বসুধৈবকুটুম্বকম্
ছোটোবেলায় জ্যাঠাবাবুর
কাছে শুনতাম-“ভূমায় সুখম্ নাল্পে সুখম্ নাস্তি”।বহুতেই সুখ, অল্পে সুখ নাই।তিনি
আরো বলতেন –এই পৃথিবীর সবাই আমার আত্মার আত্মীয়,সবাই আমার কুটুম্ব।একটুও অতিরঞ্জন
নয়,বাস্তবেও তাই ছিল।
আমাদের বাড়িটা যেহেতু ছিল
একান্নবর্তী পরিবার জ্যাঠা-বাবা-কাকা-দাদা-দিদি-ঠাকুমা-ঠাকুরদা-জেঠিমা-খুড়িমা আমরা
ভাই বোনেরা মিলে কম্-সে-কম্ তিরিশ পয়ত্রিশজন সদস্য।তা বাদে প্রায় প্রতিদিন কোনো না
কোনো আত্মীয় ও তার পরিবার আর নিয়মিত মাঠে খাঠা মুনীষ।সব মিলিয়ে রোজ দু-বেলা কজন
হয়?চার-পাঁচজন বটি নিয়ে বসে গেল আনাজ কুটতে,দু-জন বসল বাটনা
বাটতে......হলুদ,লংকা,জিরে, আদা,ধনে আর পোস্ত।আর একজন মস্ত উনুনে মস্ত হাঁড়িতে চার
পাঁচ সেরের চাল পুকুরে ধুচুনিতে ধুয়ে এনে বসিয়ে দিত।তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হোত
আলু,বেগুন,উচ্ছে কখনো পুঁটলি করে ডাল বাটা,দিদিমা খাবে।দিদিমা বিধবা হবার পর বাড়িতে
অনেক নিয়ম কানুন চালু হয়েছিল।আমাদের দিদিমা কিন্তু দিদিমা নয়,ঠাকুমা,বাবার কাকিমা।
আমরা দিদিমা বলতাম কেন না আমাদের যে পিসিরা বহুদিন সপরিবারে বাপের বাড়ি থাকত তাদের
ছেলেমেয়েরা পিসিমার মা বা কাকিমাকে তো দিদিমাই বলবে?আমরা তাদের ছোটো তাই তাদের
শুনে আমরাও দিদিমা বলতাম।কিন্তু আমাদের যারা সত্যিকারের দিদিমা তাদের কী বলা
হবে?চালু হোলো ঘরের দিদিমা,মামাবাড়ির দিদিমা,নাগেদের ঠাকুমা,ঘোষেদের
ঠাকুমা......।যাদের আমি ঠাকুমা বল্লাম তারা আবার দিদিমাও।কী করে?
কায়েতদের আত্মীয়টা ছিল
বড়ো বেশি লতায় পাতায়।আমার ঠাকুমার(বাবার কাকিমা)তিন বোন ওই গ্রামের তিন পরিবারের
বউ হয়েছিল।সরকার,ঘোষ,নাগ। নাগেদের ঠাকুমার মেয়ে আমার সেজকাকিমা হয়েছিলেন।আবার আমার
মায়ের দূর সম্পর্কের মামার সংগে আমার আপন ছোটোপিসির বিয়ে হয়েছিল কল্যাণপুরে।ছোট
পিসেমশায়ের ভাই থাকতেন লক্ষ্ণৌয়ে।তাকে আমরা বলতাম লক্ষ্ণৌয়ের দাদু।ওনার ছিল
ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা।উনি যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন সংগে আনতেন নানা রকমের মশলা।তাই
দিয়ে বিরিয়ানি,পাঁঠার মাংস,নানা রংয়ের পোলাও বানাতেন আর মায়ের হাতে তৈরি সমুদ্র কাঁকড়ার
কালিয়া খেতেন।তার কোনো দাঁত ছিল না।মাড়ি দিয়েই তিনি কড়মড়িয়ে কাঁকড়া চিবোতেন।তার
ছিল বিশাল ভুঁড়ি।আমরা ছোটোরা ওই ভুঁড়িতে চড়ে নাচতাম।আমি বড় হয়ে যখন লক্ষ্ণৌ গেছি
তখন উনি ছিলেন না কিন্তু ওনার প্রতিপত্তি তখনো বেঁচে ছিল।আমাদের বাড়ির বিয়ে বা
অন্য অনুষ্ঠানে উনি আসতেন কিন্তু রান্নার তদারকি করতেন না।সেটা করতেন ঘোষেদের
দাশুজেঠু। দাশুজেঠুর বাড়িতেই প্রথম হেডফোন কানে দিয়ে রেডিয়ো শুনেছি।তখনও
ট্র্যাঞ্জিস্টরের আবিষ্কার হয়নি।হলেও আমাদের গ্রামে আসেনি।তখনো কানে হেডফোন দিয়ে
একা একা রেডিয়ো শুনতে হোতো।আমাদের বাড়িতে কিন্তু ট্রাঞ্জিস্টর রেডিয়োই
এসেছিল।যেটায় সারা পাড়া শুনতে পেত।
দাশু জেঠুর বাড়িতে অনেক
পাখি ছিল।মস্ত কাকাতুয়া আর ময়না।আমরা ওই বাড়িতে গেলে কাকাতুয়া জেঠুর কন্ঠ নকল করে
জেঠিমাকে ডাকত।“কে এসেছে?””কে?” “কে?” আর ময়না সারাক্ষণ ডাকত –“শংকরী”
“শঙ্করী”......।শঙ্করী দাশু জ্যাঠার দত্তক ছেলের নাম।শংকরীদা তাম্রলিপ্ত
মহাবিদ্যালয়ে পড়ত।খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। দেখতেও ছিল সুপুরুষ।সেই শংকরীদা একদিন উন্মাদ হয়ে
গেল একটি অহিন্দু মেয়ের জন্যে।বাড়ির লোক সম্পর্কটা মেনে নিতে চায়নি।তারপর থেকে সেই
শংকরীদা হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠত।সারা ঘর পায়চারি করত।জেঠিমার কথা ছাড়া আর কারো
কথা শুনত না।জেঠিমা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী।অনেকটা অয়েল পেন্টিংয়ের মতো। সারাক্ষণ
গলায় মুক্তোর হার ঝুলত।কী আদর করে আমাদের খেতে দিতেন।গাছ,পাখি আর ছেলের যত্ন
করতেন।সেই জেঠিমা অনেক ক্লেশ আর কষ্ট চেপে রেখে পাগল ছেলে আর রাশভারী নিঃস্ব
দাশুজ্যাঠাকে রেখে মারা গিয়েছিলেন।একেও কি স্বাভাবিক প্রয়াণ বলে?
দাশু জ্যাঠা আমাদের কেউ
ছিলেন না।কালোকাকাও আমাদের কেউ ছিলেন কী?কিন্তু এরা বাবার বন্ধু ছিলেন।আমাদের
পরিবারের সুখে,দুঃখে এরা পাশে থাকতেন।দাশুজ্যাঠা কারো বাড়িতে খেতেন না।জেঠিমা
আসতেন।একটা দামি শাড়ী কি অলংকার উপহার নিয়ে।দাশুজ্যাঠার শখ ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরার।বিশাল
ডোরের হুইল ছিপ ছিল কয়েকটা।(আমার বাবারও ছিল)যে পুকুরে মাছ ধরতেন সেই বাড়ির মানুষ
জ্যাঠাকে সবচেয়ে বড়ো মাছটা দিয়ে দিত।ওটাই যে ছিল দস্তুর।আর সম্পর্কও ছিল আষ্ঠে
পৃষ্ঠে বাঁধা।না হলে আমার আপন পিসতুতো দাদার সংগে কখনো আমার আপন মাসতুতো দিদির
বিয়ে হয়?আমার দুই মাসির বিয়ে হয়েছিল সেনেদের বাড়ির দুই ছেলের সংগে। আমি আমার
পিসিদের বিয়ে দেখিনি কিন্তু আমার ছোটো কাকা,রাঙা কাকা আর ছোটো মাসির বিয়ে দেখেছি।
আমার এই দুই মেসোমশায়
চাকরির জন্যে থাকতেন পাইকপাড়ায়।দেশে সেনেদের বিশাল প্রাসাদ কিন্তু কলকাতায় থাকতেন
প্রায়ান্ধাকার বাসায়।পাইকপাড়া থেকে ডালহৌসি যেতেন ট্রামে,ফিরতেন গংগার পাড় ধরে
হেঁটে।অফিস থেকে ফেরার পথে এক ছেলেকে দেখলেন একা বসে আছে।সে আশ্রয় চায়।মেসোমশায়
তার নাম,ধাম,গোত্র কিছুই জানতে চাইলেন না।তাকে মাসিমার হাতে তুলে দিলেন।সেদিন থেকে
সেই দাদা মাসিমার ছেলে।তার খাওয়া থাকা পড়াশোনা সব করলেন তারাই।পরে জানা গেল সে
ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে।তার বিয়ে দেওয়া হোলো জাত মেনেই।এই মেসোমশায় খুব নিয়মনিষ্ঠ
ছিলেন।দুভাই খেতে বসে দু-সের আটার রুটি আর ডাল খেয়ে নিতেন।এই মেসোমশায় শেষ বেলায়
খুব আঘাত পেয়েছিলেন।খুব নির্মমভাবে আত্মহণন করেছিলেন।এ ঘটনার কিছু মাস আগে উনি
নিজের বাসা ছেড়ে,নিজের দেশ ছেড়ে আমাদের দেশের বাড়িতে বাবা মায়ের অনুরোধে
এসেছিলেন।পরম তৃপ্তিতে গ্রামে কাটিয়েছিলেন।কোনদিন কারো সেবা তিনি গ্রহণ
করেননি।কিন্তু এখানে এসে আমার মা আর আমার সেবা যত্ন তিনি নিয়েছিলেন।তিনি ফিরে যেতে
চাননি যান্ত্রিক প্রাণহীণ শহর কলকাতায়।যেদিন ফিরে যেতে বাধ্য হলেন তার কয়েক দিন
পরেই তিনি মুক্তি নিলেন।যে চলে যেতে চায় তাকে কেউ আটকে রাখতে পারে?
ডাক্তার জ্যাঠামশায়কে
কিন্তু আমার বাবা কাকারা আটকে রাখতে পেরেছিলেন।ডাক্তার জ্যাঠামশায়ের নাম ছিল
কালীপদ বাগচি আর আমরা ছিলাম সরকার।ডাক্তার জ্যাঠামশায় আমাদের গ্রামের হাসপাতালের
ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন।ওখানেই যেদিন তার সরকারি ভাবে অবসর হোলো তার পরেই তার দেশের
বাড়ি নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় চলে যাওয়ার কথা কিন্তু আমার কাকারা বললেন আপনার এখান
ছেড়ে যাওয়া চলবে না।জ্যাঠামশায় এখানে একা থাকতেন হাসপাতালের কোয়ার্টারে,ফলে থাকার
মধ্যে ছিল কয়েকটা টিনের প্যাঁটরা আর একটা কাঠের টেবিল,কাঠের চেয়ার। আমার এক কাকা
ওই চেয়ারটা হাতে তুলে নিল,আর এক কাকা টেবিলটা।বাড়ির জন মজুর খাটা ঝড়ুদা কি চণ্ডীদা নিল বাক্স
প্যাঁটরা।সোজা আমাদের দাওয়ায়।জ্যাঠামশায় পিছু পিছু এসে আমাদের বাড়ির বাহির ঘরে
থেকে গেলেন।এসব আমার জন্মের অনেক আগেই।আমি জন্মেছি ডাক্তার জ্যাঠামশায়ের হাতেই
মামাবাড়িতে।আমার মতো অনেকেই।আমরা জ্ঞান হওয়া থেকেই ওনাকে আমাদের নিজেদের
জ্যাঠামশায় বলেই জানতাম।আমাদের বাড়ির ঠিকানায় জ্যাঠামশায়ের নামে অনেক বিদেশি
মেডিক্যাল জার্নাল আসত।অন্য ইংরাজি ম্যাগাজিনও আসত।একবার এলো রুমানিয়ার
ম্যাগাজিন।এ বাদে সোভিয়েত রাশিয়ার ম্যাগজিন আসত।ডাক্তার জ্যাঠামশায় আমাদের সংগে
চিকিৎসা থেকে বাড়ির কথা,ছেলেমেয়ের কথা তাও আলোচনা করতেন।ওনার সব ছেলেমেয়ে আমাদের
বাড়িকেই নিজের বাড়ি জানত।আমি কিন্তু কোনদিন জেঠিমাকে আমাদের বাড়িতে দেখিনি যদিও
তার ছেলে-মেয়ে,জামাই,নাতি, নাতনি সব্বাই বিয়ের আগে পরে আমাদের বাড়িতে এসেছে
থেকেছে।জ্যাঠামশায়ের দুই ছেলে।বড়ো স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চিকিৎ্সক,ছোটো মেডিক্যাল
রিপ্রেজেন্টেটিভ।জেঠিমা মারা যাবার পর বাবা,জ্যাঠাবাবুর পরামর্শে জ্যাঠামশায় ছোটো
ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে নিয়ে এলেন ঠিক সেইদিন যেদিন তার একটু আগে
আমাদের বাড়ির বাগানে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বিষ্টুদা বউয়ের সংগে ঝগড়া করে গায়ে আগুন
লাগিয়ে ঝলসে মারা গেল।
বিষ্টুদার মতো প্রাণবন্ত
মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।আমরা সবাই তখন ওই পোড়া মানুষটাকে হাসপাতালে শোওয়া দেখে
ফিরছি আর দেখলাম এক ছটফটে দুরন্ত কিশোর আমাদের উঠোনে জড়ো করা ধানের গাদায় লাফ
দিচ্ছে।এই সুনন্দদা আমাদের স্কুলেই পড়াশোনা শুরু করল।বাষট্টির ভারত-চীন সীমান্ত
সংঘর্ষের সময় এই সুনন্দদাই ভূগোলের ক্লাসে স্যারকে বলেছিল-‘স্যার ম্যাপ থেকে চীন
কেটে বাদ দিয়ে দিন’।তার পর পার্টি ভাগ হোলো।যারা ছিল এক ঠাঁই তারা দুই দুই হয়ে
গেল।যারা এতদিন কংগ্রেসের সংগে আদর্শের সংগ্রাম করেছে আজ তারাই দুই ভাই হয়ে এক
আদর্শের দু পিঠ নিয়ে লড়ছে।
আমরা একদিন এক হাঁড়ির ভাত
খেয়ে স্কুলে গেলাম।ফিরে এসে দেখলাম রান্নাঘরটা এক আছে কিন্তু বাসন-কোসন আলাদা হয়ে
গেছে।রাত নামল।আলাদা আলাদা হাঁড়িতে আলাদা রান্না হোলো।ডাক্তার জ্যাঠামশায় কিন্তু জানতেও পারলেন
না।কেউ না কেউ তাদের খাইয়ে আসছে।জ্যাঠামশায় জেনেছিলেন অনেক পরে।তখন থেকে মায়ের
কাছেই খেতেন। তারও পরে সেজকাকিমার কাছে।একদিন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সল্ট লেকে
বড়ো ছেলের কাছে চলে এলেন।তার পরেও সল্ট লেকে আমাদের বাসায় চলে আসতেন।আমরাও
যেতাম।জ্যাঠামশায় এ শহরে নিজেকে পরবাসী ভাবতেন।তার মন পড়ে থাকত ওই ভিখিরিপতি
গ্রামের সরকার বাড়ির উঠোনে।তার টেবিল-চেয়ার,কাঠের আলমারি আর ওষুধ মাপার
নিক্তিতে।আমরা তার ঘরের সামনের খোলা দাওয়ায় যেসব অপারেশন দেখেছি বিনা রক্ত,বিনা
অক্সিজেনে শুধুমাত্র স্যালাইন দিয়ে আর যেসব দুরারোগ্য ব্যধির তিনি চিকিৎসা করেছেন
আজকের মতো হাজার একটা টেস্ট না করেই তা এখন ভাবতেও কেমন লাগে।উনি এম্নিতে ছিলেন
ভোলাভালা হাসিখুশি মানুষ কিন্তু ট্রিটমেন্টের সময় অন্য মানুষ।আবার অন্য সময়ে সেই
তিনিই সেক্স থেকে শাক সব্জি সব বিষয়ে খোলা মনে আলোচনা করতেন।আমাদের পৃথক অন্ন তিনি
খোলা মনে মেনে নিতে পারেননি।ঠিক যেমন আমরা ছোটোরাও মানতে পারিনি।
আর তাই আমরা ভাই-বোনেরা
যার যার খাওয়ারটা নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে এক সংগে খেলতে দৌড় দিতাম।এক সংগে এক বিছানায়
শুতাম।বই ভাগাভাগি করে পড়তাম।এ ঘরের রান্না ও ঘরেও যেত।এ বাড়ির ছেলে মেয়ে ও
বাড়িতেও খেত।তার পরেও ভাগটা গলায় লাগা মাছের কাঁটার মতো সারাক্ষণ খচখচ করত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
‘একান্নবর্তী’ গল্পে যৌথ খামারের কথা লিখেছিলেন আর আমরা সেই থেকে শুধু ভাগ-ভাঙা-টুকরো
হওয়া দেখে চলেছি।কোনো ফেভিকুইকের সাধ্য কী?এ খণ্ডিত মলিকিউল জীবন আমাদের এ
শতাব্দের শহুরে সিনড্রোম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন