্তু
খোদ কোলকাতায় এমন খ্যাপা খেপির সন্ধান পাব স্বপ্নেও ভাবা ছিল না।ছেলেটি বদ্যি
বাঙাল মেয়েটি মেদিনীপুরের ঘটি।মেয়েটি যতটাই বকবক করে ছেলেটি ঠিক ততটাই চুপচাপ।মেয়েটি
যাচাই না করেই যাকে তাকে আপন ভেবে ঠকে আর ছেলেটি যাচাই করেই ঠকতে চেয়েই ঠকে।মেয়েটি
যদি উত্তর হয়,ছেলেটি প্রশ্ন।ছেলেটি অরূপ দাশগুপ্ত,মেয়েটি সুদীপ্তা বোস।ওদের দুজনের
হাজারটা অমিলের মধ্যে একটাই মিল ওরা দুজনেই আন্তরিকভাবে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী।পার্টি
যখন ক্ষমতায় তখন আর পাঁচজনের মতো গুছিয়ে নেবার সদস্য নয়।ওরা নিজের নিজের বিচার
বুদ্ধি দিয়েই রাজনীতি আর কাজনীতি চালিয়ে যেত।
ওদের দুটোকে প্রথম দেখি
৬৬ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা-নয় এ গণনাট্য সংঘের দপ্তরে সন্ধ্যে
নামলে।তখন গণনাট্য পত্রিকা ও গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকা দপ্তর এক ঠিকানায়,এক ছাতার
তলায়।গণনাট্য দপ্তরের বাবলু দাশগুপ্ত যখন শেষ বেলায় পত্রিকা প্রকাশের তাড়ায় প্রুফ
না পেয়ে পায়চারি করতে করতে হতাশ হয়ে বসে পড়েছে ঠিক তখন এক সুন্দরী যুবতীর উপস্থিতি
এক তাড়া প্রুফ হাতে দপ্তরে বিশুদার সামনে।তার পিছনে পরম নিশ্চিন্ত ভাবে যুবকের
প্রবেশ।বিশুদার ততোধিক যান্ত্রিক নিষ্ঠায় ঘোষণা-‘বাবলুদা ভিতরে আছে’ বলেই সকালের গণশক্তি
পত্রিকায় রাত্রির নিবিড় মনোনিবেশ নয়ত হিসাবের পাতায় জমা খরচের নিখুঁত উত্তর
মেলানোর নিরলস প্রয়াস।
আশুদা(সেন)তখন হয়ত গ্রুপ
থিয়েটার দপ্তরের থেকে আমাকে ডেকে ওই ছেলে মেয়েটির সংগ্রামী প্রয়াসকে সাহায্য করার
জন্যে আমাদের পত্রিকাকে ওদের কাজ দিতে বলছেন।শিশিরদা(সেন)কিছু না বলে শুধু একবার
চাইলেন আমার দিকে।বুঝলাম উনিও তাই চান।আর বিমলদা বলে উঠলেন_’বাঙালি ব্যবসা করতে
ভুলে গেছে’।এরা ছিলেন চিরকালের চিরকুমার।তবু
সংসার পাততে চাওয়া কমরেডকে সাহায্য করার চেষ্টা।পরে জেনেছিলাম বাবলু দাশগুপ্ত আর
অরূপ দাশগুপ্ত একটা বদ্যিতুতো সম্পর্ক ছিল আর বাবলুদা ও শিশিরদা ছিলেন মামাতো
পিসতুতো দাদাভাই।কায়েত বামুনদের মতো না তার চেয়েও বেশি বদ্যিদের মধ্যে ‘কমিউনিটি
ফিলিং’।ওই অনুভবটা প্রায় ‘জর্মন’দের মতো।
সুদীপ্তা অরূপের কম্পোজের
হাত ছিল মারাত্মক দ্রুত।ওদের ওটা ছিল স্বাধীন প্রচেষ্টা।ওরা উল্টোডাঙার সরকারি
আবাসনে বসেই কম্পিউটরে কম্পোজের কাজ করে দিত আমরা সেটাকেই সত্যযুগ দপ্তরে অফসেটে
ছাপতাম।এক সময় ওরা দুজন সত্যযুগ দপ্তরের কাজও শুরু করল।তার পর সত্যযুগ যখন সান্ধ্য
পত্রিকা বের করল আমার সংগে ওরাও জুটে গেল।তখন ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।
সুদীপ্তারূপ-এর বিয়ে ১৯৯৮
এ আমার মেয়ে তিথি হবার প্রায় এক মাস পরে জুনের একুশে।ওরা যখন চুটিয়ে প্রকাশনার কাজ
করছে তখন আচমকাই অরূপ চা বাগানের ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে আসাম চলে গেল।আমরাও
ততোদিনে নিজেদের কম্পিউটরে কম্পোজ করে সত্যযুগে প্রিন্ট করি।যোগাযোগটা ছিন্ন হবার
কথা কিন্তু কমিউনিস্টরা ফিউডাল পরিবারের মতোই গায়ে গায়ে লেগে থাকতে ভালোবাসে যদি
তাদের কিছু একটায় সাদৃশ্য থাকে।এখানে সাদৃশ্যটা বোধহয় না গুছিয়ে নেবার না ‘কামিয়ে
নিস’এর।অরূপ বাবা-মা থাকতেও অবিবাহিতা মাসির কাছেই মানুষ।আর সুদীপ্তারা ছিল হাতের
পাঁচ আঙুলের মতো-বাবা-মা-সুদীপ্তা-পিংকি-টুটুন।হাতের পাঁচ আঙুল যেমন এক মাপের হয়
না সুদীপ্তারাও তাই।এখন ওদের বুড়ো আঙুলটাই নেই।রবি বোস ছিলেন ওদের বাবার চেয়েও
বেশি ছন্নছাড়া,বাঁধনহারা জীবনের বুড়ো আঙুল। কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের সামান্য
চাকুরেজীবী ও জাত বামপন্থী কিন্তু মুক্ত মনের।না হলে সেই দুহাজার সালেই মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানেই মিটিং করতেন সেখানেই ছুটে যেতেন না।ডায়লিসিস করেই ছুটেছেন
একদিন জ্যোতি বোস আর একদিন মমতা ব্যানার্জির সভাস্থলে।বাংলায় এই প্রজাতি বিলুপ্ত
হয়েছে।এখন সবটাই সাদা-কালো।রবি বাবু আমার নাটকের খুব ভক্ত ছিলেন।আর অরূপের পালিকা
আমাদের সবার মাসি (যদিও এরা সবাই আমাকে সলিলদা বলেই ডাকে।সুদীপ্তা-অরূপের বাবা মা
থেকে ওরা ও ওদের ছেলে টুপাই আর পিংকির ছেলে পুপু আমাকে সলিলদাই বলে।ওরা কি তখনই জানত
আমি একদিন শান্তিনিকেতনে পড়াতে যাব?)বরানগরের লাল বাড়ির মেয়ে।ওদের বরানগরের বাড়িতে
বাংলার সব বাম নেতারাই যেতেন।মাসি কিন্তু কোন দিন রাজনীতি করেননি।এ,জি,বেংগলে
চাকরি করতেন।পরের ছেলেকে মানুষ করতে হবে বলে সংসার পাতেননি।এখন অবসর জীবনে দিব্যি
আছেন দাবাড়ু নাতিকে নিয়ে।
অরূপ আসামে যেমন গেল আবার
ফিরেও এলো।আবার শুরু হোলো ব্যবসা।আর বারেবারেই ডাক পড়ে আমার।যেন আমি কতো চৌকস
তুখোড় ব্যবসায়ী বানিয়া। আসলে ওরা আমাকে পরম আত্মীয় ভাবত।এখনও ভাবে।ওদের কেউ শাসন
করার সাহস পায় না।আমি পারি।আর সেই পারার দায় ঘাড়ে নিয়ে আমি নয় ওরাই আমাকে ডেকে
ডেকে শাসন চেয়েছে,প্রশ্রয় চেয়েছে।
বীরভূমের রূপপুরে
‘রক্তকরবী কারুগ্রাম’ হোলো।আমি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ছুটে গেলাম।নেচে গেয়ে খেয়ে
এলাম।ট্রাভেল এজেন্সী খুলল।সবাই মিলে ছুটলাম সিকিমে।এই ২১ এ জুন ফোন করে জানাল ওরা
কলাপাতায় কিছু খাওয়াবে।আমি বহুদিন কলাপাতায় গরম ভাত খাইনি।তাই ৪৮ দমদম রোড এ গিয়ে দেখি “ক লা পা তা” একটি
রেস্তোরার নাম।যার মালিক ওরা।
এটা ওদের ১৮ বিবাহ
বার্ষিকী ছিল।আমার মেয়ে তিথি তারও তো আঠারো হোলো? তা হলে সুদীপ্তা অরূপ ওরাও এবার বুঝি
ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে এডাল্ট হোলো।রাত আটটা থেকে এগারোটা অব্দি নানান পদ চেখে দেখলাম।তার
মধ্যে ‘কালি চিকেন’, ‘হলদি চিকেন’, ‘ড্রাগন বল’, ‘চিকেন মুমতাজ’,’কাশ্মীরি পোলাও’,
‘কোলকাতা বিরিয়ানী’, ‘বাটার নান’ চমৎকার।
চাইলে আপনার ইচ্ছেটাকে
লাগাম না টেনে নাগের বাজার থেকে হনুমান মন্দির পেরিয়ে ঘুঘুডাঙা ফাঁড়িতে রাস্তার
উপরেই রেস্তোরায় পৌঁছে যেতে পারেন।আর যদি চিড়িয়া মোড়ের দিক থেকে কি ট্রেনে বা
মেট্রোয় আসেন তাহলে দমদম স্টেশন ছাড়িয়ে একটুখানি।ওদের ঠিকানা
সুদীপ্তা-অরূপ এ জীবনে
বহু ঘুঘু দেখেছে।বহু ফাঁদেও পড়েছে কিন্তু ফান্দে পড়িয়া বগার মতো না কেঁদে জীবনের
শক্ত ডাঙায় দাঁড়ানোর জন্যে হেসে খেলে লোককে খাইয়ে তৃপ্তি পেতে ও তৃপ্তি দিতে চায়।
মন্দ কী?BUY ONE কলা,GET ONE FREE পাতা।
নিঃস্ব সুরের বিশ্ব
দিবস......।
“কে জানে মন
গুরু আমার কয় জনা?
(আমার) অথিক গুরু,পথিক
গুরু
(করি) শতেক গুরুর ভজনা।
কে না জানে গুরু আমার কয়
জনা।
দূরের গুরু,সুরের গুরু
কাছের গুরু অজানা।
সেই জানে মন
সুজন গুরু নয় জনা”।
ভিকিরিপতি গ্রামে আমাদের
বাড়িতে সুরের কোনও যন্ত্র ছিল বলে আমার মনে পড়ে না।না ছিল হারমোনিয়ম,না ছিল
ঢোল-খোল,থাকার মধ্যে ছিল একটা ‘খত্তাল’নাকি ‘খঞ্জনি’?সেটা নিয়ে আমরা কীর্তণে তালে
বেতালে নাচতাম।হারমোনিকা আর তবলা বাড়িতে এসেছিল অনেক পরে।আমার খুড়তুতো বোন সুজাতা
যখন গান শেখা শুরু করল।আর তবলা এলো খুড়তুতো ভাই অতনুর জন্যে।সুজাতা ওই গ্রাম থেকে
শিখেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীতে এম মিউজিক করে এখন সে বাণীপুর
বেসিক ট্রেনিং কলেজের গানের দিদিমনি।
আমার শৈশবে ভিকিরিপতি
গ্রামে সুর ছিল আকাশে বাতাসে।শ্বাসে-প্রশ্বাসে,বিভাবে বিভাসে।পাখির ডাক ছাড়াও সুর
ছিল ছাতপেটাই গানে,নলকূপ তৈরির সুরে, ফেরিওয়ালার ডাকে,মঙ্গলচণ্ডীর
ব্রতকথায়,পুন্যিপুকুরের সুরে,বিয়ের বাসরে এমনকি প্রয়াণের বিষাদেও।
আমার শৈশবে হেমন্তের ভোরের
কুয়াশায় বিছানায় মায়ের শরীরের পাশে লেপ্টে বোষ্টমীর আগমনী গান শুনতাম।খর রৌদ্রে
কাগমারাদের বিদ্ঘুটে ভাষার গানে ছিল অন্য মাদকতা।এই কাগমারাদের দেখলে আমরা ভয়ে
কুঁকড়ে যেতাম।তাদের শরীরে থাকত বিদ্ঘুটে পোশাক।কপালে মস্ত লাল টিপ।কালো কুচকুচে
চেহারায় লম্বা চুল তার উপরে লাল ফেট্টি।হাতে স্টীলের বালা আর ধারালো ছুরি।সেই ছুরি
বালায় ঘা দিয়ে সুর তুলত।ওরা নাকি দিনের বেলা গান আর রাতেরবেলা ‘গান’ নিয়ে ডাকাতি
করত।কিন্তু শীতের দুপুরে যখন পটুয়ারা পট নিয়ে আসত আমাদের মন ভরে যেত। কতো পট,কতো
কথা,কথকতা আর পটচিত্র।মা ঠাকুমা থলি ভরে চাল চিড়ে আর পয়সা দিত তাদের।যে অন্ধ
ভিখারি সপ্তাহে একদিন গান গেয়ে ভিক্ষা নিতে আসত তার গানের গলাও খুব খারাপ ছিল না।আর
সাধনদা গাড়ি গ্যারাজ করে নেশায় চুর হয়ে মধ্যরাতে যখন পাড়ায় ফিরত তখন তার গানে
সুরের থেকেও আবেগ থাকত বেশি।এরা সবাই আমার গানের গুরু।কিছু পরে ঘরে রেডিয়ো এলে
আমার গুরু পালটে গেল।
আমার গানের গুরু তখন
পঙ্কজ মল্লিক।প্রতি রোববার তিনি বে-তারে প্রতিটি পংক্তি ধরে শেখান।রাত গভীর হলে
শিখি রাগ।সন্ধ্যায় শিখি পাশ্চাত্য সংগীত।শিখি মানে কি আর তানসেন হওয়া?পণ্ডিত
রবিশঙ্কর এর ভাষায় ‘কানসেন’।শুনে শুনে শুন্যি।পরে সেই রবিশঙ্করজীর সেতার শুনলাম
সামনে থেকে আর তার রাগালাপ শুনলাম সামনে বসে।উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সরোদ
শুনলাম আর তার সংগে আলাপচারিতার সুযোগ পেলাম আমার পরম সুহৃদ গৌতম ঘোষের
কল্যাণে।শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরির আকাশদীপ বাড়িতে বসে সারা দুপুর সুরের জাদুকরের সংগে
সুর আর কথার আলাপ সেও গৌতমের কল্যাণেই।
মানিকতলায় রামমোহন
লাইব্রেরি আর মঞ্চের পাশের ১০,রামমোহন রায় রোডে গৌতমদের পৈতৃক
আবাস।রবীন্দ্রভারতীতে যখন ড্রামায় এম,এ তে ভর্তি হলাম গৌতম তখন মিউজিকে বি,এ
পড়ছে।যদিও বয়সে সামান্য বড়ো।গৌতম যেমন লম্বা,তেমন রোগা,তেমনি ফর্সা,তেম্নি
ঠোঁটকাটা।আবার সরোদে তার হাত ততোধিক সুরেলা।অসুর আমির সংগে সুরের গৌতমের কেমন করে
সখ্য গড়ে উঠল আজ আর তা তেমন করে মনে করতে পারি না।
গৌতমদের চিলেকোঠার ছাদের
ঘরটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন আর সুরের কারখানা।কতো দুপুর,কতো রাত আমাদের ওখানে কেটেছে
যেখানে আমি,গৌতম,সরোদ কি ম্যাণ্ডোলিন আর ঠিক সময়ে মাসিমার প্রবেশ চা নিয়ে কি খেতে
ডাকার জন্যে।ভিকিরিপতিতে যে সব সুর শুনেছিলাম সেইসব সুরের ব্যাখ্যা শুনতাম নিবিষ্ট
মনে বাধ্য ছাত্রের মতো গৌতমের কাছে।কী করে রাগ চিনতে হয়।কী করেই বা সিম্ফনির
চরিত্র বুঝতে হয়।‘কর্ড’ কী?’স্কেল” কী?’সোপ্রানো’ কি,’স্ট্যাকাটো’ই বা কী?ধরে ধরে শেখাত।হঠাৎ
হঠাৎ সরোদে স্ট্রোক দিত আর আমি পাশে পড়ে থাকা বইয়ে তাল ঠুকে ঠেকা দিতাম।আর স্বপ্ন
দেখতাম একদিন এইসব সব আমাদের নাটকে কাজে লাগাব।
গৌতমকে নাটকের কাজে টেনে
আনলাম আমি।তার আগের নাটকে শ্রীপতিদার স্টক মিউজিক দিয়েই কাজ চালানো হয়েছিল।তখন
অধিকাংশ দলেই শ্রীপতিদাই ছিল সুরের কাণ্ডারী।সত্যজিৎ রায়ও শ্রীপতি দাসের প্রশংসায়
পঞ্চমুখ ছিলেন।উৎপল দত্তের সব নাটকে শ্রীপতিদাই টেপ চালাত নেপথ্যে।‘সমাবর্তন’
নাটকে গৌতমের প্রবেশ।তার পর বহু নাটকে গৌতম তার প্রতিভার ছাপ রেখেছে।আমার ‘আবরণ’,
‘প্রবহতি’ আর ‘বাস্তুভিটে’ নাটকের মিউজিক স্কোর গৌতমেরই।
একদিন গৌতম আর আমার
সম্পর্কটা সরোদের তারের মতো ছিঁড়ে গেল।হাতের জবার মতো হারিয়ে গেল আচমকাই।সেটা
একদিনে ঘটেনি।বহু মৈত্রী, বহু মনান্তরের, বহু মলিনতা,সাংসারিক জীর্ণ দৈন্যে ‘কোন
হাহারবে তার ছিঁড়ে গিয়েছিল’।আবার দেখা হোলো শান্তিনিকেতনে সংগীত ভবনে।গৌতম পরীক্ষক
আর আমি অতিথি অধ্যাপক। আবার তারটা জুড়লাম আমরা দুজনে মিলেই।কী আশ্চর্য!যে রাগটা
আমাদের প্রিয় ছিল সেই ইমন রাগই বাজছে আমার অ্যাতোদিন ঠুকে যাওয়া তালেই।
সোমবার, ২০ জুন, ২০১৬
সাতটি কালুয়া ও মোকাম কলিকাতার কথা......।
ভিকিরিপতি গ্রামটা ছিল পদ্মলোচনের কানাখোঁড়া নামের মতো।অর্থ
ছিল,সংস্কৃতি ছিল, শিক্ষাদীক্ষা ছিল,পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে সদ্ভাব ছিল,বুনিয়াদী
শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বেসিক ট্রেনিং কলেজ তাও ছিল।সবচেয়ে বড় কথা
ছোটোদের জন্যে মন্তেসারি স্কুল আর মেয়েদের জন্যেও স্কুল ছিল যেখানে বাইরের মেয়েদের
থাকার জন্যে হস্টেল ছিল সেই কালেই।ছেলেদের হস্টেলও ছিল।খেলাধুলোর মাঠ ছিল।সাঁতার
কাটার ভালো পুকুর ছিল।বাইরের থেকে পড়তে আসা ছেলেদের হস্টেলে থাকার ও খাওয়ার ভালো
বন্দোবস্ত ছিল।প্রতি সকাল সন্ধ্যে হস্টেলে প্রেয়ার হোতো।এক সংগে জন ষাটেক ছেলে
গাইত-“আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ সত্য সুন্দর”।কিম্বা-“আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও
প্রাণে......”।যেহেতু আমাদের বাড়ির পাশেই স্কুল আর হস্টেল তাই আমিও ওদের সংগে
গাইতাম রোজ দু-বেলা পড়তে বসার আগে।এমনকি একটু দূরের বেসিক ট্রেনিং কলেজে বৈতালিক-এ
যোগ দিতাম।শীতকালে ওখানে বেশ কয়েকদিন
জুড়ে উৎসব চলত।যেখানে কবিতা আবৃত্তি,গান,নাটকে যোগ দিতাম। কলেজের মাঝখানে ছিল মস্ত
দিঘী।সেখানে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হোতো।সাংস্কৃতিক উৎসব তো হোতোই।এই সমস্ত
অঞ্চলটির নাম ছিল ‘কেলোমাল’।নামটা শুনে আজকের অনেকের এটাকে নিম্নমানের মনে হোতে
পারে কিন্তু এই নামের ইতিহাস জানা থাকলে এখানকার ও এখনকার ছেলেমেয়েরা লজ্জিত নয়
গর্বিত হবে অবশ্যই।
শোনা যায় অনেক কাল আগে এই স্থানটি ছিল ভুঁইঞা
রাজাদের।গ্রামগুলো তাই ‘কালুয়া’ ছিল।যেমন ডুবকালুয়া,রামকালুয়া,ভুবনকালুয়া,বনমালীকালুয়া,বলীকালুয়া,
মুরারীকালুয়া ও সাতকালুয়া এই সাতটি কালুয়া নিয়ে কালুয়ার মাল>কেলোমাল।মালের অর্থ
যে সমষ্টি এটা শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই জানেন।এই কালুয়া ছাড়াও ছিল বাটি ও বাড়,পুর ও
গঞ্জ।এখানেও জয়রামবাটি আছে।কুমোরগঞ্জ আছে।পোদোম্পুর,হীরাপুর, চোন্সোদপুর,মামুদপুর,রাধামনি,রাধাবল্লভপুর,রঘুনাথপুর,নাইকুড়ি,মৈশালী
এরকম নানা নাম ও তার ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।গ্রামগুলোর নাম থেকে আশা করি বোঝা যাচ্ছে
এখানে হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি বাস করত।আজও বাস করে।এখানে চড়ক-গাজন যেমন হয়
মহরমের তাজিয়াও বেরোয়।কিন্তু তা নিয়ে কোথাও কখনও কোনও কাজিয়া ঘটেনি।এখানে দোলখেলা
যেমন হয় ঈদও মহাসমারোহে হয়।এখানে কোনদিন কেউ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা
ভাবেনি।এখানে নীলচাষ যেমন হয়েছে আবার জমির আন্দোলন সেও হয়েছে।এখানে নানা শ্রেণীর
মানুষের সহাবস্থান সবার ঈর্ষার বিষয় ছিল।আমাদের প্রপিতামহ এখানে এসেছিলেন
তাম্রলিপ্ত রাজার নয় মহিষাদল রাজার করণিক হিসাবে তাই আজও আমাদের কিছু জ্ঞাতি
‘কারকুন’ হিসাবে পরিচিত।
শোনা যায় মহিষাদল রাজা গর্গ ‘দে’ ও ‘ঘোষ’দের এই গ্রাম দান
করে।আমাদের মূল পদবী ‘দে’ পরে ‘সরকার’।গ্রাম দান করার কালে নানা জীবিকার মানুষদেরও
বসতের ব্যবস্থা হয়।তার পাশাপাশি আত্মীয়তা সূত্রে নাগ,চন্দ,বোস,মিত্র,ভঞ্জ,দত্ত
এরকম কায়েতকুল বসতি গাড়ে।গ্রামে একটা কথা আজও শোনা যায়-‘দেখাদেখির চাষ,লাগালাগির
বাস’।আজও তাই বামুন কায়েতের পাশে ‘হাঁড়ি-মুচি-ডোম-ধোপা-মালাকার-নাপিত’ সব
সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন।যদিও আজ তারা সবাই প্রাচীণ জীবিকাতেই যে ব্যস্ত তা নয়।উড়িষ্যা
থেকে জীবন ও জীবিকার কারণে এখাণে আশা মানুষের সংখ্যাও কম নয়।ব্রাহ্মণদের মধ্যে
যেমন সৎপতি(শতপথী?)সুকুল,ষড়ঙ্গী,মিশ্র আবার মাহিষ্য সম্প্রদায়ের
জানা(জেনা?)মাইতি,বেরা এমন বহু পদবি ও উপাধি ছড়িয়ে আছে পূর্ব মেদিনীপুরে।পান-লাল-বাগ-সিংহ-হাতি-কাঁঠাল-চিনি-বিজলী-দিণ্ডা
ধাড়া-খাঁড়া-ধর-বর-বারুই-পাড়ুই-কুইল্যা-কোলে-পাঁজা-প্রামানিক-পরামানিক-পাত্র-পাল-পাখি-পাখিরা-বল-বালা-ঘোড়া-ঘোড়ুই-গোড়ুই-গুছাইত-মান্না-দাস-দাশ-শাসমল
আরও বহু পদবির সমাহার।বস্তুত কেলোমাল তথা তাম্রলিপ্ত ‘মিনি ভারতবর্ষ’।
এখানে ঘোষ ও সরকারদের মধ্যে বিত্তের রেষারেষি ছিল।তা নিয়ে
নানা গল্প ও কাহিনি চালু আছে।ঘোষেদের একজন সে কালে ‘কালাপানি’ পার হয়েছিলেন বলে
তার গ্রামে প্রবেশাধিকার ছিল না।এক আতর বিক্রেতা সারা গ্রাম ঘুরে কোথাও আতর বেচতে
না পেরে বিদ্রুপ করায় আমাদের এক পিতামহ পুকুর থেকে স্নান সেরে ওঠার সময় সমস্ত আতর
কিনে পায়ের চটিতে ঢেলে দিতে বলেছিলেন এমনই কৌলিন্যের দাম্ভিকতা।আমাদের শৈশবেও এই
দাম্ভিকতা প্রত্যক্ষ করেছি।তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমাদের সরকার বাড়ির থেকে
ঘোষেদের বাড়িতে শিক্ষার চর্চা ছিল অনেক বেশি।আবার বিপদে আপদে দুই বাড়ির সবাই
একসাথে হোতো নির্দ্বিধায়।
আমাদের সেকালেই একটা ক্লাব ছিল ‘কেলোমাল অ্যাথেলেটিক
ক্লাব’।নামে অ্যাথেলেটিক হলেও খেলাধুলোর পাশাপাশি পুজো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোতো
যখন তখন।যাত্রা ও নাটকের বিশেষ গুরুত্ব ছিল।আমার ছোটোকাকা কমেডি অভিনয়ে ওস্তাদ
ছিল।তাই তার ডাক পড়ত সবার আগে।আমার রাঙাকাকাকে আমি যোগেশ চৌধুরির “সীতা” নাটকে
সীতার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি।শংকুদা পয়সার জোগান দিত বলেই হয়তো সবসময় নায়ক
চরিত্রে অভিনয় করত।আমাদের এক জ্ঞাতিকাকা ছিল রুদ্র নামের।তিনি সবসময় শংকুদার পাশে
থাকতেন।নাটকের অভিনয়ের কালেও।অনেকটা মেফিস্টোর মতোই।নিয়ম মাফিক নয় হুজুগ উঠলেই
নাটকের মঞ্চ তৈরি হোতো।আবার জগদ্ধাত্রী পুজোর শেষ দিন যাত্রা হোতো।রাস পূর্ণিমায়
সাতদিন ধরে ম্যারাপ বেঁধে যাত্রার আসর বসত।বাইরের আমন্ত্রিত দলের পাশে একদিন
নিজেদের পালাও থাকত।
আসর বসত রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটার পরে।সবাই রাতের খাবার
খেয়ে,মেয়েরা হেঁসেলের কাজ সেরে পানের ডিবে হাতে নিয়ে চিকের আড়ালে এসে বসবে।সংগে আমরা কচিকাচার দল।বড়রা আসরের সামনে।হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত আসরে যখন একে
একে বাদকের দল এসে বসবে।কনসার্টের প্রথম ঘন্টা বাজবে ঢং করে আমাদের মন হবে উতলা
রাধার মতো।থার্ড বেল পড়া মানেই বাজনা শুরু হবে। সবাই যে যেখানে থাকবে পড়িমরি
ছুটবে।কারো কোঁচড়ে মুড়ি,আঁচলে পান,কানে বিড়ি কিম্বা হাতে সিগারেট।কেউ
কেউ মেলায় বসা দোকান থেকে একশ বিশ কি গোপাল জর্দা দিয়ে, কেউ কেউ কড়া দোক্তা দিয়ে
পান সাজাবে সারা রাতের জন্যে।কেঊ কেউ ধেনো টেনে এসেছে।তারা বসবে দূরে।তবু গন্ধ
আড়াল করবে কী করে?সারা আসর পান-বিড়ি-সিগারেট-গুড়াকু আর ধেনোর গন্ধে ম ম করবে।রাত
গভীর হলে এর সংগে বদহজমের বায়ু......তবু সব ভুলে জনতা উত্তাল হবে যুদ্ধের
‘সীন’-এ।আর পাছে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে তাই প্রতি দৃশ্যের পরেই থাকত একটি ‘আইটেম সং’
কিম্বা ‘আইটেম ডান্স’।ভালো অভিনেতাকে ‘মেডেল’ বা টাকা দেওয়া হোতো।বলতে ভুলে গেছি
তখন ছেলেরাই নারী চরিত্রে রূপদান করত।বহুপরে নারী চরিত্রে অভিনয় করতে
দেখেছি।কুমোরগঞ্জে যখন পেশাদার যাত্রার দল হয়েছিল তাদের ফাইন্যাল মহড়ায় আমরা
যেতাম।সেখানে মেয়েরাই অভিনয় করত।তারা কেউ সুন্দরী ছিল না।অভিনয় করত এক অদ্ভূত
কন্ঠে।আমার তাই নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনেতার অভিনয়ই জুতসই মনে হোতো।পরে কেতকীদির
(কেতকী দত্ত)ভাই চপলরানি(চপল ভাদুড়ি)কে নিয়ে কাজ করতে গিয়েও তাই মনে হয়েছে।যাত্রার
কিংবদন্তী চপল ভাদুড়ি বাংলা প্রসেনিয়ম মঞ্চে প্রথম আমার “নিজভূমে” নাটকেই অভিনয়
করেন কেতকী দত্তের সংগে।এর পর তাকে বেশ কয়েকবার মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা
হয়েছে।এখানে সুযোগ মতন জানিয়ে রাখি বাংলা যাত্রার প্রথম ‘নটী’ জ্যোৎস্না দত্ত যার
অভিনয় দেখে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মানুষ আপ্লুত হতেন তিনি অপূর্ব সুন্দরী
ছিলেন।রাখাল মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে যাত্রার আসরে নানান পালায় তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ
হয়েছি।সেই তিনি যখন অকালে অসুস্থ হয়ে হেদুয়ার গলিতে বিছানায় শয্যাশায়ী তাকে দেখতে
গিয়ে অবাক হয়েছি।যে মানুষটি এক কালে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন।যাত্রার মালিক মরসুমের
শুরুতে টাকার থলে আর দামি গাড়ি নিয়ে হাজির হোতো সেই তিনি তখন একা। দেখার কেউ
নেই।খবরটা প্রকাশ করেছিলাম ‘সত্যযুগ’-এর পাতায়।সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব
ভট্টাচার্য খবরটা প্রকাশের সংগে সংগেই মেডিকেল টিম পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কোনও
অনুদান কি অনুগ্রহ নিতে রাজি নয়।এই হোলো জাত শিল্পীর আত্মাভিমান।আর একটা কথাও
জানিয়ে রাখি অনেকেই ‘নটী’ কথাটিতে অসম্মানের সন্ধান করেন কিন্তু ‘নট’ ও ‘নটী’
কথাটিকে যারা অশ্লীলভাবে ব্যবহার করেন সেটা তাদের শালীনতা ও রুচির বিষয়।আমি নিজেকে
‘নাটুয়া’ ভাবতে গর্ব অনুভব করি।
আমরা যখন অভিনয় করা শুরু করেছিলাম তখন আমাদের এক জ্ঞাতিদাদা
দুলুদা, ভালো নাম তপন সরকার আমাদের মেন্টর ছিলেন।দুলুদার কণ্ঠস্বর,পড়াশোনা আমাকে
মুগ্ধ করত।দুলুদা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত।‘শের আফগান’, ‘নানা রংয়ের দিন’,
‘তিন পয়সার পালা’ ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’র সব সংলাপ তার মুখস্থ।কবিতা পাঠে আবার
শম্ভু মিত্রের ভক্ত।এখনও মনে করি তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল চমৎকার। দুলুদার মতো অনেক
না হলেও বেশ কিছু মানুষকে এই পোড়া দেশে দেখেছি যারা সুযোগ পেলে কিছু করে
দেখাতেন।সেই দুলুদা একবার ‘সাজাহান’ নাটক পরিচালনা করল।নিজে হলেন সাজাহান।সে এক
অভিজ্ঞতা!প্রতি সীনের শেষ-এ ড্রপ পড়ত।আর কেউ সংলাপ ভুলে গেলেও ড্রপ পড়বে।আর দড়ির
টানাটানিতে ড্রপ আটকে গেলে আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে।সখের থিয়েটারের অভিনেতা
অভিনেত্রীদের নিয়ে কতো ঝামেলাই যে হোত সে বলার নয়।আবার নাটক করতে এসে প্রেম
ভালোবাসাও হয়ে যেত।আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা
বৌদির বিয়ে হয়েছিল “শ্রীমতি ভয়ঙ্করী” নাটকেই।
ভিকিরিপতি গ্রামে আমার এক বন্ধু ছিল কুমোরগঞ্জের মোহনদা
মোহন মাইতি।প্রাইমারী স্কুলের টিচার।ছবি আঁকায় পটু।সেও আমাদের নাটকের দলে জুটে
গিয়েছিল।আমরা এক বৈশাখে ‘ডাকঘর’ করলাম।কলকাতা থেকে নাটকের কিছু আত্মীয় গিয়েছিলেন দেখতে। আমি তাদের হাত ধরে থলিতে করাত-বাটালি-হাতুড়ি-র্যাঁদা-তুরপুন নিয়ে চলে এসেছিলাম মোকাম কলিকাতায় নাটকের কাজে।ফেলে এলাম ছবি-কবিতা-সখের থিয়েটার।ছেড়ে এলাম ভিকিরিপতি।ফেলে এলাম আমার শৈশব,আমার কৈশোর।আমার গুটিপোকা আমিকে।
বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬
শেষ নাহি
যে......অশেষ-কথা কে বলবে?
বয়সে সে আমার চেয়ে কিছু
ছোটো ছিল।মনের বয়সে আমার থেকে কিছুটা,কিছুটা কেন অনেকটাই বড়ো ছিল।বুদ্ধিতে সে
বায়সের মতো ধূর্ত ছিল।ফূর্তিতে সে ছিল চড়াইয়ের মতো সদা চঞ্চল ও
স্ফূর্তিবাজ।প্রিয়জনের পাকশালায় প্রবেশে সে ছিল শালিকের মতোই তৎপর।চলনে সে ছিল
ছাতারের মতোই ছটফটে।যাকে তাকে কারণে অকারণে ঠোকরাতে সে ছিল বাহারি কাটঠোকরা।বচনে
সে ছিল টিয়াপাখি।লোচনে সে ছিল ময়না।মানুষের পাশে দাঁড়াতে সে ‘সুখের পায়রা’ হতে
পারেনি।সে ছিল দুখের পায়রা।দ্রুততায় ছিল চিতাবাঘ।অভীষ্টলাভে সে সিঙ্ঘ।আক্রমণে রয়েল
বেঙ্গল টাইগার। গাধার মতো পরিশ্রমী।সারমেয়-র মতো সে ছিল কমিটেড।এমন এক যুবকের সংগে
আমার মতো এলেবেলের কীভাবে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল সেটাই পরম বিস্ময়!
আমি ছিলাম গেঁয়ো,সে ছিল
শহুরে।সে ছিল ‘কাঠ বাঙাল’ আর আমি ‘গাছ ঘটি’।সে ছিল বদ্যি সে ছিল লম্বা।আমি বেঁটে-কায়েত।তার চুল পাতলা পাতা করে
আঁচড়ানো।আমার চুল তখন ঘন আর কোকড়ানো।সে ছিল ইংরেজিতে তুখোড় আর আমি গোমুখ্যু।সে ওই
বয়সেই প্রেম করে সংসার পাতার চিন্তা করছে তখন আমি দাদার সংসারে এবেলা ওবেলা পাত
পেড়ে খাই।প্রেমে শুধু
পড়ি,কোনও পরী(ডানাকাটা তো দূর অস্ত)আমাকে ফ্রেম করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।অভিনয়ে
সে নিজেকে ডাস্টিন হফম্যান ভাবত আর আমি গাঁ থেকে আসা ভবম নাপিত কি হানিফ
মিস্ত্রী।সারাদিন থিয়েটারের নেপথ্য কর্মী।আর সে শো শুরু হবার কিছু আগে হন্তদন্ত
হয়ে এসে মেক-আপ এ বসে পড়ত।কথা বলার সময় সে অফুরাণ থুতু ছেটাত আর আমি কিছু কথা বলতে
গেলেই ঢোঁক গিলতাম।শুধু ক্বচিৎ কখনও শোয়ের শেষে কোনও সুন্দরী গ্রীনরুমে এসে আমাকে
‘হাগ’ করলে রঞ্জনদা আর অশেষ প্রকাশ্যে হিংসায় পুড়ে মরত?না আমাকে মারত।
অশেষ-এর নাটকের ফাঁদ পাতা
ভুবনে ধরা পড়া নেহাতই বিধির লিখনে।অশেষ তখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার
ডিগ্রীর ছাত্র।ইউনিভার্সিটির নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমাদের নাট্যদলের প্রধান
অভিনেতা দ্বিজেন(বন্দ্যোপাধ্যায়)দার পাল্লায় পড়ে গেল।আমাদের কাজই ছিল ইন্সিওরেন্স
কোম্পানির এজেন্টের মতো নিমরাজি ছেলেদের ধরে এনে দলে ঢোকানো।অশেষ এলো তবে একা এলো না।আরও
কয়েকজন জুটিয়ে নিয়ে এলো।একসময় তারা পালালো।ধরা পড়ল অশেষ।এ বড় কঠিন ঠাঁই।এ বড় জটিল
বিন্যাস।যে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় দলের প্রধান অভিনেতা তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক,পারিবারিক
টানাপোড়েন প্রতিষ্ঠানের সংগে একাকার।এক দিন সরতে হোলো তাকে।রয়ে গেল অশেষ।
আমি তখন নানা ঘটনার
টানাপোড়েনে ছারখার।জীবন সংগ্রাম, নাট্যদল,পারিবারিক সম্পর্ক আর পাশের মানুষদের
অতিরিক্ত বিশ্বাস,ইউনিভার্সিটির অন্তিম পরীক্ষা, প্রেমের প্রতি অগভীর অনাস্থা,......নাট্য
আন্দোলনের কাছে অন্ধ প্রণিপাত এই সব আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল দু-দুটো মৌলিক নাটক-‘আবরণ’
ও ‘প্রবহতি’।লিখলাম আমি নামকরণ করল অশেষ।এই দুটি নাটকেই অশেষ অসাধারণ অভিনয় করল।খুব
সামান্য ব্যয়ে নাটক দুটি মঞ্চস্থ হোতো কিন্তু তাতে কী?নাটক দুটি বেশিদিন চালানো
হোল না।আমিও থামিয়ে দিলাম নাটক লেখা।আমি যে তখন নাট্যভক্ত হনুমান।সীতাকে রক্ষা করাই
কাজ।রামের আদেশ পালনেই কৃতার্থতা।গন্ধমাদন বয়ে আনা তুচ্ছ।প্রভুর বাণী শ্রবণেই
তৃপ্তি।কিন্তু প্রাপ্তিও যে হয়নি তাই বা বলি কী করে?আজ অ্যাতোদূর হেঁটে আসা তো ওই
প্রাপ্তির জোরেই।
ধ্বনির শ্রীপতি দাস,রূপ
সজ্জাকর শক্তি সেন কী সাহস জোগালেন সারাক্ষণ পাশে থেকে।নাট্যকার মোহিত
চট্টোপাধ্যায় প্রথম শোয়ের শেষে এক ‘দাদা’কে ডেকে বলেছিলেন-‘সলিল যেন নাটক লেখা না
থামায়’।হায়!নটনাথ নাকি ভরত মুনি মুচকি হাসলেন?পরের প্রযোজনায় আমি ফিরে গেলাম ছুতোর
মিস্ত্রীর কাজে।অশেষ তখন দামাল অভিনয় করছে।অশেষ তখন দলের অপরিহার্য অঙ্গ।আমি তখন
নিজে নিজেই একা নিঃসঙ্গ।শক্তিদা এক দিন ডেকে বললেন-‘সলিল ভুল করছ।চোরের উপর রাগ করে
মাটিতে ভাত খেয়ো না’।আমি এবার নাটক অনুবাদে হাত দিলাম।আর লিখে চললাম নাট্য প্রবন্ধ।অশেষও
তখন কেমন দোলাচলে।আমি একা এবং কয়েকজন বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম কুক্ষিগত বৃত্ত
থেকে।না আমি অতীতের কেচ্ছা লিখতে বসিনি।আমি অশেষের মহিমা কীর্তনে গা ভাসাইনি।আমি
লিখছি পুরানো পাতার আড়ালে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো অতীত যা আজ অবশ্যই ইতিহাস।
মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬
আমাকে তুমি অশেষ
করোনি......
মা বলত মায়ের পেট থেকে
শিশু বেরোবার পর বিধাতা পুরুষ এসে শিশুকন্যা বা শিশুপুত্রের ললাটে বিধিলিপি লিখে
দেন।সেই ললাট লিখন নিয়েই সে চলে আমরণ। আমার ললাটে বিধাতা পুরুষ কী লিখেছিল মা তুমি
কি জানো?মা বলেছিল-“তুই আমার এলেবেলে,তুই আমার দুধুভাতি”।‘এলেবেলে’টা সত্যি কিন্তু
মায়ের দুধুভাতি হলেও দুধ আর ভাত কোনটাই আমি কোনকালেই পচ্ছন্দ করি না।তার চেয়েও বড়
কথা আমি আসার প্রায় পরে পরেই মায়ের পেটে পর পর দুটি মেয়ে এসেছিল যাদের জন্যে আমি
মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত।আসলে সেই ছোটবেলা থেকেই বিধাতা থেকে আশপাশের মানুষজন আমার
বিষয়ে যা ভেবেছে আর যা বলেছে হয়েছে তার বিপরীত।
আমি জন্মেছিলাম দাদুরবাড়ি
রাধাবল্লভপুরে।বাংলার ১৩২২,২৯ জ্যৈষ্ঠ সোমবার ১০.৪৫ মিনিটে ডাক্তার জ্যাঠা শ্রী
কালিপদ বাগচির হাতে।জন্মাবার পর আমার মাথায় চুল ছিল না তাই জ্যাঠাবাবু নাম
দিয়েছিলেন ‘ন্যাড়া’ অন্যরা ডাকত ‘নাড়ু’ বলে। ছোটপিসেমশায় ডাকতেন ‘নেড়ু’,সেজকাকা
ডাকত ‘লেড়ু’।ছোটোরা কেউ কেউ ‘নেরুদা’ বলেও ডাকত।তারা কোন দিন জানতেও পারেনি পাবলো
নেরুদার কথা। সেজকাকিমা নাম দিলেন ‘বাঁশরি’।কেন কে জানে!বাবা নাম রাখল ‘সলিল
কান্তি’। তাই বা কেন?তাও জানি না।বহুদিন না জেনে না বুঝে ওই ‘কান্তি’ বহন
করেছি।পরে কান্তি ক্লান্তিকর মনে হওয়ায় কান্তি বিলুপ্ত করে শুধুই সলিল
সরকার।গণৎকার কোষ্ঠী তৈরির সময় কী একটা জটিল নামের সংগে দেবশর্ম্মণ জুড়ে
দিয়েছিল।জাতকের রাশি নির্ধারণ হয়েছিল ‘মীণ’ আর লগ্ন ‘মকর’।এসব পড়ে যদি কারও মনে হয়
আমি এসবে বেশ বিশ্বাসী তাহলে কিঞ্চিৎ ভ্রম অনিবার্য।তবু বলছি এই কারণে এইসবই
ইতিহাসের দিনলিপি।
যে জ্যোতিষই আমাকে দেখেন
তিনি তৎক্ষণাৎ আমার হাতটা টেনে নিয়ে আমার আঙুলের বিন্যাস দেখে বিস্মিত হন।আমার
হাতের কাটাকুটি থেকে তারা নিশ্চিতভাবে বলে দেন আমার গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্স
যথেষ্ট।যদিও তার একটাও নেই।টাকাকড়ি তো দূর একটা ফুটো কড়িও নেই।আমার নাকি কোনওদিন
অভাব হবে না।চিরকাল ভাব আড়ির খেলাই দেখলাম হয়ত সেটাই স্বভাব বলে।
অন্নপ্রাসণের কালে আমি আর
আমার খুড়তুতো ভাই একসাথে বসেছিলাম।ও ধরেছিল কলম আর আমি ধরেছিলাম ধন আর ধান।হায় সেই
আমার প্রথম আর সেই আমার শেষ ধরা।এখনও কলম চালিয়ে কলমের জোরেই করে কম্মে খাচ্ছি।
আগেই লিখেছি গ্রামের বাড়িতে
আমাদের জন্মদিন পালন হোতো না হোতো জন্মতিথি। আর সাহেবদের মতো মাঝরাতে কেক কাটা
হোতো না।হোতো পায়েস।পাত পেড়ে ভোজ হোতো।আর পাঁচটা দিনের থেকে খুব একটা পৃথক ছিল না।শুধু
ওইদিনটায় কেউ কোনও দুষ্টুমি করলেও মার খেত না।এমনকি বকুনিও নয়।সেদিন পড়াশোনা করার
জন্যে কেউ তাড়া লাগাত না।পড়ার বইয়ের আড়ালে নয় প্রকাশ্যে গল্পের বই পড়লেও কেউ কিছু
বলত না।এ যেন ‘জন্মতিথির ভারী মজা কিল চড় নাই’।তবে দুপুরের খাওয়ারটা খেতে হোতো
পাঁজি পুঁথি মেনে।প্রথম পাতে থাকত ঘি।পাতে পড়ত মাছের মুড়ো।শেষে থাকত পায়েস।আমার
শৈশবের এই মধুর স্মৃতি আমি কাজে লাগিয়েছিলাম রাজা সেনের চলচ্চিত্র “চক্রব্যুহ” তে
চিত্রনাট্য লেখার কালে।এক বক্সার যে পেটের তাগিদে মস্তান হয়ে যায় সেই জন্মদিনে
মায়ের বেড়ে দেওয়া পঞ্চব্যঞ্জন খেতে বসেও একটি মেয়েকে যৌনপল্লী থেকে উদ্ধার করতে
পাত ছেড়ে উঠে যায় আর মেয়েটিকে বাঁচিয়ে নিজে মারা যায়।এটা দৃশ্যায়িত করার সময় রাজার
সহকারীদের খুব জ্বালিয়ে ছিলাম।খাওয়ার পাতে যাতে সব থাকে সেদিকে কড়া নজর রেখেছিলাম।
তার ফলটাও পাওয়া গিয়েছিল।প্রোট্যাগনিস্টের জন্মদিনেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন জন্ম
মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।এভাবে আমার জন্মের সংগেও জড়িয়ে গেছে এক মৃত্যু।সে আমার বন্ধু
ছিল কি না জানি না কিন্তু সে যে আমার নাট্যজন ছিল সে যে আমার মিত্র ছিল এ কথা অস্বীকার
করি কী করে?সে ছিল অশেষ......।
১৩ জুন আমার জন্মদিনের সংগে জড়িয়ে আছে 'ডব্লিউ বি ইয়েটস' এর জন্মদিন।১৩জুন ২০০৯ আমার জন্মদিনের সংগে হারিয়ে গেছে আমার প্রিয় নাট্যজন অশেষ সেন গুপ্ত।
১৩ জুন আমার জন্মদিনের সংগে জড়িয়ে আছে 'ডব্লিউ বি ইয়েটস' এর জন্মদিন।১৩জুন ২০০৯ আমার জন্মদিনের সংগে হারিয়ে গেছে আমার প্রিয় নাট্যজন অশেষ সেন গুপ্ত।
শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬
ভিকিরিপতির সলিল সর্দার
আমাদের দেশের বাড়িতে একটা
বেশ বড়ো আর ভারী বন্দুক ছিল।ওটার লাইসেন্স ছিল বাবার নামে।বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যে
কোনও প্রান্তে ওটাকে নিয়ে যাওয়া যেত।মানে তেমনই লাইসেন্সে লেখা ছিল।যতদূর স্মরণে
আছে ওটা ছিল আমেরিকার স্টিভেনসন কোম্পানির বন্দুক।সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
কেনা।না কোনও যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে নয়।কিম্বা কোনও মানুষ মারার জন্যেও নয়।বিষয়টা
আরও একটু জটিল।
ব্রিটিশদের বজ্জাতি
বুদ্ধিটা ভেতো বাঙালির চেয়ে যে কিঞ্চিৎ অধিক ছিল এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই আশা
করি।থাকার কথাও নয়।বাঙালির ইতিহাস সেই কথাই বলে।বাঙালি বজ্জাতিটা শিখেছিল খোদ্
ব্রিটিশদের থেকেই।আরও অনেক কিছু শিখেছিল।যেমন ঘুষ দেওয়া আর ঘুষ নেওয়া।ফারসি ভাষায়
যেটাকে ‘রিসওয়াৎ’ বলে।ব্রিটিশরাই শিখিয়েছিল কী করে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করতে
হয়।এছাড়া তোষামুদি করা।নবাব আলিবর্দী ও সিরাজ-উদ্-দৌল্লা এই ‘চাপলুসি’কে ঘৃণা
করতেন। ব্রিটিশ শেখাল কী ভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। নিজেরাই
যেটাকে বলত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’।মোগল পাঠান সিংহাসনের জন্যে ভাই ভাইকে
এমনকি বাপ ছেলেকে আর ছেলে বাপকে ‘কোতল’ করতে দ্বিধা করত না।আর ব্রিটিশরা শেখাল ক্ষমতা
লাভের জন্যে একটা হাত পায়ে আর অন্য হাতটা গলায় রাখতে হয়।আর শেখাল মিথ্যে কথা
বলা।সংস্কৃত ভাষায় ‘অণৃতভাষণ’ শব্দটি প্রচলিত ছিল।‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’এই
ধূর্তামিও ছিল কিন্তু উঠতে বসতে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলা এ ব্রিটিশদের দান।আর
শেখাল ‘পরের ধনে কী করে পোদ্দারি’ করতে হয়।‘বাবু’ সংস্কৃতি আর ‘দালাল’,
‘মুৎসুদ্দি’ ব্রিটিশ আমলেই ফুলে ফেঁপে উঠল।
ব্রিটিশ শাষক নিজেদের
স্বার্থেই ডাকাতির সংগে মোকাবিলার নামে ‘জোতদার’ আর ‘জমিদার’ দের বাড়িতে বন্দুক
রাখার ঢালাও লাইসেন্স দিয়েছিল যুদ্ধের কালে। ডাকাতিও যে হোতো সেটা মিথ্যে নয়।তেল-মশলা-চাল-ধানের
আড়তদার আর জোতদার জমিদার বাড়িতে বলে কয়ে যেমন ডাকাতি হোতো আবার না বলে চলে এসেও
হামলা চালাত।এক শীতের সন্ধ্যেয় আমাদের পুরানো বাড়ির জ্ঞাতি জ্যাঠাদের দালান কোঠায়
যে ডাকাতি হয়েছিল তা এই সেদিনও ভিকিরিপতি গ্রামের প্রাচীণ মানুষের মুখে মুখে
ফিরত।সেদিনের সন্ধ্যা যথেষ্ট রোমহর্ষক ছিল যা সে কালের বাংলার ডাকাত কাহিনিতে
সংকলিত হবার মতোই।আর সেই ঘটনার সংগে জড়িয়ে ছিল আমার ঠাকুরদা ‘ঈশ্বর ভূপতি সরকার’এর
নাম।
আমার ঠাকুরদা ভূপতি সরকার
তার জ্ঞাতি খুড়োর(প্রয়াণ কালে)সবিশেষ অনুরোধে তখনকার কালের ‘রাইস মিল’এর চারশ টাকা
বেতনের চাকরি প্রত্যাখান করে অনাথ বিশ্বনাথ ও অপগণ্ড(অপগণ্ড শব্দটির প্রকৃ্ত অর্থও
অনাথ)বৈদ্যনাথ সরকারের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষ্ণণাবেক্ষণ ও জমিদারির
হ্যাপা সামলাবার জন্য সামান্য বেতনেই তাদের নায়েব হয়ে বসেছিলেন।এর মধ্যে বিশ্বনাথ
জ্যাঠা পড়াশোনা করে তার মায়ের নামাঙ্কিত স্কুলের হেডমাস্টার হয়েছিলেন আর বৈদ্যনাথ
জ্যাঠা বংশ বিস্তারেই ব্যস্ত ছিলেন।বিশ্বনাথ জ্যাঠা ছিলেন বিপত্নিক আর তার একমাত্র
মেধাবী সন্তান বাড়ির দুর্গা পুজোয় বাড়িতে এসে ষষ্ঠীর দিন পুকুরে স্নান করতে নেমে
ভরা জলে ডুবে যায়।আমার সেজকাকা তাকে বাঁচানোর জন্যে পুকুরে নামলেও শেষ রক্ষা
হয়নি।শুনেছি অপূর্বকান্তি মাহারা সেই যুবকের মৃতদেহ যে দেখেছে সেই চোখের জল রাখতে
পারেনি।আর বিশ্বনাথ জ্যাঠা সন্তানের দেহ দাহ করে আর কোনদিন পৈতৃক আবাসে ফিরে যাননি।উনি
আমৃত্যু থাকতেন ওনার হাতে গড়া স্কুলের একটা ছোট্ট ঘরেই। আমরা সেইভাবেই তাকে
দেখেছি।উনি কিন্তু পালা-পার্বণে আমাদের বাড়িতে আসতেন। অরন্ধনের দিন আমাদের বাড়ির
বৈঠকখানায় পাতা আসনে বসে খেতেন।খুব রাশভারী আর স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন।ওনার
জীবৎকালেই আমাদের স্কুলের খ্যাতি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।ওনার মৃত্যুর পর
বৈদ্যনাথ জ্যাঠার একমাত্র পুত্র শংকুদা(সুনীল সরকার)হেডমাস্টার নয় স্কুলের
সেক্রেটারি হয়েছিলেন।বিশ্বনাথ জ্যাঠার মৃত্যুও হয়েছিল অপঘাতে।আমাদের কৈশোরে।
তখন স্কুলে গ্রীষ্মের
ছুটি চলছে।উনি পরীক্ষার খাতা দেখতেন স্কুলের ন্যাড়া ছাদের উপর হ্যাজাকের আলোয়।খাতা
দেখতে দেখতে হয়ত হাত-পা ছাড়াতেই পায়চারি করছিলেন।আচমকা কোথায় কিনারা বুঝতে না পেরে
এবং নিজের ছায়াই হয়ত তাকে প্রতারিত করায় দোতলার ছাদ থেকে ভর সন্ধ্যেয় নিচে ইঁটের
পাঁজার উপর পড়েন।স্কুলের বিল্ডিং বাড়ানোর জন্যেই ওখানে ইঁট-বালি-চূণ-সুরকি রাখা
ছিল।সেখানে পড়ে ওনার মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল।ডাক্তার জ্যাঠামশায় ওনাকে
ফেরাতে পারলেন না।তখনকার কালেই এই দুঃসংবাদ মুখে মুখে সারা পাড়া সারা গ্রাম সারা
মহকুমায় ছড়িয়ে পড়ল।সেজকাকা আমাদের তমলুকের মুদিখানায় ঝাঁপ বন্ধ করে সাইকেলে চড়ে
আসার সময় মাঝপথে খবরটা পেয়ে বাড়িতে না এসে সোজা হাজির হোলো শায়িত মৃতদেহের
পাশে।সারারাত সেই অকাল প্রয়াত মানুষটার পাশে বসেছিল। আমরা খেতে ডাকলেও সেজকাকা এলো
না।সেজকাকা বাড়ি ফিরেছিল জ্যাঠার শরীর দাহ করার পর।জ্যাঠার একমাত্র সন্তানের
প্রয়াণের পর সেজকাকাই হয়ত নিজেকে জ্যাঠার ভাই নয় সন্তান ভাবত!জ্যাঠার চিতা সাজানো
হয়েছিল স্কুলের বাগানেই।চিতায় দেওয়া হয়েছিল স্কুলের বাগানের চন্দন গাছের কাঠ।মুখাগ্নি
করল সেজকাকাই।হাতের পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে সেজকাকা যখন চিতাকে প্রদক্ষিণ করছে
কাতারে কাতারে মানুষ সেই দৃশ্য দেখছে ঝাপ্সা চোখে।সবাই কেঁদেছিল সেদিন।এমনকি
স্কুলের পোষা হরিণটাও।চিতা নিভেছিল দিনের শেষবেলায়।আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল পরের দিন
সকালেও।কদিন বাদে ওখানে একটা বেদী করে দেওয়া হয়েছিল।এরপর শঙ্কুদা ওই স্কুলের
শিক্ষক কাম সেক্রেটারি হোলো।স্কুলের মান নামতে থাকল।কিছু স্তাবক জুটল
চারপাশে।আমাদের বাড়ির সংগে সম্পর্কটা শীতল হতে থাকল।এক সময় আমি জ্ঞাতি হয়েও
প্রতিবাদী হয়ে উঠলাম।শঙ্কুদা তার আশপাশের মানুষদের বলত-‘নিরঞ্জন কাকার ছোটো ছেলেটা
বড়ো ঠ্যাঁটা।বাড়ির ছেলে হয়েও আমার শত্রু’।আমি কিন্তু সত্যি সত্যি শঙ্কুদার শত্রু
ছিলাম না।আমার লড়াইটা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের।আমরা জিতেওছিলাম।প্রতিবাদের
কথা এখন থাক।বরং ঠাকুরদা অন্যের সম্পত্তি রক্ষা করতে যে প্রতিরোধ গড়েছিল সেদিন তার
কথায় ফিরে যাই।
তখন শীতকাল।পৌষ মাস।মাঠে
মাঠে ধান কাটা হয়ে খ্যাসারি আর মুগ কড়াই ছড়ানো শুরু হয়েছে।আগাছার বাগানে ছড়ানো হয়ে
গেছে বিউলি কড়াইয়ের বীজ। প্রজারা নবান্ন সেরে কিছু ধান গোলায় তুলে বাকি ধান আড়তে
বেচে জমিদারের খাজনা মেটাতে আসছে।পৌষে মাঠ কুয়াশায় ভরে তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে।আর
গ্রামের সাতটা আটটা মানে রাত্রি।ঠাকুরদা সেদিনের মতো খাজনা আদায় শেষ হলে টাকা গুনে
ক্যাশ বাক্সে ভরে রাখছে এমন সময় সিংহ দরজায় শব্দ উঠল।ঠাকুরদা হাঁক পাড়ল- “রাম
সিং।ওখানে কে?” উত্তর এলো-“তোর বাপ”।ঠাকুরদা বুঝল আর কিছু নয় ডাকাত পড়েছে।তাড়াতাড়ি
করে টাকা ক্যাশবাক্সে নয় ভরে রাখল কোচড়ে।টর্চের আলো ফেলল দরজায়।গামছায় মুখ ঢেকে
ভোজালি হাতে কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে বৈঠকখানার দিকে।হাঁক উঠল-“আলো নেভা”।ঠাকুরদা
টর্চের আলোটা নিভিয়ে দিল। সামান্য ধাঁধা লাগল চোখে।ঠাকুরদা সেই সুযোগে সব টাকা
পাশের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।জানালার ওপাশেই ছিল আমাদের দালান কোঠা তাই
ওদিকটা সুরক্ষিত।ডাকাতরা এসে টাকা চাইল।ঠাকুরদা ক্যাশ বাক্স আগলে রাখার ভাণ করল।
ওরা বাক্সটা কেড়ে নিল।দেখল খুব সামান্য টাকা পড়ে আছে।জান্তে চাইল-“বাকি টাকা কোথায়?”ঠাকুরদা
বলল-“আজ এই যা আদায় হয়েছে”।ওরা বল্লে-“মিছে বলছেন সরকার মশায়।আমাদের কাছে খবর
আছে।বাকি টাকা কোথায় সরিয়েছেন?”গলাটা ঠাকুরদার খুব চেনা লাগল যেন!বলে
উঠল-“......তুই?”মুখটা সরে গেল মুহুর্তে শুধু যাবার আগে ওরা আমার ঠাকুরদা জমিদারের
বিশ্বস্ত নায়েব মশায় ভূপতি সরকারের পিঠে ভোজালি চালিয়ে দিল।
ডাকাতরা যখন সামান্য কিছু
টাকা নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেল ততক্ষণে পাড়ার লোক বুঝতে পেরেছে ডাকাত পড়েছে।সবাই
ছুটে এলো।এসে দেখে দারোয়ান হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে সিংদরজার সামনে আর আমার
ঠাকুরদা তখন পিঠে ছুরির আঘাত নিয়ে রক্তাত অবস্থায় পিছনের জানালা থেকে টাকাগুলো
তুলে আনছে।হায় বেচারা ভূপতি সরকার ওই টাকার কিছু বাণ্ডিল যদি তখন সরিয়ে রাখত নিজের
জন্যে তাহলে কী হোতো জানি না।তবে আর যাই হোক পিঠে ভোজালির ক্ষত নিয়ে বাকি জীবন
কাটাতে হোতো না।তারপর দাদুর চিকিৎসা হোলো।তমলুক থেকে পুলিশ এলো।ঠাকুরদার নাম
বহুদূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল।আর সম্পন্ন মানুষজন আত্মরক্ষায় প্রশাসনের মদতে
এক-নলা,দো-নলা বন্দুক কিনতে থাকল।আর একটা কারণও ছিল যে কারণে আমাদের বাড়ির
বন্দুকটা কেনা।
ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরের
জোতদার-জমিদারদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় যেমন ধান,পাটের জমি ও শাক-সব্জি চাষের জমি
ছাড়াও ফলের বাগান থাকত পাশাপাশি সুন্দরবনের লাট অঞ্চলেও এক একজনের দুশ পাঁচশ চাষের
জমি থাকত।আমাদেরও এমন দুশ-আড়াইশ বিঘা জমি ছিল লাটে।পূর্ব মেদিনীপুর থেকে সুন্দরবন
নদী পথে খুব একটা দূরও ছিল না।আমার ছোটোবেলায় লাট থেকে নৌকা বোঝাই যেমন বস্তা
বস্তা ধান আসত তার সংগে ডিম,মাছ,কাঁকড়া,মধু আর শাক সব্জিও আসত।সুন্দরবনে যেমন এইসব
খাদ্যবস্তু প্রচুর পরিমানে ছিল তেমনই বাঘও ছিল,ডাকাতও ছিল।তাই বন্দুকেরও প্রয়োজন
পড়ত।আমার কৈশোরেই লাটের জমি লাটে উঠেছিল।কিছু জমি বাড়ির কেউ কেউ যখন তখন কাউকে নয়া
বলে জলের দরে বেচে দিয়ে আসত। বাড়ির কত্তা হিসেবে বাবা আবার সেই জমি দাম দিয়ে
কিনত।আর মাঝে মাঝেই চাষের জমি সমুদ্রের লোনা জলে ডুবে যেত,কখনও বা সমুদ্রের গর্ভে
লীন হয়ে যেত। এইভাবে একটু একটু করে লাট থেকে কিছু আসার আশা লাটে উঠে গেল।রয়ে গেল
বন্দুক আর পাখি ও বাঘ মারার কার্তুজ।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বাবা
যেমন আমাদের সবার জন্যে ছিপে ডোর পরিয়ে,নতুন কাঁটা আর ফাৎনা লাগিয়ে পুকুরে মাছ
ধরার উপযুক্ত করে তুলত।শীতকালে বাবা তেমন যত্ন করে ঘরের এককোণে ঢাকা দিয়ে রাখা
বন্দুকটাকে বের করে একটা একটা করে সব অংশ খুলে ‘গান অয়েল’দিয়ে ভালো করে
মুছত।কারতুজগুলো রোদে শুকোতে দিত।আমি অবাক চোখে সে সব দেখতাম আর বাবার কাছে এই
বন্দুকের নানা কাহিনি শুনতাম।পরের দিন বাবা ওই ধোয়া মোছা বন্দুক নিয়ে থানায় যেত
লাইসেন্স রিনিউ করাতে।শুধু বাবা কেন ও গ্রামের ঘোষ-বোস-চন্দ-মিত্তির যার যার
রাইফেল কি বন্দুক ছিল তারা সবাই যেতেন।ফিরে এসে আবার ঘরের দেওয়ালের এক কোণে রেখে
দেওয়া।কোনও কোনও উঠতি বড়লোক আবার দেখাদেখি পাখি মারার ছররা বন্দুকও কিনতে থাকল যার
লাইসেন্স লাগত না।সেগুলো ছিল হাল্কা আর কাশীপুর গান শেল ফ্যাক্টরির।বাবার,দাশু
জ্যাঠার কি বরেন জেঠুর ‘গান’ ছিল অনেক ভারী। পরের দিকে আমি যখন ওটাকে সাফ সুতরো
করেছি আর পাখি মারার চেষ্টা করেছি বেশ ভারী ঠেকত।একবার পাখি শিকারের হুজুগ উঠল।
বরেন জ্যাঠা এক শীতের
সকালে আমাদের বাড়িতে এলেন।বরেন জ্যাঠা সাতকালুয়ার মানুষ।বাবা সে সময় বৈঠকখানায় বসে
বন্দুকটা পরিষ্কার করছিল।জ্যাঠা এসে দাওয়ায় বসে চা খেতে খেতে বললেন-“নিরঞ্জন এবারে
বনমালী কালুয়ায় অনেক ‘মাইগ্রেটরি বার্ড’ এসেছে।তোমাদের বালি পুকুরে বালি হাঁস
এসেছে,বেগড়ির ঝাঁক এসেছে।তোমার গুলিগুলো তো পড়ে পড়ে মিইয়ে যাচ্ছে।বন্দুকেও জং
ধরছে(একটু থেমে)শিকারে বেরুবে নাকি?”বাবা নলটা সাফ করতে করতেই উত্তর দিল-“আমার তো
খাজনা আদায়ে বেরোতে হবে যে”।বাবা সরকারি ‘তহসিলদার’ ছিল।পিওন আর গোমস্তা নিয়ে এক
এক গ্রামে খাজনা আদায়ে যেতে হোতো।শীতকালেই এটা বেশি হোতো।জ্যাঠা আমাকে
দেখিয়ে-“তোমার ছোটো ছেলে সলিল তো বড় হয়েছে।বন্দুক ঘাড়ে নিতে পারবে।ওর হাতেই বন্দুক
আর কারতুজ দিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিও”।পরের দিন আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অনুপ
যার ডাক নাম ছোট্টু স্টিভেন্সন কোম্পানির ‘গান’ আর ‘গান শেল ফ্যাক্টরির’ পাখিমারা
গুলি নিয়ে বরেন জ্যাঠার পিছু নিলাম পাখি মারতে।
এই বাংলায় সাতের দশক
অব্দি পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসত।সাইবেরিয়ান ক্রেন,আফগানিস্থানের হাঁসের দল
আর হিমালয়ের পাখিরা সদ্য ধান পাকা মাঠ আলো করে থাকত।তখনও পরিবেশ রক্ষার কথা কারও
মাথায় আসেনি।একদিন ডোডোর মতো অনেকেই যে বিলুপ্ত হবে সেই কথাটা চিন্তাটা কাউকে নাড়া
দিত না।আর একটা ব্যাপরও ছিল।আজ যারা বন্যপ্রাণী ও পাখি রক্ষার কথা বলেন।তাদের
অধিকাংশই এক সময় শিকারী ছিলেন।তাই বাল্মীকি থেকে বরেন জ্যাঠা কেউ তার বাইরে যাবে
কী করে?
আমরা যখন মাঠের আল পথে
গিয়ে দাঁড়ালাম মাঠে দলে দলে তখন পাখিরা ধান খেতে ক্ষেতে নামছে।শিকার দেখে শিকারীর
মন উত্তেজিত হবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু সে উত্তেজনা প্রকাশ পেলেই মাটি।মাছ ধরা আর
পাখি শিকারে ধৈর্য্য প্রধান শর্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসে বা খাড়া হয়ে থাকতে হয়
আর নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখতে হয়।আমরাও মাঠের মাঝে আলের পথে নিজেদের নলবন
আর বুনো ধানের ঝোপে লুকিয়ে রাখলাম।জ্যাঠা হতাশ কেন কি পাখিগুলো বন্দুকের নাগালের
বাইরে।অপেক্ষা করে করে এক সময় রোদ যখন চড়চড় করছে আমরা খালি হাতেই বাড়ি ফিরলাম।মাছ
শিকারেও এমন অনেক দিন যায়।আবার পরের দিন সেই এক দল কিন্তু জায়গাটা পালটে গেল।আজ
এখানে পাখিগুলো খুব কাছে নাগালের মধ্যে।জ্যাঠা চালাল বন্দুক মরলও কয়েকটা।আমরা
জল-কাদা ঘেঁটে ছুটলাম ছটফট করা আধ মরা পাখিগুলোকে কুড়িয়ে আনতে।সেই প্রথম বকের মাংস
খেলাম।সেই শেষ পাখির মাংস খেয়েছি।তার বহু পরে নয়ের দশকে লিখেছিলাম “তবু বিহংগ”
নামের ছোটো নাটক যা মূলত এক পাখির কারবারীর মেয়ের পাখি বাঁচাতে গিয়ে তার কাকার
ছোঁড়া গুলিতে মৃত্যু বরণ।তার পর আগুনে পুড়ে সে হয়ে যায় পাখি।হাজার হাজার পাখিরা
এসে তাকে নিয়ে উড়ে যায়।
কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে
চলে আসার পরে দেশের বাড়িতে গেলেও আর বন্দুক সাফ করার অবকাশ ছিল না।বাবা আচমকা
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেল এক শরতের সকালে।আমি তখন বেনারসে।কলকাতায় ফিরে শুনলাম
বাবা নেই।আমি গেলাম দেশের বাড়িতে।সেখানে সব কাজ শেষ হলে মা আমি ও বন্দুক এলাম কলকাতায়।লালাবাজারে
সেটা সারেন্ডার করার পর বিক্রির অনুমতি চেয়ে ধর্মতলার বন্দুকের দোকানে সস্তায় বেচে
দিতে বাধ্য হলাম।বাবা ও বাবার বন্দুক এভাবেই চলে গেল।রয়ে গেলাম আমি ও বাবার
বন্দুকের লাইসেন্স।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)




