তাম্রলিপ্তঃ শহরে,বন্দরে
সলিল সরকার
১
এই লেখাটা লিখতে হয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে
সম্প্রচারের জন্য।তাই আমার আগের লেখার সঙ্গে এই লেখায় পুনরাবৃত্তি দোষ ঘটবে।তবে
বন্দর শহর তাম্রলিপ্তকে জানতে এইটুকু না হয় মেনেই নেওয়া যায়।
বাঙালি হুজুগে জাতি এ কথা ভিন প্রদেশের মানুষজন যেমন বলে
থাকেন বাঙ্গালি নিজেও হাসতে হাসতে এ কথা কবুল করেন আর সুযোগ পেলেই পকেটে পয়সা আর পিঠে
লোটা-কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।এখন অবশ্য সাধু সন্ত ছাড়া আর কেউ লোটা-কম্বল নেয়
না।ওটা কথার কথা।এখন পিঠে থাকে রুক্স্যাক কি হ্যাভারস্যাক। হাতে থাকে ট্রলি ব্যাগ
আর কাঁধে থাকে ঝোলা।
কয়েক দশক আগেও শীত পড়লেই বাঙ্গালি পশ্চিমে ছুটত।পশ্চিম মানে
ঝাড়্গ্রাম, গালুডি, ঘাটশিলা,গিরিডি,গিধনি,শিমূলতলা,চাইবাসা,নেতারহাট ইত্যাদি
ইত্যাদি।বাংলা সাহিত্যে এইসব অঞ্চলের ভূরি ভূরি উল্লেখ আছে।বড়লোক বাঙালি ওইসব
অঞ্চলে সস্তা দরে বিঘার পর বিঘা জমি কিনে বাংলো বানিয়ে রেখে পুজোর ছুটি কী শীতকালে
কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন।অথচ বাংলার মধ্যেই যে কতো ঘুরে বেড়াবার,ইতিহাস খুঁড়ে দেখবার
আর দু-এক রাত হেঁসে খেলে কাটাবার মনোরম স্থান আছে তার তত্ত্ব-তালাশ আর কজন করেন?
তবে বেড়াতে যাব বল্লেই যেমন সুকুমার রায়ের ভাষায়
রাণাঘাট-কাকদ্বীপ হয়ে তিব্বত যাওয়া যায় না।আবার চাইলেই দীঘা কি দার্জিলিং যাওয়ার
ঝক্কি ঝামেলাও তো কম নয়।তার চেয়ে ছুটির দিনে ট্যাঁকের কড়ি সামান্য খরচ করে খুব
অল্প ছোটাছুটিতেই যদি এক-দুরাত কোথাও কাটিয়ে আসা যায় মন্দ কী?যেমন ধরুন আপনার মন
চাইল বন্দর দেখবে তার জন্যে কী আর আপনি বিমানবন্দরে ছুটবেন? না কী বিশাখাপত্তনম
যাবেন?বরং আপনি কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে কয়েক ঘন্টার যাতায়াতে হলদিয়া বন্দরে
ঘুরে আসতে পারেন।কিন্তু আপনি যদি ইতিহাসবিলাসী হন তাহলে হলদিয়া যাওয়ার আগে
তাম্রলিপ্ত বন্দরে যাবেন না তাই কখনও হয়?
জানি জানি আপনি মনে মনে ভাবছেন সেটা আবার কোথায়?আর যাবই বা
কী উপায়ে?সবুর করুন ধীরে ধীরে সব বলব।
কোনও এক ছুটির দিনে আপনি হাওড়া স্টেশন থেকে মেদিনীপুর
লোকাল,পাঁশকুড়া লোকাল কি মেচেদা লোকাল ধরে মেচেদা পৌঁছে যান।মেচেদার
ঝাল্মুড়ি,ঘুগ্নি,সিঙ্গাড়া খুব নাম করা।আর নাম করা পাঁশকুড়ার চপ।মেচেদায় নামুন কি
পাঁশকুড়ায় সেখান থেকে বাসে চেপে তমলুক।পাঁশকুড়া থেকে তমলুক যাওয়ার পাকা সড়ক সেই
ব্রিটিশ আমলের।কী?এবার নামটা চেনা চেনা লাগছে তো?লাগবেই তো!এটা যে এখনকার নাম।
২
আপনি হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপেই সোজা তমলুক স্টেশনেও নামতে
পারেন।আর যদি নিজের গাড়ি থাকে তাহলে তো কথাই নেই।কলকাতা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে
গঙ্গা নদি পেরিয়ে ন্যাশানাল হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে দামোদর নদ পেরোবেন তার পর পেরোতে
হবে রূপনারায়ণ।
রূপনারায়ণ ব্রীজ পেরোলেন মানেই আপনি কোলাঘাট অর্থাৎ
পূর্বমেদিনীপুরে প্রবেশ করলেন।কোলাঘাট মানেই ইলিশ মাছ কিন্তু এখন তার দেখা পাওয়াই
ভার।তবু যদি ভাগ্যে থাকে ফেরার পথে কেনার চেষ্টা করতে পারেন।তার আগে কোলাঘাটের
ধাবায় খাটিয়ায় বসে মাটির খুরি কি ভাঁড়ের কড়া চা আর প্রাতরাশ সেরে নিতে পারেন কারণ
এখান থেকেই আপনার দেখার জিনিস শুরু হয়ে গেল।
অনেক দূর থেকেই সে ট্রেন হোক কি গাড়ি বা বাস আপনি বেশ
কয়েকটি চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখছেন তো?তার মানেই আপনার ঘরে কোলাঘাট তাপ
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ গ্রীডের মাধ্যমে ঠিকভাবে সরবরাহ হচ্ছে!এই তাপ বিদ্যুৎ
চলে কয়লার তাপে।তাই কয়লার পোড়া ছাই আশপাশে একটা সমস্যার সৃষ্টি করে।এখন অবশ্য এই
ছাই জলাজমি ভরানোর কাজে এমনকি ইঁট তৈরির কাজেও ব্যবহার হচ্ছে।
এখান থেকে তমলুক যাওয়ার সময় আপনি যে পথ দিয়েই যান না কেন
বেশ কয়েকটি হাট চোখে পড়বে সেগুলি ধান-চাল-পাট-পান আর সব্জির বেশ পুরানো হাট
বাজার।রামতারক,কাঁক্টিয়া,ডিমারী,রাধামনি এই রকম নামের বেশ কয়েকটি হাট আছে তার
মধ্যে রাধামনির হাট আজও তাঁতের শাড়ি-গামছা-মশারি-চাদরের জন্যে প্রসিদ্ধ।সে কথায়
যাওয়ার আগে চলুন তাম্রলিপ্তের ইতিকথায় চোখ ফেরাই।শুরুতে এখানের নামের কথায়
আসি।এখানকার নাম নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও গবেষকদের মত অনুযায়ী তাম্রলিপ্তি>তাম্রলিপ্তিকা>ডামিলিত্তি>তাম্রলিপ্ত>তামোলিপ্তি>
তমোলোক থেকে তমলুক।আবার কেউ কেউ একে বেলাকুলা তাও বলতেন।
৩
কাশীরাম দাসের মহাভারতে লেখা হচ্ছে মহাভারতের মহা যুদ্ধে
জয়ের পর যুধিষ্ঠির ভারতের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার আশায় অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে
ছিলেন।যে দেশের রাজা সেই ঘোড়ার লাগাম টানবে তার সংগে যুদ্ধ হবে পঞ্চপাণ্ডবের।সেই
যুদ্ধে হেরে গেলে রাজাকে মেনে নিতে হবে পাণ্ডবদের আধিপত্য আর বশ্যতা।
অশ্ব্মেধের ঘোড়া যখন সারা ভারত ঘুরে এলো এই তাম্রলিপ্তে তখন
তাম্রলিপ্তের রাজা তাম্রধ্বজ আটকে দিলেন যুধিষ্ঠিরের সেই অশ্ব্মেধের ঘোড়া।যুদ্ধ
ঘোষণা করলেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।এখন যে জায়গাটার নাম ‘রণশিঙ্গা’ সেখান থেকেই নাকি
রণের অর্থাৎ যুদ্ধের শিঙ্গা ফোঁকা হয়েছিল।তাই এখানের নাম রণশিংগা।আর অশ্বমেধ
যজ্ঞের ঘোড়া তাম্রলিপ্তের রাজার কাছ থেকে মুক্ত করতে এসে কৃষ্ণ অর্জুনকে এই
তাম্রলিপ্ত বিষয়ে বলছেন-
“তমোলিপ্ত পরম স্থানম্ নাসমকম্ প্রীতৃষ্যতে
মমকং হৃদয়ং লক্ষ্মী যথায়ং তথা মায়া”
এই তমোলিপ্ত পরম
রমণীয় মনোরম স্থান।এখানে সদা আমার হৃদয় লক্ষ্মীর বাস।তিনি আরও বলছেন-“হে কৌস্তেয়
আমি সব তীর্থ পরিত্যাগ করতে পারি কিন্তু কদাপি এই তমোলিপ্ত ত্যাগ করব না।কালে কালে
যুগে যুগে আমি এখানে ফিরে ফিরে আসব” ! তাহলে তমোলিপ্ত নামটা পেলাম?
রাজাদের কথা যখন
উঠল তাহলে রাজবাড়ির কথাও বলতে হয়।তমলুকের রাজবাড়ির ইতিহাস যে অতি প্রাচীণ সে তো
আগেই বলা হোলো।ময়ূরোধ্বজ রাজার কথা পুরাণে আর মহাভারতেও আছে।সেই ময়ূরোধ্বজ রাজার
পুত্রই রাজা তাম্রধ্বজ।ভীম এই রাজার কাছ থেকে অশ্ব্মেধের ঘোড়া যুদ্ধ করে ছিনিয়ে
নিতে পারলেও তাম্রলিপ্তের রাজার সাহস আর শক্তির কথা লেখা হয়ে থাকল মানুষের মনে।
শহরের মুখেই বিশাল
জায়গা জুড়ে এই রাজবাড়ি।রাজবাড়ির সামনে বিশাল মাঠ সেখানে এক কালে সার্কাসের তাঁবু
পড়ত।রাজবাড়ির পুব দিকে এক বিশাল দীঘি যার নাম লোকের মুখে মুখে খাটপুকুর। কথাটা কী
খাদপুকুর হবে?কেন না অনেক যুগ আগে বঙ্গ উপ সাগর তো এই শহরের খুব কাছেই
ছিল।সমুদ্রের খাঁড়ি থেকে খাদ থেকে মুখে মুখে খাট হয়ে যায়নি তো?এক কালে ওখানে এক
মস্ত গাছের গুঁড়িতে লোহার শিকল বাঁধা থাকত।নৌকা ভেড়ানো থাকত পাড়ে।দীঘিতে অনেক মাছ
ছিল।দীঘির জল শুকোত না প্রখর রৌদ্রেও।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তার উপন্যাসে এই স্থানের উল্লেখ করছেন।
রাজবাড়ির ভেতরে
রাধামাধব আর রাধারমণ-এর মন্দির আর আজকের ভগ্নপ্রায় ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ কালের
সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
৪
তাম্রলিপ্ত শহর বা ব্রিটিশ আমলের তমলুক আজকের শহর কলকাতা
থেকে মাত্র একশ কিলোমিটার দূরে।যার পূর্বদিকে রূপনারায়ণ,পশ্চিমে সুবর্ণরেখা।এছাড়া
কংসাবতী আঞ্চলিক ভাষায় কাঁসাই,হলদি নদি,কেলেঘাই আর রূপনারায়ণ এর সংগে যুক্ত হয়েছে
দ্বারকেশ্বর আর শিলাইয়ের প্রবাহ।
টলেমির লেখায় এই তমালিকা বা তমলুকের চিহ্ন রয়েছে।আজ যেমন
সড়ক পথে এই শহর থেকে ভারতের অনেক শহরে যাওয়া যায়।এখন
যেমন আপনি চাইলে বাসে বা গাড়িতে তমলুক থেকে শ্রীরামপুর,ময়না,কাঁথি-দীঘা-এগরা।আবার কোলাঘাট-ঘাঁটাল।অন্যদিকে
মেদিনীপুর শহর,খড়্গপুর,ঝাড়গ্রাম,গড়বেতা যেতে পারেন আর একটু ঘুরে আসতে গেঁওখালি চলে
যান।একদিন সময় করে মহিষাদল যেতে হবে।আরো ছাড়িয়ে দুর্গাচক আর হলদিয়া বন্দর তেমন
করেই এক সময় এই শহর থেকে সড়ক পথে
রাজগৃহ,শ্রাবস্তী,পাটলিপুত্র,চম্পা নগরী,কৌসাম্বী আর তক্ষশীলা যাওয়া আসা হতো। মৌর্য
যুগে এই তাম্রলিপ্ত ছিল দক্ষিণ-পূর্বের সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ।ফা হিয়েন আর সুং সাং
এই বন্দর শহরের কথা লিখছেন।সে কথায় আসছি তার আগে এখানে আজও কী কী দেখতে পাবেন সেই
কথায় যাই।
রাজবাড়ি যাওয়ার
পথে শহরে যখন ঢুকবেন মানিকতলা মোড় থেকে তখন যেতে গিয়ে বামদিকে মানিকপীরের থান
পাবেন।স্থানীয় মানুষ সব ধর্ম নির্বিশেষে এই মাজারে আসেন আর এর সামনে যে পুকুর আছে
সেখানে স্নান করেন পুণ্যলাভের আশায়।মানিকপীর থেকেই যে মানিকতলা সে বুঝতে গবেষকের
প্রয়োজন আছে কী? তাছাড়া এখানে মানে এই শহরে বহু যুগ থেকেই বাণিজ্যের কারণেই
বহুজাতির আগমন আর বসবাস।
তাম্রলিপ্তিতে মানববসতির কালসীমা মোটামুটি
তৃতীয়/চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত বলে বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তির
সর্বশেষ প্রমাণ বহন করছে অষ্টম শতাব্দীর উদয়মনের দুধপানি প্রস্তরলিপি।
৫
গ্রীক ভৌগোলিক টলেমির মানচিত্রে ‘তমলিটিস্’ রূপে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। চৈনিক তীর্থযাত্রী সুং-সাং সবাই যাকে হিউয়েন-সাং বলেই চেনেন তিনি তাম্রলিপ্তি শহরকে ‘তান-মো-লি-তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস বলে, গুপ্ত সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আমলে এই শহরে এসেছিলেন বিখ্যাত চিনাপ রিব্রাজক ফা-হিয়েন।তার
প্রায় ২০০ বছর পরে এসেছিলেন চিনা পরিব্রাজক সুং-সাং।সম্রাট অশোক এখানে স্থাপন করেছিলেন অনুশাসন
খোদিত প্রস্তরস্তম্ভ।অশোকের ছেলে মহেন্দ্র আর কন্যা সংঘমিত্রা তাম্রলিপ্ত বন্দর
দিয়ে সিংহল তথা আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারে। ভারতের অন্যতম
প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্তে আজ আর বন্দরের অস্তিত্ব নেই।নাই বা থাকল আজও যা
আছে তাই বা কম কী?
আপনি যদি এখন একবার স্টীমার ঘাটে যেতে চান
তাহলে আপনাকে শহরের ভেতর দিয়ে মানিকপীরের থান,রাজবাড়ি,মহাপ্রভুর
মন্দির,জেলখানা,আদালত,মিউজিয়ম,পুরানো হাসপাতাল এসব ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক বর্গভীমার
মন্দিরের পাশ দিয়ে সোজা স্টীমার ঘাটের দিকে যেতে হবে।
বর্গভীমা মন্দির আর তার স্থান মাহাত্ম্যের
কথা স্টীমার ঘাট থেকে ফিরে এসেই করা যাবে না হয়।শুধু এইখানে এটুকু বলা প্রয়োজন এক
কালে এই মন্দিরের ঠিক পিছনেই রূপনারায়ণের ঢেউ আছড়ে পড়ত।এখন নদী সরতে সরতে কয়েক
কিলোমিটার দূরে সরে গেছে কিন্তু প্রাচীণ স্টীমার ঘাট সে তো আর সরতে পারে না তাই
স্থবিরের মতো অব্যবহারে জীর্ণ দীর্ণ কংকালসার হয়ে কালের সাক্ষ্য বহন করছে।
এক কালে এই স্টীমার ঘাট যাতায়াত আর ব্যবসার
জন্যে মানুষের কাছে প্রধান যাতায়াতের জলপথ ছিল।নদী তার নিজের ধারায় কুল ভেংগে
এগিয়ে এসেছে আবার পিছিয়ে গেছে যেমন আমরাও যদি সেইভাবে আবার একটু পিছিয়ে যাই তাহলে
শুনতে পাব মুখে মুখে ফেরা কালের কথা।
“গঙ্গার গতি লক্ষ করিয়া এবং পূর্বদিকে
অষ্টাদশ যোজন পথ অগ্রসর হইয়া ফাহিয়ান গঙ্গা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় আরও
পঞ্চাশ যোজন পথ অগ্রসর হইয়া চম্পা নামক সুবৃহৎ রাজ্যে উপনীত হইলেন।তথায় উপনীত হইয়া
তিনি তাম্রলিপ্ত নামক বন্দর যেখানে দ্বাবিংশটি সঙ্ঘারাম রহিয়াছে এবং প্রত্যেকটিতেই
যতিগণ বাস করেন সেখানে উপনীত হন।এই স্থানেও বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাব আছে। ফা-হিয়ান এই স্থানে সূত্র নকল ও প্রতিমূর্তির আলেখ্য প্রস্তুত
করিয়া দুই বৎসর অতিবাহিত করেন।
অতঃপর তিনি এক বৃহৎ বাণিজ্যপোতে আরোহণ করিয়া সমুদ্র দিয়া
শীত ঋতুর প্রারম্ভে দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রা করিয়া সেখানে দিবারাত্র অতিবাহিত করিয়া তিনি সিঙ্ঘল প্রদেশে
উপস্থিত হন। অধিবাসীদের মতে সিংহল হইতে তাম্রলিপ্তি সাতশত যোজন দূর।“
এর থেকেই বোঝা যায়
তাম্রলিপ্তিতে বিদেশিদের নিয়মিত যোগাযোগ যাতায়াত ছিল এবং বাইরের দেশের সঙ্গে যোগাযোগের
প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ।সুং-সাং বা হিউয়েন সাং বা ইউয়ান চোয়াং এর বর্ণনায়
তাম্রলিপ্তি প্রবলভাবে উপস্থিত। সুং সাং ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন থেকে রওনা হয়ে ৬৪৪
পর্যন্ত জীবনের মূল্যবান পনেরটি বছর ভারতীয় উপমহাদেশে কাটিয়ে ছিলেন।
তার প্র দেশে ফিরে তিনি যে ভ্রমণ
বৃত্তান্ত লেখেন তাতে আছে—
‘সমতট থেকে পশ্চিম দিকে ৯০০ লি পথ পাড়ি দেয়ার পর এসে পৌঁছলাম
তান-মো লি-তি বা তাম্রলিপ্তি রাজ্যে। রাজ্যটি আকারে ১৫০০ লির মতো। রাজধানীর আয়তন
১০ লি। .. ফল ও ফুলের ছড়াছড়ি এখানে দশটির মতো সংঘারাম
আছে, হাজার খানেক ভিক্ষুর বাস। দেবমন্দির আছে পঞ্চাশটির মতো। নানা সম্প্রদায়ের
লোকেরা এখানে মিলেমিশে বাস করছে। দেশটির উপকূল ভাগ একটি সমুদ্র খাঁড়ি দিয়ে
বেষ্টিত। জল ও ভূমি যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করছে এখানে। প্রচুর দামী দামী জিনিস এবং
রত্নসামগ্রী এখান থেকে সংগৃহীত হয়। এজন্য এলাকার অধিবাসীরা বেশ ধনী। ...’
সুং-সাং অনেক কথার পাশাপাশি আর একটা কথাও
লিখেছিলেন।এই অঞ্চলের মানুষজন যেমনতর পরিশ্রমী তেমনি গোঁয়ার আর একগুঁয়ে।তা তো হবেই
সমুদ্র উপকূলের মানুষজনদের সারাক্ষণ সামুদ্রিক ঝড়জল তুফানের সংগে লড়তে হয় কী না!
চীনা পরিব্রাজক ইিসঙ (জন্ম : ৬৩৫ খ্রি. মৃত্যু
: ৭১৩ খ্রি.) তাম্রলিপ্তিতে
৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন এবং তাম্রলিপ্তির গুরুত্বের কথা তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ
করেছেন। বাংগালি গবেষকরাও বাণিজ্যনগরী তাম্রলিপ্তির সমৃদ্ধির কথা লিখেছেন।
তবে আজও যে স্টীমার ঘাট ভেংগেচুরে পড়ে আছে সেই
ঘাট দিয়ে তো ফা-হিয়েন কি সুং-সাং কি হি-সং আসেননি বা ফিরে যাননি তাই ঘাটের কথা
থাক।চলুন এবার শহরে ফেরা যাক।সেখানে আমরা ফেলে এসেছি অনেক দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থান।
৬
প্রবীণেরা বলে থাকেন-“দ্যাখার জন্যে শুধু চোখ থাকলেই হয়
না,দরকার উৎসুক মনের!”কথাটা খুব খাঁটি আর এই কথার ভিতরে লুকিয়ে আছে আর একটা কথা।এই
যেমন ধরুন বর্গভীমা মন্দিরের কথাই যদি ধরি সেটাকে কেউ যেমন তার ধর্মের স্থান
হিসেবে দেখবেন কেউ দেখবেন এর স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব।আবার যখন শুনবেন এই
শহরে চৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন।এই বাণিজ্যক্ষেত্রের পূণ্যভূমিতে স্নান করেছিলেন
তার পর গিয়েছিলেন পুরীধাম আপনার আগ্রহী মন খুঁজে বেড়াবেই মহাপ্রভুর পায়ের চিহ্ন।আবার
যদি শোনেন একদিন এখানেই পড়েছিল তথাগত বুদ্ধের পদধূলি আপনি রোমাঞ্চিত না হয়ে
পারবেন?
ফা-হিয়েনের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যেহেতু বংগ আর মগধ
পাশাপাশি তাই তথাগত এই বাংগালায় এসেছিলেন আর তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে
সম্রাট অশোক সেইসব স্থানে স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।ফা-হিয়েনের কালে এখানে
প্রায় বাইশটি ‘মনেস্ট্রি’ ছিল।সুং-সাংয়ের সময় দশ-বারোটি।আর যে স্তুপ ছিল তার একটির
উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের বর্গভীমার মন্দির।বৌদ্ধ মহাযান হীণযান থেকে কালে কালে
তান্ত্রিকতার ধারা বেয়ে এই তাম্রলিপ্ত শহর হয়ে উঠেছিল সনাতন শক্তিরপীঠ।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমংগল কাব্যে লিখছেন –
“গোকুলে গোমতীনামা
তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা
উত্তরে বিদিতা বিশ্বকায়া”
এসবই দ্বা্দশ শতকের কথা।আর
এই স্থাপত্যের নির্মাণ আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে।
তাম্রলিপ্ত নগরের মাঝখানে অর্থাৎ আজকের তমলুক
শহরের মাঝে দেবী বর্গভীমা মন্দির একান্ন পীঠের অন্যতম।কথিত আছে দেবীর বাঁ পায়ের
গোড়ালি এখানে পড়েছিল।
পুরাণ মতে অসম্মানে,অপমানে সতী পার্বতী
দেহত্যাগ করলে শিব সেই দেহ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করায় জগত লণ্ডভণ্ড হবার আশংকায় বিষ্ণু
তাঁর চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ৫১টি খণ্ডে খণ্ডিত করেন।যার মধ্যে সতীর
বাম পায়ের কড়ে আঙুল পড়ল এই স্থানে।তার থেকেই সৃষ্টি হোল শক্তিপীঠ।দেবী এখানে ভীমা রূপা, তাই তিনি বর্গভীমা। দেবীর মূর্তি একশিলা পাথরের আর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীও
অপূর্ব।কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর
“অন্নদামঙ্গল” কাব্যে লিখছেন-
“বিভাসেতে
বাম গুল্ফ ফেলিলা কেশব
ভীমারূপা
দেবী তাতে কপিলা ভৈরব”
তমলুক পুরসভা প্রকাশিত তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, রূপনারায়ণের তীরে উঁচু মাটির ঢিবির উপর মন্দিরটি বানানো।অনেকের মতে,সম্রাট অশোক তাম্রলিপ্তে যে স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন তার উপরই মন্দিরটি নির্মিত
হয়।তাম্রলিপ্ত শহরকে এক কালে ‘বিভাস’ নামেও ডাকা হোত।
মন্দির আর তার স্থাপত্যের কথা যখন উঠল তখন
যাওয়া যেতেই পারে আর এক মন্দিরে।তবে যাওয়ার আগে বর্গভীমা মন্দিরটি যদি ঘুরে দেখতে
থাকেন তাহলে পুর্ব দিকে যখন বেয়ে চলা রূপনারায়ণ থেকে মাছ ধরে শহরের দিকে ফেরা
মৎস্যজীবীদের দেখবেন তখন এক লোককাহিনির কথা মনে পড়বে।
একবার রাজার খুব অসুখ করল৷বদ্যি বলল যদি রাজাকে রোজ একটা
করে জিওল মাছ খাওয়ানো যায় দিনের আলো থাকতে থাকতেই তবে রাজা সুস্থ হয়ে উঠলেও উঠতে
পারেন........এক জেলেকে তলব করে প্রতিদিন একটি করে জ্যান্ত মাছের জন্য বলা
হলো........মাছ মরা হলে চলবে না,চালাকি করলে গর্দান যাবে........রাজবাড়ির হুকুমে
জেলে তাই করতে থাকল,কিন্তু একদিন সে রাজার বাড়ি যাওয়ার পথে দেখল মাছটা নড়ছেও না
চড়ছেও না.......মাছটা যেন তাকে মারতেই মরেছে৷জেলে আর কী করে নদীর ধারে জেগে থাকা
মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কান্নাকাটি শুরু করল।........এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে
চলেছে......নারীরূপীশক্তি এসে সব শুনলেন তারপর মাছটাকে প্রাণ দিলেন.........জেলে
খুশি হয়ে রাজবাড়ি যখন পৌঁছল তখন সাঁঝ নামতে আর একটু বাকি......রাজা জানতে চাইলেন
তার দেরির কারণ....... জেলে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল৷রাজা তারপর ওই অবহেলিত মন্দিরের
সংস্কার করে নিত্য পূজার আয়োজন করলেন৷
এই সেদিনও এ শহরে আর কোনও দেব-দেবীর পুজো হতো না৷আর এখন সব
পুজোর ঘট শোভাযাত্রা করে আগে মন্দিরে এনে দেবীভীমার পুজো করে পরে মণ্ডপে নিয়ে
যাওয়া হয়৷সে সময় স্থানীয় মানুষ আর কৌতুহলী মানুষ এই শোভাযাত্রা দেখতেই ভীড় জমান।যাই
হোক আমরা আবার ফিরে যাই পুরাস্থাপত্যের কথায়।
শহরের রাজবাড়ির দিকে যদি আবার ফিরে যাই তাহলে
হাট-বাজারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরাস্থাপত্য জিষ্ণুহরি মন্দিরের সন্ধান পাব।
পুরসভার তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, প্রায় ৫০০ বছরের আগে এই জিষ্ণুহরি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল।মূল মন্দির প্রায় ৩০
ফুট উঁচু,
চারচালা, জগমোহনযুক্ত। জিষ্ণুহরি মন্দিরের পরিচালনার
সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অধিকারী সম্প্রদায়।
এখানে বলে রাখা ভালো মোকাম কলিকাতা সেকালে
পেশা আর কাজ দিয়ে পরিচিত ছিল।যেমন টোলা,তলা,পাড়া,বাজার,বাগান এভাবে চিহ্নিত
ছিল।ডোমটোলা,পটুয়াটোলা, কাঁসারিটোলা,বেনিয়াটোলা, শাঁখারিপাড়া,তালতলা,বেলতলা,বড়বাজার,টেরিটিবাজার,চোরবাগান,হাতিবাগান
ইত্যাদি সেভাবেই তমলুক শহরেও আছে অধিকারীপাড়া,মালাকারপাড়া, দেপাড়া,মেথরপাড়া
ইত্যাদি।এইসব পাড়াতেই ছড়িয়ে আছে নানা স্থাপত্য,ইতিহাস।
তাই জেলখানার কাছেই হরির মন্দির ও মহাপ্রভুর
দালান সেও দেখতে ভুললে চলবে না।এর সংগেও যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে।
শ্রীচৈতন্য নীলাচলে যাওয়ার পথে এসেছিলেন এই
তাম্রলিপ্ত শহরে ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে।অর্থাৎ কি না ১৪০২ শকাব্দে।এই পূণ্যভূমে তিনি
স্নান করে নীলাচলে গিয়েছিলেন।এর পর পুরীতে ১৫৩৪এ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য অন্তর্হিত হলে
তাঁর শিষ্য বাসুদেব ঘোষ এই হরির মন্দির স্থাপন করলেন।
কিন্তু
ওই মন্দিরের প্রবেশ পথ সংলগ্ন এলাকায় বাজার বসার ফলে পর্যটকদের কাছে ওই মন্দির
চোখেই পড়ে না।তবে আমরা যারা উৎসাহী তারা তো সব বাধা পেরিয়েই দেখব।তাই দেখব
মানিকপীরের থান, লালদিঘির মসজিদ,জুম্মা মসজিদ,রামকৃষ্ণ
মিশন।আর রাজবাড়ির
মধ্যেকার রাধামাধব আর রাধারমণ মন্দিরের কথা সে তো আগেই বলেছি।তবে এসব স্থাপত্যই আজ
যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
তাই প্রাচীণ শহরের
মতো একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে একবার যদি ঘুরে দেখে নিই কিছু না হোক ইতিহাসের
সাক্ষী হয়ে তো থাকলাম!