MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
সলিল সরকার
এই লেখাটি আমি লিখতে বসলাম আমার ভিকিরিপতি গ্রামের অনেক ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে একজন সুদীপ (ওকে আমি ডাকি গৌড়া বলে)এর বিশেষ অনুরোধে।আর পাঁচজনের মতো সুদীপও আমার লেখা নিয়মিত পড়ে।শেয়ার করে।এ প্রসংগে আর একজনের কথা না বল্লেই নয় সে আমার ভাগ্নে রাহুল রায়চৌধুরি(যাকে আমি পাঁচু বলে ডাকি)।বাঙালকে না কি হাইকোর্ট দেখাতে নেই।রাহুল কিন্তু আমাদের সবাইকে উচ্চ আদালত দেখায়।রাহুল কলকাতার উচ্চ আদালতে আইন বিষয়ে কাজ করে।রাহুলের বাবা আমার জামাইবাবু ছিলেন লেখক শংকরের মতোই ‘বাবু’।প্রয়াত প্রাক্তন বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় ব্যারিস্টার হিসাবে তর্কা্তীতভাবে প্রখ্যাত ছিলেন।রাহুলের বাবা তারকনাথ রায়চৌধুরি তার ও আরও অনেক ব্যারিস্টারের ‘বাবু’ ছিলেন।আর আমার জ্যাঠাবাবু প্রয়াত দুর্গাচরণ সরকার সুদীপের আপন ঠাকুরদা তিনিও কলকাতা হাইকোর্টের বিপরীতে একটি সলিসিটর ফার্মে চাকরি করতেন। ইতিহাসের কী অদ্ভূত সমাপতন এরাও আমার লেখা থেকে পেতে চাইছে ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়ের আস্বাদ।সুদীপ জানতে চায় কেলোমালের অতীতকালের দোল-দুর্গোৎসবের কথা।সত্যি বলতে কী সেই শৈশবের পর আর সেভাবে কোনদিন ফিরে যাওয়া হয়নি দেশের বাড়ির পুজোয়।মা-বাবা প্রয়াত হবার পরে তো একেবারেই নয়।তবে নাস্তিক বলে এই উৎসব আর অন্যের আনন্দকে দূরে সরিয়ে রাখি না।কারণ আমি মনে করি যা আমি সবার থেকে নির্মূল করতে চাই তা কি আমি আমার খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকেই সরাতে পেরেছি?আমার মা জানত আমি এসব মানি না কিন্তু মা যখন পুজোর ফুল নিয়ে আমার মাথায় ঠেকাতে আসত আমি একদিনের জন্যেও তার সংগে রূঢ় ব্যবহার করিনি তার কারণ আমি নিজের কাছে তখন ও এখনও খুব পরিস্কার।আমার কিছু মারক্সিস্ট ও কমিউনিস্ট বন্ধুদের জানা নেই হয়তো লেনিনের জীবদ্দশাতেই সোভিয়েত রাশায় চার্চ ছিল,মসজিদ ছিল আর তাদের ধর্ম পালনে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াননি।আমরা অনেকেই মারক্সের কথা আওড়াই “ধর্ম আফিংয়ের মতো......!”কথাটা জেনে বা না জেনে শেষ করি না।“ধর্ম ভীরূদের কাছে”।ঠিক যেমন কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আউড়ে বলি-“তোমার উপর নেই ভুবনের ভার......” গানের পরের দুটি শব্দ “ওরে ভীরু” নিঃশব্দে বাদ দেয় এস্কেপিস্টগণ।পাড়ার পুজো প্যান্ডালে যে সব মারক্সবাদী বইয়ের স্টল হোতো সেগুলোয় যেমন ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ বা “সত্যনারায়ণের মাহাত্ম্য” কিংবা ‘ইতু ও ঘেঁটু পুজোর নিয়মাবলী’ বিক্রির জন্যে থাকত না আবার প্রবীণ কমরেডদের অনেককেই পুজোর শেষে ‘মায়ের প্রসাদ’ তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখেছি।আর পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ‘মানুদার’ আমলে শনি ও সন্তোষী ঠাকুর অলিতে-গলিতে আসন পেলেও বামফ্রন্টের আমলেই তা বিস্তার লাভ করে এবং কালী ও দুর্গা পূজা থিমযোগে করপোরেট দুনিয়ার পণ্য প্রচারের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।পাশাপাশি মারক্সবাদী সাহিত্য বিক্রি ক্রমেই কমতে থাকে।নিন্দুকরা বলেন যখন থেকে কমিউনিস্ট দের চেয়েও ‘কামায়ে নিস’দের সংখ্যা বাড়তে থাকল আর বামের ‘ব’ কখন যে পুটকি বসে ‘র’ হোলো......।যাকগে।এই কলকাতা শহরের অনেক আবাসনেই বাম আমল থেকেই “দুর্গোৎসব” চালু হয়েছে।সেখানে অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আসর আলো করে বসেন।এই রকম আসরে ধর্মভীরু মানুষ যেমন থাকেন আবার সত্যজিৎ রায় থেকে সারামাগো,সুইজারল্যান্ড থেকে সিঙুর সব আলোচনাই প্রসাদ সহযোগে চর্চিত হয়।
কে কিভাবে নেবেন জানি না তবে আমি আমার শৈশবের উৎসব আর পুজোকেই সবার আগে রাখি কারণ সেখানে আড়ম্বরের চেয়েও আন্তরিকতাই মুখ্য ছিল।বারোয়ারি পুজোতেও বারো ইয়ার চাঁদার জুলুম আর পেশী শক্তির আস্ফালন দেখাত না।ঘরের পুজোর মতো না হোলেও পুজোতে আম জনতার প্রাণের যোগ থাকত।কাছে পিঠে বারোয়ারি পুজো বলতে ছিল রাধামনি বাজারের পুজো আর ঘরের পুজো বলতে ঘোষেদের,কারকুনদের আর সরকারদের।কারকুন আর সরকার দুটিই কিন্তু এক অর্থ বহন করে।এই সরকার বা কারকুন আসলে করনিক।আসল পদবি ‘দে-সরকার’।শোনা যায় এরা আদতে মুর্শিদাবাদের মানুষ।নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার পতনের পর শহর কলকাতায় অনেক নবাবি দেওয়ান বেশ কিছু নবাবি মাল লুট করে রাতের অন্ধকারে নৌকা-বজরায় পালিয়ে এসে রাতারাতি বড়লোক হয়েছিল।তারাই শহরে এসে আড়ম্বর করে চড়ক-গাজন-পুজো-পাখির লড়াই-বিড়ালের বিয়ে-বাগানবাড়ির ফুর্তি চালু করে।আর যারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি তারাই গ্রামের দিকে এসে প্রাণ বাঁচায়।
কেলোমালের সরকার আর ঘোষ পরিবার জীবন ধারণের জন্যে মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটাল হয়ে কেলোমালে আসেন।তাম্রলিপ্ত রাজাদের কারকুন হিসাবে নয় বরং মহিষাদলের রাজা গর্গদের করনিক হয়।রাজারা এই দুই পরিবারকে গ্রাম দান করেন।পাশাপাশি বাস করার পাশাপাশি রেষারেষিও ছিল বিস্তর।আবার পরিবারের বংশ বৃদ্ধি আর সম্পত্তির কারণে কারকুন আর সরকার পৃথক হয়ে যায়।
কেলোমালের সব গ্রামে পুজোর মেজাজ আসত মহালয়ার ভোর থেকে।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র শুনে কতিপয় বাড়ির রেডিয়ো শুনে।দু-তিন বাড়ির পুজো হলেও সব পাড়া আর গ্রামের সব ঘরে আত্মীয়-কুটুম্ব চলে আসত উৎসবে যোগ দিতে।পুজোটা সবার ছিল।পুজোর মন্ডপে ঢাকে কাঠি পড়লেই গ্রামের সবার বাড়ির ছেলে-মেয়েদের প্রাণ নেচে উঠত।সব বাড়িতেই সাধ্য মতন মেয়ে-বউদের জন্যে তাঁতের কোরা শাড়ি,ছোটো মেয়েদের বাহারি ফ্রক,ছেলেদের জন্যে ইংলিশ প্যান্ট-শার্ট আর পুরুষদের জন্যে ধুতি,পাঞ্জাবি কি ফতুয়া।বাড়ির কাজের লোকেদের জন্যেও বরাদ্দ ছিল।চমৎকারীর জন্যে বাড়ির বউয়েদের মানের শাড়িই তার মেজদ্দা অর্থাৎ আমার বাবা আনত।নাপিত বৌ আলতা পরাতে এসে শাড়ি পেত।ধোপা বউ পেত শাড়ি।চাষি আর প্রজারাও পেত পয়সা আর গামছা-ধুতি।ঘরে ঘরে লুচি ভাজার গন্ধে সারা পাড়া ম ম করত।ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বেতের চুবড়িতে খৈ-মুড়ি-নাড়ু কী তৃপ্তি করে খেত।উৎসবের বাড়িতে থালা-বাটি নয় কলাপাতায় আর শালপাতায় দিনে রাতের খাওয়া হোতো।মাটির গ্লাসে জল।মাথা ঘষার জন্যে থাকত কাপড়কাচার সোডা আর গায়ে মাখার জন্যে লাইফবয়।মাথার চুলে বাড়ির নারকেল তেল আর গায়ে মাখা হোতো সরষের তেল।দাঁত মাজা হোতো ঘুঁটের ছাইয়ে কি নিম ডালে।দাঁতের ব্যথা হলে নারকেলের পাতা পুড়িয়ে মিশি বানানো হোত।পেয়ারাপাতা চিবিয়ে খেয়েও ব্যথা সারত।পেটে ব্যথা হলে ‘ভাস্কর লবন’ কি জোয়ানের আরক।বুকে ব্যথা হলে রসুনের তেল।মাথা ব্যথা হলে বাড়ির বাগানের ঘৃতকুমারীর রস।মনে ব্যথা হলে ঘরের কোনে লুকিয়ে কেঁদে শোক প্রশমিত করা।পা মচকালে চূণ-হলুদ।গলা খিঁচখিঁচ করলে গরমজলে নুন।এসব বলার সংগত কারণ আছে।এই সময়ে গ্রামে হিম পড়া শুরু হোত আবার বৃষ্টিও হোত ও হয়।দৌড়ঝাঁপ করার কারণে পা মচকাতো।উৎসবে মনে রং লাগত তাই ব্যথার কী দোষ?
সরকার বাড়ির পুজোয় ছিল ডাকের সাজ।চালচিত্র বিশাল।ঘোষেদের বাড়ির পুজোয় সবটাই শোলার কাজ আর ঠাকুরের চোখ টানা টানা।ঘোষদের বাড়ির পুজোয় সপ্তমীর দিন সাত মণ,অষ্টমির দিন আট মণ,নবমীর দিন ন’মণ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হোত।পুজোর শেষে ব্রাহ্মণদের ওই চাল দিয়ে দেওয়া হোত।তারা ওই চাল রোদে শুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতেন।আমার জন্মের এক যুগ আগে ঘোষেদের বাড়ির পুজোয় ছাগ-মেষ-মোষ বলি হোত।বাংলার উনপঞ্চাশ সালের(১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ)ঝড়ের পর সে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়।আমার ঠাকুমার কাছে শোনা পুজোর সময়ের ওই ঝড়ে পূর্ব মেদিনীপুরের সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল।আমাদের পুরানো বাড়ির উঠোনে বেশকিছু বেতের ধামা আর বড়ো বড়ো মাছ ভেসে এসেছিল আর ভেসে এসেছিল মানুষের হাহাকার।“ম্যান-মেড ফেমিনের” আর্ত চিৎকার।

আজও বাংলায় পুজো মানেই শহরে উল্লাস আর এখানে ওখানে বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের হাহাকার রব।

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
মন খেরোর খাতাকে কয়েক দিন ধরে লিখছিলাম “মন খারাপের খাতা”।লেখার সংগত কারণ ছিল।কিছুদিন ধরেই আকাশে-মাটিতে যা উল্লাস দেখছিলাম।ফসল কাটা আর ফসল তোলার গান শুনছিলাম অথচ এখনও বরষা বিদায় নেয়নি।এর মধ্যে কতো বিশেষ(অ)জ্ঞ দের একতারা-দোতারার মতো করেই তিন ফসল-চার ফসলের মতামত আর আলোচনা শুনে ভুল করে ঠিক আলোয় চোনা ফেলে দিচ্ছিলাম।এর মধ্যে কে যেন মনের শততন্ত্রী বীণায় ঝংকার দিয়ে গেয়ে উঠলেন-“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/সেই তো তোমার আলো/সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/সেই তো তোমার ভালো!”
আমার চেতনায় বারে বারে ঘা দেন রবীন্দ্রনাথ।আমার গোপন ঘরে উঁকি দেন ভবঘুরে হো-চি-মিন।আমার বিভ্রান্তি কালে আলো জ্বালে “দ্বন্দ্ব্মূলক বস্তুবাদ”।আমার প্রেমে ফিরে ফিরে আসেন কবি মাওৎ-সে-তুং।আমার কলমের নিবে ধার দেন বারটোল্ট ব্রেক্ষট।আমার অক্ষম কন্ঠে ভর করেন জর্জ বিশ্বাস আর হেমাংগ বিশ্বাস,সুচিত্রা মিত্র আর সলিল চৌধুরি।আমার দিন যাপনে সংগে থাকেন লালন ফকির আর মির্জা গালিব।আমি মুক্তি খুঁজিনি উপনিষদে,যদিও সুপ্তি থেকে জেগে উঠি।‘বোকা বুড়োর গল্প’ আমাকে আশা জাগায়।তথাগত আমাকে ক্ষমাশীল হোতে সাহায্য করেন।আমাকে খেপিয়ে তোলেন চৈতন্য।আমাকে জাগিয়ে রাখেন চারণকবি মুকুন্দদাস।আমাকে সুর শোনান চাইকভস্কি, রবিশঙ্কর।আমার চিত্তে নৃ্ত্য করেন উদয়শঙ্কর।আমার শিক্ষায় লোকায়ত সুরে জাগে “মৈমনসিংহ গীতিকা”।
সম্প্রতি আকাশবাণী দুই-বাংলার সুর আর সংস্কৃতিকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করার যে উদ্যোগ নিয়ে “মৈত্রী চ্যানেল” এর সম্প্রচার শুরু করার সংগে সংগেই বিপুল সাড়া জেগেছে তা আশা জাগাচ্ছে।সেই কোন শৈশব থেকে খেলার পুতুলকে পাশে নিয়ে শোবার মতো করে রেডিয়ো আমাদের সংগী ছিল।তার প্রচারিত সংবাদ,নাটক,গান আর খেলার ধারা-বিবরণী আমরা চোখ বুজে কান খুলে দেখতাম।নিশুত রাতে পাশ্চাত্য সংগীত,সিম্ফনি আর ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের “লাইভ ব্রডকাস্ট” আমাকে ঘুমোতে দিত না।আমি জেগে থাকতাম সারা রাত।আমি জেগে আছি আজও।
আকাশবাণীতে নাটক লিখছি বহুদিন।এবার আমার ভাই-বন্ধু আশিস গিরি আর সুব্রত মজুমদার আমার কাঁধে আরও গুরু দায়িত্ব চাপিয়েছে।কতোকাল আগে পড়া গীতিকাগুলি নিয়ে এবার বেতার নাট্যরূপ দিতে আমার ডাক পড়েছে।আমিও সানন্দে রাজি হয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছি।আর এ ব্যাপারে একটি আপ্তবাক্য আমাকে খুব সাহস জুগিয়েছে।“জিধর বুজুর্গ পাও নেহি রাখ সকতে,মূরখ্ ঝট সে পাও রাখ দেতে!” বাংলা করলে এই রকম দাঁড়ায় – “যেখানে বিজ্ঞরা পা ফেলতে সাহস পান না,সেখানে মূর্খ মুহুর্তে পা ফ্যালে!”
এই যে সব লিখলাম এ সবই “ধান ভাণতে শিবের গীত”।কিছুদিন ধরেই মনের কথা গুলো মনের মধ্যে চেপে না রেখে,চায়ের কাপে তুফান না তুলে ফেসবুকে লিখছিলাম।সে সব পড়ার লোকজনও দেখলাম আছেন।তারা পড়েন,পছন্দ করেন আর কেউ কেউ মতামত দেন।আর আমার শান্তিনিকেতনের সাংবাদিক বন্ধুরা বিশেষ করে স্নেহাশিস আর মহেন্দ্র ওগুলোকে ব্লগের বাক্সে ভরার পরামর্শ দিল।আমিও জুন মাস থেকে ব্লগ শুরু করলাম।এই চার মাসে আমার ব্লগ ভিজিট করেছেন হাজারের বেশি মানুষ।আমি ভাবতেও পারিনি।আশার কথা আমার লেখার পাঠিকা-পাঠক যেমন ভুবন ডাঙাতে আছে,পারুল ডাঙাতেও আছে।আবার এই দুই ডাঙা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন।সর্বশেষ পরিসংখ্যান এই রকম –
India
633
United States
239
France
74
Bangladesh
27
Australia
2
United Kingdom
2
United Arab Emirates
1
Chile
1
China
1
Germany
1
আচ্ছা এরা যে সবাই ভারতীয় নয় সে তো বোঝাই যায় কিন্তু বাংগালিও নয়?তাও নয় সবাই।তবে বাংলাটা পড়তে পারেন তারা।অনেকে আবার নিজের নিজের ভাষায় অনুবাদ করে পড়ছেন।তা হোলে আমার কী করা উচিত?আরও লিখে যাওয়া?যেমন করে আমার পেশা আমার নেশা নাট্য কলা।

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আমার ভিকিরিপতি গ্রাম থেকে সাগর উপ সাগর কিছু মাইল দূরে।লক্ষ যোজন দূরে নয়।রূপনারায়ণ আর ইতিহাসের তাম্রলিপ্ত বন্দর চার মাইলের মধ্যে।হলদি নদি, কংসাবতী,কেলেঘাই,দামোদর এরা এদিকে ওদিকে গা এলিয়ে রয়েছে।আর বাংলা উপ-সাগর আরও কিছু মাইল দূরে।
কিশোরবেলায় আমরা যখন সমুদ্র দেখতে দীঘায় যেতাম তখন দু-দুটো নদি কিছুটা নৌকায় আর কিছুটা পায়ে হেঁটে পেরোতে হোত।নরঘাটের ব্রীজ তখন তৈরির কাজ চলছে।যতবার পিলার তোলা হয় ততবারই সেগুলো হয় হেলে যায়,নয় ভেঙে যায় জলের তোড়ে।আর আমরাও কাদা ছপ ছপিয়ে যেতে যেতে ওই হেলে পড়া থাম দেখি।তখন কলকাতা বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে যারা দীঘায় যেতেন তাদের খড়্গপুর হয়ে যেতে হোত।ওটা অনেক ঘুর পথ ছিল।তখন কেউ তাজপুর,মন্দারমনি,জুনপুট,তালসানি এসব জায়গায় ভ্রমণে যেত না।এদিকে বকখালি,ফ্রেজারগঞ্জ এসব জায়গায় মাছের কারবার চলত।হেনরি আইল্যান্ড,মৌসুমী দ্বীপ এসব জায়গাতেও।কালে কালে সব ভ্রমণ ক্ষেত্র হয়ে গেল।এটা বেশ ভালো।এক জায়গায় ঠাসাঠাসি আর গুঁতোগুঁতি করার চেয়ে নানা জায়গায় ইচ্ছে মতন ঘোরো।যদিও ঘোরার নামে ঠেসে কারণবারি পান করে সমুদ্রে স্নানে নামা আর তার পরিণতিতে সাগরে তলিয়ে যাওয়া এটা এখন বেশ রেওয়াজ হয়েছে।
ঘুরতে ঘুরতেই আমার সিনেমার কাজেও সাগর খুব টানে।যখন মাধবী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে "ঝরা পাতার বেলা" করেছি তখন দক্ষিণেশ্বর-এর গঙ্গা থেকে চলে গেছি দীঘা-নিউদিঘা ছাড়িয়ে উড়িষ্যার জলেশ্বরে।আবার "লিটল মারমেড" করার সময় বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, হেনরি আইল্যান্ড ছুটে বেড়িয়েছি।বিজ্ঞাপনের কাজে মন্দারমনিকে
আমার জুতসই মনে হয়েছিল।তথ্যচিত্রের কাজ করতে শংকরপুরের সমুদ্রতটকেই উপযুক্ত লেগেছিল।ওই লাল কাঁকড়ায় ভরে থাকা তট।"লিটল মারমেড" করার সময় বকখালিতেও অনেক লাল কাঁকড়া পেয়েছিলাম।ওখানকার স্থানীয় ছেলেরা বোতলে জল নিয়ে কী দ্রুত কাঁকড়াগুলোকে তুলে আনে ওপরে।
কাজের সময় কাজ ছাড়া আলাদা করে সমুদ্রকে দেখার অবকাশ থাকে না।তাই যেবার কক্সবাজারে গিয়েছিলাম সেবার সমুদ্রকে দেখেছিলাম প্রাণভরে।যদিও চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম নাটকের কাজেই।অভিজিৎ সেনগুপ্ত নিয়ে গিয়েছিল এবাংলা থেকে আমাকে আর নাট্যকার চন্দন সেন কে আর ঢাকা থেকে রামেন্দু মজুমদার কে।যেদিন শুনেছিলাম চট্টগ্রামের লোকেরা জাহাজ কেনা বেচার কারবার করে বেশ মজা পেয়েছিলাম।আমি নাটকের ব্যপারী হোলেও এই জাহাজের কারবারটায় বেশ মজা পেয়েছিলাম।
বাংলাদেশের কথা উঠলেই আমার কলমকে লাগাম দেওয়া শক্ত কাজ হয়ে ওঠে।একবার চলচ্চিত্রের কাজে ঢাকা থেকে বিক্রমপুরে গিয়ে কয়েক রাত কাটিয়েছিলাম।সেবার হাবিবভাইয়ের জেদ চাপল আমাকে বিক্রমপুরের বাড়ির থেকেই (আক্ষরিক ভাবেই) নৌকায় চাপিয়ে পদ্মার মাঝ দরিয়ায় নিয়ে যাওয়ার।তখন বরষা কাল।পদ্মা পানিতে ভরপুর।আকাশ ছিল জ্যোৎস্নায় ভরা।মাঝিরা ডাকাতির ভয়ে ওই রাতে যেতে রাজি হোলো না।অগত্যা বেরুলাম ভোরে।বাড়ির উঠোন থেকে নৌকায় চেপে এর বাড়ি ওর বাড়ির উঠোন পেরিয়ে এর ক্ষেত ওর আম বাগানের ভেতর দিয়ে,আখের ক্ষেতের ঝোপ পেরিয়ে পড়েছিলাম মাঝ পদ্মায়।সে এক পরম বিস্ময়!
সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়।পদ্মা কিন্তু কিছূই ফেরায় না।শুধু গ্রাস করে।গংগায় জোয়ার ভাটা আছে।পদ্মায় শুধুই যাওয়া।তবু ফিরে আসতে হয় উজান বেয়ে।
এটা বকখালির ছবি।শুটিং য়ের সময় তুলেছিল সৌমালি চৌধুরি।কী আশ্চর্য সৌমালি এখন বাংলাদেশে।

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
পাবলো নেরুদার দেশ থেকে এসেছিল সেই ছেলেটি ২০১০ এর দীপাবলীর রাত্রে আমাদের বাগুইআটির বাসায়।ওকে নিয়ে এসেছিল সুদীপ্তা-অরূপ।সুদীপ্তা-অরূপ আমার সংগে জুটেছিল কর্মসূত্রে।তারপর সেই কর্ম থেকে কবে যে তারা আমার অকর্মের পারিবারিক মর্মস্থানে বাসা বেঁধে ফেলেছে নিজেরাও কী জানে?আমি তো জানিই না।তবে এটা জানি ওরা হোলো সেই শ্রেণীর যারা নিজেরা দুপায়ে সরষের পুটুলি বেঁধে ওদের গোত্রের বাকিদেরও পায়ের তলায় সরষে ছড়িয়ে রাখে যাতে তারাও সুস্থির না থাকে।আর গোলা পায়রা যেমন দল(কমিউনিটি)ভারী করতে এবাড়ি ওবাড়ির পোষা পায়রাদেরও জুটিয়ে আনে।ওরা দুজন হোলো সেই জুটি।নিজেরা সুস্থির থাকে না।অন্যদেরও অস্থির করে তোলে।ফলে তারাই যে দীপাবলীর রাত্রে আর একটি ভবঘুরেকে জুটিয়ে আনবে এতে খুব একটা আশ্চর্য হইনি সেদিন কিন্তু সেই ভবঘুরেটি যে আমার প্রিয় কবির দেশের ছেলে আর এদেশে এসেছে ভারতীয় ভাষা আর সংগীত শিখতে এটা শুনেই আমি পরাস্ত।এসেই পরিস্কার বাংলায় বল্ল-“সোলিল আমার নাম ইভান ভিক্তর জদ্রেসিক অগুইলা”!না,আমি এতেই ইভানের প্রেমে পড়ে যাইনি বা আমার বাড়ির জামাই করার কথা ভাবিনি।এদেশে এসে এরকম বাংলা-হিন্দি প্রায় সবাই বলতে পারে।আমাদের দেশের বাড়িতে অনেক বিদেশি আসতআর সত্তরের কলকাতায় হিপিরা দাপিয়ে বেড়াত।রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের সংগে অনেক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়ত।মুগ্ধ হয়েছিলাম ওর কিছু আচার ও আচরনে।ও এদেশে এসেছিল সেতার শিখতে।যদিও ও নিজে বাঁশি বাজাতে জানে,গীটার বাজিয়ে স্প্যানিশ গান করে।ইভান কোনও রকম নেশা করে না।আর নিরামিষাশী।ইভানের ব্যবহার অতি চমৎকার।বাংলা শেখার আপ্রাণ চেষ্টা।সুদীপ্তা-অরূপের সংগে ও নিজেই নিজেকে জুটিয়েছিল হিমালয় পাহাড়ের কোলে।
সেই দীপাবলীর রাত্রে ইভান আমাদের বাড়িতে নিরামিষ নৈশভোজ সারল আমরা বাকিরা যখন মাংসাশী প্রাণীর মতো হাড় চিবুচ্ছি।তার পর যখন তার কানে এলো পাড়ার কালীপুজোর তাসা পার্টির “কুড় কুড় কুড় কুড়”বাজনা ও আর থাকতে না পেরে জুটে গেল তাদের সংগে।শুরু হোলো ইভানকে ঘিরে উদ্দাম নাচ।ফেরার সময় বল্ল-“সখা আবার আসব!”
সেই যে ইভান এ বাড়িতে এলো তার পর সে যে কতোবার কত কারণে অকারণে এসেছে তার হিসেব রাখিনি।মধ্যমগ্রামের ডেরা থেকে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এসেছে আমাদের বাসায়।আমাদের সংগে এক টেবিলে রুটি-চাটনি-আচার যেমন খেয়েছে আবার আমার হাতে তৈরি পাস্তা খেয়েও আপ্লুত হয়েছে।দেশে ফেরার সময় নিয়ে গেছে অপর্ণার হাতে তৈরি আচার-চাটনি-কাসুন্দি আর গুড়ের বাতাসা।
ইভান ফিরে এলো একবছর পরে।এর মধ্যে ‘ফেসবুকে’ আর মেইলে কথা হয়েছে কখনও সখনও।এসেই আমাকে হণ্যে হয়ে খুঁজছে।কারণটা কী?ওর এক বান্ধবীর আমার কথা শুনে আর ছবি দেখে মনে হয়েছে আমি না কি মেয়েটির আগের জন্মের দাদু(তখন কিন্তু আমার এমন পাকাচুল-গোঁফ-দাড়ির জংগল ছিল না)আর মেয়েটি না কি সেই জন্মে ছিল ভারতীয়।এ জন্মে মেয়েটির নাম ‘ফুন্সুক দোল্মা দেচেন পামো’।আমাকে ইভানের হণ্যে হয়ে খোঁজার কারণ পামো আমার জন্যে চিলির পাহাড়ের টুকরো,চিলির মূদ্রা,বৌদ্ধ স্মারক এইসব পাঠিয়েছে।আর পামো একদিন এই বাংলায় এসে আমার সংগে কয়েকটা দিন কাটাবে।এই কথায় আমাদের একটু কেমন লাগে কিন্তু ওদের দেশে ওরা সম্পর্কগুলোকে খুব খোলা চোখে দেখতেই অভ্যস্ত।
কিছুদিন আগে ইভান বিয়ে করেছে মায়াকে।না,মায়া কোনও ভারতীয় মেয়ে নয়।মায়া চেক।মায়া চাকরি করে সংসার চালায়।আর ইভান দেশে দেশে ঘরে ঘরে গান ফেরি করে বেড়ায়।

আজ ইভানের জন্মদিন।আমি ওকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।আমি জানি ইভান একদিন মায়াকে নিয়ে আসবে এই বাংলার মায়ায়।

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মন খেরোর খাতা
তখন এখানে সেখানে,আদাড়ে-বাদাড়ে,শহরে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই সিনেমার কাজে।রাজা সেন আর আমি চিত্রনাট্য(কিছু হাতে লেখা,কিছু মগজে রাখা)নিয়ে সকাল থেকে রাজার গাড়িতে তেল ভরে ঘুরে বেড়াতাম।সেবার মহাশ্বেতাদির 'ঘাতকের মা' নিয়ে কাজ করছি।চলচ্চিত্রের নাম রাখা হোলো 'চক্রব্যুহ'।সকাল সকাল আমি পৌঁছে গেলাম রাজার বাড়ি।সেখান থেকে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম লোকেশন দেখতে।ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম শ্রীরামপুর।শ্রীরামপুর রাজবাড়ির ওখানে থাকত আমাদের পরিচিত একজন অভিনেত্রী।সে আমাদের পেয়ে পুলকিত চিত্তে বেদম খাইয়ে(স্বহস্তে তৈরি খাবার)ছাড়ল।রাজা খুব খেতে ভালোবাসে।আর সবাই ওকে খাইয়ে মজাও পায়।পেট ঠুসে খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ি থেকে চলে এলাম কোঠিবাড়িতে।রেল লাইনের ধারে।দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার আর লখনৌ এর ভুল্ভুলাইয়ার থেকেও জটিল অলি গলি।চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে আমাদের দরকার ছিল একটি শহরতলির যৌনপল্লী।ওই ভরদুপুরে আমরা ঢুকে পড়লাম।না,আমাদের সংগে কোনও দালাল ছিল না।স্থানীয় মানুষও নয়।রাজা খুব ডাকাবুকো।ঢুকেই এদিকে ওদিকে উঁকি দিচ্ছে।আমি ভয়ে ভয়ে পিছনে পিছনে।এর আগে বিডন স্ট্রিটের পাশে নীলমনি মিত্র স্ট্রিটে নাটকের রিহারসাল দিতে দিন রাত পড়ে থাকতাম।ওদের মেজাজ মর্জি জানি।আমাকে অবাক করে ওই দুপুরে চুলের গোড়ায় তেল দিতে দিতে এক প্রৌঢ়া এক যুবতীকে বল্ল-"আরে খদ্দের নয়।শ্যুটিং পার্টি!"আমি সেদিন বুঝেছিলাম এরাই ঠিক ঠাক মানুষ চেনে।
আর একবার গেলাম মানে যেতে হোল টাটা ইস্পাত নগরী পেরিয়ে দলমা পাহাড়ে।তখন ওখানে থাকে হাতির দল আর চোরাকারবারী,পরিযায়ী পাখি আর সশস্ত্র মানুষজন।সারাক্ষণ জ্যামার লাগানো।ছিলাম আমি আর কান্তি(অভিনেতা-পরিচালক শ্রদ্ধেয় দিলীপ রায়ের ভাইপো)আর তার ছেলে পাপু আর রামুদার শ্যালক উজ্জ্বল।আমরা থাকতাম পাহাড়টার তলায় হাইওয়ের পাশে একটা রিসর্টে।
পাহাড়তলীতে থাকে ভূমিকন্যা ও ভূমিপুত্ররা।তারা দিন বদলের কোনও সংবাদ পায়নি।প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে না ফিরলে রাতে চুলায় হাঁড়ি চড়ে না।
তারা 'স্টোন ক্রাসারে' কাজ করে।তারা 'স্পঞ্জ আয়রনের' গ ন গ নে আগুনে চুটা ধরায়।আবার তারাই বাড়ি ফিরে মাল টেনে মাদলে তাল তোলে।
একদিন জ্যোৎস্নারাতে খুব ঝুঁকি নিয়ে চলে গেলাম তাদের ডেরায়।অন্ধকারে কূপীও জ্বলছে না কেরোসিনের অভাবে কিন্তু প্রাণশক্তির অভাব নেই।
উঠোনের কাঠের চুলায় মাটির হাঁড়ির ভাতের গন্ধ আর মহুয়ার ঘ্রাণ স্পঞ্জ আয়রনের কালো ছাই মিশে চাঁদটাকে ফ্যাকাশে বিবসনা করে দিয়েছে।খুঁটিতে বাঁধা গাধাগুলোকে মনে হচ্ছে মহীনের ঘোড়া।আর ছাগল্গুলো বড়ো বড়ো বৃষ্টির দানার মতো বিষ্ঠা ছড়াচ্ছে অবিরাম।
বাচ্চাগুলো ক্ষিদে তেষ্টায় কেঁদে উঠলে মা আগুনের পাশ থেকে উঠে আগুনেই ফিরে এসে মুখে গুঁজে দিচ্ছে শুকনো বুক।অন্ধকারে থেকে থেকে আগুনের শিখায় সে দৃশ্য মনে হচ্ছিল সোমনাথ হোড় আড়ালে বসে 'তেভাগার ডায়েরী'র স্কেচ করছেন।না ইচ্ছে করেই তখন কোনও ছবি তুলিনি।ছবি তুলেছি ল্যাংটো রোদের মাধুকরী ধূলায়।
চলচ্চিত্রের নাম ছিলঃরক্তকরবী।ঠিক ধরেছেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ আমার হোলেও পরিচালক ছিলেন বন্ধু সুকান্ত রায়।প্রযোজক ছায়াবাণী আর কাহিনি?অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

হেমন্তের ডাক পিওন ফ্লিপকার্ট,স্ন্যাপডিল,আমাজন ডট কম
(মন খারাপের খাতা)
সলিল সরকার
আমাকে বসিয়ে রেখে ওরা বেরিয়ে গেল।হলদিয়া যাওয়ার বাস ধরবে বলে।ওরা মানে তিথিপর্ণা আর অপর্ণা।এই ঈদের ছুটিতেও নিস্তার নেই।কাল সকাল থেকেই কলেজের ক্লাস।পড়াশোনার চাপ।ছুটির আনন্দ কাকে বলে ওরা জানে না।ছোটাছুটির বিড়ম্বনা ওরা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে।আর আমাকে বাসায় বসিয়ে রেখে গেছে স্ন্যাপডিল-এ কিছু একটা আসবে বলে।আমাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে কখন সে আসবে।তার পিঠে থাকবে হ্যাভারস্যাক,হাতে থাকবে স্মার্টফোন,মাথায় থাকবে হেলমেট।আর আমার হাতে থাকবে ঠিকঠাক খুচরো টাকা আর পয়সা।নেবে আর দেবে তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে।
আমার এই অপেক্ষা করাটা খারাপ লাগে না।ছোটোবেলা থেকে কতোদিন অপেক্ষা করেছি কতোকিছুর জন্যে।কতো প্রতীক্ষায় থেকেছি।কখনও আশ মিটেছে।কখনও হতাশা।আমাদের ছিল ডাকঘর পোস্টঅফিস বা পোস্টাপিস।ছিল ডাকপিওন বা পোস্টম্যান।সে আসত সাইকেলে চড়ে।এক কাঁধে থাকত খাঁকি ডাকব্যাগ আর হাতে থাকত গোছা গোছা চিঠি।দূর থেকে সাইকেলের ঘন্টি শুনলেই বুঝতে পারতাম ডাকপিওন আসছে।ঘন্টি তো সবাই বাজায়।তার পরেও কী করে বুঝতে পারতাম কোনটা কার সাইকেলের ঘন্টি?এটা বোঝানো মুশকিল!যখন ল্যান্ডফোনে কলার ছিল না।কালো টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং সাউন্ড শুনে কী করে বুঝতাম এটা ভালো খবরের ফোন কল না কি খারাপ খবরের কি খারাপ লোকের রং নাম্বার!
ভোরের টেলিফোন আর মাঝরাতের টেলিফোন মানেই ধরে নিতে হবে খুব খারাপ কোনও খবর কিম্বা বেশ ভালো কোনও সংবাদ!একটানা ক্রিং ক্রিং সাউন্ড মানেই ট্রাংককল।তারও আগে মহিলা অপারেটর ফোন করে বলতেন “লাইনটা ধরে থাকুন। ট্রাংক কল আছে!”দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে হোত।খারাপ খবর হোলে অপারেটরের কন্ঠস্বর শুনেই কী করে যে বুঝতাম!ভালো খবর হোলে মহিলা কী মিহি সুরে বলতেন-“ফোনটা ধরে থাকুন।ছাড়বেন না!”কখনও কখনও বার বার কেটে যেত লাইন।আবার ফিরে ফিরে আসত।নানা সময়ের মহিলা অপারেটরের নানান ব্যবহার সে এক অপূর্ব কল্পনার বিলাস।এই নিয়ে এক কালে রেডিয়োয় নাটকও লেখা হয়েছে।কিন্তু ডাকপিওন তো পালটে পালটে যেত না।মহিলাও হোত না।তবু তার অপেক্ষায় থাকতাম
কেন না তার হাতের খামে আর থলির ভিতরে থাকত হাজার রহস্য।পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড,এনভেলপ,বুক পোস্ট,বিদেশের চিঠি আর দেশি-বিদেশি জার্নাল।আর বড়োদের থাকত মানি অর্ডার।ডাকপিওন টাকাটা দিয়ে উত্তর লিখিয়ে নিয়ে ঘন্টি বাজিয়ে চলে যেত।শুধু কোনও পার্সেল এলে কি রেজিস্ট্রি চিঠি এলে খোলা অব্দি অপেক্ষা করত বখশিসের আশায়।নিদেন পক্ষে জল-মিষ্টি।কিছু না হোক জল-বাতাসা।কী পরম তৃপ্তিতে সেই জল পান করে,গাছের ছায়ায় কি বৈঠকখানার দাওয়ায় সামান্য জিরিয়ে আবার সাইকেল চালিয়ে হারিয়ে যেত মোরামের রাস্তায়।পাশের খবর এলে কি চাকরির জয়েনিং লেটার এলে বাড়ির লোকের সংগে ডাকপিওনও খুসিতে আপ্লুত হোত।আর শোক সংবাদ এলে বিশদ জেনে নিয়ে ফিরে যেত নিজের ডিউটিতে।তখন অনেক বেশি অবকাশ আর অবসর ছিল?না কি আন্তরিকতা ছিল?আত্মীয়তা বোধটা তখনও ক্রিয়াশীল ছিল?
এখন স্ন্যাপডিল কি ফ্লিপকার্ট-এর যুবক(কোনও যুবতীকে কখনও দেখিনি করিনা কাপুরের মতো হেলমেট মাথায় ডোর বেল বাজাতে)ঘামের গন্ধ ঢাকতে চড়া সেন্ট মেখে আসে।স্মার্টফোন এগিয়ে দেয় সই করার জন্যে।টাকাটা গুনে গুনে নিয়ে এক টাকা ফেরত দেবার হোলে সেটাও ফেরত দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নির্বিকার চিত্তে নেমে যায় পরের কোনও বাড়ির ডোরবেল বাজাবে বলে।
লেখাটা লিখতে লিখতেই ডোরবেল বাজল।দরজা খুলতেই স্ন্যাপডিল-এর ঘেমো যুবক ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে টাকাটা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল ছোট্ট একটা বাক্স।সেটা খুলতেই দেখলাম তার ভেতরে আছে এক সেন্টিমিটার মাপের একটা “স্মৃতি আধার”(মেমরি কার্ড)যার ধারণ ক্ষমতা ১৬গিগা বাইট।
হায়!স্মৃতি কী সংকুচিত হোয়ে এসেছে!



শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বেল পাকলে কাকের কী?
সলিল সরকার
সুকুমার রায় সেই কবেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুষিয়ে দিয়েছিলেন – ন্যাড়া “বেল” তলাতে যায় কিন্তু দিনের মধ্যে কতবার?পরে নিজেই তার উত্তরটাও দিয়ে দিয়েছিলেন সে কথায় পরে আসছি।এখন প্রশ্ন হোলো “কাক কী কাকের মাংস খায়?”সবাই জানেন না।কিন্তু এদেশের কাক কয়েক দিন আগে খেতে শুরু করেছিল।তাই দেখে আমরা যার পর নাই বিব্রত ও বিস্মিত!
কথায় বলে “চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই”।এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যপারটা এখন আর নেই।এখন চোরে চোরে ভাই-বোনও হয়।কী বল্লেন হয় না?হয় হয় Zনতি পারেন না।কতো ভুল যে আজও চলছে!সবাই বলে “চোরের মায়ের বড়ো গলা”!কেন রে বাবা(থুড়ি মা)চোরের কি দিদি বোন থাকতে নেই?চোরের দিদিরও তো গলা বড়ো হোতে পারে?
কবিরা না কি সত্যদ্রষ্টা হন?গুরুদেব তার গীতিনাট্যে কবেই চ্যাঁচালেন – ঐ চোর,ওই চোর বলে!কিন্তু কে চুরি করেছিল আর কে ধরা পড়েছিল?কে জেল খেটেছিল?কে “বেল” পেয়েছিল?এই যাহ আবার সেই বেলের কথায় এসে পড়লাম?
আগে গাছে থরে থরে পাকা বেল ঝুলত।মাটিতে পড়লে তবেই কুড়োত।এখন কাউকে ঝুলিয়ে রাখলে লোকে রেগেমেগে বলে-“খামোকা লোকটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে কেন?কাকে যদি খেয়ে নেয়?” তার মানে কাকেও এখন পাকা বেলের সরবত খাচ্ছে?
লোকে বলে-‘পচা ভাদ্র!’কোন পচা বলে রে?ভাদ্রেও ধান পাকে।বেল পাকে।সিদ্ধিদাতা গণেশ সিদ্ধি পানের ব্যবস্থা করেন।এর পর বিশ্বকর্মা পুজো আসছে।শ্রমিক-মজুর শ্রেণী তাকে আজকাল বিশ্বকর্মা না বলে নিঃস্ব-অকর্মা বলছে গায়ের জ্বালায়।শিল্প নেই তো কী?আমাদের আশে পাশে শিল্পীর কী অভাব ঘটিয়াছে?পেশাগত পোষ্য শিল্পীরা “উন্নয়ন”, “উন্নয়ন” বলিয়া ধামসা-মাদল ও নিজ ঢাক পেটাইতেছেন না?সদ্য বেল পাকাতে তারাও তেলে সলতে পাকাতে শুরু করেছেন।
আর আশ্বিনের শারদপ্রাতে আসার আগেই ঢাকে কাঠি পড়ল।‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া!’আবার বেল?কেন ঘড়িয়ালরা গেল কোথায়?তেলে ব্যস্ত?না জলে?
সবাই জানে “তেলে-জলে মিশ খায় না” এখন থেকে সবাই শিখবে “জেলে-বেলে”ও মিশ খায় না।কতো চোরই তো জেল খাটে কিন্তু সবাই কি বেল পায়?না বেল খায়?
আবার ফিরে আসি সুকুমার রায়ে.........ন্যাড়া বেল তলাতে নিদেন পক্ষে পঁচিশবার যায়।সবে একবার হোল।এখনও চব্বিশবার বাকি।

বিশেষ ভ্রমঃ নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একবার ফেসবুকে ‘প্ল্যানচেট’ নিয়ে লেখার পর পাড়ার কয়েকজন চুয়াড় জুয়ার আড্ডা ছেড়ে প্ল্যানচেটে বসেছিল।সেখানে কয়েকজন চিটফান্ডে টাকা খুইয়ে আত্মহত্যাকারী ভূত নেমে এইসব লিখে গেছে।তারই প্রতিলিপি পড়েছিল ডেংগুর আস্তানায়।ব্লিচিং দিয়ে সাফ করে সেটাই তুলে দেওয়া হোলো মন খারাপের খাতায়।

সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

শিক্ষা গুরু...দীক্ষা গুরু
TARAWOHOPI HI JIBANTI
JIBANTI MRIGAPOKSHINO
SA JIBATI MANO YASSYO
MANANENO HI JIBATI.
এই বিশ্ব-জগতে সব প্রাণীই প্রাণ ধারণ করে।কিন্তু একমাত্র সেই জীবিত যিনি মান-যশ ও আপন আত্মাভিমানে বাঁচেন।
শৈশবে দেশের বাড়ির বৈঠকখানায় মায়ের হাতে তৈরি রেশমী সুতোর সূচীশিল্পে একটা ফ্রেম টাঙানো ছিল যেখানে ফুল-পাতা মাঝে রেখে লেখা ছিল “শাসন করা তারই সাজে/সোহাগ করে যে”।এই দুটো কথারই অর্থ বুঝতাম না সেই বয়সে।শুধু কোনও মা তার ছেলেকে মারলে বা বকুনি দিলে জ্যাঠাবাবু ফ্রেমটা পেড়ে সবার সামনে রেখে দিতেন।সেই মা লজ্জায় আর সেই কাজ করতেন না।আর জ্যাঠাবাবুই এই শ্লোকটি আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়েছিলেন যার অর্থ সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি এই বয়সের প্রতি পদক্ষেপেই।
শিক্ষক অনেক প্রকারের হন।বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথাই সবাই আজ উচ্চারণ করবেন।তাদের কথায় আসব,তবে আমার প্রথম ও যথার্থ শিক্ষক ছিলে আমার জ্যাঠাবাবু প্রয়াত দুর্গাচরণ সরকার।এবং আমি এই অনুভবে গর্ব বোধ করি তিনি তার যৌবন কালে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণননের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।আর আমি শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষক জ্যাঠাবাবুর কাছে যিনি জাতীয় শিক্ষক রাধাকৃষ্ণনন,রবীন্দ্রনাথ,চিত্তরঞ্জন,সুভাসচন্দ্র প্রমুখদের কাছ থেকে দেখেছেন,বক্তৃতা শুনেছেন,অথিক গুরু,পথিক গুরুর কাছেও শিক্ষা গ্রহণে বঞ্চিত হননি। জ্যাঠাবাবু যখন উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন “সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি,তারায় তারায় খচিত” বা “এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর” আমি তখন ভাবতাম আমি ভাগ্যবান কেন না আমি এমন একজন শিক্ষক পেয়েছি।আজ শিক্ষক দিবসে আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জ্যাঠাবাবু।
আমার অক্ষর জ্ঞান বাড়িতে হলেও প্রাথমিক শিক্ষা লাভ মন্মথ প্রাথমিক বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে। আগেও লিখেছি আমাদের স্কুল জীবন আমাদেরই সরকার বংশের নির্মিত প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।প্রাইমারি স্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ির বাগানের গড়খাইয়ের ওপারে।সারাবছর আমরা স্কুলে যেতাম হাতে স্লেট-পেন্সিল আর বই-খাতা নিয়ে পায়ে হেঁটে। গ্রীষ্মকালে স্কুলে যেতাম শুকিয়ে যাওয়া গড়খাই পেরিয়ে।আজকের ভাষায় ‘স্কুল বাংক’ করার কোনও অবসর ও অবকাশ ছিল না।বাড়ির বৈঠকখানা থেকেই আমাদের কীর্তিকলাপ দেখা যেত।আমাদের ব্যাপারে শিক্ষকদের কোনও অভিযোগ কি প্রশস্তি থাকলে খালের জলের এপার-ওপারেই আদান-প্রদানে কোনও বাধা ছিল না।বাধা ছিল না প্রকাশ্য শাসন কি বেত্রাঘাতেও।যে কোনও কারণেই আমাকে অফিসঘর থেকে বেত ও চক-ডাস্টার আনতে হোত ক্ষয়ে আসা চকও ক্লাস শেষে পেতাম কিন্তু বেতের ঘা পেতাম না।আজ আমার কবুল করতে লজ্জা নেই আমিও কোন দিন আমার কোনও ছাত্র-ছাত্রীকে অপমান কি অসম্মান করিনি।এ কথা কবুলেও লজ্জা নেই কেউ কেউ অপমান অসম্মান করেছে কারও না কারও প্ররোচনায় আবার পরে লজ্জায় মাথা হেঁট করে ক্ষমা চাইতে এসেছে।আমি তাদের অনেক আগেই ক্ষমা করেছি।শুধু ক্ষমা করতে পারি না সেই সব শিক্ষকদের যারা এইসব অজ্ঞানী ছাত্র-ছাত্রীদের প্ররোচিত করেন স্থূল স্বার্থে ও আত্ম অন্তঃসার শূন্যতাকে চাপা দেবার চেষ্টায়।এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ“আশ্রমের রূপ ও বিকাশ” পুস্তকে অতি চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন।
প্রাইমারি স্কুলে আমার যে শিক্ষকগণ ছিলেন তাদের মধ্যে দুজনের কথা আমার আজও মনে আছে।হেডমাস্টারমশায়ের নাম ছিল নীরেন কোলা আর একজন ছিলেন অন্নদাবাবু।নীরেনবাবু ছিলেন ধীর-স্থির আর অন্নদাবাবু ছিলেন ত্রাস।‘জলদ গম্ভীর’ শব্দটি শিখে ছিলাম ওনার কাছেই আর ওনার কণ্ঠও ছিল তাই।আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে পড়াশোনায় ভালো ছিল কিন্তু দোষের মধ্যে পড়া বলতে গেলেই তোতলাতো।একদিন অন্নদাবাবু তাকে কাছে ডেকে তার হাত থেকেই দু-দুটো পেন্সিল নিলেন।তাকে জিভ বের করতে বল্লেন।এবার জিভের উপর-নীচে পেন্সিল রেখে চাপ দিয়ে জিভটা টান দিলেন।আমরা শিউরে উঠলাম।ছেলেটি একটু ধাতস্থ হতেই দেখলাম তার উচ্চারণ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এ যেমন দেখেছি আবার এও সত্যি তার মার খেয়ে অনেক ছেলেই মানুষ হবার পরিবর্তে বাঁদর থেকে চোর-চোট্টা হয়েছে।না মাস্তান বা গুন্ডা হয়নি।আর নীরেনবাবুর কাছে আমরা সব বিষয়েই পাঠ নিতাম, বলা ভালো পেতাম।আমাদের কালে ক্লাস ফোরে বৃত্তি পরীক্ষার চল ছিল।প্রধান শিক্ষক অনেকের থেকে জনা কয়েক ছেলেকে নির্বাচন করে পরীক্ষায় বসাতেন।তার জন্যে তিনি স্কুলের পাঠের বাইরেও দিন-রাত তার বাসাতে আমাদের পড়াতেন।এমন অনেক রাত গেছে রাতের খাওয়া সেরে তার বাসায় গিয়ে সারারাত পড়াশোনা সেরে ভোরে হ্যারিকেন নিভিয়ে বাড়ি ফিরেছি।সেবার আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম।সেই নীরেনবাবু আর আমার সাক্ষাতের একটি দিন আমি আজও বিস্মৃত হতে পারিনি।
তখন কলকাতায় নিয়মিত নাট্যচর্চায় যুক্ত আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে পড়াচ্ছি।বাবা-মা বেঁচে।তাদের কাছে যাব বলে আজকের হলদিয়া হাইওয়েতে রাধামনিতে নেমে বাড়ির দিকে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিলাম।উল্টোদিক থেকে সাইকেলে চেপে নীরেনবাবু বাড়ি ফিরছিলেন।আমাকে দেখেই নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে।আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই উনি ছিটকে সরে যেতে চাইলেন।আমি ভাবলাম উনি কি কোনও কারণে আমার এখনকার
ব্যবহারে অসন্তুষ্ট?সে কথা প্রকাশ করার আগেই উনি দ্বি্ধাজড়িত স্বরে বল্লেন-‘তুই এ কী করছিস?আমি সামান্য প্রাইমারি স্কুলের টিচার!আর তুই এখন ইউনিভারসিটিতে পড়াস।আমাকে প্রণাম করা তোকে মানায়?লোকে কী বলবে?”আমি অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলাম-‘আমার অক্ষর শিক্ষা আপনার কাছেই।আপনি আমার প্রণম্য।আপনাকে সম্মান না জানালে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে সম্মান জানাবেন কেন?’নীরেনবাবুর চোখে তখন জল।উনি কাঁদছেন।আমাকে আবার অপ্রস্তুত করে সাইকেল চালিয়ে মিলিয়ে গেলেন।নীরেনবাবু তার পর বহুবার বাবার কাছে আমার সংবাদ নিয়েছেন সেটা বাবার কাছেই শোনা।
হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে আমার অনেক মাস্টারমশায় ছিলেন।তাঁদের মধ্যে লজিক টিচার দীপকবাবু,ইংলিশ টিচার নিরঞ্জনবাবু,সায়েন্সের টিচার সুদিনবাবু আর সুকুমারবাবু আমাকে কী জানি কেন খুব স্নেহ করতেন।আমি তাদের ছাত্র ছিলাম।যখন কলেজে পড়ি আমি তাদের বন্ধু হলাম।আমি জানি না এই সৌভাগ্য কজনের হয়?
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বাংলা মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত শিল্পীদের।অভিনয় শেখাতেন অভিনেতা-পরিচালক কুমার রায়,রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্ত,গণেশ মুখোপাধ্যায়।স্ক্রিপ্টের ক্লাস নিতেন(অভিনয়েরও)প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার ডঃ বিভূতি মুখোপাধ্যায়।মঞ্চস্থাপত্য শেখাতেন আর্ট ডিরেক্টর রবি চট্টোপাধ্যায়।মেক-আপের ক্লাস নিতেন রূপ সজ্জাকর শক্তি সেন।আলোর কাজ শিখেছি অমর ঘোষের কাছে যিনি সারকারিনা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা।বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পেয়েছিলাম অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামের শ্রদ্ধেয় তরুণ রায়কে।
গান শিখেছি সুচিত্রা মিত্র,মায়া সেনের কাছে।নাচ শিখেছি বেলা অর্ণবের কাছে।মূকাভিনয় শিখেছি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যোগেশ দত্তের কাছে।
আজ সব্বাইকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।