MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

বাস্তুভিটে
আমি যে রকম উড়ন চণ্ডী আর ভবঘুরে তাতে তাম্রলিপ্ত শহর যে আমার বাসস্থান
হবে এটাই তো স্বাভাবিক।শুধু কলকাতা শহরেই বিয়াল্লিশ বছরে কতো জায়গায় যে বাস করেছি ......।শুরুতে পাকপাড়া(পাইকপাড়া)সেখান থেকে দমদমা (দমদম পার্ক)।
ওখান থেকে বাঘাযতীন।সেখান থেকে সোজা লবণ হ্রদ (সল্ট লেক)।আমরা যখন ওখানে বাস শুরু করেছিলাম তখন আমাদের বাসার আশপাশে দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুল, পাখি,সাপ, শেয়াল আর সাইকেল চোর।সেখান থেকে বাগুইআটি দক্ষিণ(দশ বছর) দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসে পনেরো বছর পার করে দিলাম। এর ফাঁকে কখন যে পাঁচ বছর শান্তিনিকেতনে অশান্তি বাধিয়ে বসলাম!যারা কলকাতার মানচিত্র আর মানস চরিত্র জানেন তারা বুঝতে পারবেন কেমন বাউন্ডুলে।
থাক সে কথা ......।ফিরে আসি বন্দরে......।
তমলুকের কাহিনি মহাভারতেও আছে।তাম্রধ্বজ রাজা যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধের ঘোড়ার
লাগাম টেনে ধরেছিলেন।এখন যে জায়গাটা রণসিঙ্গা ওখানেই নাকি রণের শিঙা ফোঁকা
হয়েছিল।তমলুকের রাজার ভাঙা প্রাসাদ আজো আছে।আছে খাটপুকুর(কথাটা হবে
“খাদ পুকুর” কেন না ওটা নাকি সমুদ্রের খাদ ছিল)ওখানে একটা লোহার মস্ত শিকল
ছিল।পুকুরের তলায় না কি মন্দির আছে।গরমে জল শুকিয়ে গেলে তার চূড়া দেখা
যায়!আর বর্গভীমার মন্দির যে সতীর মাহাত্ম্য প্রচার করে তা কি ঠিক না কি ওটা
ছিল জৈন থেকে বৌদ্ধস্তুপের পরম্পরা?মন্দিরের স্থাপত্য সে কথাই বলে......এখন রূপনারায়ণ অনেক দূরে সরে গেছে........আগে মন্দিরের পিছনেই সে আছড়ে পড়ত৷
আমরা শৈশবে এই স্থানের একটা লোককথা জানতাম........একবার রাজার খুব অসুখ
করল৷বদ্যি বলল যদি রাজাকে রোজ একটা করে জিওল মাছ খাওয়ানো যায় দিনের আলো থাকতে থাকতেই তবে রাজা সুস্থ হয়ে উঠলেও উঠতে পারে........এক জেলেকে তলব করে প্রতিদিন একটি করে জ্যান্ত মাছের জন্য বলা হলো........মাছ মরা হলে চলবে না,চালাকি করলে গর্দান যাবে........জেলে তাই করতে থাকল,কিন্তু একদিন সে রাজার বাড়ি যাওয়ার পথে দেখল মাছটা নড়ছেও না চড়ছেও না.......মাছটা যেন তাকে মারতেই মরেছে৷জেলে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কাঁদছিল........এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে চলেছে......শক্তি এসে সব শুনলেন তারপর মাছটাকে প্রাণ দিলেন.........জেলে খুশি হয়ে রাজবাড়ি যখন পৌঁছল তখন সাঁঝ নামতে আর একটু বাকি......রাজা জানতে চাইলেন তার দেরির কারণ.......জেলে সব বলল৷রাজা তারপর ওই অবহেলিত
মন্দিরের সংস্কার করে নিত্য পূজার আয়োজন করলেন৷এই সেদিনও শহরে আর কোনও পুজো হতো না৷আর এখন সব পুজোর ঘট আগে মন্দিরে এনে পুজো করে পরে মণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হয়৷অবিশ্বাসীদের জানাই.....এর মধ্যেও একটা সত্যি লুকিয়ে আছে......পরে সুযোগ হলে সে কথা লিখব৷এখন বরং ফিরে যাওয়া যাক বন্দরের কথায়.........৷
সুনীতিবাবু লিখছেন যেখানে তামিলরা বাস করে তাকে বলা হত “ডামিলিত্তি”।তাই থেকেই তামিলিত্তি.....তাম্রলিপ্ত.......তমোলোক......তমলুক?
প্রখ্যাত সেই চৈনিক পরিব্রাজক সুং সাং(হিউয়েং সাং?চীন থেকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিল লী আর তার স্বামী ইয়ো ইয়ো ওরা বলেছিল উচ্চারণটা এমনি হবে।আমাকে লী একটা সুন্দর সুং সাংয়ের সোনার জল করা মূর্তি উপহার দিয়েছে)তার ভ্রমণ কথায় লিখেছেন তমলুকের লোকেরা নাকি গোঁয়ার আর কঠোর পরিশ্রমী।সুং সাং আমরা আজো তাই......।এই তাম্রলিপ্ত এনেছিল স্বাধীনতার স্বাদ।মাতঙ্গিণী থেকে মণি ভৌমিক সবাই তো লড়াইয়ের সৈনিক।তেরঙা থেকে তেভাগা.........নুনএর ভেড়ি (লবণ)থেকে নন্দীগ্রাম......।ডুলুং থেকে ডেবরা......গোঁয়ারের গোঁ ছাড়া কী?
আর তাই কালে কালে বন্দর লিখে চলেছে কালের ইতিহাস ......।
এখনো বন্দরের ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে ওখানে।ফেরিঘাট আর শঙ্করআড়া,মূদ্রা আর ভাঙা মৃৎ্পাত্র......মূর্তি আর মদিরা সেই সাক্ষ্যই বহন করে চলেছে।খুব ছোটবেলায় ছুটে গেছি পুকুর খুড়তে গিয়ে কোথায় জাহাজের মাস্তুল আর মাছের আঁশ পাওয়া গেল দেখতে।কুড়িয়ে পাওয়া ইট আর পাথর দিয়ে বাড়ি করেছে অনেকেই।
আমার এখনো মনে হয় আমাদের বাস্তুভিটে অনেক গভীর করে খুড়লে গুপ্তধনের ঘড়া(কলসি)পাওয়া যাবে।কিছু না হোক প্রাণীর মড়া কি ফসিল পাওয়া যেতেই পারে।   
আমার বাবার কাছে অনেক প্রাচীণ মুদ্রা ছিল।সেগুলো কারা যে নিয়ে নিল।অনেক গ্রামাফোন ডিস্ক ছিল।সেসব নষ্ট হলো তবু কেউ আমাকে হাতে ধরে নিতে দিল না।
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত এক আনা দু আনার কতো কবিতা আর
প্রবন্ধের বই ছিল।সংস্কৃ্ত ভাষার কালিদাস থেকে উপনিষদ,যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ থেকে
কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত সব পোকায় কাটল তবু পকেটে পুরতে পারিনি।
শুধু বাবা বেঁচে থাকতে বাবার লেখা বংশলতিকা নিজের কাছে এনে রেখেছি।ওটা
কাউকে দেব না।ওটা যে আমাদের উদ্বাস্তু হবার ইতিহাস লিপি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন