MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭

মন্বন্তরে মরিনি আমরা
সলিল সরকার

বাংলা এই উপকূল বছর বছর বর্ষা হলেই জলে ভাসবে,বানভাসি হবে মানুষ এ আর নতুন কথা কী?বানভাসি মানুষের ত্রাণ,বাঁধভাঙার চাপান-উতোর,কিউসেকের হিসেব নিকেস তাও চলবে চ্যানেলে চ্যানেলে।যদিও মানুষ তখন জলমগ্ন।আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা বল্লেন আমি যেন মানুষের কথা বলি।বেশ আমি বরং ঝড়ের খুড়সিনামা(কুরসিনামা) খুলে বসি।
বাংলার উনপঞ্চাশ সালের উপকুলীয় ঝড় আর জলোচ্ছাস,পঞ্চাশের মন্বন্তর আমার জন্মের তেরো-বারো বছর আগের দুর্বিপাক।আমার জন্মের কালে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে দেশভাগ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,উদ্বাস্তু উদ্বে্গ আর “এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” কমিউনিস্ট আন্দোলনে।যদিও রেখে গিয়েছিল তার রেশ শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্পকলায়,গীতিকার-সুরকারদের সুর আর কথায়,গায়িকা-গায়কের গানে যা ভিকিরিপতি গ্রামেও ছাপ ফেলেছিল।আর ছিল জলবসন্তের দাগের মতো গভীর সামাজিক ক্ষত যা সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনও মুছে দিতে পারেনি।
কবুল করতে লজ্জা নেই রবীন্দ্রানুরাগী জ্যাঠাবাবুর কণ্ঠে কোন দিন “নব জীবনের গান” শুনিনি।শুনিনি ইকবালের “সারে জাঁহাসে আচ্ছা......”কিন্তু রেডিয়োতে কি বাড়ির ‘কলের গানে’ শুনেছি “অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি” কি “পথে এবার নামো সাথী” আর শুনেছি ‘রানার’।শুনেছি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পুত্র কাজী সব্যসাচীর উদাত্ত কণ্ঠে “কারার এই লৌহ কপাট”, “কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই” কি “বিদ্রোহী রণক্লান্ত......”।
তবে বাবার কাছে,জ্যাঠাবাবুর আর ঠাকুমার কাছে উনপঞ্চাশ সালের ঝড়ের বিবরণ শুনেছি যখনই সাইক্লোন এসেছে কি অতি বর্ষনে ভেসে গেছে সারা গ্রাম।সেই সময়ের সাময়িক সংকটের কথা শুনেছি কিন্তু “ম্যান-মেড ফেমিন”এর ভয়াবহতা,শহরের পথে পড়ে থাকা সারি সারি লাশ, ‘প্রাণ দাও,ফ্যান দাও’ আর্ত চিৎকারের বিবরন দেখেছি,শুনেছি,পড়েছি তৃপ্তি মিত্রের লেখায়, বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” নাটকে,নিমাই ঘোষের“ছিন্নমূল”সিনেমায়,চিত্তপ্রসাদের,জয়নুল আবেদীনের স্কেচে,সোমনাথ হোড়ের পেন্টিংয়ে আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কবিতা আর ‘নব জীবনের গান’এ,সলিলদার কথায়-সুরে।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দপ্তরে নিয়মিত কাজের মধ্যেই শুনেছি রেবা রায়চৌধুরির বলিষ্ঠ স্বরে “প্রাণের দেউলে যত বধূরা প্রদীপ জ্বালাবেই” তার পরেই নরেনদার(মুখোপাধ্যায়)ব্যারিটোন ভয়েসে “ঝড়ে ভাঙা ঘর যত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবেই”।তার বেশ কিছু আগেই পড়ে জেনেছি ১৯৪২-এ পূর্ব মেদিনীপুরের প্রায় ৪৫০ স্কোয়ার মাইল ভেসে গিয়েছিল সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে।প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৪০০ স্কোয়ার মাইলেরও বেশি অঞ্চল।৩২০০ স্কোয়ার মাইল বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঝড় আর লাগাতার বৃষ্টিতে।মানুষ মরেছিল চোদ্দ-পনের হাজার।গবাদি পশু মরেছিল কমপক্ষে এক লক্ষ নব্বই হাজার কি তারও বেশি।গ্রাম থেকে শহরে বাঁচবার আশায় পালিয়ে এসেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে লুটপাট করেনি,কেড়ে খায়নি।খেটে খাওয়া মানুষেরা শহরের রাস্তায় খুঁটে খেয়েছে।উৎসব-আনন্দের ভোজসভায় প্রবেশ না করে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে নেড়ি কুকুরের সংগে লড়াই করেই।ব্রিটিশ সরকার নীরব থেকেছে।কালোবাজারীরা দু-হাতে টাকা লুটেছে। আড়তদারেরা চড়া দামে মাল বেচেছে সম্পন্ন শহরবাসীদের কাছে।একমাত্র ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গান গেয়ে,নাটক মঞ্চস্থ করে টাকা,জামাকাপড়,খাদ্য সংগ্রহ করে রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছে।
ব্রিটিশ রাজ চিত্তপ্রসাদের মুদ্রিত চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে দিয়েছে।অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বেড়াজালে ফেলে নাটকের গতি স্তব্ধ করতে চেয়েছে,পারেনি। রবীন্দ্রনাথের গান দেখিয়েছে পথের দিশা।সুচিত্রা মিত্র,দেবব্রত বিশ্বাস এর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠল বিদ্রোহের গান।কালের অমোঘ নিয়মে মানুষ না খেতে পেয়ে যত মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মারা গেল অনেক দিনের না খাওয়ার পর খেয়ে।মাঠে মাঠে ফসল।ফসল কাটার কেউ নেই।ঘরে ঘরে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ।গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।রেংগুনে বোমা পড়ল কলকাতা শহরের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালাল গ্রামে।কালের পরিহাসে গ্রামের মানুষ আশ্রয় দিল শহরবাসীদের,যে শহুরে বাবুরা পথে পথে পড়ে থাকা অভুক্ত মানুষদের মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে অন্ন তুলেছে মুখে।তারাই প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিল গ্রামে।জন্ম নিল ‘ড্যাংচি বাবু’রা যারা কথায় কথায় বলত “ড্যাম চিপ”।
আমার শৈশবেও এই ‘ড্যাংচি বাবুদের’ আমি দেখেছি।তারা পালা-পার্বণে,দোল-দুর্গোৎসবে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সপরিবারে দেশে যেতেন।বাস থেকে নেমেই সামনে যাকেই পেতেন (সে চাষি হোক কি মুনিষ)তাকে ধমকে তার মাথায় বাক্স-প্যাঁটরা চাপিয়ে দিতেন।এই দেখে একবার আমার এক জাঠতুতো দাদা মাথায় কাঁধে-পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে তাদের বাড়ি অব্দি যাওয়ার পর বাড়ির মানুষজন দুলুদাকে চিনতে পেরে কোথায় মুখ লুকোবে ভেবে পায় না।শেষে দুলুদার কাছে ক্ষমা চেয়ে পুজোর মিষ্টি খাইয়ে নিস্তার চেয়েছিল।
গ্রামের পুজোয় দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় কুটুম্ব দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে ফিরে আসবে এটাই ছিল রেওয়াজ।যার যা সংগতি তাই দিয়েই গ্রামের মানুষ অতিথি আপ্যায়ণে ত্রুটি রাখত না।সহজলভ্য শাক-সব্জি,খাল-বিলের মাছ,বাড়ির ধানের খৈ-মুড়ি,ক্ষেতের আখের আখিগুড় আর পুকুর পাড়ের তালের সারির তাল গুড় দিয়ে মুড়কি।ঘরের গাই-গোরুর দুধের ছানা-দৈ-ঘি।গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে আর বাড়ির গাছের নারকেলের নাড়ু-চিত্রকূটে পাড়া জুড়ে মিঠে সুবাস।খাল-বিলের মাছ ভাজা হোলে বিশেষ করে বেলে মাছ,গুলে মাছ,গুড় জাউলি মাছ,পারষে মাছ,নোনা চিংড়ি মাছের গন্ধ পেয়ে অবারিত দ্বা্রের বৈঠকখানায় বসে পড়ত যে কেউ বিনা আমন্ত্রণেই।পেট পুরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে তবে তার নিস্তার মিলত।ষষ্ঠীতে নিরামিষ সোনা মুগের ডাল,আলুভাজা,বেগুনভাজা,শাক,শুক্তো,আলুপোস্ত,ছানার ডালনা,আলুবখরার চাটনি।সপ্তমীতে মাছ ভাত।অষ্টমীতে নুচি(লুচি)-কুমড়োর ছক্কা,ছোলার ডাল আর ধোঁকার ডালনা,প্লাস্টিক চাটনি।নবমীতে বলির পাঁঠার মাংস পাড়ায় বিলিয়ে যা পড়ে থাকত তার সংগে বাজার থেকে কিনে এনে তাই দিয়ে সবার পাতে দু-টুকরো মাংস আর চার-টুকরো আলু দিতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর উঠত।যার পাতে মেটে পড়ত সে ভাগ্যবান।সে সময় কেউ অসুস্থ হলে সে পেত ‘টেংরির জুস’।
যাদের এই সংগতি ছিল না তারাও হীণমন্যতায় না ভুগে এই কয়েকটা দিন আউস ধানের পায়েস তৈরি করত বাড়ির আখের গুড় দিয়ে।মাঠে ‘মুগরি’(বাঁশের তৈরি মাছ ধরার খাঁচা)বসিয়ে কুচো মাছ আর নোনা চিংড়ি ধরত।জলভরা আমন ধানের ক্ষেতে বঁড়শিতে আরশোলা,ঘুরঘুরে পোকা কি জ্যান্ত চিংড়ি টোপ দিয়ে বড়ো বড়ো ট্যাংরা,শোল,ভেটকি ধরত।শোলাকে ছোট ছোট করে কেটে তাতে সুতো বেঁধে কাঁটাতে কেঁচো লাগিয়ে ভাসিয়ে দিত ধান ক্ষেতে।ভোরবেলা সেগুলোকে তুলে দেখত কী মাছ গেঁথেছে সেই ভাসা বঁড়শিতে।প্রায় সব বাড়িতেই কচু,মান কচু,ওল,চুপড়ি আলু, বিচিকলা,নটে শাক,পালং শাক,কাটোয়ার ডাঁটা,বেগুন,লংকা,ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,চিচিঙ্গে,কুদরি, কাঁচা আর পাকা কুমড়ো অঢেল না হোলেও অপ্রতুল ছিল না।এই সময়টা শাপলা-শালুক,গেঁড়ি-গুগলি,কলমি শাক,সজনে পাতা,শুষনি শাক অঢেল ছিল।গুগলির তরকারী কম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ছিল না।কুমড়োফুল,বকফুলের বড়া আহা কী লোভনীয় যে ছিল।গ্রামের মানুষ এইসব খেয়েই অষ্টমীর সারারাত কয়েক ক্রোশ-মাইল পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখত।কী অফুরান প্রাণশক্তি!কী অনাবিল উচ্ছ্বলতা!
আমাদের বাড়িটাই ছিল একটা ক্লাবের মতো।ছোটোরা সারাদিন-রাত চোর-পুলিশ, ক্যারাম,ব্যাগাডুলি,সাপ-লুডো,রং-মিলান্তি,বাঘবন্দী খেলা খেলতাম।বড়োরা ব্রীজ,ব্রে আর মা-জেঠিমা-কাকিমা-ঠাকুমা খেলত টুয়েন্টি নাইন।শুধু ন’পিসেমশায় একা একা তাসের পেশেন্স খেলতেন আর জর্দা-পান খেতেন।ছোটো কাকা লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেত। মেজপিসি আর চমৎকারী গুড়াকু দিয়ে সময়ে অসময়ে দাঁত মাজত।কেউ কেউ ভাঁড়ার থেকে চুরি করে পুকুর পাড়ে গিয়ে লুকিয়ে খেত আর পেটের ব্যথায় কাৎরাতো। কাড়াকাড়ি পড়ত শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে।হুড়োহুড়ি পড়ত বাড়িতে হঠাৎ কোনও অতিথি এলে।আর ঢাকের আওয়াজ থেমে গেলে অলস দুপুরে সবাই দিনের খাওয়ার পাট চুকিয়ে মাদুরে গা এলিয়ে চুপ করে শুনত রেডিয়োয় পুজোর গান-“প্রান্তরের গান আমার,মেঠো সুরের গান আমার”, “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”, “একটা গান লিখো আমার জন্যে”, “আকাশ-প্রদীপ বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে ব্যথার আগুনে গান গেয়ে” এসব গান শুনতে শুনতে কখন যে ঝুপ্ করে সন্ধ্যে নেমে আসত।পশ্চিম আকাশে সাঁঝতারার একটু ওপরে ঝুলত ফালি চাঁদ।হাল্কা হিমে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা আজকের এল,ই,ডি আলোর মতো টিমটিম করে আলো ছড়াত।শিউলি ফুলের আর হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে যেত বাতাসে।আকাশের উত্তরে ভাসত সপ্তর্ষি,দক্ষিণে কালপুরুষ।আর আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে রমণীয় ছায়াপথ।
দশমীর ভোরে আকাশবাণীর গানে “শুকতারা গো,নিও না বিদায়,নিও না......”আজও কানে বাজে।দশমীর দিন শুধু দিনের বেলায় রান্না হোত। দেবীমূর্তি জলে পড়লেই দশমী শুরু হোত না।ঘরের ঠাকুমা পুজোর দালান থেকে শান্তিজল আর অপরাজিতার লতা নিয়ে আসবে।বাড়ির সবাই পা ঢেকে বৈঠকখনায় বসবে।শান্তিজল ছেটানো হবে।তারপর অপরাজিতার বালা পরানো হবে এই মন্ত্র আউড়ে-“জয়দে বরদে দেবি,দশম্যে অপরাজিতে......”।এবার ছোটোরা প্রণাম করবে।বড়োরা করবে কোলাকুলি(পরে জেনেছি এই কোলাকুলি প্রথাটি এসেছে ঈদের থেকে)আর শুরু হবে মিষ্টি বিতরণ।ডানহাত বাড়িয়ে মিষ্টি নেওয়াটাই ছিল সৌজন্য।কিন্তু অধিকের আশায় হাতপাতা কারও পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে এমন ভাবে হাত বাড়াতাম যেন দুই মানুষের ভিন্ন হাত।বাড়ির প্রণাম সারা হোলে বেরিয়ে পড়া পাড়ার প্রণামে।আমাদের জানা ছিল প্রণামের পর কোন বাড়িতে নিমকি দেবে,কোন বাড়িতে ঘুগ্নি।যে বাড়িতে বয়স্ক-প্রবীণ মানুষজন থাকতেন তারা নিজের হাতে কিছু তৈরি করতে পারতেন না তাই ময়রার দোকান থেকে দরবেশ-সন্দেশ-মিহিদানা-সীতাভোগ আনিয়ে রাখতেন।সেই রাত্রে সবার বাড়িতে যেতাম না।পেট ভরে যাওয়ার কারণে পরের দিনের জন্যে ওই বাড়িগুলো রাখা থাকত। 
এইভাবেই কেটে যেত কটা দিন।এবার আমাদের পড়ায় মন বসাতে হবে আর যারা এসেছিল আবার তারা বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে ফিরে যাওয়া ঢাকির দলের প্রায় সংগে সংগেই চাল-নারকেল-নাড়ু ব্যাগে ভরে ফিরে গেলে গ্রামগুলো শোকে মলিন হয়ে পড়বে।এবার অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মী স্থাপন করে দীপাবলীর প্রদীপ জ্বালিয়ে মরা গ্রামের প্রাণ ফিরিয়ে আনার কাজ।সে আর এক উৎসব।
বাংলার বানভাসি নাটকের বান

“কেউ বলে ফাল্গুন,কেউ বলে পলাশের মাস।
আমি বলি আমার সর্বনাশ” 
ঠিক এইভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলা ও বাঙ্গালির উৎসবের মাস আবার প্লাবনেরও মাস।কোথাও মানুষ আনন্দে-উৎসবে ভাসছে আবার একই সময়ে বাংলার মানুষ বরষনে প্লাবনে ভাসছে।উৎসবে ভাসা মানুষজনকে এখনও সবাই ‘পল্লীবাসি’ বলে আর ভেসে যাওয়া জীবনকে ডাকা হয় ‘বানভাসি’ বলে।
উনপঞ্চাশ(১৯৪২)সালের ঝড়ের কথা লিখতে গিয়ে নিজের কালের ৭৮এর দুর্বিপাকের কথা ঝড়ের মতো উড়ে এলো স্মৃতিতে।
দীর্ঘ ত্রাস-সন্ত্রাস-কারাবাস-রক্তের স্নানের পর বাংলায় এসেছে বামফ্রন্ট মানুষের অদম্য প্রয়াসে।বাংলা নাটকে তার আগে থেকেই এসেছিল প্লাবন।বাংলায় প্লাবন এলো শারদীয় উৎসবের কিছু আগে।তখনও মানুষ সে শহর হোক কি গ্রাম ত্রাস ও সন্ত্রাসের দিন গুলো মন থেকে মুছে উঠতে পারেনি।তখনও রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পায়নি।তখনও ‘জমানা বদল হোলে দেখে নেবার’হুমকি দিয়ে চলেছে দেবী ও দেবের পারিষদরা। তখনও বাসে পেট্রোল বোমা পড়ে।খোলা রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা ও চপার নিয়ে ঝন্টু-মিন্টু-পিন্টু-কাল্টু(কল্পিত)রা ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে না হোলেও রাতের অন্ধকারেই।
পেশাদার থিয়েটারে তখন নাভিঃশ্বাস।‘এ’মার্কা থিয়েটার বিদায় নিচ্ছে কালের নিয়মেই। গ্রুপ থিয়েটার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আক্ষরিক অর্থেই।লিটল থিয়েটার গ্রুপ(এল,টি,জি)থেকে পিপলস লিটল থিয়েটার তৈরি হয়ে গেছে।“দুঃস্বপ্নের নগরী” তখনও যায়নি।চলছে “টিনের তলোয়ার”, “এবার রাজার পালা”।থিয়েটার ইউনিট করছে “পন্তু লাহা” আবার শেখর চট্টোপাধ্যায় বাণিজ্যিক থিয়েটারে করছেন “শ্রীমতি ভয়ংকরী”।নান্দীকার করছে “ফুটবল”।থিয়েটার ওয়র্কশপ করছেক “চাক ভাঙা মধু”, “রাজরক্ত”।চার্বাক করছে “কর্ণিক”।থিয়েটার কমিউন “কিং কিং”,“দানসাগর”।চেতনা করছে “জগন্নাথ”। বহুরূপী কুমার রায়ের পরিচালনায় নিয়ে এলো “মৃচ্ছকটিক”।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলেন “পাপ পুণ্য” নিয়ে।সুন্দরম্ করছে “সাজানো বাগান”।আর কিছু তরতাজা যুবক নির্মাণ করল নতুন সংগঠন শূদ্রক।এলো সময়ের প্রকাশ্য প্রতিভাস “অমিতাক্ষর”।বাদল সরকার প্রসেনিয়ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কার্জন পার্কের ঘাসে,অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এর লনে করছেন “ভোমা”, “মিছিল”, “সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস”।কেউ করছেন “লাল লন্ঠন”।কেউ করছেন “পদ্মা নদির মাঝি” আবার “গোরুর গাড়ির হেডলাইট”ও চলছে রমরমিয়ে।গ্রামে,মফঃস্বলে নাট্যকর্মী্রা কোমর বেঁধে নেমে পড়ছেন প্রতিযোগিতার মঞ্চেই। আসানসোল, রূপনারায়ণপুর,ঝরিয়ায়,কুলটিতে সুনীল রায়,সুনীল মুখোপাধ্যায়,বংশী মুখোপাধ্যায়, দুর্গাপুরে গোপাল দাস,বোকারোয় নিমু ভৌমিক,বালুরঘাটে হরিমাধব মুখোপাধ্যায় করছেন “দেবাংশী”।বহরমপুরে প্রদীপ ভট্টাচার্য লড়ে যাচ্ছে নাটক নিয়ে।চাকদহে নাট্যকার চন্দন সেন নাটক লিখছেন,পরিচালনা করছেন।দক্ষিণেশ্বরে কালী মা নয় গোর্কির “মা” করছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়।কথায় কিছু এলোমেলো হোলো যদিও লুটেপুটে খাওয়ার দিন ছিল না সেইসব দিন।বন্যায় ভেসে যাওয়া আবার ভেসে ওঠার পরে ছয় ছয়টি নাট্যদল দলাদলি না করে নয় ছয় না করেই ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর পরিচালনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রকে নিয়ে করল বারটোল্ট ব্রেষটের নাটক “গালিলেওর জীবন”।সুব্রত নন্দী এর আগেই নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সেটিই “বহুরূপী” করল “গালিলেও” নামে।সবটাই সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তা বলব না তবে আজকের ক্যান্সারের মতো তা নিঃশব্দ প্রকট ব্যাধি হোয়ে ওঠেনি।
বাংলায় বন্যা নতুন কিছু নয়।উপ সাগরীয় অঞ্চল,খাল-বিল-নদি-নালার দেশ।ঝড়-তুফান সে তো উঠবেই।মা-মাটি সে তো ভাসবেই।একটু হাল্কা চালেই বলি-আমার বাবা কবি ছিলেন না,জ্যাঠাবাবুর মতো রসিকও ছিলেন না।ছিলেন খাজনা আদায়ের ‘তহশিলদার’।নিজেদের নাম দেব-দেবীর নামে হোলেও আমাদের নাম রেখেছিলেন-মলয়
মিলন,সলিল।কী আশ্চর্য আমার জন্মের ঠিক পরের বছর বাংলায় বন্যা হয়েছিল।১৯৪২ এর পরে ১৯৫৬ আর ১৯৫৯।এই দুই বারে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু এর পরে ১৯৭৮ এ এই সময়ে বিপুল বর্ষণে ভেসে গিয়েছিল বাংলার প্রায় সব জেলা।এমনকি কলকাতাও।
আমরা তখন সারা রাজ্যজুড়ে মঞ্চে-খোলা মাচায় নাটক করে বেড়াই।সেবার নাটক ছিল বর্ধমান রাজ কলেজে।তখনও দাপুটে বাহিনী “অমিতাক্ষর” করার সময় নাটক থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোলো।সেই রাতে আমাদের ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল।আমরা না থেকে বাস নিয়ে কলকাতার রাস্তা ধরলাম।রাস্তায় নেমে বুঝলাম আমরা উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বড়ো রাস্তার উপরেই জল বইতে শুরু করেছে। কলকাতায় এসে নামলাম এক হাঁটু জলে।
মা-বাবা-জ্যাঠা-কাকা-কাকিমা-ভাই-বোনেরা সবাই তখন ভিকিরিপতি গ্রামে।অনেক বন্যা হয়েছে কিন্তু তাম্রলিপ্ত বন্দর কখনও জলে ভাসেনি।কাঁথি-দীঘায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে কিন্তু আমরা কখনো ভাসিনি।এবার কোলাঘাট,বাগনান,রাধামনি,হাকোল্লা,ব্যবত্তা সব ভেসে গেল।গ্রামের ডাকঘরে ট্রাংককল করা যাচ্ছে না।স্থানীয় সংবাদ রেখে ঢেকেও যা জানাচ্ছে তা ভয়ংকর।রূপনারায়ণ বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।রেললাইন জলের তোড়ে ভেসে গেছে বাগনানে।বাড়ির সবাই,গ্রামের মানুষ সব ফেলে রেখে উঠছে স্থানীয় স্কুলে।সেই প্রথম ভিকিরিপতি গ্রাম দেখল লঙ্গরখানা।
আমার দাদা আর আমি কলকাতা থেকে ডাল-চাল-চিঁড়ে-বাতাসা-গুড়-মুড়ি-কেরোসিন তেল নিয়ে নূরপুর থেকে নৌকায় গেঁওখালি হয়ে মহিষাদল,সেখান থেকে কীভাবে যে তমলুক হয়ে মা-বাবার কাছে পৌঁছেছিলাম তা মনে করতেও ভয় পাই।কাতারে কাতারে মানুষ জলেডোবা গ্রামে যাচ্ছে স্বজন-পরিজনকে উদ্ধার করতে।ঠিক ৪২এর দুর্বিপাকের বিপরীত।পথে ঘাটে মরা পশু।জলে ভাসছে মরা মাছ।রাতেরবেলা ভরা মাঠের থেকে ভেসে আসছে গুম গুম শব্দ!বাবা বল্লে-“মাটির বাড়ি জল নামার সংগে সংগে জলের উপরেই মুখ থুবড়ে পড়ছে!তারই শব্দ ভেসে আসছে দূর-দূরান্ত থেকে!”
আটাত্তরের সেই দুর্বিপাক কাটিয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ আর বামফ্রন্ট।তার কতো বছর পরে গ্রীষ্মকালে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল বামফ্রন্ট।একেই বলে “বিধি বাম?” না কী এরই নাম সিঙ্গুর,খেজুরি,নন্দীগ্রাম?


মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭

বাদল বাউলের একতারা 
সলিল সরকার 
অন্তিম পর্ব 
বাদল সরকার যখন বেশ কিছু কৌতুক নাটক লিখে ১৯৬৩ তে বাংলা নাটককে ধাক্কা দিলেন “এবং ইন্দ্রজিৎ“ দিয়ে ঠিক সেই বছরেই কবিতার প্রাঙ্গণ থেকে বাংলা নাটকে পা রাখলেন কবি মোহিত চটোপাধ্যায় “কণ্ঠনালীতে সূর্য” নিয়ে। কবি মোহিত এসেছিলেন কলকাতায় ৪৭এ বরিশাল থেকে ১৪ বছর বয়সে। নতুন প্রজন্মের কবিতা পত্রিকা কৃত্তিবাসের কবি সুনীল শক্তি তুষারের পাশে মোহিত এক আলোচিত নাম।ঠিক তখন আর এক নাট্যকার সাতক্ষীরা জেলার ধুলিহর গ্রাম থেকে এলেন। ১৯৫৭তে কলকাতার মঞ্চে অভিনয় করা শুরু করে ১৯৫৯এ ছোট নাটক “মৃত্যুর চোখে জল” লিখলেও বাংলা নাটকের দর্শক চমকে উঠল ৭২এ তার “চাক ভাঙা মধু” বিভাস চক্রবর্তী র পরিচালনায় থিয়েটার ওয়রকশপ এর ব্যানারে। মনোজ মিত্রের কথাই বলছিলাম। আমরা যারা সে নাটক দেখেছি অশোক মুখোপাধ্যায়, মায়া ঘোষ আর বিভাসদার অভিনয় সমৃদ্ধ বাংলা মঞ্চে অনুভব করেছি নাট্যকার আর পরিচালকের সম্পর্কটা যদি দোসরের হয় তবেই সার্থক প্রযোজনা সম্ভব। যেমন মোহিত ও নক্ষত্রের শ্যামল ঘোষের মেলবন্ধন বাংলা নাটককে দিল মুক্তি।  
এর আগে বাংলা নাটকে কিন্তু ঘোর দুর্দিন চলছিল। বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, শচীন সেন গুপ্ত, বিধায়ক ভট্টাচার্য,মন্মথ রায় হাংরি জেনারেশনকে তুষ্ট করতে পারছেন না। বাংলা নাটকের সেই ক্ষুধার রাজ্যে এলেন নাটকের তরবারি হাতে বাদল মোহিত মনোজ। এর মধ্যে আবার বাদল মোহিতকে নিয়েই ইন্টেলেকচুয়ালদের আলোচনা তর্কাতর্কি তুঙ্গে।কফি হাউসে বসে তারা মজা করে বলছেন মোহিতের নাটক দেখতে গেলে একটা অভিধান ঝোলায় রাখিস।আর বাদল বাবুর নাটক আমাদের শুকনো গলায় বারদুয়ারির কারণবারি। 
মোহিতদা লিখছেন “চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড”, “মৃত্যুসংবাদ”,”নীল রঙয়ের ঘোড়া”, “গন্ধরাজের হাততালি”,”বাঘবন্দী”,”নিষাদ",“ক্যাপ্টেন হুররা”,”রাজরক্ত”,” স্বদেশী নক্সা”। এই ধারাটাই সাতের দশক থেকে আটের দশকে এসে পাল্টে ফেলছেন। আর বাদল সরকার পালটাচ্ছেন অন্ধকার মঞ্চ থেকে আলোর অঙ্গনে নিয়ে এসে নিজেকে। তাহলে লিখলাম কেন বাউল ও একতারা কথাটি? আসি সেই কথায়। 
বাদল সরকার যে থার্ড থিয়েটার শুরু করলেন সেখানে ধনী ও পেশাদার মঞ্চের দর্শক পা মাড়ালেন না।কাউন্টারে এসে টিকিট কাটা নেই। দেখার জন্যে দীর্ঘ লাইন নেই। সাজগোজ করে এসে গাড়ি থেকে নামা নেই। কমপ্লিমেন্টারি নেই।কায়েত বামুন চাষা কৈবর্ত শ্রমিক মধ্যবিত্ত সব মেঝেতে কি ঘাসে বসবে এ কেমন ধারা? তাও বা যদি কৌতূহল মেটাতে যাওয়া গেল ও বাবা না আছে আলোর কারিকুরি, না সাজপোশাক,না আছে বিশাল বিশাল সেট আর নটনটীর চাকচিক্য। যদিও তাতে থার্ড থিয়েটারের কিছু এলো গেল না।তারা চাইলেনও না এইসব শ্রেণী গোষ্ঠীকে। তারা চাইলেন নাটক শেষে মুগ্ধতা নয়, উঠুক তর্ক, উঠুক প্রশ্ন,জিজ্ঞাসা। 
তবু একটা দূরত্ব ও এই ধরনের নাট্য ধারার প্রতি ছুঁৎমার্গ রয়েই গেল। ফলে থার্ড থিয়েটার আপামর বাঙালিকে আনতে পারল না তার অঙ্গনে। এই সুযোগটা নিল গ্রুপ থিয়েটার। তারা আত্মরক্ষায় “থার্ড থিয়েটারের” বিরুদ্ধে কোমর বাঁধল।এর মধ্যে গণনাট্য ধারার সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীরা কিন্তু একটু একটু করে এই ধারায় পা বাড়াতে শুরু করে দিয়েছে ততদিনে। যদিও তারা থার্ড থিয়েটারের আঙ্গিককে গ্রহণ করলেন। বিষয়কে নয়। থার্ড থিয়েয়ারে যে অতি বামপন্থার ছোঁয়াটা আছে সেটা বামফ্রন্টের আমলের সংসদীয় গণতন্ত্রবাদীরা মেনে নেবেন কী রে?  বাদল সরকার ও তার থিয়েটার আবার একলা হোল। 
এ বাদে যে সব নাট্যদল বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটারের থিয়োরি ও ফিলজফি না বুঝে কেবলমাত্র এর নিরাভরণ ছিমছাম সহজিয়া ধারাকেই প্রকৃত নাট্য ভাবলেন তারা এই ধারার সবচেয়ে ক্ষতিকারক অংশ। এর মধ্যে এক সমালোচক যিনি শম্ভু মিত্র ছেড়ে বাদল সরকার নিয়ে পড়েছিলেন তিনি আচমকাই থার্ড থিয়েটার ছেড়ে অল্টারনেটিভ থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলেন। ফলে সাতের দশকের শেষ থেকে খড়দহের প্রবীর গুহ র “সমুদ্র অস্থির” খড়দহ থেকে ম্যাক্সমুলার ভবন ছাড়িয়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলার গ্রুপ থিয়েটার ধারাকে অস্থির করে তুলেছিল বৈকি। পোল্যান্ড থেকে জর্জি গ্রোতস্কি এসে সে ধারার নাটক দেখছেন। অবনী বিশ্বাস প্রবীর গুহ এদের পোল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছেন।অবনী বিশ্বাস গুরুর শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছেন ইতালি। সেখান থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলছেন “থিয়েটার হাউস”। আর প্রবীর খড়দহ থেকে মধ্যমগ্রামে এসে নির্মাণ করল “আখড়া"।বস্তুত প্রবীরের হাত ধরেই এসেছে  আজকের “অন্তরঙ্গ থিয়েটার”। 
ইতোমধ্যে দিল্লীর ছেলে সফদর হাসমি তার বাংলা থিয়েটারের প্রতি অনুরাগ আর শ্রদ্ধার কারণেই বাংলার নাট্যকর্মীদের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল সহজেই। তার সঙ্গে চাকরি সূত্রে দিল্লীতে বাংলার তথ্য ও জন সংযোগের অফিসার হিসাবে বেশ কয়েক বছর বাংলা নাটকের উৎসব এর আয়োজন করে।বাংলার প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠিত নাট্যগোষ্ঠী সেই উৎসবে যোগ দিয়েছিল। সেই হাসমিকে আটের দশকের শেষে নাটক চলাকালীন আক্রমণ করে খুন করা হলে বাংলা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। ইতিহাসের কারণেই জানিয়ে রাখা প্রয়োজন প্রয়াণ সংবাদ পাবার পরেই স্বজন হারানোর ব্যথা ও ক্ষোভে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি,কুমার রায় ও আরও কয়েকজন অধ্যাপক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শোকসভার আয়োজন করি। বিকেলবেলা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার,গণতান্ত্রিক লেখক ও কলাকুশলী সংগঠন এর আয়োজনে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে স্মরণ সভার আয়োজন করলে নাট্য কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েত হয়ে এই হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেদিন উৎপল দত্ত এক তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষায় বক্তব্য রাখেন। সেদিনের একটি কথা আজো ভুলতে পারিনি। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন শাসকরা যেভাবে অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এরপর দেখব তারা কোন নাটককেই মঞ্চস্থ হতে দেবে না আর দূরদর্শনে বিনোদনের জন্যে সংবাদ পাঠের মধ্যেই বিজ্ঞাপন গুঁজে দেবে।আমাদের বাধ্য করবে রবিশঙ্করের সেতার বাদন থামিয়ে সাবান আর গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখতে। সেদিন হাসমির জন নাট  মঞ্চের জীবিত সহযোদ্ধারা করেছিল “হল্লা বোল”। যে নাটক চলাকালীন আক্রমণ নেমে এসেছিল ও প্রয়াণ হয়েছিল প্রিয় বন্ধুর। বাংলায় এবার জোয়ার এলো নুক্কড় নাটকের। ১২ এপ্রিল সফদরের জন্মদিনকে সামনে রেখে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল মাঠ পাথার বন্দরের নাটক। হাসমির নির্দেশিত সবকটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হোল।আবার জানিয়ে রাখি হাসমির জীবদ্দশাতেই শূদ্রক নাট্য দলের ভারতীয় নাট্য সংখ্যায় নাট্যকার দেবাশিস মজুমদারের অনুবাদে মুদ্রিত হয়েছিল “আওরৎ”। বাদল সরকার প্রসঙ্গে এই কথাগুলি বলার কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেই বাদল সরকারের জীবদ্দশাতেই থার্ড থিয়েটার একটা গণ্ডীর মধ্যে আবর্তিত হতে থাকল। বাদল সরকার নিজেও কিন্তু তখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। 
বাদল সরকার তখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তার দর্শনকে তুলে ধরতে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ওয়রকশপ করাচ্ছেন।এই ভাবেই ১৯৯৪ তে তিনি এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে। ছিলেন কয়েকমাস। ঠিক যেভাবে এসেছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কুমার রায় প্রমুখ নাট্য ব্যক্তিত্ব। তবে বাদল সরকারের সান্নিধ্য যারা পেয়েছিল সে সময় তারা সবাই যে আজ নাটকের সঙ্গে জড়িত তা না হলেও চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে একটা নতুন দিশার সন্ধান পেয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। আবার প্রতিকূলতাও কম পেতে হয়নি।এখানেও অনেকটা একলা বাউল তিনি। 
জীবনের উপান্তে এসে বাদল সরকার নাটক পাঠ করছেন। কোলাজ করছেন। একটা গুটিপোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন একটু একটু করে।                
২০১১এর এপ্রিলে কোলনে ক্যান্সার ধরা পড়ল।একা মানুষ বাদল সরকার ১৩ মে, ২০১১, বছর বয়েসে নিঃশব্দে চলে গেলেন।বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের কিংবদন্তী এই নাট্যব্যক্তিত্ত্ব সাতের দশকের উত্তাল সময়ের শুরু থেকেথার্ড থিয়েটারনামক ভিন্ন এক নাট্য আঙ্গিক দর্শনের এর দ্গাতা, নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বর্ণময় নাট্যজীবনে কালের রাখালের মতোই কাটিয়েছেন। 

আজ পড়ে আছে তার ফেলে যাওয়া একলা একতারা। হাজার নাট্য উৎসব আর আলোচনা সেই একাকীত্বকে কাটিয়ে নিকানো অঙ্গনে টঙ্কার তুলবে না কি সযত্নে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখবে সেটাই দেখার।  

সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭

স-বিনয়ে অপ্রিয় কথন

সেদিনও এমন বৃষ্টিস্নাত শহর।নিম্নচাপের জোরে যত না ভাসছে নগরী তার চেয়ে অনেক বেশি অশ্রু আকুল এই বাংলার নারীকুল।কারণ উত্তমকুমার নেই।সবাইকে ভাসিয়ে তিনি কেমন করে অকালে চলে গিয়েছিলেন সে কথা তার প্রয়াণের ৩৭এ এসেও সবাই মনে রেখেছেন।হাহাকার আজো থামেনি।কারণ তার স্থান কেউই পূরণ করতে পারলেন না এই সাইত্রিশ বছরেও।উত্তম-সুচিত্রা,উত্তম-সাবিত্রী,উত্তম-মাধবী, উত্তম-সুপ্রিয়া একের পর এক হিট বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্র।তাদের অভিনয়,অনবদ্য পরিচালনা,সম্পাদনা,চিত্রনাট্য আর সংগীত হেমন্ত,শ্যামল,মান্না,লতা,সন্ধ্যা,আরতি।শুধু তাই নয় সত্যজিত রায়ের “নায়ক” এ তিনি তার জাত চেনালেন।কবি সাহিত্যিকদের কাছে পাত পেলেন।যারা এতোদিন কফি হাউসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশে তার অভিনয় তুচ্ছ জ্ঞান করতেন তারাও নড়েচড়ে বসেছিলেন।এমন এক ম্যাটিনি আইডল এর অকাল প্রয়াণ সবাইকে শোকাহত করবে এটাই তো প্রত্যাশা।বিশেষ করে বাংগালি যারা সারা ভারতের চোখে তখনও কালচারাল আইকন।
পরের দিন পচিশে জুলাই খোলা গাড়িতে ফুলের পাহাড়ে আড়াল হয়ে সারা নগরী ঘুরে তিনি শায়িত হলেন কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।তার শেষযাত্রা কেউ কেউ বাইশে শ্রাবণের সংগে মেলালেন।মাদার টেরিজা তার বহু পরে এমন ক্রাউড টেনেছিলেন।ফিরে আসি আশির কলকাতায়।ফিরে আসি পচিশে জুলাই।এই পচিশে জুলাই মহানায়কের মহাশোকের মধ্যেই সবিনয়ে কখন যে চলে গেলেন বিনয় ঘোষ কেউ জানতে পারলেন না।জানতে চাইলেনও না।
কে এই বিনয় ঘোষ?তার মৃত্যুর সাইত্রিশ বছরে এসে কেন এই উচ্চারণ,কেন এই হাহাকার?যাকে কেউ মনে রাখেনি তখনই তাকে মনে রাখবে কাল?কেন?কীসের দায়ে?দাদাগিরিতে এর কথা আসবে না।দিদি নং ওয়ানেও নয়।চ্যানেলে চ্যানেলে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নমালায় তিনি নেই।তিনি নাট্যকার-প্রাবন্ধিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবি বিনয় ঘোষ।
পৈতৃক নিবাস ছিল যশোরে।১৯১৭ সালের ১৪ জুন কলকাতায় তাঁর জন্ম।আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও নৃতত্ত্বে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুর।নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাপ্তাহিক ফরোয়ার্ড(১৯৩৯-১৯৪১),যুগান্তর(১৯৪৩-১৯৪৫),দৈনিক বসুমতী (১৯৪৬-১৯৪৭)ও সাপ্তাহিক অরণি পত্রিকায় সাংবাদিকতার বিভিন্ন পদে তিনি বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিক, সমাজতাত্ত্বিক, লেখক, সাহিত্যসমালোচক, বাংলা ভাষা ও লোকসংস্কৃতির গবেষক বিনয় ঘোষ ‘কালপেঁচা’ ছদ্মনামেও লিখতেন।ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক পর্যালোচনায় ও মার্কসবাদী বিশ্বাসে ছিলেন প্রত্যয়ী।আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সোভিয়েত সভ্যতা (২ খন্ড), ফ্যাসিজম ও জনযুদ্ধ, সোভিয়েত সমাজ ও সংস্কৃতি ইত্যাদি ছিল তাঁর রাজনীতিবিষয়ক গ্রন্থ।
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের (IPTA)সঙ্গে বিনয় ঘোষের ছিল নিবিড় সখ্য।সঙ্ঘের জন্মলগ্নেই তাঁর লেখা “ল্যাবরেটরী” নাটকটি অভিনীত হয়।গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ (১৯৪০), মেট্রোপলিটন মন, বাংলার নবজাগৃতি (১৯৪৮), পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ ও ক্ষেত্রসমীক্ষা-ভিত্তিক আলোচনাগ্রন্থ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (১৯৫৭) তাঁর বিশিষ্ট রচনা। বিদ্যাসাগর ও বাঙালীসমাজ (১৯৫৭), বিদ্রোহী ডিরোজিও (১৯৬১), সুতানুটি সমাচার (১৯৬২), বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (১৯৬৮), মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ (১৯৭৩), বাংলার বিদ্বৎ সমাজ (১৯৭৩), কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (১৯৭৫), বাংলার লোকসংস্কৃতি ও সমাজতত্ত্ব (১৯৭৯) প্রভৃতি তাঁর অন্যান্য প্রধান রচনা। মার্কসবাদের আলোকে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা ও বিশ্লেষণ এসব গ্রন্থের প্রধান আকর্ষণ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ টাউন কলিকাতার কড়চা (১৯৬১), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (৪ খন্ড, ১৯৬২-৬৬), জনসভার সাহিত্য, কালপেঁচার নকসা, নববাবুচরিত, ডাস্টবিন (গল্প-সংকলন) ইত্যাদি। “৩০৪” নামে একটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেছিলেন।
বিনয় ঘোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিদ্যাসাগর বক্তৃতা’র প্রথম বক্তা (১৯৫৭) ছিলেন। ১৯৫৮-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রকফেলার রিসার্চ স্কলার হিসেবে গবেষণারত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র-পুরস্কারে (১৯৫৯)ভূষিত করা হয়।
কলকাতা নিয়ে গবেষণা করেছেন অথচ তার কিছুই পড়েননি এমন গবেষক নেই বললেই চলে।যদিও বিনয় ঘোষের লেখার মূল সূত্র ছিল আগের বেংগল গেজেট, গেজেটিয়ার,স্মৃতিকথা ও হিকির ডায়েরি এবং অন্যান্য ব্রিটিশ লেখকদের লেখা তবুও বাংলায় সেগুলি এক মূল্যবান প্রাপ্তি।
১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই তাঁর প্রয়াণ হয়।বিস্মৃত বাঙালি নাই বা তাকে মনে রাখল। গবেষকদের কাছে তার কদর ফুরিয়ে যাবার নয়।লেখকের মৃত্যু হয় না।
পুনশ্চঃ আজ সকালে এই লেখাটি পোস্ট করার পর দিল্লী প্রবাসী আমার বন্ধু শ্রীময়ী সুতপা চক্রবর্তী লেখাটি পড়ে আমাকে১৯৮০ র ২৫জুলাই দিনটির কথা মনে করিয়ে দিল অন্যভাবে।আমরা তখন রবীন্দ্রভারতীতে নাটক বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী।ঠাকুরদার ক্যান্টিনে চা আর চিড়ের পোলাও-ঘুগনি খেতে খেতে উত্তমকুমারের মূল্যায়ন চলছিল।তার মধ্যে আমার বিষন্ন মুখ দেখে ওরা ভেবেছিল আমি উত্তমকুমারের প্রয়াণ শোকে মুহ্যমান।ওরা যখন শুনল উত্তমকুমার নয় আমি শোক করছি বিনয় ঘোষের জন্যে আর বিনয় ঘোষের প্রয়াণ সংবাদ সেই গুরুত্ব পেল না দেখে কিছুটা ক্ষুব্ধ ওরা আমার এই শোককে লেপ-তোষকের তুলো যেভাবে ধুনুরি হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় সেইভাবে বলেছিল –ওরে তোর বিনয়কে কেউ মনে রাখবে না রে,মনে রাখবে ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে।

ওরা কতটা সত্যদ্রষ্টা ছিল তখন বুঝতে চাইনি।এখনও কী বুঝেছি?কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ সংবাদ দৈনিক সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় মুখ লুকিয়েছিল ঋত্বিক রোশনের কলকাতা আগমনের উল্লাসে।কতো শিল্পী-বুদ্ধিজীবি-সাহিত্যিক-কবি চলে গেলেন চুপি চুপি,একা একা।সেও কী আমাদের জন্যে? 

শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭

শম্ভু উৎপল অজিতেশ এবং বাদল সরকার
সলিল সরকার

শুরুর প্রথম তিনটি নাম বাংলা থিয়েটারে একসময় একসাথে উচ্চারিত হোত।ঠিক যেমন এর আগে গিরিশ, অর্দ্ধেন্দু, অমৃতলাল কিম্বা শিশির, অহীন্দ্র।শিশির অহীন্দ্র নিয়ে "নাচঘর" পত্রিকায় হেমেন্দ্র কুমার রায় নিয়মিত একটা লড়াই জারি রাখতেন।শিশির ভাদুড়ির দিকেই পাল্লাটা ভারি থাকত।কিন্তু ম‍্যাগসাইসাই পাওয়ার পরে পরে আমাদের চোখের সামনে যে পত্র পত্রিকা বাংলা থিয়েটারের নাম উচ্চারণ করতে নাক সিঁটকাতো তারাই জয়গানে মাতল আর উৎপল দত্ত মানেই কমিউনিস্ট হিন্দি সিনেমার ভিলেন।অজিতেশ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ও তাই "হাটে বাজারে"র খলনায়ক।কজন বাংলা গ্রুপ থিয়েটার কে সমাদর করতেন কমিটেড মধ‍্যবিত্ত ছাড়া?আর সেখানে বাদল নামটির কোনও স্থান ছিল কী?শম্ভুদা তার যে নাটক করেছেন সেগুলি নিয়ে সেসময় তেমন আলোচনা বা মাতামাতি হয়েছে বলে জানা নেই বরং থার্ড থিয়েটার নিয়ে একটা তাচ্ছিল্য ছিল বাংলা প্রসেনিয়ম থিয়েটারের আটের দশকের নাট‍্যকার পরিচালক দের মধ‍্যে।আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না "থিয়েটার বুলেটিন" পত্রিকায় বাদল সরকার ও তার থিয়েটার নিয়ে ঠিক কতটা শিথিল সরসতা ও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছিল।এই তারা এই পত্রিকায় অজিতেশ কে নিয়েও পড়েছিলেন।অজিতেশ নীলকণ্ঠ হয়ে তা পান করে এক নবীন নাটককার কে বলেছিলেন বাংলায় ভালো নাটকের খুব অভাব।ওটাই করো।ওটাই থাকবে।কেচ্ছা নয়।
বাদল সরকার অবশ‍্য নির্বিকার থেকে নিজের কাজ করে যেতেন।অবশ‍্য কিছু ছেলেমানুষীও নিজের চোখে দেখেছি।একবার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তাকে তার থিয়েটার নিয়ে বলতে আমন্ত্রণ জানান হোল।তিনি শুরু করলেন ডায়াসে মাইক হাতে।হঠাৎ বলে উঠলেন আমি তো এই মঞ্চ বিরোধী।বলেই মাইক রেখে ডায়াস থেকে নেমে এসে আমাদের সামনে খালি গলায় তরতরিয়ে বলতে থাকলেন তার নাট‍্যভাষা ও ভাবনার কথা।তিনি মিডিয়া কে সযত্নে এড়িয়ে যেতেন।একসাথে আড্ডা দিয়েছি, তর্ক করেছি সেই আমি নাট‍্য আকাদেমির উৎসবে তার ছবি তুলতে গেলে আপত্তি জানিয়েছেন।আবার "দেশ" পত্রিকার জন‍্য বিভাস চক্রবর্তী এক লম্বা সাক্ষাৎকার ক‍্যাসেটবন্দী করে আমার হাতে দিয়েছিলেন অনুলিখন করতে।এতো ছাপোষা ভঙ্গিতে নিজের কথা কাউকে বলতে শুনিনি।রাগ পুষে রাখতেও দেখিনি।নিজের প্রতি আস্থাই কি তাকে এমন করে তুলেছিল?
শম্ভুদার স্বাভিমান দেখেছি, উৎপল দত্তের ক্রোধ,অজিতেশদার অভিমান আর বাদলদার জেদ।অনেকের হেঁসেলি চাল ও চলন তাও দেখেছি কিন্তু আজ ১৫ জুলাই জন্ম নেওয়া মানুষটির কথাই বলা হোক।
বাদল বাউলের একতারা 
সলিল সরকার 
বাদল সরকার তার নতুন নাট্য ধারাকে শুরুতে “অঙ্গন মঞ্চ” বললেও পরে একে অভিহিত করছেন “থার্ড থিয়েটার” নামে। বাংলায় তথা ভারতে জন্ম নিল এক নতুন নাট্য ধারা। কী সেই ধারা এখন সেটাই দেখার। 
বাদল বাবুর মতে বাংলার লোকনাট্য হোল “ফার্স্ট থিয়েটার”, পাশ্চাত্যের অনুকরণে যে নাটক যা ব্রিটিশদের হাত ধরে এলো তা “সেকেন্ড থিয়েটার” আর তিনি তৈরি করলেন “থার্ড থিয়েটার” যেখানে প্রসেনিয়মের আড়াল থাকবে না। আলো আঁধারের মায়া থাকবে না। প্রযোজনার বাহল্য থাকবে না। প্রসেনিয়মের হাতি পোষা ব্যয় বিড়ম্বনায় ফেলবে না নাট্য দল গুলিকে। প্রযোজনা হবে নিরাভরণ, বাহুল্য বর্জিত, ছিমছাম। যেখানে টেক্সট ও অভিনয় প্রকাশ্য দিবালোকে কিম্বা ফিলামেন্টের আলোয় দর্শককে ভাবাবে, জারিত করবে, তাড়িত করবে। 
বাদল সরকার দাবি করলেন এখন থেকে দর্শক আর নিরাপদ দূরত্বে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে না। নাট্য মুহূর্তরা হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলবে। রাজা বাদশা আর হরিপদ কেরানি একই পোশাকে সামনে মূর্তমান। তফাৎ সামান্য কিছু উপকরণে। মিউজিকের ব্যবহার সেও মুখে মুখে। রূপসজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। 
প্রথমে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস এর চিত্র প্রদর্শন কেন্দ্র সেকান থেকে এখানে ওখানে কিছু অন্তরঙ্গ স্থানে সেখান থেকে একেবারে সরাসরি কার্জন পার্কের ঘাসে। ১৯৭৬ এ শতাব্দী প্রতি শনিবার কার্জন পার্ক আজকের সুরেন্দ্রনাথ পার্কে খোলামেলা ভাবে নাট্যের আসর বসাল। টিকিট বিক্রির বালাই নেই। বিজ্ঞাপনের ব্যয় নেই। নাটক দেখার জন্যে মানুষের হাতে পায়ে ধরা নেই।শুধু প্রযোজনা শেষে কলাকুশলীরা একটা কাপড় নিয়ে সমবেত দর্শকদের সামনে হাজির হবে।তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা দেবেন সেটাই। এই ধারার নাটক প্রযোজনা বাংলার মধ্যবিত্তকে নাড়া দিল, রাজনৈতিক অস্থিরতার আবহে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ দিল।বলা ভালো গুমরে মরা মনের কথাগুলো প্রাণ পেতে থাকল। 
১৯৭৬ থেকে ২০০৩ কার্জন পার্ক থেকে থিয়োজফিক্যাল সোসাইটি, ওয়াই এম সি আই সারা ভারতের নানান প্রান্তে “থার্ড থিয়েটার” তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে চলল। 
"His plays reflected the atrocities that prevailed in the society, the decayed hierarchical system and were socially enlightening. He is a proponent of the "Third theatre" movement that stood ideologically against the state. Third theatre involved street plays, with actors being attired no differently than the audience. Also the formal bindings of the proscenium theatre was given up. Sarkar's "Bhoma" is an example of a third theatre play, set as always, in an urban background. Starting with Sagina Mahato, which marked his advent into arena stage, his subsequent plays, Michhil (Juloos), Bhoma, Basi Khobor, Spartacus based on Howard Fast's historical novel by the same name, were performed in parks, street corners and remote villages with the audience sitting all around.”
নাট্যকার বাদল সারকার,প্রযোজক অভিনেতা বাদল বাবু নিছক নাটকের জন্যে নাটকে কখনই বিশ্বাসী ছিলেন না। বস্তুত বিশ্বের কোথাও কোনও নাট্যজনই তার সময় সমাজ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। 
৬৪ তে কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়েছিল।৬৯ এ আর এক ভাগ হোল। নকশাল বাড়ি থেকে সারা বাংলা ভারতে ছড়িয়ে গেল সে বিপ্লব। এর পাশে প্রতিবেশী বাংলায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এর আঁচ এসে পড়ল এ বাংলাতেও। মিছিল, ভোমা, হট্টমালার ওপারে, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, দ্বৈরথ, বাসি খবর, স্পারটাকাস, জন্মভূমি আজ, গণ্ডী এই নাটকগুলিও বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। 

১৯৬৮ তে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সম্মান। ১৯৭১ এ পেলেন জহরলাল নেহেরু ফেলোশিপ, ১৯৭২ এ পেলেন পদ্মশ্রী,১৯৯৭ এ পেলেন “রত্নসদস্য" আর ২০১০ প্রয়াণের এক বছর আগে পেয়েছিলেন কেরালা সঙ্গীত নাটক আকাদেমির থেকে “আম্মান্নুর পুরস্কারম”। এ তো গেল পুরস্কারের কথা। বাদল সরকার শুধু পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছিলেন? তিরস্কার পাননি? সে কথায় যাব পরের পর্বে।  

বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭

বাদল বাউলের একতারা
সলিল সরকার

বাদল সরকারের প্রথম পর্বের নাটক মূলত সরস কৌতুক। মাইথন অফিসারদের রিক্রিয়েশন ক্লাবে নিয়মিত নাটক হতো। বড় পিসিমা, সলিউশন এক্স, রাম শ্যাম যদু, বল্লভপুরের রূপকথা,  
বাংলা নাটকে সরস কৌতুকের এক নতুন মাত্রা আনল। এর আগে কমেডির নামে যা লেখা হচ্ছিল তা যেন শিথিল ভাঁড়ামো। এমন ঝরঝরে ভাষায় তরতর করে এগিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ছিল না বললেই চলে। এরপর লিখলেন “সারারাত্তির”। এই সবকটি নাটকই সেসময় বিপুল সাড়া ফেলেছিল। বাংলা নাটকে তখনো নতুন চমক আসার কথা ভাবেননি কেউই। রক্তকরবী-এর পরে যেমন নবান্ন সেইভাবেই এলো “এবং ইন্দ্রজিৎ”। বাংলা নাটক আধুনিক হয়ে উঠল। 
নাট্যের অ ম ল বি ম ল ক ম ল এবং সুধীন্দ্রনাথেরা পেল নতুন দিশা।  
সুধীন্দ্রনাথ সরকারকে বুঝতে গেলে বাংলার ছয়ের দশককে ও সাতের দশককে বুঝতে হবে।তবেই পাওয়া যাবে বাদল সরকারকে। পাওয়া যাবে বাংলা নাটকের নতুন দিশা। পাওয়া যাবে “এবং ইন্দ্রজিৎ” ও আরও কিছু। 
১৯৫৯ এর ৩১ আগস্ট এক নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছিল এই বাংলার মোকাম কোলকাতায়। মারা গিয়েছিল ৮১জন।১সেপ্টেম্বর পালিত হোল শহীদ দিবস। এই দশকে ছাত্র আন্দোলন এক অনন্য ভূমিকা নিতে এগিয়ে এলো। ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে বাম রাজনীতি ‘কনফিউজড’ । সরকারি চাকুরেদের মাইনে বাড়ছে। অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে।এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়তেই ছাত্ররা ট্রাম বাস পুড়িয়ে আন্দোলন শুরু করে দিল। উত্তাল কলকাতা।উত্তাল বাংলা। বাংলা থিয়েটারে মুক্তির সন্ধান পাশ্চাত্য নাটকের অনুবাদ ও মঞ্চায়নে। “এবং ইন্দ্রজিৎ” সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবাদের দ্বিধার দলিল। কারণ তখন অমল বিমল কমল সুধীন্দ্রনাথ এরা বামপন্থী রাজনীতিতে কালের নিয়মে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। বাদলবাবু লিখছেন, “হাসাবার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে আমার। ... এতো রূপক এতো আড়াল সত্ত্বেও সত্যি মানুষগুলো বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’’
প্রসেনিয়াম মঞ্চে বাদলবাবুর নাট্যকার হিসেবে তীব্র সাফল্য তৈরি হচ্ছেসারারাত্তির’, ‘এবং ইন্দ্রিজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘প্রলাপ’, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’, ‘পাগলা ঘোড়া মতো নাটকগুলির মধ্য দিয়ে।প্রবাদপ্রতিম শম্ভু মিত্র ও বহুরূপী বাদল সরকারকে নাট্যকার হিসেবে সম্মান জানাচ্ছে তার নাটক মঞ্চায়ন করে। বাদল সরকার “বাকি ইতিহাস” লিখছেন ৬৫ তে, ৬৬তে লিখছেন “প্রলাপ", একই সময়ে লিখছেন “ত্রিংশ শতাব্দী” ৬৭ তে লিখছেন “পাগলা ঘোড়া” ।তাপস সেনের আলো, খালেদ চৌধুরীর মঞ্চ, শক্তি সেনের রপ সজ্জা আর শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বাদল সরকারের নাটক পাচ্ছে নতুন মাত্রা। বাংলার আন্দোলনের মতোই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে বাদল ধারা। 
তার ফলে ১৯৬৮ তে তিনি পাচ্ছেন সংগীত নাটক আকাদেমি সম্মান। 

এই পুরস্কার প্রাপ্তির এক বছর আগেই গ্রে তুলছেন নিজের নাট্য সংগঠন “শতাব্দী"। প্রসেনিয়ম মঞ্চেই চলছে প্রযোজনা। কিন্তু সে আর কতদিন? বাংলার মাঠ-পাথার-প্রান্তর ডাকছে আয় আয় আয়। এবং ইন্দ্রজিতের মতো তিনিও দোলাচলে। প্রসেনিয়মের পাশাপাশি অঙ্গন মঞ্চ। যখন খ্যাতির তুঙ্গে তখনি তো মায়া কাটানোর কাল। বাউল বাদল আলো অন্ধকারে ছটফট করতে করতে পেলেন অন্ধকার থেকে মুক্তির দিশা। বাদল বাউল নাট্যের একতারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন অঙ্গনে।    

মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭

বাদল বাউলের একতারা
সলিল সরকার
 
চেনা পরিচয় বহুদিনের এমন দাবি করি না।আবার খুব বেশি নয় তাও বা বলি কী করে?ভিকিরিপতি গ্রামে বসেই রেডিয়োতে তার নাটক শুনতাম।শম্ভুদার সেই জাদুকরী কণ্ঠে “দম্পতি>জম্পতি>জায়াপতি”,”অমল বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ”।
অজিতেশদার ভরাট গলায় “বল্লভপুরের রূপকথা”।তখন থেকেই জানি বাদল সরকার বাঙালি হয়েও জাতীয় নাট্যকার।রবীন্দ্রনাথের পরে বাদলবাবুর নাটক সবচেয়ে বেশি নানান ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছে।আর এমনও হয়েছে কোনও কোনও প্রদেশ ভেবেছে বাদল সরকার তাদের ভাষারই নাট্যকার।এ নিয়ে ঘটে যাওয়া এক মজার কথা না লিখে পারছি না।
হিন্দি নাটকের প্রতিভাময়ী নাট্যব্যক্তি এই কলকাতার প্রতিভা অগ্রবাল যিনি প্রখ্যাত নাট্যকার ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের আত্মীয়া নিয়মিত বাংলা নাটকের হিন্দি অনুবাদ আর হিন্দি নাটকের বাংলা অনুবাদ করতেন।একবার অখিল ভারতীয় কার্যক্রমের জন্য তাকে দিল্লি থেকে একটি নাটক পাঠানো হোল যার বাংলা তর্জমা করে দিতে হবে।প্রতিভাজি প্যাকেট খুলে দেখলেন নাটকটির নাম ও নাট্যকারের নাম।এবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে নাট্যকারের মৌলিক নাটকটি কিনে দিল্লির আকাশবাণীতে পাঠিয়ে দিলেন।নাটকটির নাম “পাগলা ঘোড়া”।নাট্যকারের নাম যে বাদল সরকার সে কথা কী বলে দিতে হবে?
বস্তুত ভারতীয় নাটকের এই কিংবদন্তী বাঙালি নাট্যকার প্রথম জীবনে প্রসেনিয়ম থিয়েটারের সার্থক নাট্যকার।
বাদল সরকারের জন্ম ১৯২৫এর ১৫ জুলাই।উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে মানিকতলার প্যারি রোতেই সারাজীবন কাটিয়ে গেলেন। শিবপুর  থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে প্রথমে মাইথনে পরে কলকাতায় চাকরি করেন।মাইথনের চাকরি আর শখের নাট্যচর্চা তাকে নাটক লিখতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
 ১৯৫৭-৫৯ লন্ডনে এরপর ১৯৬৩-৬৪ সালে ফ্রান্সে থাকার সময় প্রচুর ইউরোপীয় থিয়েটার দেখার সুযোগ পান।কর্মসূত্রে নাইজেরিয়ায় থাকার সময় বেশ কয়েকটি নাটক লিখলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে টাউন প্ল্যানিং এর চাকরী নিয়ে কলকাতায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। নাটক লেখা, প্রযোজনার কাজ ছাড়াও দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোতে অদম্য উৎসাহ ছিল। বিশ্বভাষাএস্পারেন্তোনিয়ে ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ, নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। শেষ কয়েক বছরে আত্মজীবনীমূলক লেখাপুরানো কাসুন্দীতে বিস্তারিতভাবে নাটক দেখা, করা, নাটক নিয়ে নানা ভাবনা চিন্তার কথা সরস ভাবে লিখে গেছেন।আর একটা কাজ তিনি শেষবেলায় শুরু করেছিলেন “কোলাজ”।
বাদল সরকারের প্রথম পর্বের নাটক মূলত সরস কৌতুক। মাইথন অফিসারদের রিক্রিয়েশন ক্লাবে নিয়মিত নাটক হতো। বড় পিসিমা, সলিউশন এক্স, রাম শ্যাম যদু, বল্লভপুরের রূপকথা,  

বাংলা নাটকে সরস কৌতুকের এক নতুন মাত্রা আনল। এর আগে কমেডির নামে যা লেখা হচ্ছিল তা যেন শিথিল ভাঁড়ামো। এমন ঝরঝরে ভাষায় তরতর করে এগিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ছিল না বললেই চলে। এরপর লিখলেন “সারারাত্তির”। এই সবকটি নাটকই সেসময় বিপুল সাড়া ফেলেছিল। বাংলা নাটকে তখনো নতুন চমক আসার কথা ভাবেননি কেউই। রক্তকরবী-এর পরে যেমন নবান্ন সেইভাবেই এলো “এবং ইন্দ্রজিৎ”। বাংলা নাটক আধুনিক হয়ে উঠল।