ভিকিরিপতির সলিল সর্দার
আমাদের দেশের বাড়িতে একটা
বেশ বড়ো আর ভারী বন্দুক ছিল।ওটার লাইসেন্স ছিল বাবার নামে।বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার যে
কোনও প্রান্তে ওটাকে নিয়ে যাওয়া যেত।মানে তেমনই লাইসেন্সে লেখা ছিল।যতদূর স্মরণে
আছে ওটা ছিল আমেরিকার স্টিভেনসন কোম্পানির বন্দুক।সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
কেনা।না কোনও যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে নয়।কিম্বা কোনও মানুষ মারার জন্যেও নয়।বিষয়টা
আরও একটু জটিল।
ব্রিটিশদের বজ্জাতি
বুদ্ধিটা ভেতো বাঙালির চেয়ে যে কিঞ্চিৎ অধিক ছিল এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই আশা
করি।থাকার কথাও নয়।বাঙালির ইতিহাস সেই কথাই বলে।বাঙালি বজ্জাতিটা শিখেছিল খোদ্
ব্রিটিশদের থেকেই।আরও অনেক কিছু শিখেছিল।যেমন ঘুষ দেওয়া আর ঘুষ নেওয়া।ফারসি ভাষায়
যেটাকে ‘রিসওয়াৎ’ বলে।ব্রিটিশরাই শিখিয়েছিল কী করে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করতে
হয়।এছাড়া তোষামুদি করা।নবাব আলিবর্দী ও সিরাজ-উদ্-দৌল্লা এই ‘চাপলুসি’কে ঘৃণা
করতেন। ব্রিটিশ শেখাল কী ভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। নিজেরাই
যেটাকে বলত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’।মোগল পাঠান সিংহাসনের জন্যে ভাই ভাইকে
এমনকি বাপ ছেলেকে আর ছেলে বাপকে ‘কোতল’ করতে দ্বিধা করত না।আর ব্রিটিশরা শেখাল ক্ষমতা
লাভের জন্যে একটা হাত পায়ে আর অন্য হাতটা গলায় রাখতে হয়।আর শেখাল মিথ্যে কথা
বলা।সংস্কৃত ভাষায় ‘অণৃতভাষণ’ শব্দটি প্রচলিত ছিল।‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’এই
ধূর্তামিও ছিল কিন্তু উঠতে বসতে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলা এ ব্রিটিশদের দান।আর
শেখাল ‘পরের ধনে কী করে পোদ্দারি’ করতে হয়।‘বাবু’ সংস্কৃতি আর ‘দালাল’,
‘মুৎসুদ্দি’ ব্রিটিশ আমলেই ফুলে ফেঁপে উঠল।
ব্রিটিশ শাষক নিজেদের
স্বার্থেই ডাকাতির সংগে মোকাবিলার নামে ‘জোতদার’ আর ‘জমিদার’ দের বাড়িতে বন্দুক
রাখার ঢালাও লাইসেন্স দিয়েছিল যুদ্ধের কালে। ডাকাতিও যে হোতো সেটা মিথ্যে নয়।তেল-মশলা-চাল-ধানের
আড়তদার আর জোতদার জমিদার বাড়িতে বলে কয়ে যেমন ডাকাতি হোতো আবার না বলে চলে এসেও
হামলা চালাত।এক শীতের সন্ধ্যেয় আমাদের পুরানো বাড়ির জ্ঞাতি জ্যাঠাদের দালান কোঠায়
যে ডাকাতি হয়েছিল তা এই সেদিনও ভিকিরিপতি গ্রামের প্রাচীণ মানুষের মুখে মুখে
ফিরত।সেদিনের সন্ধ্যা যথেষ্ট রোমহর্ষক ছিল যা সে কালের বাংলার ডাকাত কাহিনিতে
সংকলিত হবার মতোই।আর সেই ঘটনার সংগে জড়িয়ে ছিল আমার ঠাকুরদা ‘ঈশ্বর ভূপতি সরকার’এর
নাম।
আমার ঠাকুরদা ভূপতি সরকার
তার জ্ঞাতি খুড়োর(প্রয়াণ কালে)সবিশেষ অনুরোধে তখনকার কালের ‘রাইস মিল’এর চারশ টাকা
বেতনের চাকরি প্রত্যাখান করে অনাথ বিশ্বনাথ ও অপগণ্ড(অপগণ্ড শব্দটির প্রকৃ্ত অর্থও
অনাথ)বৈদ্যনাথ সরকারের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষ্ণণাবেক্ষণ ও জমিদারির
হ্যাপা সামলাবার জন্য সামান্য বেতনেই তাদের নায়েব হয়ে বসেছিলেন।এর মধ্যে বিশ্বনাথ
জ্যাঠা পড়াশোনা করে তার মায়ের নামাঙ্কিত স্কুলের হেডমাস্টার হয়েছিলেন আর বৈদ্যনাথ
জ্যাঠা বংশ বিস্তারেই ব্যস্ত ছিলেন।বিশ্বনাথ জ্যাঠা ছিলেন বিপত্নিক আর তার একমাত্র
মেধাবী সন্তান বাড়ির দুর্গা পুজোয় বাড়িতে এসে ষষ্ঠীর দিন পুকুরে স্নান করতে নেমে
ভরা জলে ডুবে যায়।আমার সেজকাকা তাকে বাঁচানোর জন্যে পুকুরে নামলেও শেষ রক্ষা
হয়নি।শুনেছি অপূর্বকান্তি মাহারা সেই যুবকের মৃতদেহ যে দেখেছে সেই চোখের জল রাখতে
পারেনি।আর বিশ্বনাথ জ্যাঠা সন্তানের দেহ দাহ করে আর কোনদিন পৈতৃক আবাসে ফিরে যাননি।উনি
আমৃত্যু থাকতেন ওনার হাতে গড়া স্কুলের একটা ছোট্ট ঘরেই। আমরা সেইভাবেই তাকে
দেখেছি।উনি কিন্তু পালা-পার্বণে আমাদের বাড়িতে আসতেন। অরন্ধনের দিন আমাদের বাড়ির
বৈঠকখানায় পাতা আসনে বসে খেতেন।খুব রাশভারী আর স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন।ওনার
জীবৎকালেই আমাদের স্কুলের খ্যাতি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।ওনার মৃত্যুর পর
বৈদ্যনাথ জ্যাঠার একমাত্র পুত্র শংকুদা(সুনীল সরকার)হেডমাস্টার নয় স্কুলের
সেক্রেটারি হয়েছিলেন।বিশ্বনাথ জ্যাঠার মৃত্যুও হয়েছিল অপঘাতে।আমাদের কৈশোরে।
তখন স্কুলে গ্রীষ্মের
ছুটি চলছে।উনি পরীক্ষার খাতা দেখতেন স্কুলের ন্যাড়া ছাদের উপর হ্যাজাকের আলোয়।খাতা
দেখতে দেখতে হয়ত হাত-পা ছাড়াতেই পায়চারি করছিলেন।আচমকা কোথায় কিনারা বুঝতে না পেরে
এবং নিজের ছায়াই হয়ত তাকে প্রতারিত করায় দোতলার ছাদ থেকে ভর সন্ধ্যেয় নিচে ইঁটের
পাঁজার উপর পড়েন।স্কুলের বিল্ডিং বাড়ানোর জন্যেই ওখানে ইঁট-বালি-চূণ-সুরকি রাখা
ছিল।সেখানে পড়ে ওনার মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল।ডাক্তার জ্যাঠামশায় ওনাকে
ফেরাতে পারলেন না।তখনকার কালেই এই দুঃসংবাদ মুখে মুখে সারা পাড়া সারা গ্রাম সারা
মহকুমায় ছড়িয়ে পড়ল।সেজকাকা আমাদের তমলুকের মুদিখানায় ঝাঁপ বন্ধ করে সাইকেলে চড়ে
আসার সময় মাঝপথে খবরটা পেয়ে বাড়িতে না এসে সোজা হাজির হোলো শায়িত মৃতদেহের
পাশে।সারারাত সেই অকাল প্রয়াত মানুষটার পাশে বসেছিল। আমরা খেতে ডাকলেও সেজকাকা এলো
না।সেজকাকা বাড়ি ফিরেছিল জ্যাঠার শরীর দাহ করার পর।জ্যাঠার একমাত্র সন্তানের
প্রয়াণের পর সেজকাকাই হয়ত নিজেকে জ্যাঠার ভাই নয় সন্তান ভাবত!জ্যাঠার চিতা সাজানো
হয়েছিল স্কুলের বাগানেই।চিতায় দেওয়া হয়েছিল স্কুলের বাগানের চন্দন গাছের কাঠ।মুখাগ্নি
করল সেজকাকাই।হাতের পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে সেজকাকা যখন চিতাকে প্রদক্ষিণ করছে
কাতারে কাতারে মানুষ সেই দৃশ্য দেখছে ঝাপ্সা চোখে।সবাই কেঁদেছিল সেদিন।এমনকি
স্কুলের পোষা হরিণটাও।চিতা নিভেছিল দিনের শেষবেলায়।আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল পরের দিন
সকালেও।কদিন বাদে ওখানে একটা বেদী করে দেওয়া হয়েছিল।এরপর শঙ্কুদা ওই স্কুলের
শিক্ষক কাম সেক্রেটারি হোলো।স্কুলের মান নামতে থাকল।কিছু স্তাবক জুটল
চারপাশে।আমাদের বাড়ির সংগে সম্পর্কটা শীতল হতে থাকল।এক সময় আমি জ্ঞাতি হয়েও
প্রতিবাদী হয়ে উঠলাম।শঙ্কুদা তার আশপাশের মানুষদের বলত-‘নিরঞ্জন কাকার ছোটো ছেলেটা
বড়ো ঠ্যাঁটা।বাড়ির ছেলে হয়েও আমার শত্রু’।আমি কিন্তু সত্যি সত্যি শঙ্কুদার শত্রু
ছিলাম না।আমার লড়াইটা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের।আমরা জিতেওছিলাম।প্রতিবাদের
কথা এখন থাক।বরং ঠাকুরদা অন্যের সম্পত্তি রক্ষা করতে যে প্রতিরোধ গড়েছিল সেদিন তার
কথায় ফিরে যাই।
তখন শীতকাল।পৌষ মাস।মাঠে
মাঠে ধান কাটা হয়ে খ্যাসারি আর মুগ কড়াই ছড়ানো শুরু হয়েছে।আগাছার বাগানে ছড়ানো হয়ে
গেছে বিউলি কড়াইয়ের বীজ। প্রজারা নবান্ন সেরে কিছু ধান গোলায় তুলে বাকি ধান আড়তে
বেচে জমিদারের খাজনা মেটাতে আসছে।পৌষে মাঠ কুয়াশায় ভরে তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে।আর
গ্রামের সাতটা আটটা মানে রাত্রি।ঠাকুরদা সেদিনের মতো খাজনা আদায় শেষ হলে টাকা গুনে
ক্যাশ বাক্সে ভরে রাখছে এমন সময় সিংহ দরজায় শব্দ উঠল।ঠাকুরদা হাঁক পাড়ল- “রাম
সিং।ওখানে কে?” উত্তর এলো-“তোর বাপ”।ঠাকুরদা বুঝল আর কিছু নয় ডাকাত পড়েছে।তাড়াতাড়ি
করে টাকা ক্যাশবাক্সে নয় ভরে রাখল কোচড়ে।টর্চের আলো ফেলল দরজায়।গামছায় মুখ ঢেকে
ভোজালি হাতে কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে বৈঠকখানার দিকে।হাঁক উঠল-“আলো নেভা”।ঠাকুরদা
টর্চের আলোটা নিভিয়ে দিল। সামান্য ধাঁধা লাগল চোখে।ঠাকুরদা সেই সুযোগে সব টাকা
পাশের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।জানালার ওপাশেই ছিল আমাদের দালান কোঠা তাই
ওদিকটা সুরক্ষিত।ডাকাতরা এসে টাকা চাইল।ঠাকুরদা ক্যাশ বাক্স আগলে রাখার ভাণ করল।
ওরা বাক্সটা কেড়ে নিল।দেখল খুব সামান্য টাকা পড়ে আছে।জান্তে চাইল-“বাকি টাকা কোথায়?”ঠাকুরদা
বলল-“আজ এই যা আদায় হয়েছে”।ওরা বল্লে-“মিছে বলছেন সরকার মশায়।আমাদের কাছে খবর
আছে।বাকি টাকা কোথায় সরিয়েছেন?”গলাটা ঠাকুরদার খুব চেনা লাগল যেন!বলে
উঠল-“......তুই?”মুখটা সরে গেল মুহুর্তে শুধু যাবার আগে ওরা আমার ঠাকুরদা জমিদারের
বিশ্বস্ত নায়েব মশায় ভূপতি সরকারের পিঠে ভোজালি চালিয়ে দিল।
ডাকাতরা যখন সামান্য কিছু
টাকা নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেল ততক্ষণে পাড়ার লোক বুঝতে পেরেছে ডাকাত পড়েছে।সবাই
ছুটে এলো।এসে দেখে দারোয়ান হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে সিংদরজার সামনে আর আমার
ঠাকুরদা তখন পিঠে ছুরির আঘাত নিয়ে রক্তাত অবস্থায় পিছনের জানালা থেকে টাকাগুলো
তুলে আনছে।হায় বেচারা ভূপতি সরকার ওই টাকার কিছু বাণ্ডিল যদি তখন সরিয়ে রাখত নিজের
জন্যে তাহলে কী হোতো জানি না।তবে আর যাই হোক পিঠে ভোজালির ক্ষত নিয়ে বাকি জীবন
কাটাতে হোতো না।তারপর দাদুর চিকিৎসা হোলো।তমলুক থেকে পুলিশ এলো।ঠাকুরদার নাম
বহুদূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল।আর সম্পন্ন মানুষজন আত্মরক্ষায় প্রশাসনের মদতে
এক-নলা,দো-নলা বন্দুক কিনতে থাকল।আর একটা কারণও ছিল যে কারণে আমাদের বাড়ির
বন্দুকটা কেনা।
ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরের
জোতদার-জমিদারদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় যেমন ধান,পাটের জমি ও শাক-সব্জি চাষের জমি
ছাড়াও ফলের বাগান থাকত পাশাপাশি সুন্দরবনের লাট অঞ্চলেও এক একজনের দুশ পাঁচশ চাষের
জমি থাকত।আমাদেরও এমন দুশ-আড়াইশ বিঘা জমি ছিল লাটে।পূর্ব মেদিনীপুর থেকে সুন্দরবন
নদী পথে খুব একটা দূরও ছিল না।আমার ছোটোবেলায় লাট থেকে নৌকা বোঝাই যেমন বস্তা
বস্তা ধান আসত তার সংগে ডিম,মাছ,কাঁকড়া,মধু আর শাক সব্জিও আসত।সুন্দরবনে যেমন এইসব
খাদ্যবস্তু প্রচুর পরিমানে ছিল তেমনই বাঘও ছিল,ডাকাতও ছিল।তাই বন্দুকেরও প্রয়োজন
পড়ত।আমার কৈশোরেই লাটের জমি লাটে উঠেছিল।কিছু জমি বাড়ির কেউ কেউ যখন তখন কাউকে নয়া
বলে জলের দরে বেচে দিয়ে আসত। বাড়ির কত্তা হিসেবে বাবা আবার সেই জমি দাম দিয়ে
কিনত।আর মাঝে মাঝেই চাষের জমি সমুদ্রের লোনা জলে ডুবে যেত,কখনও বা সমুদ্রের গর্ভে
লীন হয়ে যেত। এইভাবে একটু একটু করে লাট থেকে কিছু আসার আশা লাটে উঠে গেল।রয়ে গেল
বন্দুক আর পাখি ও বাঘ মারার কার্তুজ।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বাবা
যেমন আমাদের সবার জন্যে ছিপে ডোর পরিয়ে,নতুন কাঁটা আর ফাৎনা লাগিয়ে পুকুরে মাছ
ধরার উপযুক্ত করে তুলত।শীতকালে বাবা তেমন যত্ন করে ঘরের এককোণে ঢাকা দিয়ে রাখা
বন্দুকটাকে বের করে একটা একটা করে সব অংশ খুলে ‘গান অয়েল’দিয়ে ভালো করে
মুছত।কারতুজগুলো রোদে শুকোতে দিত।আমি অবাক চোখে সে সব দেখতাম আর বাবার কাছে এই
বন্দুকের নানা কাহিনি শুনতাম।পরের দিন বাবা ওই ধোয়া মোছা বন্দুক নিয়ে থানায় যেত
লাইসেন্স রিনিউ করাতে।শুধু বাবা কেন ও গ্রামের ঘোষ-বোস-চন্দ-মিত্তির যার যার
রাইফেল কি বন্দুক ছিল তারা সবাই যেতেন।ফিরে এসে আবার ঘরের দেওয়ালের এক কোণে রেখে
দেওয়া।কোনও কোনও উঠতি বড়লোক আবার দেখাদেখি পাখি মারার ছররা বন্দুকও কিনতে থাকল যার
লাইসেন্স লাগত না।সেগুলো ছিল হাল্কা আর কাশীপুর গান শেল ফ্যাক্টরির।বাবার,দাশু
জ্যাঠার কি বরেন জেঠুর ‘গান’ ছিল অনেক ভারী। পরের দিকে আমি যখন ওটাকে সাফ সুতরো
করেছি আর পাখি মারার চেষ্টা করেছি বেশ ভারী ঠেকত।একবার পাখি শিকারের হুজুগ উঠল।
বরেন জ্যাঠা এক শীতের
সকালে আমাদের বাড়িতে এলেন।বরেন জ্যাঠা সাতকালুয়ার মানুষ।বাবা সে সময় বৈঠকখানায় বসে
বন্দুকটা পরিষ্কার করছিল।জ্যাঠা এসে দাওয়ায় বসে চা খেতে খেতে বললেন-“নিরঞ্জন এবারে
বনমালী কালুয়ায় অনেক ‘মাইগ্রেটরি বার্ড’ এসেছে।তোমাদের বালি পুকুরে বালি হাঁস
এসেছে,বেগড়ির ঝাঁক এসেছে।তোমার গুলিগুলো তো পড়ে পড়ে মিইয়ে যাচ্ছে।বন্দুকেও জং
ধরছে(একটু থেমে)শিকারে বেরুবে নাকি?”বাবা নলটা সাফ করতে করতেই উত্তর দিল-“আমার তো
খাজনা আদায়ে বেরোতে হবে যে”।বাবা সরকারি ‘তহসিলদার’ ছিল।পিওন আর গোমস্তা নিয়ে এক
এক গ্রামে খাজনা আদায়ে যেতে হোতো।শীতকালেই এটা বেশি হোতো।জ্যাঠা আমাকে
দেখিয়ে-“তোমার ছোটো ছেলে সলিল তো বড় হয়েছে।বন্দুক ঘাড়ে নিতে পারবে।ওর হাতেই বন্দুক
আর কারতুজ দিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিও”।পরের দিন আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অনুপ
যার ডাক নাম ছোট্টু স্টিভেন্সন কোম্পানির ‘গান’ আর ‘গান শেল ফ্যাক্টরির’ পাখিমারা
গুলি নিয়ে বরেন জ্যাঠার পিছু নিলাম পাখি মারতে।
এই বাংলায় সাতের দশক
অব্দি পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসত।সাইবেরিয়ান ক্রেন,আফগানিস্থানের হাঁসের দল
আর হিমালয়ের পাখিরা সদ্য ধান পাকা মাঠ আলো করে থাকত।তখনও পরিবেশ রক্ষার কথা কারও
মাথায় আসেনি।একদিন ডোডোর মতো অনেকেই যে বিলুপ্ত হবে সেই কথাটা চিন্তাটা কাউকে নাড়া
দিত না।আর একটা ব্যাপরও ছিল।আজ যারা বন্যপ্রাণী ও পাখি রক্ষার কথা বলেন।তাদের
অধিকাংশই এক সময় শিকারী ছিলেন।তাই বাল্মীকি থেকে বরেন জ্যাঠা কেউ তার বাইরে যাবে
কী করে?
আমরা যখন মাঠের আল পথে
গিয়ে দাঁড়ালাম মাঠে দলে দলে তখন পাখিরা ধান খেতে ক্ষেতে নামছে।শিকার দেখে শিকারীর
মন উত্তেজিত হবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু সে উত্তেজনা প্রকাশ পেলেই মাটি।মাছ ধরা আর
পাখি শিকারে ধৈর্য্য প্রধান শর্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসে বা খাড়া হয়ে থাকতে হয়
আর নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখতে হয়।আমরাও মাঠের মাঝে আলের পথে নিজেদের নলবন
আর বুনো ধানের ঝোপে লুকিয়ে রাখলাম।জ্যাঠা হতাশ কেন কি পাখিগুলো বন্দুকের নাগালের
বাইরে।অপেক্ষা করে করে এক সময় রোদ যখন চড়চড় করছে আমরা খালি হাতেই বাড়ি ফিরলাম।মাছ
শিকারেও এমন অনেক দিন যায়।আবার পরের দিন সেই এক দল কিন্তু জায়গাটা পালটে গেল।আজ
এখানে পাখিগুলো খুব কাছে নাগালের মধ্যে।জ্যাঠা চালাল বন্দুক মরলও কয়েকটা।আমরা
জল-কাদা ঘেঁটে ছুটলাম ছটফট করা আধ মরা পাখিগুলোকে কুড়িয়ে আনতে।সেই প্রথম বকের মাংস
খেলাম।সেই শেষ পাখির মাংস খেয়েছি।তার বহু পরে নয়ের দশকে লিখেছিলাম “তবু বিহংগ”
নামের ছোটো নাটক যা মূলত এক পাখির কারবারীর মেয়ের পাখি বাঁচাতে গিয়ে তার কাকার
ছোঁড়া গুলিতে মৃত্যু বরণ।তার পর আগুনে পুড়ে সে হয়ে যায় পাখি।হাজার হাজার পাখিরা
এসে তাকে নিয়ে উড়ে যায়।
কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে
চলে আসার পরে দেশের বাড়িতে গেলেও আর বন্দুক সাফ করার অবকাশ ছিল না।বাবা আচমকা
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেল এক শরতের সকালে।আমি তখন বেনারসে।কলকাতায় ফিরে শুনলাম
বাবা নেই।আমি গেলাম দেশের বাড়িতে।সেখানে সব কাজ শেষ হলে মা আমি ও বন্দুক এলাম কলকাতায়।লালাবাজারে
সেটা সারেন্ডার করার পর বিক্রির অনুমতি চেয়ে ধর্মতলার বন্দুকের দোকানে সস্তায় বেচে
দিতে বাধ্য হলাম।বাবা ও বাবার বন্দুক এভাবেই চলে গেল।রয়ে গেলাম আমি ও বাবার
বন্দুকের লাইসেন্স।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন