মন খেরোর খাতা
সলিল সরকার
এই লেখাটি আমি লিখতে
বসলাম আমার ভিকিরিপতি গ্রামের অনেক ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে একজন সুদীপ (ওকে আমি ডাকি
গৌড়া বলে)এর বিশেষ অনুরোধে।আর পাঁচজনের মতো সুদীপও আমার লেখা নিয়মিত পড়ে।শেয়ার
করে।এ প্রসংগে আর একজনের কথা না বল্লেই নয় সে আমার ভাগ্নে রাহুল রায়চৌধুরি(যাকে
আমি পাঁচু বলে ডাকি)।বাঙালকে না কি হাইকোর্ট দেখাতে নেই।রাহুল কিন্তু আমাদের
সবাইকে উচ্চ আদালত দেখায়।রাহুল কলকাতার উচ্চ আদালতে আইন বিষয়ে কাজ করে।রাহুলের
বাবা আমার জামাইবাবু ছিলেন লেখক শংকরের মতোই ‘বাবু’।প্রয়াত প্রাক্তন বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী
সিদ্ধার্থশংকর রায় ব্যারিস্টার হিসাবে তর্কা্তীতভাবে প্রখ্যাত ছিলেন।রাহুলের বাবা
তারকনাথ রায়চৌধুরি তার ও আরও অনেক ব্যারিস্টারের ‘বাবু’ ছিলেন।আর আমার জ্যাঠাবাবু
প্রয়াত দুর্গাচরণ সরকার সুদীপের আপন ঠাকুরদা তিনিও কলকাতা হাইকোর্টের বিপরীতে একটি
সলিসিটর ফার্মে চাকরি করতেন। ইতিহাসের কী অদ্ভূত সমাপতন এরাও আমার লেখা থেকে পেতে
চাইছে ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়ের আস্বাদ।সুদীপ জানতে চায় কেলোমালের অতীতকালের
দোল-দুর্গোৎসবের কথা।সত্যি বলতে কী সেই শৈশবের পর আর সেভাবে কোনদিন ফিরে যাওয়া
হয়নি দেশের বাড়ির পুজোয়।মা-বাবা প্রয়াত হবার পরে তো একেবারেই নয়।তবে নাস্তিক বলে
এই উৎসব আর অন্যের আনন্দকে দূরে সরিয়ে রাখি না।কারণ আমি মনে করি যা আমি সবার থেকে
নির্মূল করতে চাই তা কি আমি আমার খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকেই সরাতে পেরেছি?আমার
মা জানত আমি এসব মানি না কিন্তু মা যখন পুজোর ফুল নিয়ে আমার মাথায় ঠেকাতে আসত আমি
একদিনের জন্যেও তার সংগে রূঢ় ব্যবহার করিনি তার কারণ আমি নিজের কাছে তখন ও এখনও
খুব পরিস্কার।আমার কিছু মারক্সিস্ট ও কমিউনিস্ট বন্ধুদের জানা নেই হয়তো লেনিনের
জীবদ্দশাতেই সোভিয়েত রাশায় চার্চ ছিল,মসজিদ ছিল আর তাদের ধর্ম পালনে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াননি।আমরা
অনেকেই মারক্সের কথা আওড়াই “ধর্ম আফিংয়ের মতো......!”কথাটা জেনে বা না জেনে শেষ
করি না।“ধর্ম ভীরূদের কাছে”।ঠিক যেমন কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আউড়ে বলি-“তোমার উপর
নেই ভুবনের ভার......” গানের পরের দুটি শব্দ “ওরে ভীরু” নিঃশব্দে বাদ দেয়
এস্কেপিস্টগণ।পাড়ার পুজো প্যান্ডালে যে সব মারক্সবাদী বইয়ের স্টল হোতো সেগুলোয়
যেমন ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ বা “সত্যনারায়ণের মাহাত্ম্য” কিংবা ‘ইতু ও ঘেঁটু পুজোর
নিয়মাবলী’ বিক্রির জন্যে থাকত না আবার প্রবীণ কমরেডদের অনেককেই পুজোর শেষে ‘মায়ের
প্রসাদ’ তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখেছি।আর পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ‘মানুদার’ আমলে শনি ও
সন্তোষী ঠাকুর অলিতে-গলিতে আসন পেলেও বামফ্রন্টের আমলেই তা বিস্তার লাভ করে এবং কালী
ও দুর্গা পূজা থিমযোগে করপোরেট দুনিয়ার পণ্য প্রচারের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।পাশাপাশি
মারক্সবাদী সাহিত্য বিক্রি ক্রমেই কমতে থাকে।নিন্দুকরা বলেন যখন থেকে কমিউনিস্ট
দের চেয়েও ‘কামায়ে নিস’দের সংখ্যা বাড়তে থাকল আর বামের ‘ব’ কখন যে পুটকি বসে ‘র’
হোলো......।যাকগে।এই কলকাতা শহরের অনেক আবাসনেই বাম আমল থেকেই “দুর্গোৎসব” চালু
হয়েছে।সেখানে অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আসর আলো করে বসেন।এই রকম আসরে ধর্মভীরু
মানুষ যেমন থাকেন আবার সত্যজিৎ রায় থেকে সারামাগো,সুইজারল্যান্ড থেকে সিঙুর সব
আলোচনাই প্রসাদ সহযোগে চর্চিত হয়।
কে কিভাবে নেবেন জানি না
তবে আমি আমার শৈশবের উৎসব আর পুজোকেই সবার আগে রাখি কারণ সেখানে আড়ম্বরের চেয়েও
আন্তরিকতাই মুখ্য ছিল।বারোয়ারি পুজোতেও বারো ইয়ার চাঁদার জুলুম আর পেশী শক্তির
আস্ফালন দেখাত না।ঘরের পুজোর মতো না হোলেও পুজোতে আম জনতার প্রাণের যোগ থাকত।কাছে
পিঠে বারোয়ারি পুজো বলতে ছিল রাধামনি বাজারের পুজো আর ঘরের পুজো বলতে
ঘোষেদের,কারকুনদের আর সরকারদের।কারকুন আর সরকার দুটিই কিন্তু এক অর্থ বহন করে।এই
সরকার বা কারকুন আসলে করনিক।আসল পদবি ‘দে-সরকার’।শোনা যায় এরা আদতে মুর্শিদাবাদের
মানুষ।নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার পতনের পর শহর কলকাতায় অনেক নবাবি দেওয়ান বেশ কিছু
নবাবি মাল লুট করে রাতের অন্ধকারে নৌকা-বজরায় পালিয়ে এসে রাতারাতি বড়লোক
হয়েছিল।তারাই শহরে এসে আড়ম্বর করে চড়ক-গাজন-পুজো-পাখির লড়াই-বিড়ালের
বিয়ে-বাগানবাড়ির ফুর্তি চালু করে।আর যারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি তারাই গ্রামের
দিকে এসে প্রাণ বাঁচায়।
কেলোমালের সরকার আর ঘোষ
পরিবার জীবন ধারণের জন্যে মুর্শিদাবাদ থেকে ঘাঁটাল হয়ে কেলোমালে আসেন।তাম্রলিপ্ত
রাজাদের কারকুন হিসাবে নয় বরং মহিষাদলের রাজা গর্গদের করনিক হয়।রাজারা এই দুই
পরিবারকে গ্রাম দান করেন।পাশাপাশি বাস করার পাশাপাশি রেষারেষিও ছিল বিস্তর।আবার
পরিবারের বংশ বৃদ্ধি আর সম্পত্তির কারণে কারকুন আর সরকার পৃথক হয়ে যায়।
কেলোমালের সব গ্রামে
পুজোর মেজাজ আসত মহালয়ার ভোর থেকে।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র শুনে কতিপয় বাড়ির
রেডিয়ো শুনে।দু-তিন বাড়ির পুজো হলেও সব পাড়া আর গ্রামের সব ঘরে আত্মীয়-কুটুম্ব চলে
আসত উৎসবে যোগ দিতে।পুজোটা সবার ছিল।পুজোর মন্ডপে ঢাকে কাঠি পড়লেই গ্রামের সবার
বাড়ির ছেলে-মেয়েদের প্রাণ নেচে উঠত।সব বাড়িতেই সাধ্য মতন মেয়ে-বউদের জন্যে তাঁতের
কোরা শাড়ি,ছোটো মেয়েদের বাহারি ফ্রক,ছেলেদের জন্যে ইংলিশ প্যান্ট-শার্ট আর
পুরুষদের জন্যে ধুতি,পাঞ্জাবি কি ফতুয়া।বাড়ির কাজের লোকেদের জন্যেও বরাদ্দ
ছিল।চমৎকারীর জন্যে বাড়ির বউয়েদের মানের শাড়িই তার মেজদ্দা অর্থাৎ আমার বাবা
আনত।নাপিত বৌ আলতা পরাতে এসে শাড়ি পেত।ধোপা বউ পেত শাড়ি।চাষি আর প্রজারাও পেত পয়সা
আর গামছা-ধুতি।ঘরে ঘরে লুচি ভাজার গন্ধে সারা পাড়া ম ম করত।ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা
বেতের চুবড়িতে খৈ-মুড়ি-নাড়ু কী তৃপ্তি করে খেত।উৎসবের বাড়িতে থালা-বাটি নয়
কলাপাতায় আর শালপাতায় দিনে রাতের খাওয়া হোতো।মাটির গ্লাসে জল।মাথা ঘষার জন্যে থাকত
কাপড়কাচার সোডা আর গায়ে মাখার জন্যে লাইফবয়।মাথার চুলে বাড়ির নারকেল তেল আর গায়ে
মাখা হোতো সরষের তেল।দাঁত মাজা হোতো ঘুঁটের ছাইয়ে কি নিম ডালে।দাঁতের ব্যথা হলে
নারকেলের পাতা পুড়িয়ে মিশি বানানো হোত।পেয়ারাপাতা চিবিয়ে খেয়েও ব্যথা সারত।পেটে
ব্যথা হলে ‘ভাস্কর লবন’ কি জোয়ানের আরক।বুকে ব্যথা হলে রসুনের তেল।মাথা ব্যথা হলে
বাড়ির বাগানের ঘৃতকুমারীর রস।মনে ব্যথা হলে ঘরের কোনে লুকিয়ে কেঁদে শোক প্রশমিত
করা।পা মচকালে চূণ-হলুদ।গলা খিঁচখিঁচ করলে গরমজলে নুন।এসব বলার সংগত কারণ আছে।এই
সময়ে গ্রামে হিম পড়া শুরু হোত আবার বৃষ্টিও হোত ও হয়।দৌড়ঝাঁপ করার কারণে পা
মচকাতো।উৎসবে মনে রং লাগত তাই ব্যথার কী দোষ?
সরকার বাড়ির পুজোয় ছিল
ডাকের সাজ।চালচিত্র বিশাল।ঘোষেদের বাড়ির পুজোয় সবটাই শোলার কাজ আর ঠাকুরের চোখ
টানা টানা।ঘোষদের বাড়ির পুজোয় সপ্তমীর দিন সাত মণ,অষ্টমির দিন আট মণ,নবমীর দিন
ন’মণ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হোত।পুজোর শেষে ব্রাহ্মণদের ওই চাল দিয়ে দেওয়া হোত।তারা
ওই চাল রোদে শুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতেন।আমার জন্মের এক যুগ আগে ঘোষেদের বাড়ির পুজোয়
ছাগ-মেষ-মোষ বলি হোত।বাংলার উনপঞ্চাশ সালের(১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ)ঝড়ের পর সে সব বন্ধ করে
দেওয়া হয়।আমার ঠাকুমার কাছে শোনা পুজোর সময়ের ওই ঝড়ে পূর্ব মেদিনীপুরের সব তছনছ
হয়ে গিয়েছিল।আমাদের পুরানো বাড়ির উঠোনে বেশকিছু বেতের ধামা আর বড়ো বড়ো মাছ ভেসে
এসেছিল আর ভেসে এসেছিল মানুষের হাহাকার।“ম্যান-মেড ফেমিনের” আর্ত চিৎকার।
আজও বাংলায় পুজো মানেই শহরে
উল্লাস আর এখানে ওখানে বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষের হাহাকার রব।
Piyali Palit পুজো মানেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় সারা পাড়া, সারা গ্রাম বা শহর একসঙ্গে খুশিতে মেতে ওঠা। ওই কদিন সাতখুন মাফ, বছরকার দিন বলে। সেই দিনগুলো এখন আকাশের তারা হয়ে গেছে। কেবল অন্ধকারেই দেখতে পাই।
উত্তরমুছুনLike · Reply · 9 hrs
Salil Sarkar
Salil Sarkar আপনার নাম তাহলে সুরঙ্গমা।কারণ কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন-"এ অন্ধকারে কী দেখ সুরঙ্গমা?"
Sumana Adhikary খুবই অসাধারণ।কিন্তু এ ধরনের পুজোর আনন্দ চিরদিনই আমার কাছে অধরা রয়ে গেল।
উত্তরমুছুনLike · Reply · 1 · 3 hrs
Arghya Mukherjee
Arghya Mukherjee Katha diye ki sundar chhabi akchhen Salilda !
Like · Reply · 3 hrs
Samir Mitra
Samir Mitra Darun lekha....
Like · Reply · 22 mins