MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬

শেষ নাহি যে......অশেষ-কথা কে বলবে?
বয়সে সে আমার চেয়ে কিছু ছোটো ছিল।মনের বয়সে আমার থেকে কিছুটা,কিছুটা কেন অনেকটাই বড়ো ছিল।বুদ্ধিতে সে বায়সের মতো ধূর্ত ছিল।ফূর্তিতে সে ছিল চড়াইয়ের মতো সদা চঞ্চল ও স্ফূর্তিবাজ।প্রিয়জনের পাকশালায় প্রবেশে সে ছিল শালিকের মতোই তৎপর।চলনে সে ছিল ছাতারের মতোই ছটফটে।যাকে তাকে কারণে অকারণে ঠোকরাতে সে ছিল বাহারি কাটঠোকরা।বচনে সে ছিল টিয়াপাখি।লোচনে সে ছিল ময়না।মানুষের পাশে দাঁড়াতে সে ‘সুখের পায়রা’ হতে পারেনি।সে ছিল দুখের পায়রা।দ্রুততায় ছিল চিতাবাঘ।অভীষ্টলাভে সে সিঙ্ঘ।আক্রমণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। গাধার মতো পরিশ্রমী।সারমেয়-র মতো সে ছিল কমিটেড।এমন এক যুবকের সংগে আমার মতো এলেবেলের কীভাবে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল সেটাই পরম বিস্ময়!
আমি ছিলাম গেঁয়ো,সে ছিল শহুরে।সে ছিল ‘কাঠ বাঙাল’ আর আমি ‘গাছ ঘটি’।সে ছিল বদ্যি সে ছিল লম্বা।আমি বেঁটে-কায়েততার চুল পাতলা পাতা করে আঁচড়ানো।আমার চুল তখন ঘন আর কোকড়ানো।সে ছিল ইংরেজিতে তুখোড় আর আমি গোমুখ্যু।সে ওই বয়সেই প্রেম করে সংসার পাতার চিন্তা করছে তখন আমি দাদার সংসারে এবেলা ওবেলা পাত পেড়ে খাইপ্রেমে শুধু পড়ি,কোনও পরী(ডানাকাটা তো দূর অস্ত)আমাকে ফ্রেম করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।অভিনয়ে সে নিজেকে ডাস্টিন হফম্যান ভাবত আর আমি গাঁ থেকে আসা ভবম নাপিত কি হানিফ মিস্ত্রী।সারাদিন থিয়েটারের নেপথ্য কর্মী।আর সে শো শুরু হবার কিছু আগে হন্তদন্ত হয়ে এসে মেক-আপ এ বসে পড়ত।কথা বলার সময় সে অফুরাণ থুতু ছেটাত আর আমি কিছু কথা বলতে গেলেই ঢোঁক গিলতাম।শুধু ক্বচিৎ কখনও শোয়ের শেষে কোনও সুন্দরী গ্রীনরুমে এসে আমাকে ‘হাগ’ করলে রঞ্জনদা আর অশেষ প্রকাশ্যে হিংসায় পুড়ে মরত?না আমাকে মারত।
অশেষ-এর নাটকের ফাঁদ পাতা ভুবনে ধরা পড়া নেহাতই বিধির লিখনে।অশেষ তখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার ডিগ্রীর ছাত্র।ইউনিভার্সিটির নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমাদের নাট্যদলের প্রধান অভিনেতা দ্বিজেন(বন্দ্যোপাধ্যায়)দার পাল্লায় পড়ে গেল।আমাদের কাজই ছিল ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্টের মতো নিমরাজি ছেলেদের ধরে এনে দলে ঢোকানো।অশেষ এলো তবে একা এলো না।আরও কয়েকজন জুটিয়ে নিয়ে এলো।একসময় তারা পালালো।ধরা পড়ল অশেষ।এ বড় কঠিন ঠাঁই।এ বড় জটিল বিন্যাস।যে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় দলের প্রধান অভিনেতা তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক,পারিবারিক টানাপোড়েন প্রতিষ্ঠানের সংগে একাকার।এক দিন সরতে হোলো তাকে।রয়ে গেল অশেষ।
আমি তখন নানা ঘটনার টানাপোড়েনে ছারখার।জীবন সংগ্রাম, নাট্যদল,পারিবারিক সম্পর্ক আর পাশের মানুষদের অতিরিক্ত বিশ্বাস,ইউনিভার্সিটির অন্তিম পরীক্ষা, প্রেমের প্রতি অগভীর অনাস্থা,......নাট্য আন্দোলনের কাছে অন্ধ প্রণিপাত এই সব আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল দু-দুটো মৌলিক নাটক-‘আবরণ’ ও ‘প্রবহতি’।লিখলাম আমি নামকরণ করল অশেষ।এই দুটি নাটকেই অশেষ অসাধারণ অভিনয় করল।খুব সামান্য ব্যয়ে নাটক দুটি মঞ্চস্থ হোতো কিন্তু তাতে কী?নাটক দুটি বেশিদিন চালানো হোল না।আমিও থামিয়ে দিলাম নাটক লেখা।আমি যে তখন নাট্যভক্ত হনুমান।সীতাকে রক্ষা করাই কাজ।রামের আদেশ পালনেই কৃতার্থতা।গন্ধমাদন বয়ে আনা তুচ্ছ।প্রভুর বাণী শ্রবণেই তৃপ্তি।কিন্তু প্রাপ্তিও যে হয়নি তাই বা বলি কী করে?আজ অ্যাতোদূর হেঁটে আসা তো ওই প্রাপ্তির জোরেই।

ধ্বনির শ্রীপতি দাস,রূপ সজ্জাকর শক্তি সেন কী সাহস জোগালেন সারাক্ষণ পাশে থেকে।নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায় প্রথম শোয়ের শেষে এক ‘দাদা’কে ডেকে বলেছিলেন-‘সলিল যেন নাটক লেখা না থামায়’।হায়!নটনাথ নাকি ভরত মুনি মুচকি হাসলেন?পরের প্রযোজনায় আমি ফিরে গেলাম ছুতোর মিস্ত্রীর কাজে।অশেষ তখন দামাল অভিনয় করছে।অশেষ তখন দলের অপরিহার্য অঙ্গ।আমি তখন নিজে নিজেই একা নিঃসঙ্গ।শক্তিদা এক দিন ডেকে বললেন-‘সলিল ভুল করছ।চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়ো না’।আমি এবার নাটক অনুবাদে হাত দিলাম।আর লিখে চললাম নাট্য প্রবন্ধ।অশেষও তখন কেমন দোলাচলে।আমি একা এবং কয়েকজন বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম কুক্ষিগত বৃত্ত থেকে।না আমি অতীতের কেচ্ছা লিখতে বসিনি।আমি অশেষের মহিমা কীর্তনে গা ভাসাইনি।আমি লিখছি পুরানো পাতার আড়ালে পড়ে থাকা টুকরো টুকরো অতীত যা আজ অবশ্যই ইতিহাস।    

৫টি মন্তব্য:

  1. আবারো তোমাকে ধন্যবাদ ।লিখে যাও লিখে যাও আর আমরা পড়ে যাই নাটকের back stage এর অপঠিত ইতিহাস ।

    উত্তরমুছুন
  2. আবারো তোমাকে ধন্যবাদ ।লিখে যাও লিখে যাও আর আমরা পড়ে যাই নাটকের back stage এর অপঠিত ইতিহাস ।

    উত্তরমুছুন
  3. অশেষ-কথা বলা হোক : তুমি বল , আর যার বলার ইচ্ছে থাকে সে বলুক শুধু সেই অসময়ে চলে-যাওয়া লোকটার সব দোষ-গুণের তলায় তলায় লুকিয়ে থাকা লুকিয়ে রাখা তার একবুক অভিমানটুকু ছুঁয়ে থেকে তার হৃত্স্পন্দন শুনতে শুনতে তার কথা বলা হোক । সে নিজের আসল জায়গাগুলো ফোকাস করতে চিরকাল-ই অপটু ছিল । বায়সের মত ধূর্ত্তামিটুকু ছিল বদ্যিগত জন্মের মাশুল ( কোন অদৃশ্যলোকে বসে নির্ঘাত্ সবংশে সপিণ্ডকরণ ঘটছে আমার ) ! যেখানে সে তার নিজের মত একক মানুষ সেখানে সে সত্যি-ই ছিল দুখের পায়রা । সেইখানেই তার চলে যাওয়াটা শুধু শেষ নয় : শেষের শুরু একটা অতল গহ্বরের মত ভ্য়ঙ্কর অন্ধকার নিষ্করুণ !
    সমান্তরাল রেখার মত পাশাপাশি চলতে চলতে একটা মানুষের যাপনধর্মকে জানা যায়, তার আত্মার সুবাস-কুবাস খুব কাছ থেকে পেয়ে আত্মীয়তার স্পন্দনছন্দের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো যায় ; তা নিয়ে আত্মকথন চলে সোচ্চার হতে বাধা আসে রুচিগত কারণে । শুধু অন্তরঙ্গ আন্তরিক স্মৃতিচারণায় যে কিভাবে কি পাওয়া যায়: কেন তার জন্য কেউ কান পেতে বসে থাকে বুঝবে যদি ঐ গানটি প্রতি শব্দ ধরে অনুধ কর.
    Ramita Sengupta

    উত্তরমুছুন
  4. রমিতা তুমি ছিলে তার সহপাঠী।তুমি ছিলে তার বান্ধবী।তুমি হলে তার স্ত্রী।তোমরা দুজন হলে দুই সন্তানের জনক-জননী।তুমি নিশ্চয় খেয়াল করেছ আমি নিজেই নিজেকে হ ন ন কব্রে চলেছি।আমি ইতিহাস লিখতে বসে নিজেকেও রেয়াত করছি না।তুমি তোমরা প্রশ্রয় দিচ্ছ তাই লিখে চলেছি তবে রুচির মাত্রা ছাড়ালে বোলো।আমার এই লিখনে অশেষ সখা নয়,সময়ের দলিল।সলিল কোনও কালেই অশেষ কে ভুলতে পারবে না।সে ব্যবস্থা সে নিজের প্রয়াণ দিয়ে করে গেছে।অপর্ণাও তাকে আজও ভুলতে পারেনি।যদিও দুজনের সম্পর্ক ছিল পিঠোপিঠি ভাই-বোনের মতোই খুনসুটির।আমাদের মেয়ে তিথিপর্ণার নাম রেখেছিল ও 'ঢেউ'।যাবার আগে সেই রাতে ও নিঃশব্দে এসেছিল আমাদের শিয়রের পাশে।এর কোনটাই ব্যক্তিগত কথন নয়।বাংলা নাটক আমাদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে ফেলেছিল।ওর মা ওকে ডাকতেন 'নাটুকে গিরিশ' বলে।আমরা যাযাবর চালচুলোহীন নাটুয়ার দল।

    উত্তরমুছুন
  5. Ramita Sengupta সলিল যন্ত্রটা গোলমাল করছে তোমার লেখা পড়ে যা লিখছি কখনও তা আধপথে হারিয়ে যাচ্ছে কখপো ভেঙেচুরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে । তোমার লেখা নয় আমি কিছু লিখলে হয়তো আত্মকথন হয়ে যাবে, বেশি সোচ্চার হয়ে যাবে । তার সময় আসেনি । অসময়ে যে চলে গেছে সে সময়ের দলিলের অঙ্গ হয়েই বেঁচে থাক তবু তো থাকবে ! "আমি কান পেতে রই---" গানটার প্রতি শব্দে মন রেখে নিজের ভেতরে তলিয়ে যাও বুঝতে পারবে কি উন্মুখ হয়ে থাকি তোমার লেখার জন্য এবং কেন । সংবেদনশীল লোকের পৃথিবীতে কাছের জন হয় হাতেগোণা । আর কাছের জনের যারা কাছের তাদের পরমাত্মীয় বলে মানি ।
    Like · Reply · 1 · 16 June at 11:09
    Ramita Sengupta
    Ramita Sengupta তুমি লেখ, লেখ, লিখে চল । রুচির মাত্রা ছাড়ানোর কোনো প্রশ্ন তোমার ক্ষেত্রে দেখা দেয়নি তো ! আমি যদি লিখি তো বেশি সোচ্চার হয়ে যাবার ভয় থাকে ; রুচিগত বাধা আসে সেখান থেকে । আশা করি আর মেঘ রইলনা ভুল বোঝার ।
    Like · Reply · 16 June at 11:23
    Ramita Sengupta
    Ramita Sengupta আমার ফোন আংশিক বৈকল্যে ভুগছে । তা নাহলে কথা বলতাম ।বলতে চাইছি । তুমি অপর্ণা তোমরা চাইছ কি ?
    Like · Reply · 16 June at 11:31
    Salil Sarkar
    Salil Sarkar রমিতা আমাকে আশা জাগালে।খুব তাড়াতাড়ি কথা হবে।আপাতত লিখে যাই আর পড়ে যাও.........
    Like · Reply · 16 June at 17:01
    Ramita Sengupta
    Ramita Sengupta অবশ্য-ই লিখে চল । ঐ আমাদের একমাত্র সংযোগ-সেতু ।জানিনা কোথায় আছ । ভাল থেকো ।
    Like · Reply · 16 June at 19:22

    উত্তরমুছুন