MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

মঙ্গলবার, ১৫ মে, ২০১৮

মন খেরোর খাতা
তরণীসেন বধ পালা
সলিল সরকার
এই দু দিনে আমাদের করা যাত্রাপালা ও প্রযোজনা নিয়ে এতো আলোচনায় আমি অভিভূত কেন না এই প্রযোজনায় যুক্ত মানুষজন লেখাটার সংগে নতুন করে যোগ দিয়ে ইতিহাস সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করছে।
প্রথমেই গৌরবন্ধুর কথা বলি গৌর আমাদের সমবয়সী হলেও বিভাগে আমাদের জুনিয়র ছিল।পরে কলকাতা দূরদর্শনে চাকরি পায়।ওর দিদি গৌরী আমাদের সংগে পড়ত।যদ্দুর মনে পড়ছে গৌর ও একটা চরিত্র করত।আর গৌর যেটা লিখেছে সেটাও ঠিক কেন না আগেই বলেছি শৈশবে দেখা যাত্রাপালার মতো এখানেও পালার শুরুতে আইটেম ডান্স ছিল।
কনসার্ট এ ছিল ফ্লুট, ক্ল‍্যারিওনেট, ভায়োলিন, তবলা,ঝাঁঝ,কাঁসর,হারমোনিয়াম আর এফেক্ট।অভিনয়ে সাবেকি ধারা আনার চেষ্টা ছিল।সাজসজ্জা, পোশাক এসবেও যত্নবান ছিলেন গণেশবাবু।
অলোকের কথা আগেই লিখেছি।অলোক কিছু কথা মনে করিয়েও দিয়েছে।যেভাবে অপরূপ মনে করাল।অপরূপের বাবা একটা পত্রিকা চালাতেন যেখানে আমি প্রবন্ধ লিখেছি।অপরূপ যাত্রা ও পরে প্রাইভেট চ‍্যানেলে যুক্ত হয়।
দেবাশিস ও অরুণীতা শূদ্রকের সংগে যুক্ত হয়েছিল আর বহুরূপীতেও ছিল অরুণীতা।দেবাশিস নাট‍্যশোধে ও পরে রবীন্দ্রভারতীতে অধ‍্যাপক হয়।মানসী আমাদের জুনিয়র আর প্রতিমা আমাদের সংগে পড়তে আসার আগে থেকেই বিভিন্ন দলে অভিনয় করত।
পলাশ ফোটোগ্রাফিটা নেশা থেকে পেশায় পাল্টে নেয়।ইংরেজি নাটকের সংগে যুক্ত ছিল।অমিতাভ গণকৃষ্টি নাট‍্য দলের প্রধান।বিজয় বেথুয়াডহরীর ছেলে।প্রতীক পড়তে পড়তেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিল।এখানে অনেকের কথাই উল্লেখ করিনি তারা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না এমনটি নয়।আমি সামগ্রিক ইতিহাস উস্কে দিতে চেয়েছিলাম।অভিনয়ে গণেশবাবু পেশাদারী প্রথায় বিকল্প রেখেছিলেন যার কারণেই অনেকেই নাম বিভ্রান্তিতে পড়ছেন।
দেবেশ বিভাগে পড়তে এলেও ফুটবল খেলাতেই বেশি আগ্রহ ছিল।ওকে বহুরূপীতে আমরাই জোর করে পাঠাই।এখন দেবেশ প্রতিষ্ঠানের ও প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা।
এই পালায় হ‍্যাজাকের আলো ব‍্যবহার সবাই খুব উপভোগ করেছিলেন।প্রবেশ প্রস্থান আদি প্রথাতেই হয়েছিল।তবে সেকালের যাত্রার মতো প্রবেশ ও প্রস্থান কালে "গেট" নেওয়া ছিল না।
এই গেট নেওয়া ব‍্যাপারটা আজকের প্রজন্মের জানার কথা নয়।মঞ্চে অভিনয় করে প্রস্থান কালে কিনারে এসে অতিরিক্ত ভঙ্গিতে সংলাপ ও কসরৎ দেখানো ছিল হাততালি কুড়ানোর কৌশল।
এই প্রযোজনাগুলি পঠনপাঠনের অঙ্গ হলেও বাস্তব জীবনেও কাজে লেগেছে তা আজকের প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হোলো।মন খেরোর খাতা এইখানেই সফল।
মন খেরোর খাতা
সলিল সরকার
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাত্রাপালার চল অনেকদিনের।রবি ঠাকুরের কালে গোপাল উড়ের যাত্রা কবিকে গান লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বিদ‍্যাসুন্দর পালার সেই গান "ওই দেখা যায় বাড়ি আমার চারদিকে মালঞ্চ বেড়া।ভ্রমরেতে গুনগুন্ করে।কোকিলেতে দিচ্ছে সাড়া।" হয়ে গেল "ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে।" কিংবা "দুজনে দেখা হোলো মধুযামিণীরে।"
সেই ঠাকুরবাড়ি থেকে যাত্রা নির্বাসিত হয়েছিল।আমরা ছাত্রাবস্থায় আবার ফিরিয়ে এনেছিলাম।মহর্ষি ভবনের উঠোন জুড়ে পরপর কয়েকবার গণেশবাবুর পরিচালনায় আমরা করেছিলাম "তরণীসেন বধ" পালা। উঠোনের মাঝখানে বসেছিল আসর।চারকোনায় রাখা হয়েছিল হ‍্যাজাকের বাতি পুরানো মেজাজ ফিরিয়ে আনার জন‍্যে।পোশাক অভিনয় মঞ্চ আলো রূপসজ্জা সংগীত সবেতেই পুরানো আমেজ আনা হয়েছিল।
যাত্রার শুরুতে কনসার্ট।তার ও আগে অধিকারী সেজে নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে বসতাম আসরের একপাশে।একটা পেটানো ঘণ্টায় জানাতাম সময়।থার্ড বেলে শুরু হতো পিলুরাগে বৃন্দাবন।সেখানে ক্ল‍্যারিওনেট, বাঁশি, ঢোল,খোল,হারমোনিয়াম, বেহালা,ঝাঁঝ,সব থাকত।
অভিনয়ে দেবেশ রায়চৌধুরী আমি কখনও অধিকারী আবার অন‍্য চরিত্রে।এ বাদে অরুণীতা মজুমদার(প্রখ্যাত গায়ক নায়ক রবীন মজুমদারের ছোট মেয়ে),অলোক চন্দ্র, অপরূপ গাঙ্গুলি, দেবাশিস রায়চৌধুরী, সমীর, প্রতীক আরও অনেকে।
বিশ্বদেব দত্ত গণেশবাবুর সহকারী ছিল।বিশ্ব আজ আর নেই।
প্রতিটি শোয়েই হাউস থুড়ি উঠোন ফুল থাকত। ঠাকুর বাড়ির উঠোনের চারপাশ ছাড়াও দোতলার বারান্দায় বসে দাঁড়িয়ে দেখতেন।
কলকাতার অনেক নাট‍্যজন এই প্রযোজনা এসে দেখেছিলেন।আর রাধা স্টুডিয়োতে আসর বসিয়ে কাজ করেছিলাম আমরা।সে এক যুগান্তকারী প্রযোজনা।যারা দেখেছেন তারাই বলেছেন।
পলাশ আমার সহপাঠী বন্ধু এই ছবি তুলে ইতিহাস ধরে রেখেছিল সেলুলয়েডের ক‍্যানভাসে।না হলে স্মৃতি ছাড়া সব হারিয়ে যেত।হয়তো কলকাতার দূরদর্শনে আছে সাদা কালোর চলমান ছবি হয়ে।একবার ফিরে দেখলে হোতো।তখন বিভাস চক্রবর্তী ছিলেন প্রযোজক।সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন।আর ছিলেন ধ্রুব মিত্র।তরুণ রায়,কুমার রায় খুব উৎসাহ জুগিয়ে ছিলেন।
এটা ১৯৮১/৮২ র কথা।এই কথাগুলো লিখলাম তখনকার মান বোঝাতে ও যাদের সান্নিধ্য পেয়েছি সেই ঋণ স্বীকৃতিতে।আজকের মতো ঢাক পেটাতে ও মিথ‍্যায় মজতে নয়।
লাম "তরণীসেন বধ" পালা। উঠোনের মাঝখানে বসেছিল আসর।চারকোনায় রাখা হয়েছিল হ‍্যাজাকের বাতি পুরানো মেজাজ ফিরিয়ে আনার জন‍্যে।পোশাক অভিনয় মঞ্চ আলো রূপসজ্জা সংগীত সবেতেই পুরানো আমেজ আনা হয়েছিল।
যাত্রার শুরুতে কনসার্ট।তার ও আগে অধিকারী সেজে নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে বসতাম আসরের একপাশে।একটা পেটানো ঘণ্টায় জানাতাম সময়।থার্ড বেলে শুরু হতো পিলুরাগে বৃন্দাবন।সেখানে ক্ল‍্যারিওনেট, বাঁশি, ঢোল,খোল,হারমোনিয়াম, বেহালা,ঝাঁঝ,সব থাকত।
অভিনয়ে দেবেশ রায়চৌধুরী আমি কখনও অধিকারী আবার অন‍্য চরিত্রে।এ বাদে অরুণীতা মজুমদার(প্রখ্যাত গায়ক নায়ক রবীন মজুমদারের ছোট মেয়ে),অলোক চন্দ্র, অপরূপ গাঙ্গুলি, দেবাশিস রায়চৌধুরী, সমীর, প্রতীক আরও অনেকে।
বিশ্বদেব দত্ত গণেশবাবুর সহকারী ছিল।বিশ্ব আজ আর নেই।
প্রতিটি শোয়েই হাউস থুড়ি উঠোন ফুল থাকত। ঠাকুর বাড়ির উঠোনের চারপাশ ছাড়াও দোতলার বারান্দায় বসে দাঁড়িয়ে দেখতেন।
কলকাতার অনেক নাট‍্যজন এই প্রযোজনা এসে দেখেছিলেন।আর রাধা স্টুডিয়োতে আসর বসিয়ে কাজ করেছিলাম আমরা।সে এক যুগান্তকারী প্রযোজনা।যারা দেখেছেন তারাই বলেছেন।
পলাশ আমার সহপাঠী বন্ধু এই ছবি তুলে ইতিহাস ধরে রেখেছিল সেলুলয়েডের ক‍্যানভাসে।না হলে স্মৃতি ছাড়া সব হারিয়ে যেত।হয়তো কলকাতার দূরদর্শনে আছে সাদা কালোর চলমান ছবি হয়ে।একবার ফিরে দেখলে হোতো।তখন বিভাস চক্রবর্তী ছিলেন প্রযোজক।সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন।আর ছিলেন ধ্রুব মিত্র।তরুণ রায়,কুমার রায় খুব উৎসাহ জুগিয়ে ছিলেন।
এটা ১৯৮১/৮২ র কথা।এই কথাগুলো লিখলাম তখনকার মান বোঝাতে ও যাদের সান্নিধ্য পেয়েছি সেই ঋণ স্বীকৃতিতে।আজকের মতো ঢাক পেটাতে ও মিথ‍্যায় মজতে নয়।
মন খেরোর খাতা
তরণীসেন বধ পালা
সলিল সরকার
এই দু দিনে আমাদের করা যাত্রাপালা ও প্রযোজনা নিয়ে এতো আলোচনায় আমি অভিভূত কেন না এই প্রযোজনায় যুক্ত মানুষজন লেখাটার সংগে নতুন করে যোগ দিয়ে ইতিহাস সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করছে।
প্রথমেই গৌরবন্ধুর কথা বলি গৌর আমাদের সমবয়সী হলেও বিভাগে আমাদের জুনিয়র ছিল।পরে কলকাতা দূরদর্শনে চাকরি পায়।ওর দিদি গৌরী আমাদের সংগে পড়ত।যদ্দুর মনে পড়ছে গৌর ও একটা চরিত্র করত।আর গৌর যেটা লিখেছে সেটাও ঠিক কেন না আগেই বলেছি শৈশবে দেখা যাত্রাপালার মতো এখানেও পালার শুরুতে আইটেম ডান্স ছিল।
কনসার্ট এ ছিল ফ্লুট, ক্ল‍্যারিওনেট, ভায়োলিন, তবলা,ঝাঁঝ,কাঁসর,হারমোনিয়াম আর এফেক্ট।অভিনয়ে সাবেকি ধারা আনার চেষ্টা ছিল।সাজসজ্জা, পোশাক এসবেও যত্নবান ছিলেন গণেশবাবু।
অলোকের কথা আগেই লিখেছি।অলোক কিছু কথা মনে করিয়েও দিয়েছে।যেভাবে অপরূপ মনে করাল।অপরূপের বাবা একটা পত্রিকা চালাতেন যেখানে আমি প্রবন্ধ লিখেছি।অপরূপ যাত্রা ও পরে প্রাইভেট চ‍্যানেলে যুক্ত হয়।
দেবাশিস ও অরুণীতা শূদ্রকের সংগে যুক্ত হয়েছিল আর বহুরূপীতেও ছিল অরুণীতা।দেবাশিস নাট‍্যশোধে ও পরে রবীন্দ্রভারতীতে অধ‍্যাপক হয়।মানসী আমাদের জুনিয়র আর প্রতিমা আমাদের সংগে পড়তে আসার আগে থেকেই বিভিন্ন দলে অভিনয় করত।
পলাশ ফোটোগ্রাফিটা নেশা থেকে পেশায় পাল্টে নেয়।ইংরেজি নাটকের সংগে যুক্ত ছিল।অমিতাভ গণকৃষ্টি নাট‍্য দলের প্রধান।বিজয় বেথুয়াডহরীর ছেলে।প্রতীক পড়তে পড়তেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিল।এখানে অনেকের কথাই উল্লেখ করিনি তারা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না এমনটি নয়।আমি সামগ্রিক ইতিহাস উস্কে দিতে চেয়েছিলাম।অভিনয়ে গণেশবাবু পেশাদারী প্রথায় বিকল্প রেখেছিলেন যার কারণেই অনেকেই নাম বিভ্রান্তিতে পড়ছেন।
দেবেশ বিভাগে পড়তে এলেও ফুটবল খেলাতেই বেশি আগ্রহ ছিল।ওকে বহুরূপীতে আমরাই জোর করে পাঠাই।এখন দেবেশ প্রতিষ্ঠানের ও প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা।
এই পালায় হ‍্যাজাকের আলো ব‍্যবহার সবাই খুব উপভোগ করেছিলেন।প্রবেশ প্রস্থান আদি প্রথাতেই হয়েছিল।তবে সেকালের যাত্রার মতো প্রবেশ ও প্রস্থান কালে "গেট" নেওয়া ছিল না।
এই গেট নেওয়া ব‍্যাপারটা আজকের প্রজন্মের জানার কথা নয়।মঞ্চে অভিনয় করে প্রস্থান কালে কিনারে এসে অতিরিক্ত ভঙ্গিতে সংলাপ ও কসরৎ দেখানো ছিল হাততালি কুড়ানোর কৌশল।
এই প্রযোজনাগুলি পঠনপাঠনের অঙ্গ হলেও বাস্তব জীবনেও কাজে লেগেছে তা আজকের প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হোলো।মন খেরোর খাতা এইখানেই সফল।
২৫ বৈশাখ
সলিল সরকার
সত্তরের উত্তাল কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বড়ো বিড়ম্বনা ছিল আমাদের।একদিকে রাজনীতি বিপরীতে তাঁর গান।সে এক অপূর্ব দোলাচল।আর তাই তাতে ও দ্বান্দ্বিকতায় আরও আরও ডুবতে থাকা।উত্তর মেলেনি আজও।
জোড়াসাঁকোর ২৫ বৈশাখ ছিল বেশ বিচিত্র।সারা কলকাতার কজনই বা মনে রাখত সেই দিনটা।তবলাপট্টি পেরিয়ে বা রামমন্দির পাশে রেখে ঢুকতে হোতো ঠাকুর বাড়িতে।যে বাড়ির প্রতিটি ঘর,ঘরের কোণ,কাঠের সিঁড়ি, রেলিং আমার চেনা।হাজার মানুষের ভীড়ে হাসফাস্ দুপুরে সদ‍্য প্রকাশিত কবিতা হাতে কবিরা।একে একে গেয়ে যাচ্ছেন আমারই প্রিয় শিল্পীরা।অনুষ্ঠান শেষে সবাই ছুটবে রবীন্দ্রসদনে।আর আমরা কর্তব‍্যের শেষে জমাটি আড্ডায়।
সন্ধ‍্যা নামলে উঠোনে অনুষ্ঠান।অমিয়া ঠাকুর, শৈলেন দাস, মেনকা ঠাকুর কে নেই?
শান্তিনিকেতনে সবটাই একেবারে অন‍্যরকম। প্রায় সবাই চেনা আর অনেক অচেনাকে ঠিক আলাদা করে না দেখে একাকার করার আনন্দ।আবার কতো মানুষ তাকে খুঁজে ফিরছে উপাসনা গৃহে,মাধবীবিতান, ঘণ্টাতলায় পান্থশালায়, ছাতিমতলা, গৌরপ্রাঙ্গণে।
প্রতিদিন সূর্য ওঠে তবু্ সে নিত্য নতুন।এও তাই।
ফিরে ফিরে আসে ২৫ বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ।

সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮


তাম্রলিপ্তঃ শহরে,বন্দরে
সলিল সরকার
এই লেখাটা লিখতে হয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে সম্প্রচারের জন্য।তাই আমার আগের লেখার সঙ্গে এই লেখায় পুনরাবৃত্তি দোষ ঘটবে।তবে বন্দর শহর তাম্রলিপ্তকে জানতে এইটুকু না হয় মেনেই নেওয়া যায়।
বাঙালি হুজুগে জাতি এ কথা ভিন প্রদেশের মানুষজন যেমন বলে থাকেন বাঙ্গালি নিজেও হাসতে হাসতে এ কথা কবুল করেন আর সুযোগ পেলেই পকেটে পয়সা আর পিঠে লোটা-কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।এখন অবশ্য সাধু সন্ত ছাড়া আর কেউ লোটা-কম্বল নেয় না।ওটা কথার কথা।এখন পিঠে থাকে রুক্স্যাক কি হ্যাভারস্যাক। হাতে থাকে ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধে থাকে ঝোলা।
কয়েক দশক আগেও শীত পড়লেই বাঙ্গালি পশ্চিমে ছুটত।পশ্চিম মানে ঝাড়্গ্রাম, গালুডি, ঘাটশিলা,গিরিডি,গিধনি,শিমূলতলা,চাইবাসা,নেতারহাট ইত্যাদি ইত্যাদি।বাংলা সাহিত্যে এইসব অঞ্চলের ভূরি ভূরি উল্লেখ আছে।বড়লোক বাঙালি ওইসব অঞ্চলে সস্তা দরে বিঘার পর বিঘা জমি কিনে বাংলো বানিয়ে রেখে পুজোর ছুটি কী শীতকালে কিছুদিন কাটিয়ে আসতেনঅথচ বাংলার মধ্যেই যে কতো ঘুরে বেড়াবার,ইতিহাস খুঁড়ে দেখবার আর দু-এক রাত হেঁসে খেলে কাটাবার মনোরম স্থান আছে তার তত্ত্ব-তালাশ আর কজন করেন?
তবে বেড়াতে যাব বল্লেই যেমন সুকুমার রায়ের ভাষায় রাণাঘাট-কাকদ্বীপ হয়ে তিব্বত যাওয়া যায় না।আবার চাইলেই দীঘা কি দার্জিলিং যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলাও তো কম নয়।তার চেয়ে ছুটির দিনে ট্যাঁকের কড়ি সামান্য খরচ করে খুব অল্প ছোটাছুটিতেই যদি এক-দুরাত কোথাও কাটিয়ে আসা যায় মন্দ কী?যেমন ধরুন আপনার মন চাইল বন্দর দেখবে তার জন্যে কী আর আপনি বিমানবন্দরে ছুটবেন? না কী বিশাখাপত্তনম যাবেন?বরং আপনি কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে কয়েক ঘন্টার যাতায়াতে হলদিয়া বন্দরে ঘুরে আসতে পারেন।কিন্তু আপনি যদি ইতিহাসবিলাসী হন তাহলে হলদিয়া যাওয়ার আগে তাম্রলিপ্ত বন্দরে যাবেন না তাই কখনও হয়?
জানি জানি আপনি মনে মনে ভাবছেন সেটা আবার কোথায়?আর যাবই বা কী উপায়ে?সবুর করুন ধীরে ধীরে সব বলব।
কোনও এক ছুটির দিনে আপনি হাওড়া স্টেশন থেকে মেদিনীপুর লোকাল,পাঁশকুড়া লোকাল কি মেচেদা লোকাল ধরে মেচেদা পৌঁছে যান।মেচেদার ঝাল্মুড়ি,ঘুগ্নি,সিঙ্গাড়া খুব নাম করা।আর নাম করা পাঁশকুড়ার চপ।মেচেদায় নামুন কি পাঁশকুড়ায় সেখান থেকে বাসে চেপে তমলুক।পাঁশকুড়া থেকে তমলুক যাওয়ার পাকা সড়ক সেই ব্রিটিশ আমলের।কী?এবার নামটা চেনা চেনা লাগছে তো?লাগবেই তো!এটা যে এখনকার নাম।
আপনি হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপেই সোজা তমলুক স্টেশনেও নামতে পারেন।আর যদি নিজের গাড়ি থাকে তাহলে তো কথাই নেই।কলকাতা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে গঙ্গা নদি পেরিয়ে ন্যাশানাল হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে দামোদর নদ পেরোবেন তার পর পেরোতে হবে রূপনারায়ণ।
রূপনারায়ণ ব্রীজ পেরোলেন মানেই আপনি কোলাঘাট অর্থাৎ পূর্বমেদিনীপুরে প্রবেশ করলেন।কোলাঘাট মানেই ইলিশ মাছ কিন্তু এখন তার দেখা পাওয়াই ভার।তবু যদি ভাগ্যে থাকে ফেরার পথে কেনার চেষ্টা করতে পারেন।তার আগে কোলাঘাটের ধাবায় খাটিয়ায় বসে মাটির খুরি কি ভাঁড়ের কড়া চা আর প্রাতরাশ সেরে নিতে পারেন কারণ এখান থেকেই আপনার দেখার জিনিস শুরু হয়ে গেল।
অনেক দূর থেকেই সে ট্রেন হোক কি গাড়ি বা বাস আপনি বেশ কয়েকটি চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখছেন তো?তার মানেই আপনার ঘরে কোলাঘাট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ গ্রীডের মাধ্যমে ঠিকভাবে সরবরাহ হচ্ছে!এই তাপ বিদ্যুৎ চলে কয়লার তাপে।তাই কয়লার পোড়া ছাই আশপাশে একটা সমস্যার সৃষ্টি করে।এখন অবশ্য এই ছাই জলাজমি ভরানোর কাজে এমনকি ইঁট তৈরির কাজেও ব্যবহার হচ্ছে।
এখান থেকে তমলুক যাওয়ার সময় আপনি যে পথ দিয়েই যান না কেন বেশ কয়েকটি হাট চোখে পড়বে সেগুলি ধান-চাল-পাট-পান আর সব্জির বেশ পুরানো হাট বাজার।রামতারক,কাঁক্টিয়া,ডিমারী,রাধামনি এই রকম নামের বেশ কয়েকটি হাট আছে তার মধ্যে রাধামনির হাট আজও তাঁতের শাড়ি-গামছা-মশারি-চাদরের জন্যে প্রসিদ্ধ।সে কথায় যাওয়ার আগে চলুন তাম্রলিপ্তের ইতিকথায় চোখ ফেরাই।শুরুতে এখানের নামের কথায় আসি।এখানকার নাম নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও গবেষকদের মত অনুযায়ী তাম্রলিপ্তি>তাম্রলিপ্তিকা>ডামিলিত্তি>তাম্রলিপ্ত>তামোলিপ্তি> তমোলোক থেকে তমলুক।আবার কেউ কেউ একে বেলাকুলা তাও বলতেন।
কাশীরাম দাসের মহাভারতে লেখা হচ্ছে মহাভারতের মহা যুদ্ধে জয়ের পর যুধিষ্ঠির ভারতের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার আশায় অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে ছিলেন।যে দেশের রাজা সেই ঘোড়ার লাগাম টানবে তার সংগে যুদ্ধ হবে পঞ্চপাণ্ডবের।সেই যুদ্ধে হেরে গেলে রাজাকে মেনে নিতে হবে পাণ্ডবদের আধিপত্য আর বশ্যতা
অশ্ব্মেধের ঘোড়া যখন সারা ভারত ঘুরে এলো এই তাম্রলিপ্তে তখন তাম্রলিপ্তের রাজা তাম্রধ্বজ আটকে দিলেন যুধিষ্ঠিরের সেই অশ্ব্মেধের ঘোড়া।যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।এখন যে জায়গাটার নাম ‘রণশিঙ্গা’ সেখান থেকেই নাকি রণের অর্থাৎ যুদ্ধের শিঙ্গা ফোঁকা হয়েছিল।তাই এখানের নাম রণশিংগা।আর অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া তাম্রলিপ্তের রাজার কাছ থেকে মুক্ত করতে এসে কৃষ্ণ অর্জুনকে এই তাম্রলিপ্ত বিষয়ে বলছেন-
“তমোলিপ্ত পরম স্থানম্ নাসমকম্ প্রীতৃষ্যতে
মমকং হৃদয়ং লক্ষ্মী যথায়ং তথা মায়া”
এই তমোলিপ্ত পরম রমণীয় মনোরম স্থান।এখানে সদা আমার হৃদয় লক্ষ্মীর বাস।তিনি আরও বলছেন-“হে কৌস্তেয় আমি সব তীর্থ পরিত্যাগ করতে পারি কিন্তু কদাপি এই তমোলিপ্ত ত্যাগ করব না।কালে কালে যুগে যুগে আমি এখানে ফিরে ফিরে আসব” ! তাহলে তমোলিপ্ত নামটা পেলাম?
রাজাদের কথা যখন উঠল তাহলে রাজবাড়ির কথাও বলতে হয়।তমলুকের রাজবাড়ির ইতিহাস যে অতি প্রাচীণ সে তো আগেই বলা হোলো।ময়ূরোধ্বজ রাজার কথা পুরাণে আর মহাভারতেও আছে।সেই ময়ূরোধ্বজ রাজার পুত্রই রাজা তাম্রধ্বজ।ভীম এই রাজার কাছ থেকে অশ্ব্মেধের ঘোড়া যুদ্ধ করে ছিনিয়ে নিতে পারলেও তাম্রলিপ্তের রাজার সাহস আর শক্তির কথা লেখা হয়ে থাকল মানুষের মনে।
শহরের মুখেই বিশাল জায়গা জুড়ে এই রাজবাড়ি।রাজবাড়ির সামনে বিশাল মাঠ সেখানে এক কালে সার্কাসের তাঁবু পড়ত।রাজবাড়ির পুব দিকে এক বিশাল দীঘি যার নাম লোকের মুখে মুখে খাটপুকুর। কথাটা কী খাদপুকুর হবে?কেন না অনেক যুগ আগে বঙ্গ উপ সাগর তো এই শহরের খুব কাছেই ছিল।সমুদ্রের খাঁড়ি থেকে খাদ থেকে মুখে মুখে খাট হয়ে যায়নি তো?এক কালে ওখানে এক মস্ত গাছের গুঁড়িতে লোহার শিকল বাঁধা থাকত।নৌকা ভেড়ানো থাকত পাড়ে।দীঘিতে অনেক মাছ ছিল।দীঘির জল শুকোত না প্রখর রৌদ্রেও।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার উপন্যাসে এই স্থানের উল্লেখ করছেন।
রাজবাড়ির ভেতরে রাধামাধব আর রাধারমণ-এর মন্দির আর আজকের ভগ্নপ্রায় ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ কালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
তাম্রলিপ্ত শহর বা ব্রিটিশ আমলের তমলুক আজকের শহর কলকাতা থেকে মাত্র একশ কিলোমিটার দূরে।যার পূর্বদিকে রূপনারায়ণ,পশ্চিমে সুবর্ণরেখাএছাড়া কংসাবতী আঞ্চলিক ভাষায় কাঁসাই,হলদি নদি,কেলেঘাই আর রূপনারায়ণ এর সংগে যুক্ত হয়েছে দ্বারকেশ্বর আর শিলাইয়ের প্রবাহ।
টলেমির লেখায় এই তমালিকা বা তমলুকের চিহ্ন রয়েছে।আজ যেমন সড়ক পথে এই শহর থেকে ভারতের অনেক শহরে যাওয়া যায়এখন যেমন আপনি চাইলে বাসে বা গাড়িতে তমলুক থেকে শ্রীরামপুর,ময়না,কাঁথি-দীঘা-এগরা।আবার কোলাঘাট-ঘাঁটাল।অন্যদিকে মেদিনীপুর শহর,খড়্গপুর,ঝাড়গ্রাম,গড়বেতা যেতে পারেন আর একটু ঘুরে আসতে গেঁওখালি চলে যান।একদিন সময় করে মহিষাদল যেতে হবে।আরো ছাড়িয়ে দুর্গাচক আর হলদিয়া বন্দর তেমন করেই এক সময় এই শহর থেকে সড়ক পথে রাজগৃহ,শ্রাবস্তী,পাটলিপুত্র,চম্পা নগরী,কৌসাম্বী আর তক্ষশীলা যাওয়া আসা হতো। মৌর্য যুগে এই তাম্রলিপ্ত ছিল দক্ষিণ-পূর্বের সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ।ফা হিয়েন আর সুং সাং এই বন্দর শহরের কথা লিখছেন।সে কথায় আসছি তার আগে এখানে আজও কী কী দেখতে পাবেন সেই কথায় যাই।
রাজবাড়ি যাওয়ার পথে শহরে যখন ঢুকবেন মানিকতলা মোড় থেকে তখন যেতে গিয়ে বামদিকে মানিকপীরের থান পাবেন।স্থানীয় মানুষ সব ধর্ম নির্বিশেষে এই মাজারে আসেন আর এর সামনে যে পুকুর আছে সেখানে স্নান করেন পুণ্যলাভের আশায়।মানিকপীর থেকেই যে মানিকতলা সে বুঝতে গবেষকের প্রয়োজন আছে কী? তাছাড়া এখানে মানে এই শহরে বহু যুগ থেকেই বাণিজ্যের কারণেই বহুজাতির আগমন আর বসবাস।
তাম্রলিপ্তিতে মানববসতির কালসীমা মোটামুটি তৃতীয়/চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলে বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তির সর্বশেষ প্রমাণ বহন করছে অষ্টম শতাব্দীর উদয়মনের দুধপানি প্রস্তরলিপি।
গ্রীক ভৌগোলিক টলেমির মানচিত্রে তমলিটিস্‌রূপে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। চৈনিক তীর্থযাত্রী সুং-সাং সবাই যাকে হিউয়েন-সাং বলেই চেনেন তিনি তাম্রলিপ্তি শহরকে তান-মো-লি-তিহিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস বলে, গুপ্ত সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আমলে এই শহরে এসেছিলেন বিখ্যাত চিনাপ রিব্রাজক  ফা-হিয়েন।তার প্রায় ২০০ বছর পরে এসেছিলেন চিনা পরিব্রাজক সুং-সাংসম্রাট অশোক এখানে স্থাপন করেছিলেন অনুশাসন খোদিত প্রস্তরস্তম্ভ।অশোকের ছেলে মহেন্দ্র আর কন্যা সংঘমিত্রা তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে সিংহল তথা আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্তে আজ আর বন্দরের অস্তিত্ব নেই।নাই বা থাকল আজও যা আছে তাই বা কম কী?
আপনি যদি এখন একবার স্টীমার ঘাটে যেতে চান তাহলে আপনাকে শহরের ভেতর দিয়ে মানিকপীরের থান,রাজবাড়ি,মহাপ্রভুর মন্দির,জেলখানা,আদালত,মিউজিয়ম,পুরানো হাসপাতাল এসব ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক বর্গভীমার মন্দিরের পাশ দিয়ে সোজা স্টীমার ঘাটের দিকে যেতে হবে।
বর্গভীমা মন্দির আর তার স্থান মাহাত্ম্যের কথা স্টীমার ঘাট থেকে ফিরে এসেই করা যাবে না হয়।শুধু এইখানে এটুকু বলা প্রয়োজন এক কালে এই মন্দিরের ঠিক পিছনেই রূপনারায়ণের ঢেউ আছড়ে পড়ত।এখন নদী সরতে সরতে কয়েক কিলোমিটার দূরে সরে গেছে কিন্তু প্রাচীণ স্টীমার ঘাট সে তো আর সরতে পারে না তাই স্থবিরের মতো অব্যবহারে জীর্ণ দীর্ণ কংকালসার হয়ে কালের সাক্ষ্য বহন করছে।
এক কালে এই স্টীমার ঘাট যাতায়াত আর ব্যবসার জন্যে মানুষের কাছে প্রধান যাতায়াতের জলপথ ছিল।নদী তার নিজের ধারায় কুল ভেংগে এগিয়ে এসেছে আবার পিছিয়ে গেছে যেমন আমরাও যদি সেইভাবে আবার একটু পিছিয়ে যাই তাহলে শুনতে পাব মুখে মুখে ফেরা কালের কথা।
“গঙ্গার গতি লক্ষ করিয়া এবং পূর্বদিকে অষ্টাদশ যোজন পথ অগ্রসর হইয়া ফাহিয়ান গঙ্গা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় আরও পঞ্চাশ যোজন পথ অগ্রসর হইয়া চম্পা নামক সুবৃহৎ রাজ্যে উপনীত হইলেন।তথায় উপনীত হইয়া তিনি তাম্রলিপ্ত নামক বন্দর যেখানে দ্বাবিংশটি সঙ্ঘারাম রহিয়াছে এবং প্রত্যেকটিতেই যতিগণ বাস করেন সেখানে উপনীত হন।এই স্থানেও বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাব আছে। ফা-হিয়ান এই স্থানে সূত্র নকল ও প্রতিমূর্তির আলেখ্য প্রস্তুত করিয়া দুই বৎসর অতিবাহিত করেন।
অতঃপর তিনি এক বৃহৎ বাণিজ্যপোতে আরোহণ করিয়া সমুদ্র দিয়া শীত ঋতুর প্রারম্ভে দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রা করিয়া সেখানে  দিবারাত্র অতিবাহিত করিয়া তিনি সিঙ্ঘল প্রদেশে উপস্থিত হন। অধিবাসীদের মতে সিংহল হইতে তাম্রলিপ্তি সাতশত যোজন দূর।“
এর থেকেই বোঝা যায় তাম্রলিপ্তিতে বিদেশিদের নিয়মিত যোগাযোগ যাতায়াত ছিল এবং বাইরের দেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ।সুং-সাং বা হিউয়েন সাং বা ইউয়ান চোয়াং এর বর্ণনায় তাম্রলিপ্তি প্রবলভাবে উপস্থিত। সুং সাং ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন থেকে রওনা হয়ে ৬৪৪ পর্যন্ত জীবনের মূল্যবান পনেরটি বছর ভারতীয় উপমহাদেশে কাটিয়ে ছিলেন।
তার প্র দেশে ফিরে তিনি যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখেন তাতে আছে
সমতট থেকে পশ্চিম দিকে ৯০০ লি পথ পাড়ি দেয়ার পর এসে পৌঁছলাম তান-মো লি-তি বা তাম্রলিপ্তি রাজ্যে। রাজ্যটি আকারে ১৫০০ লির মতো। রাজধানীর আয়তন ১০ লি। .. ফল ও ফুলের ছড়াছড়ি এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে, হাজার খানেক ভিক্ষুর বাস। দেবমন্দির আছে পঞ্চাশটির মতো। নানা সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে মিলেমিশে বাস করছে। দেশটির উপকূল ভাগ একটি সমুদ্র খাঁড়ি দিয়ে বেষ্টিত। জল ও ভূমি যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করছে এখানে। প্রচুর দামী দামী জিনিস এবং রত্নসামগ্রী এখান থেকে সংগৃহীত হয়। এজন্য এলাকার অধিবাসীরা বেশ ধনী। ...
সুং-সাং অনেক কথার পাশাপাশি আর একটা কথাও লিখেছিলেন।এই অঞ্চলের মানুষজন যেমনতর পরিশ্রমী তেমনি গোঁয়ার আর একগুঁয়ে।তা তো হবেই সমুদ্র উপকূলের মানুষজনদের সারাক্ষণ সামুদ্রিক ঝড়জল তুফানের সংগে লড়তে হয় কী না!
চীনা পরিব্রাজক ইিসঙ (জন্ম : ৬৩৫ খ্রি. মৃত্যু : ৭১৩ খ্রি.) তাম্রলিপ্তিতে ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন এবং তাম্রলিপ্তির গুরুত্বের কথা তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন। বাংগালি গবেষকরাও বাণিজ্যনগরী তাম্রলিপ্তির সমৃদ্ধির কথা লিখেছেন।
তবে আজও যে স্টীমার ঘাট ভেংগেচুরে পড়ে আছে সেই ঘাট দিয়ে তো ফা-হিয়েন কি সুং-সাং কি হি-সং আসেননি বা ফিরে যাননি তাই ঘাটের কথা থাক।চলুন এবার শহরে ফেরা যাক।সেখানে আমরা ফেলে এসেছি অনেক দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থান।
প্রবীণেরা বলে থাকেন-“দ্যাখার জন্যে শুধু চোখ থাকলেই হয় না,দরকার উৎসুক মনের!”কথাটা খুব খাঁটি আর এই কথার ভিতরে লুকিয়ে আছে আর একটা কথা।এই যেমন ধরুন বর্গভীমা মন্দিরের কথাই যদি ধরি সেটাকে কেউ যেমন তার ধর্মের স্থান হিসেবে দেখবেন কেউ দেখবেন এর স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব।আবার যখন শুনবেন এই শহরে চৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন।এই বাণিজ্যক্ষেত্রের পূণ্যভূমিতে স্নান করেছিলেন তার পর গিয়েছিলেন পুরীধাম আপনার আগ্রহী মন খুঁজে বেড়াবেই মহাপ্রভুর পায়ের চিহ্ন।আবার যদি শোনেন একদিন এখানেই পড়েছিল তথাগত বুদ্ধের পদধূলি আপনি রোমাঞ্চিত না হয়ে পারবেন?
ফা-হিয়েনের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যেহেতু বংগ আর মগধ পাশাপাশি তাই তথাগত এই বাংগালায় এসেছিলেন আর তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে সম্রাট অশোক সেইসব স্থানে স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।ফা-হিয়েনের কালে এখানে প্রায় বাইশটি ‘মনেস্ট্রি’ ছিল।সুং-সাংয়ের সময় দশ-বারোটি।আর যে স্তুপ ছিল তার একটির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের বর্গভীমার মন্দির।বৌদ্ধ মহাযান হীণযান থেকে কালে কালে তান্ত্রিকতার ধারা বেয়ে এই তাম্রলিপ্ত শহর হয়ে উঠেছিল সনাতন শক্তিরপীঠ।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমংগল কাব্যে লিখছেন –
“গোকুলে গোমতীনামা
তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা
উত্তরে বিদিতা বিশ্বকায়া”
এসবই দ্বা্দশ শতকের কথাআর এই স্থাপত্যের নির্মাণ আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে।
তাম্রলিপ্ত নগরের মাঝখানে অর্থাৎ আজকের তমলুক শহরের মাঝে দেবী বর্গভীমা মন্দির একান্ন পীঠের অন্যতম।কথিত আছে দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি এখানে পড়েছিল।
পুরাণ মতে অসম্মানে,অপমানে সতী পার্বতী দেহত্যাগ করলে শিব সেই দেহ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করায় জগত লণ্ডভণ্ড হবার আশংকায় বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ৫১টি খণ্ডে খণ্ডিত করেন।যার মধ্যে সতীর বাম পায়ের কড়ে আঙুল পড়ল এই স্থানে।তার থেকেই সৃষ্টি হোল শক্তিপীঠদেবী এখানে ভীমা রূপা, তাই তিনি বর্গভীমা। দেবীর মূর্তি একশিলা পাথরের আর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীও অপূর্বকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর “অন্নদামঙ্গল” কাব্যে লিখছেন-
“বিভাসেতে বাম গুল্ফ ফেলিলা কেশব
ভীমারূপা দেবী তাতে কপিলা ভৈরব”
তমলুক পুরসভা প্রকাশিত তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, রূপনারায়ণের তীরে উঁচু মাটির ঢিবির উপর মন্দিরটি বানানো।অনেকের মতে,সম্রাট অশোক তাম্রলিপ্তে যে স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন তার উপরই মন্দিরটি নির্মিত হয়।তাম্রলিপ্ত শহরকে এক কালে ‘বিভাস’ নামেও ডাকা হোত।
মন্দির আর তার স্থাপত্যের কথা যখন উঠল তখন যাওয়া যেতেই পারে আর এক মন্দিরে।তবে যাওয়ার আগে বর্গভীমা মন্দিরটি যদি ঘুরে দেখতে থাকেন তাহলে পুর্ব দিকে যখন বেয়ে চলা রূপনারায়ণ থেকে মাছ ধরে শহরের দিকে ফেরা মৎস্যজীবীদের দেখবেন তখন এক লোককাহিনির কথা মনে পড়বে।
একবার রাজার খুব অসুখ করল৷বদ্যি বলল যদি রাজাকে রোজ একটা করে জিওল মাছ খাওয়ানো যায় দিনের আলো থাকতে থাকতেই তবে রাজা সুস্থ হয়ে উঠলেও উঠতে পারেন........এক জেলেকে তলব করে প্রতিদিন একটি করে জ্যান্ত মাছের জন্য বলা হলো........মাছ মরা হলে চলবে না,চালাকি করলে গর্দান যাবে........রাজবাড়ির হুকুমে জেলে তাই করতে থাকল,কিন্তু একদিন সে রাজার বাড়ি যাওয়ার পথে দেখল মাছটা নড়ছেও না চড়ছেও না.......মাছটা যেন তাকে মারতেই মরেছে৷জেলে আর কী করে নদীর ধারে জেগে থাকা মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কান্নাকাটি শুরু করল।........এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে চলেছে......নারীরূপীশক্তি এসে সব শুনলেন তারপর মাছটাকে প্রাণ দিলেন.........জেলে খুশি হয়ে রাজবাড়ি যখন পৌঁছল তখন সাঁঝ নামতে আর একটু বাকি......রাজা জানতে চাইলেন তার দেরির কারণ....... জেলে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল৷রাজা তারপর ওই অবহেলিত মন্দিরের সংস্কার করে নিত্য পূজার আয়োজন করলেন৷
এই সেদিনও এ শহরে আর কোনও দেব-দেবীর পুজো হতো না৷আর এখন সব পুজোর ঘট শোভাযাত্রা করে আগে মন্দিরে এনে দেবীভীমার পুজো করে পরে মণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হয়৷সে সময় স্থানীয় মানুষ আর কৌতুহলী মানুষ এই শোভাযাত্রা দেখতেই ভীড় জমান।যাই হোক আমরা আবার ফিরে যাই পুরাস্থাপত্যের কথায়।
শহরের রাজবাড়ির দিকে যদি আবার ফিরে যাই তাহলে হাট-বাজারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরাস্থাপত্য জিষ্ণুহরি মন্দিরের সন্ধান পাব
পুরসভার তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, প্রায় ৫০০ বছরের আগে এই জিষ্ণুহরি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল।মূল মন্দির প্রায় ৩০ ফুট উঁচু, চারচালা, জগমোহনযুক্ত। জিষ্ণুহরি মন্দিরের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অধিকারী সম্প্রদায়।
এখানে বলে রাখা ভালো মোকাম কলিকাতা সেকালে পেশা আর কাজ দিয়ে পরিচিত ছিল।যেমন টোলা,তলা,পাড়া,বাজার,বাগান এভাবে চিহ্নিত ছিল।ডোমটোলা,পটুয়াটোলা, কাঁসারিটোলা,বেনিয়াটোলা, শাঁখারিপাড়া,তালতলা,বেলতলা,বড়বাজার,টেরিটিবাজার,চোরবাগান,হাতিবাগান ইত্যাদি সেভাবেই তমলুক শহরেও আছে অধিকারীপাড়া,মালাকারপাড়া, দেপাড়া,মেথরপাড়া ইত্যাদি।এইসব পাড়াতেই ছড়িয়ে আছে নানা স্থাপত্য,ইতিহাস।
তাই জেলখানার কাছেই হরির মন্দির ও মহাপ্রভুর দালান সেও দেখতে ভুললে চলবে না।এর সংগেও যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে।
শ্রীচৈতন্য নীলাচলে যাওয়ার পথে এসেছিলেন এই তাম্রলিপ্ত শহরে ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে।অর্থাৎ কি না ১৪০২ শকাব্দে।এই পূণ্যভূমে তিনি স্নান করে নীলাচলে গিয়েছিলেন।এর পর পুরীতে ১৫৩৪এ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য অন্তর্হিত হলে তাঁর শিষ্য বাসুদেব ঘোষ এই হরির মন্দির স্থাপন করলেন।
কিন্তু ওই মন্দিরের প্রবেশ পথ সংলগ্ন এলাকায় বাজার বসার ফলে পর্যটকদের কাছে ওই মন্দির চোখেই পড়ে না।তবে আমরা যারা উৎসাহী তারা তো সব বাধা পেরিয়েই দেখব।তাই দেখব মানিকপীরের থান, লালদিঘির মসজিদ,জুম্মা মসজিদ,রামকৃষ্ণ মিশনআর রাজবাড়ির মধ্যেকার রাধামাধব আর রাধারমণ মন্দিরের কথা সে তো আগেই বলেছি।তবে এসব স্থাপত্যই আজ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
তাই প্রাচীণ শহরের মতো একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে একবার যদি ঘুরে দেখে নিই কিছু না হোক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তো থাকলাম!


তাম্রলিপ্তঃশহরে,বন্দরে
সলিল  সরকার
দাদাঠাকুর বলতেন-“বুড়োয় বুড়োয় দেখা হোলে কথায় কথায় কাসি,আর যুবায় যুবায় দেখা হোলে কথায় কথায় ঘুষি!”তমলুকের হাটে-বাজারে কি চায়ের দোকানে যদি কোনও জটলা দেখেন আর সেখানে গিয়ে যদি একটু কান পাতেন তাহলে আপনিও হয়ত দাদাঠাকুরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন।
চা আর লেড়ো বিস্কুট খেতে খেতে আলাপ-আলোচনা থেকে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতিতে গড়ানোর আগেই কেউ হয়ত বলে উঠলেন-“চলো খিরিষ তলায় দেখা হবে!”আপনি ভাবছেন সেটা আবার কী?তাহলে খুলেই বলি-‘খিরিষ’ হোল শিরীষ গাছের আঞ্চলিক নাম আর শিরীষ তলা হোল জেলার আদালত চত্বর।বহু যুগ ধরে আদালতের আশেপাশে এবং আজও অনেক প্রাচীণ শিরীষ গাছ রয়েছে।
এখানেই প্রতিদিন কতো মানুষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য নিরুপণ হয়।আর সেখানে আপনাদের একবার ঘুরে দেখতে বলব মামলা,মোকদ্দমা দেখার জন্যে নয়,ঐতিহাসিক স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক স্থানের মাহাত্ম্যের জন্যে।
বলা বাহুল্য আজকের তমলুক জেলখানা,আদালত,বার লাইব্রেরী,সেটেলমেন্ট অফিস,ডি এম এর বাংলো এসবই ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য।বিশাল বিশাল থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীণ ইঁটের চূণ-সুরকির গাঁথনির লাল রংয়ের বাড়িঘর।
এই স্থানকে কেন্দ্র করে আশেপাশে কতো খাবার হোটেল চলে।এখনও বেশ কম টাকায় এখানে পেট ভরে খাবার মেলে যেমন নানা ধরনের খবরও মেলে।মামলা-মোকদ্দমা করতে মানুষজন হয়ত এক হোটেলে পাশাপাশি বসে খাওয়া-দাওয়া সারছেন।আবার আদালতের কাজের শেষে এখানে পসরা সাজিয়ে বসা ব্যাপারীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় টুকি টাকি ঘর-গেরস্থালির জিনিসও কিনে বাড়ি ফিরছেন।
কী না পাওয়া যায় এখানে?কাগজ-কলম-পেন-কার্বন-স্ট্যাম্প পেপার এসব তো মামলার প্রয়োজনে আছেই তার সংগে মরসুমী ফুলের চারা,ঘটি-বাটি ঝাল দেওয়ার রাং,চাষের কাজে লাগে কি ঘর-গেরস্থালির কাজের জন্যে কুড়ুল-কোদাল-দা-বটি-খুরপি থেকে ভাগ্য ফেরানোর তাবিজ-মাদুলি-আংটি সব মেলে এখানে
ওখানে টিয়া পাখি নিয়ে বসে থাকা অবাংগালি মানুষটিও যেমন দু-পয়সা আয় করছে আবার জড়ি-বুটী বিক্রী করেও গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরছে।যে জিপসি ছেলেটি বা মেয়েটিকে দেখছিলেন একটা ছেঁড়া জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে মুহুর্তে সেই কোনও সাহায্য ছাড়াই একটা এলুমিনিয়মের থালা নিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছে দড়ির উপর।পায়ের তলায় থালাটা রেখে দড়ির উপরে হাঁটছে সবার বুকে শিহরণ জাগিয়ে।আর ওই শিহরণই সামনে পেতে রাখা গামছায় টপাটপ টাকা পয়সা ফেলতে উদবুদ্ধ করছে মামলায় হেরে যাওয়া কি জিতে যাওয়া মানুষকে।নানান মানুষের ব্যস্ততা আর কথাবার্তায় স্থানটি সরগরম হয়ে থাকে সারাক্ষণতারপর দিন বিকেলের দিকে যত গড়িয়ে আসে মানুষের শব্দ কমে এসে ওইসব বিশাল গাছের ডালে ফিরে আসা পাখিদের কল-কাকলিতে মনে হবে ওরা যেন মানুষের ব্যবহার শিখে ওখানেই আসর বসিয়েছে।তার পর বিকেল সন্ধ্যের দিকে যত গড়াবে পাখিরাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসবে।শুধু রাত নামলে হাজার হাজার মানুষের হাসি-কান্না বুকে নিয়ে একা শিরীষ গাছগুলি নীরবে শ্বাস ফ্যালে!
এই আদালত চত্বর এক কালে বিলাতি সাহেবদের দখলে ছিল।তার চিহ্ন হয়ে আজও ‘টেনিস কোট’ রয়েছে আদালতের পিছনে ‘বানপুকুরের’পাড়ে।এই বানপুকুর আরো অনেক সংগ্রাম আর লড়াই,অসহযোগ আন্দোলন আর শহীদের সাক্ষী।

১৯৪২এ গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা ভারত,বাংলা এবং এই তাম্রলিপ্ত যখন অসহযোগ অহিংস আন্দোলন শুরু করেছিল একদল জনতা তমলুকের প্রশাসনিক ভবন দখল করতে এসে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠিচার্জ আর বন্দুকের গুলির কাছে হার না মেনে এগিয়ে চলল।সেই জনতার মধ্যে জাতীয় পতাকা হাতে ছিলে মাতঙ্গিনী হাজরাও।পুলিশের গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েও আন্দোলনের পতাকাকে তুলে ধরে বলেছিলেন-“বন্দে মাতরম্ “।আভাসবাড়ির বানপুকুর এই আন্দোলনের শহীদ স্মৃতি বহণ করে চলেছে আজও।মহাত্মা গান্ধী শহীদ মাতঙ্গিনীকে তার সাহসিকতা আর দেশের জন্যে আত্মদানে তাকেবীরাঙ্গনাআখ্যা দিলেনআর আজ যে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সেইখানে তার মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
এই ঐতিহাসিক স্থানের পাশ দিয়ে যে পাকা রাস্তা রয়েছে তা গিয়ে মিলেছে তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়েএই মহাবিদ্যালয় দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সবচেয়ে প্রাচীণ মহাবিদ্যালয়
আন্দোলন আর শহীদের কথা যখন উঠল তখন যাওয়া যাক আর এক ঐতিহাসিক ভবন ‘রক্ষিত বাটি’।
তমলুকের মাটিতে যখন বিপ্লব আর আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভয় ধরাচ্ছে তখন এই রক্ষিত বাড়িতেই চলত “অনুশীলন সমিতি” আর “গুপ্ত সমিতি”র গোপন কার্যকলাপ।এবাড়ির ইতিহাসবিদ ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত এই বাড়িকে নতুন ভাবে নির্মাণ করেন।এই তমলুকের মাটিতেই জন্মেছিলেন বিপ্লবী ও বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশ চন্দ্র সামন্ত প্রমুখ অনেক গুণীজন।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব ইতিহাস দেখতে দেখতে যদি আবার নদীর কাছে যেতে চান তাহলে রূপনারায়ণ-এর তীরের কাছে যে “ইরিগেশন বাংলো” আছে সেটিও দেখবার মতো।নদী এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে হলেও জোয়ারের সময় দু-কুল ভেসে যাওয়া আর ভাটায় শান্ত হয়ে যাওয়া চারপাশ মনের শান্তি আর চারদিকের চির সবুজ চোখের বিশ্রাম আনে।
রাত কাটানোর জন্যে এখানে বেশ কিছু ছোটো ও মাঝারি হোটেল আছে।আর পুরসভার আয়োজনে রূপনারায়ণ নদের তীরে “রূপনারায়ণ” নামের অতিথি নিবাস আছে।সারাদিন ঘোরাঘুরির পর রূপশ্রী কি চলন্তিকায় সিনেমা কিম্বা কোনও নাট্যদলের নাট্যপ্রযোজনা দেখে এখানে এসে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন আমরা যাব তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালায়।যেখানে ইতিহাস কথা বলে।
তমলুক শহরের অন্যতম দর্শনীয় হল পুরসভা অফিসের কাছে তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্রএই সংগ্রহশালায় প্রবেশের আগে এই শহর আর তার আশেপাশে নানা কালে যে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় তাতে কী কী পুরাতাত্ত্বিক বস্তু পাওয়া যায়,কারা এই কাজ করেন তা জানা থাকলে সংগ্রহশালা ঘুরে দেখতে সুবিধে হবে তাই না?
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছিলেন –
“হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে!”
কবিকে আমরা ভুলতে পারিনি কিন্তু এই মানুষটিকে যিনি প্রাণাধিক ভালোবাসতেন সেই প্রিয় বন্ধু সেকালের আই,সি,এস গৌরদাস বসাক কে কী আমরা ভুলে যাব?গৌরদাস বসাক প্রথম তমলুকের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। প্রসিডিংস অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্য (কলকাতা, ১৮৮৯) তিনি তাঁর আবিষ্কারের কথা সংক্ষেপে প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে তমলুকের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব উমাচরণ অধিকারী একটি গ্রন্থে তমলুক নগরের প্রাচীন নির্দশন সম্পর্কে বর্ণনা করেন।
তখন এই স্থানটিতে কমপক্ষে দু-দুবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালানো হয় এবং বেশ কয়েকবার প্রত্নসম্পদের সন্ধান করা হয়েছে।
১৯২০-১৯২১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ তমলুক-এর ওপর একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করে। ১৯৪০ সালে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ সম্পাদন করেন প্রখ্যাত স্যার গুরুসদয় দত্ত ,টি,এন,রামচন্দ্রন এবং কে,এন,দীক্ষিত।
এই উৎখনন থেকে যে সব প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল পোড়ামাটির সামগ্রী, মৃৎপাত্র আর মুদ্রা। প্রাপ্ত নিদর্শনাবলির অনেকগুলিই ছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর।এ.এস.আই ১৯৫৪-৫৫ সালে এম,এন,দেশপাণ্ডের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী প্রত্ন-উৎখননের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে চার স্তরের সাংস্কৃতিক পর্যায় উঠে আসে
অবশ্য এ উৎখনন থেকে কোন ধরনের কাঠামোগত অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কেবল পেটানো মেঝে এবং পাতকুয়ার সন্ধান মিলেছিল।
১৯৭৩-৭৪ সালে এস,কে মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে আরেক দফা উৎখননের উদ্যোগ চলে। এ উৎখনন থেকে চারটি পৃথক সাংস্কৃতিক পর্বের সন্ধান পাওয়া গেল
এগুলির মধ্যে প্রথম পর্বে নব্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির অসম্পূর্ণভাবে পোড়ামাটির পাত্র , বিপুল পরিমানে মধ্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে তৈরি সূঁচ আর অল্প কিছুসংখ্যক তাম্রসামগ্রী পাওয়া গে্ল
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতাব্দী হলো দ্বিতীয় পর্বের কালসীমা।এ স্তরে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রএর কিছু টুকরা,পাথরের গুটিকাআর পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণে ছাপাঙ্কিত ও ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা
কেউ কেউ এ স্তরকে তথাকথিত মৌর্য-শুঙ্গ যুগের বলে অনুমান করেন।এখানে ইঁটের তৈরী একটি জলাধার এবং পোড়ামাটির কিছু পাতকুয়ার নিদর্শনও পাওয়া গেলতৃতীয় স্তরটি কুষাণ-শুঙ্গ যুগের সমসাময়িক এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ বলে মনে করলেন গবেষকরা
এখানে মৃৎশিল্প, এবং প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির মূর্তি,যার কোন কোনটির সাথে হেলেনীয় রীতির সুস্পষ্ট মিল পাওয়া যায়।এ সবই কী এক আধুনিক নাগরিক জীবনের ইঙ্গিত দেয় না? যেখানে নাগরিকরা শিল্পকর্মে লিপ্ত থাকতো।
চতুর্থ স্তরটি গুপ্তযুগের সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়।তবে এ পর্যায় থেকে পাওয়া প্রত্ন নিদর্শন তেমন একটা আকর্ষণীয় ছিল না।
১৯৫৪-৫৫ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালের মধ্যে কয়েকজন গবেষকের ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁড়াখুঁড়ি করেন।এই উৎখননে তমলুকের আশে-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন উঠে আসে
প্রয়াত প্রফেসর পি,সি দাশগুপ্ত ছিলেন গবেষণার এ অঙ্গনে পথিকৃৎ।এই প্রত্নস্থল থেকে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন-নিদর্শনের সংগে পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালের পর তাম্রলিপ্ত গবেষণা ও জাদুঘর কেন্দ্র এই অঞ্চলে স্বাধীন গবেষণা সম্পাদন করে। জাদুঘরের কিউরেটর তমলুকের প্রত্নতত্ত্বের উপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ মনোগ্রাফ প্রকাশ করেন।প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এইসব অঞ্চলে আরও কয়েকটি প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হলো
তমলুকের আদি ঐতিহাসিক যুগ নানা ধরনের মৃৎপাত্র, যেমন রুলেটেড’ (নক্‌শা করা) পাত্র, ধূসর মৃৎপাত্র, লোহিত মৃন্ময় পাত্র, কালো মসৃণ মৃৎপাত্র ও উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র
মৃৎপাত্রের পাশাপাশি বিরল সৌন্দর্যের কিছু পোড়ামাটির সামগ্রীও এই প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেল
এবার চলুন মিউজিয়মের ভেতরে যাওয়া যাক।এখানে আপনি দেখতে পাবেন নানা সময়ে পাওয়া আদি প্রস্তর যুগ থেকে মধ্যপ্রস্তর যুগ অব্দি আদিম মানুষের ব্যবহৃত প্রস্তরীভূত হাড়, পাথরের অস্ত্র, হরিণের শিঙের উপর খোদাই করা নকসাযুক্ত আসবাব, মৌর্য, শুঙ্গ যুগ থেকে পাল-সেন আমল অবধি প্রাপ্ত পোড়া মাটির মূর্তি
তমলুক জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে পোড়ামাটির তৈরি যক্ষী ও জীবজন্তুর মূর্তি এবং সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের জীবন সম্পর্কিত পোড়ামাটির ফলক।
এই মিউজিয়ম যদি খুঁটিয়ে দেখতে হয় তাহলে সারা দিন লেগে যাবে।আর আপনি একটু একটু করে চলে যাবেন অতীতের তাম্রলিপ্তে।

১০
যে তাম্রলিপ্ত বন্দর-নগর আজকের তমলুক শহর এক কালে ছিল এমন সমৃদ্ধ আর সম্পদশালী সেখানকার জ্ঞান চর্চা আর শিক্ষার হার যে হবে অনেক উন্নত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তমলুকের শিক্ষার হার শতকরার হিসাবে ভারতের অনুপাতে অনেক বেশি।২০০১ এর সেন্সাস অনু্যায়ী এখানে পুরুষ ৫২ভাগ আর নারী ৪২ ভাগ।এর মধ্যে শিক্ষার হার শতকরা ৭৭ভাগ।পুরুষ শিক্ষার হার ৮৩ নারী শিক্ষার হার শতকরা ৭২ ভাগ।
শিক্ষার কারণেই এখানে শিল্প ও সংস্কৃতি একটা বড়ো জায়গা দখল করে আছে।এখানে নিয়মিত নাট্যচর্চা হয়,পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং চলচ্চিত্র কেন্দ্র তাও রয়েছে।চলুন আজ আমরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে একটু ঘুরে আসি।
এই খানে একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোলো “তমলুক হ্যামিল্টন হাই স্কুল”মেদিনীপুর জেলার মধ্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোলো প্রাচীণতার দিক থেকে দ্বিতীয়।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মিস্টার রবার্ট চার্লস হ্যামিল্টন প্রতিষ্ঠা করেন।যদিও এই হ্যামিল্টন সাহেব পেশায় ছিলেন নুনের কারবারী কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবী। তাই তমলুকের মানুষ তাকে ডেভিড হেয়ারের সংগেই এক আসনে বসান।তমলুকের শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে তার অবদান ভোলার নয়।
এখান থেকে সেকালে ও একালেও অনেক কৃ্তি ছাত্রের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে।আর এই স্কুলেই কিছুদিন পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বসু১৯০০ থেকে ১৯০৩ সাল অব্দি তিনি এখানে পড়েছিলেন।
এই স্কুলের মাটিতে একটি প্রস্তরীভূত গাছের ফসিল রাখা আছে।এই স্কুলের মূল ভবণে একটি সুন্দর সংগ্রহশালাও আছে।
এর কিছু দূরে “রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যালয়”নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যার বিরাট অবদান।
এছাড়াও আছে তমলুক টাউন স্কুল।
বিদ্যাপীঠ বালিকা বিদ্যালয়।
শালগেছিয়া হাই স্কুল
রঘুনাথ মেমোরিয়াল হাই স্কুল
তমলুক সেন্ট্রাল স্কুল
আর তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ের কথা তো আমরা আগেই বলেছি।যার সামনে এক বিশাল খেলার মাঠ।এই ভবণটিও বেশ প্রাচীণ।
এই শহরে যেমন পড়াশোনা হয় আবার মেলা পার্বণ তাও হয়।
এ শহরে মকর সংক্রান্তিতে বারুণির মেলা প্রায় গংগাসাগরের মেলার মতোই প্রসিদ্ধ।
আবার বাংলা মাঘ মাসের ১১ দিনে এখানে ভীম মেলা বসে।
কালীর মেলা হয় চৈত্র্য মাসে
চৈত্র্যের শেষে গাজন আর চড়ক মেলা।
আর আষাঢ় মাসে হরির হাটে রথের মেলা বসে।
অবশ্য এই রথযাত্রা মহিষাদলের রথযাত্রার মতো প্রসিদ্ধ নয়।তবে চাইলে আমরা এই শহর থেকেই একবার মহিষাদল রাজবাড়ি,গেঁওখালি,সুতাহাটা,ময়না,রঘুনাথবাড়ি, রাধামনির হাট ঘুরে আসতে পারি।
গেঁওখালিতে গেলে গংগার আর এক রূপ দেখতে পাব।আর এখানে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পর্তুগীজদের এদেশে আগমনের সাক্ষ্য।
পর্তুগীজরাই এই শহরে আসা প্রথম খ্রিশ্চান।এরা বাণিজ্যের কারণে এই তাম্রলিপ্ত বন্দরে এসে কালে কালে এখানকার মানুষদের সংগে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করে।মোমের কারবার ছিল এদের প্রধান ব্যবসা।
১৬৩৫এ এই শহরে প্রথম চার্চ স্থাপিত হয়।১৬৯৫ এ তমলুক শহরে পর্তুগীজরাই রাজত্ব করত।
তমলুক শহর থেকে সামান্য কয়েক ঘন্টায় ময়নায় ঘুরে আসা যায়।ময়নার রাজবাড়ি স্থাপত্যের দিক ঐতিহ্যশালী।ময়নার মাদুর আর ময়নার গয়না বড়ি সেও বিখ্যাত।বিউলির ডালে তৈরি এই বড়ি এতোটাই শিল্পসম্মত আর হাল্কা যে ছাঁকা তেলে ভাজার পর এই বড়ি শোনপাপড়ির মতো মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।
শুধু ময়না কেন তমলুক-এর প্রায় সবখানেই এই গয়না বড়ি তৈরি করেন বাড়ির মেয়েরা।শীতকালে প্রায় ঘরে ঘরে ডাল বেটে বাঁশের পাটায় তেল মাখিয়ে আল্পনা দেবার ভঙ্গিমায় বড়ি দিয়ে রোদে শুকানো হয়।আর গয়না বড়ি দেওয়া হয় পোস্তদানার উপর।থালায় পোস্ত ছড়িয়ে তার উপর জিলিপি ভাজার মতো করে বড়ি দেওয়া হয়।
তমলুকের আশেপাশে হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি ঠক ঠক শব্দ শুন্তে পান ত্বে জানবেন ওখানে তাঁতে কাপড় বোনা চলছে।ঠক ঠক শব্দ হয় বলে আঞ্চলিক ভাষায় েই তাঁতকে ঠকঠকিও বলা হয়।
হাট থেকে কিনে আনা সুতো রং করে বেচা এটাও এই অঞ্চলের প্রধান জীবিকা।আর ধান-চাল-বোনা কাপড় তো আছেই।
তাই ফেরার পথে রাধামনির হাট থেকে বাংলার তাঁতের গামছা-মশারি-চাদর-শাড়ি ছাড়াও বাংলা পাতা পান,মিঠেপাতা পান কিনতে ভুলবেন না।এবার কোলাঘাটের কাছে এসে সেই বিখ্যাত ইলিশ মাছ নিতে ভুলবেন কী?মাছের সংগে ফুল মানায় কী না বলা মুশকিল তবে ঘাটাল আর কোলাঘাটে মাঠের পর মাঠ ফুলের চাষ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
আর যদি কোলাঘাটের কাছে দেনান ডাকবাংলোতে রাত কাটানো যায় সেও বা মন্দ কী?