আমাদের সেই নদির নামটি...
নদি আর সমুদ্র আমার দেশ।খাল,বিল,পুকুর,ডোবা
আমার গাঁ।যদিও আমার প্রথম নৌকায় চড়া মায়ের সংগে দাদুর দেশে যাব বলে।পুকুরে
মান্দাসে(কলার ভেলায়) ভেসেছি,খালে তালের ডোঙায় চড়েছি কিন্তু আমার নৌকা ভ্রমণ মায়ের
সংগে।দাদুর দেশে যেতে হলে সবার আগে বাসে চড়তে হবে।তারপর ট্রেনে।তারপরে নৌকায়।সেটা
ছিল গরমের ছুটির সময়।দাদুর কাছে যাব সেই আনন্দেই কদিন বিভোর ছিলাম। আমাদের এক
জ্ঞাতি কাকা কী একটা কাজে বাবার কাছে এসেছিল।(বাবার কাছে সবাই আসত খাজনা দেবার
জন্যে)কাজের শেষে আমাকে দেখেই বললে –‘হ্যাঁরে তুই নাকি খুব ভালো আবৃত্তি করিস?’আমি
খুব মুখচোরা ছিলাম।চুপ করে থাকলাম।ছোটোকাকা না কে যেন বলল –‘পারে পারে।ও কবিতা বলে
প্রাইজ পেয়েছে।‘সেই কাকা আর ছাড়ে?তাকেও শোনাতে হবে।ভালো লাগলে পুরস্কার।আমি
ছোটোবেলায় অনেক পুরস্কার পেয়েছি ছড়া,কবিতা বলে,অভিনয় করে।বড়োবেলায় অনেক তিরস্কার
পেয়েছি সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলে।সত্যি কথাটা সহজ করে লিখে।তার অনেক পরে জেনেছিলাম
গিরিশ চন্দ্র ঘোষ কবেই লিখেছিলেন –“তিরস্কার, পুরস্কার,কলঙ্ক কণ্ঠের
হার......।“ভাগ্যিস সেই ছোটবেলায় এসব জানতাম না।তাই পুরস্কারের আশায় গড়গড়িয়ে,হাত
পা নেড়ে কবিতা শুনিয়ে দিলাম।দাদুর দেশে যাবার ভোরে সেই কাকা আমার হাতে তুলে
দিয়েছিল দুটো মিষ্টি পাউরুটি।দাদুর দেশে পৌঁছে সেই পাউরুটি খেয়েছিলাম আমি আর
রিনি।রিনি আমার পিঠোপিঠি মা মরা মাসতুতো বোনের নাম।
ট্রেন থেকে নেমে নদির
পাড়ে গেলাম, সেখানে ওপারে যাওয়ার নৌকা বাঁধা আছে। মাঝি
হাঁকছে-‘রায়পুর......রায়পুর’।আমাদের সংগে ছিল সেজকাকা।সেজকাকা ওখানে আমাদের পৌঁছে
দিয়ে কলকাতায় চলে আসবে।সেজকাকা এক প্রকাশনায় তখন প্রচ্ছদ শিল্পীর কাজ করে।নৌকায়
উঠে বসতেই মাঝি আমাদের নিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল। আমার একটুও ভয় করেনি।মা সংগে ছিল
যে।নৌকায় উঠে আমরা কাগজ পেতে পাঁশকুড়ার চপ(এই সেদিনও পাঁশকুড়ার চপ আর মেচেদার
সিঙাড়া বিখ্যাত ছিল)আর মুড়ি খেতে থাকলাম।জলের মধ্যে শুশুক ভুস করে জেগে উঠে আবার
মিলিয়ে যাচ্ছে (গঙ্গায় সাতের দশকেও শুশুক দেখেছি)জেলে নৌকা লম্বা লম্বা জাল টেনে
মাছ ধরছে
আমরা ছপাৎ ছপাৎ শব্দে
একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি দাদুর দেশের দিকে।মাঝি দাঁড় টানতে টানতে জানতে চায়
আমরা কোথায় যাব,কার বাড়ি?সেজকাকা বলল বিধুভূষণ চন্দের বাসায়।মাঝি দুহাত তুলে
নমস্কার করে বলে –ডাক্তারবাবুর বাড়ি? উনিই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন গো!মাঝি
মাল্লা আর জেলেরা দাদুকে খুব সম্মান করত।দাদুতো ওদেরই চিকিৎসা করতেন।আর একটু দূরের
বিড়লা জুট মিলের শ্রমিকরা কম পয়সায় দেখাতে আসত।তখনকার ডাক্তারদের আজকের মতো পয়সা
ছিল না।তাছাড়া দাদুর কোনও ছেলে ছিলনা, ছিল ছ-ছটা মেয়ে।এখন বুঝতে পারি সেই ছ ছটা
মেয়ের বিয়ে দিতে আর কটুম্বি করতে করতেই দাদু ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন।দাদু মারা
গেয়েছিলেন বাড়িতে কোনও ধন গচ্ছিত না রেখেই।দিদিমা রায়পুর থেকে ফিরে এসেছিলেন
রাধাবল্লভপুরে নিঃস্ব অবস্থায়।দাদুর বড়ো ভাই দিদিমাকে রাধাবল্লভপুরের বাড়ি থেকেও
বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন।দাদুরা ছিলেন তিন ভাই।ছোটো ভাই অনেক দিন নিরুদ্দেশে
ছিলেন।পরে ফিরে এসে আমাদের দেশের বাড়িতে এসেছিলেন।অনেকটা ঠিক সত্যজিৎ রায়ের
আগন্তুক সিনেমার কাহিনির মতো।
আমার দাদু আমাদের ডাক্তার
জ্যাঠামশায়ের থেকে অনেক কম ফি নিতেন। জ্যাঠামশায়ের ফি ছিল এক টাকা,বাড়িতে গেলে
দুটাকা।সময়টা ষাট,সত্তর।দাদুর ফি ছিল অনেক কম কিন্তু দাদুকে ওখানকার গরিব গুর্বোরা
খুব ভালোবাসত।আপনজন ভাবত আর জ্যাঠামশায়কে ভাবত কালীবাবু যমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনে
প্রাণ। দাদুর একজন চিকিৎসা সহকারী ছিলেন।সেই দাদুর নামটা আমি মনে রাখতে পারিনি
কিন্তু তার ছেলে শংকর মামার কথা আমার মনে আছে আজও......।সেই শংকর মামা আমাকে তার
গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল চৈত্রের চড়ক আর গাজন দেখাতে। ফেরার পথে আমি ক্লান্ত
হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শংকর মামা আমাকে সারা পথ কোলে চড়িয়ে এর বাড়ির উঠোন,ওর বাড়ির ছাঁচতলা
দিয়ে কুমোর পাড়ার সবার সংগে গপ্পো করতে করতে রাতের আধো অন্ধকারে বাড়ি ফিরেছিল।সব
বাড়িতে তখন কূপীর আলোয় কাঠ পাতা জ্বাল দিয়ে মাটির হাঁড়িতে ভাত ফুটছিল।বাড়ি ফিরে
আধো ঘুমের আমাকে শংকরমামা গরম মাটির হাঁড়ির ভাত আর হাঁসের ডিমের ঝোল নিজের হাতে
খাইয়ে দিয়েছিল।খুব ছোটোবেলা থেকেই আমি যে কেউ ডাকলেই তার সাথে চলে গেছি বাড়ির
জন্যে কোনও টান অনুভব করিনি।অনেক ছোটোবেলায় মাকে কলকাতায় কয়েকবার আনা হয়েছিল
অপারেশনের জন্যে।আমি কোনদিন মায়ের সংগে যাব বলে বায়না করিনি।আমি ছিলাম একান্নবর্তী
পরিবারের চিরকালের এলেবেলে,চিরকালের দুধুভাতি।তাই অবহেলায় বেড়ে ওঠাটাই ছিল
দস্তুর।আর তাই আমার নিজের একটা জগত ছিল যা কিছুটা বাস্তবের,অনেকটাই কল্পনার।
আমাদের দেশ আর বাড়ি নিয়ে
একটা অকারণ অহমিকা ছিল।দাদু সেটা জানতেন আর তাই আমার কাছে উজাড় করে তিনি তার
জগতটাকে দেখিয়েছিলেন ওই কয়েকদিনেই।সকালবেলায় নুন মরিচ মাখা গরম মুরগীর ডিম খেয়ে
দাদুর হাত ধরে গংগার পাড়ে এসে দাঁড়াতাম।মাঝিরা ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দাদুর কাছে মাছ
বেচত আগে তারপর বাজারে যেত।কতো রকমের নদির মাছ – ফ্যাসা,চ্যালা,চাপড়া চিংড়ি,
বেলে,ভেটকি,গুড় জাউলি আর তোপসে মাছ।মস্ত সাইজের বাগদা আর গলদা চিংড়িও পাওয়া
যেত।গংগার ইলিশও খেয়েছি দাদুর দেশে।আমাদের কোলাঘাটের ইলিশ আর গঙ্গার ইলিশের
স্বাদের বিস্তর ফারাক।
এক একদিন আমি একা একাই
স্টিমারের ভোঁ শুনে নদির পাড়ে গিয়ে দাড়িয়েছি।কতো রকমের পাল তোলা নৌকা দেখেছি।জাহাজ
আর স্টিমার দেখেছি।ফেরার পথে দাদুর চেনা দোকানে জিলিপি কিনে ফিরতে গিয়ে চিলে ছোঁ
মেরে আমার ঠোঙা তুলে নিয়েছে।ওখানে অনেক লাল কাঁকড়া দেখতাম যা পরে
মন্দারমনিতে,গোপালপুরে বকখালিতে দেখেছি।আর দেখতাম পাড় ভাঙা......।ঝুপ করে শব্দ
হোতো।দাদু বলতেন “দাদুভাই এই পাড় ভাঙতে ভাঙতে একদিন আমার বাড়িটাও নদি নিয়ে
নেবে”।দাদু মিথ্যে বলেননি ......।বহু পরে ছোটোমাসির শ্বশুরবাড়ি থেকে স্মৃতি
কাতরতায় দাদুর দেশে গিয়েছিলাম.........।দাদুর বাড়িটা সত্যি সত্যিই নদি নিয়ে
নিয়েছে।তারও বহু পরে একবার ‘মিলাদ’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে নদির এ পাড়ে এসেছিলাম
যেখান থেকে মায়ের হাত ধরে নৌকায় উঠেছিলাম।অনুষ্ঠানের পর এক বাড়িতে হাতে গড়া চালের
রুটি আর মুরগীর মাংস খেলাম।তখন বিকেল চলে গেছে।ও পাড়ে বিড়লা জুট মিলে আলো দেখা
যাচ্ছে।দাদুর বাড়িটা হারিয়ে গেছে কতকাল আগেই।
দাদুর বাড়ির পিছনেই ছিল
বিরাট আম বাগান।তার পরে ছিল দীঘি।আমরা ওখানেই নাইতে যেতাম।নদির পাড়েই ছিল
ইস্কুল।দাদু ছিলেন ওই স্কুলের প্রেসিডেন্ট।আমি যে কদিন ওখানে ছিলাম রিনির সংগে
ওখানেই পড়তে যেতাম।দেশের স্কুলে তখন আমার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের বই আর বিদ্যাসাগরের
প্রথম ভাগ,দ্বিতীয় ভাগ পড়া হয়ে গেছে।(সহজ পাঠ পড়েছি বাড়িতে)স্কুলের ব্ল্যাক বোর্ডে
‘ভ্রমর’ বানান ঠিকভাবে লিখে বেসিক ট্রেনিং টিচারের কাছে একটা আস্ত চকখড়ি প্রাইজও
পেয়েছি।এখন বুঝতে পারি দাদু এসব জানতেন তাই ওখানে পাঠিয়েছিলেন যাতে ওখানকার
ছেলেদের কিছু শেখা হয়।দাদুর দেশের স্কুলটা আমার ভালোই লেগেছিল।আমাদের স্কুলের পাশে
ছিল আমাদের বাড়ির গড়খাই আর দাদুর দেশের স্কুলের পাশে ছিল মস্ত নদি।সারক্ষণ পাল
তোলা নৌকা যাচ্ছে নয়ত স্টিমার।কখনো কখনো জাহাজ।রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যেত জাহজের
‘ভোঁ’ শুনে।ভয় করত হয়ত একটু।পাশে দাদুকে দেখে সব ভয় চলে যেত।
আমার ভয়টা হয়ত একটু কম
ছিল তা না হলে যে জটা পাগলকে সব্বাই ভয় পেত তাকে আমি ভয় পেতাম না কেন?ছোটোদের ভয়
দেখাতে জটাকেই সবাই ডাকত।তার মাথায় বিশাল জটা ছিল।হাতে থাকত লাঠি আর কপালে
সিঁদুর।একদিন বৃষ্টিতে জটা দাদুর চেম্বারের দাওয়ায় এসে দাঁড়াল রাত্রে।সবাই বলল
‘জটা ভেতরে আয়’ জটা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।সবাই বলত জটা শোকে পাগল হয়ে গেছে।শংকরমামা
শুধু বলেছিল জটা পাগল সেজে থাকে।ও আসলে পুলিশের চর।শংকরমামা কী বাম রাজনীতি করত?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন