আমার জন্মের কোনও শেষ
নেই......।
আমার শৈশব ভিখিরিপতির যে
বাড়িতে কেটেছে সেখানে বারো মাসে তেরো পাব্বন যেমন লেগেই থাকত তার অনুষঙ্গে তেত্রিশ
কোটি না হলেও তেত্রিশের বেশিই দেব-দেবীর পুজো আচ্চা হতো সম্বচ্ছর।কবুল করতে দ্বিধা
নেই আমি সে সময় সেই সব দেব ও বিশেষ করে দেবীদের স্মরণ না করে জলস্পর্শ করতাম
না।উপবাস করার আমার অভ্যাস ছিল।পরে অভাবের কারণে উপবাস করেছি।তারও পরে স্বভাব
কৌতুহলে বাংলাদেশে থাকাকালীন রোজাও রেখেছি।আমার উপবাস আজও ঘোচেনি যদিও তার ভিন্ন
রূপ।নাস্তিক তকমা পাবার পরে বুঝেছি উপবাসের একটা নেশাও থাকে।আমার এক ভ্রাতৃপ্রতিম
চলচ্চিত্র পরিচালক একবার আমাকে বলেছিল “সলিলদা আপনি তো প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্ট
আর আমি কয়েক প্রজন্মের” সত্যি বলতে কি কমিউনিস্টদেরও যে বংশগরিমা থাকতে হয় ও আছে
সেটা বাংলায় না জন্মালে বুঝতেই পারতাম না।কায়েত-বদ্যি-বাউন(বামুন)রাই যে জাত
কমিউনিস্ট,বাকি সব এলেবেলে সে ধারা আজও বহমান।আবার এইসব ব্র্যান্ডেড কমিউনিস্টরা
যে মা বউয়ের দোহাই দিয়ে পুজোর পরের স্নান জল পান আর প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকাতে
দ্বিধা করেন না তাও কম দেখলাম কোথায়?এমনকি অতি বামপন্থীদের শক্তির প্রতি
ভক্তি(কালী মা থেকে কালীমাতা ধেনো)সেকাল থেকে একালেও বিরাজমান।আমার আবার নাস্তিক
হবার পরে দেব-দ্বিজে ভক্তি উধাও হলেও এক ঠাকুর গুরুদেবের প্রতি ভক্তি ও নিষ্ঠা
কিছুতেই কাটল না।
কবি বিষ্ণু দের ‘তুমি
শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?’ পড়ার পরেও শৈশবের ওই দিনটা আমার কাছে বিশেষ
অর্থবহ ছিল।আগেই লিখেছি জ্যাঠাবাবুর দৌলতে সারা বছর আমরা রবি ঠাকুরের সাধনায় মগ্ন
থাকতাম।যে কোনও কথায় তার কবিতা আর গান চলে আসত আমাদের আলোচনায়।তাই সেদিন ভোরে
বৈঠকখানায় টাঙানো তার ছবিটা নামিয়ে ভালো করে ধুয়ে মুছে চন্দন পরিয়ে একটা জলচৌকির
উপর সাদা চাদর পেতে তাতে রাখা হতো তাঁকে।বৈশাখের ভোরে ফোটা জুঁই-বেলি-টগর
-রজনীগন্ধা দিয়ে দিদিরা মস্ত বড়ো গোড়ের মালা গেঁথে পরিয়ে দিত তাঁর গলায়। আমরা গোল
করে ছবি ঘিরে বসতাম।কবিতা আবৃত্তি করতাম,গান গাইতাম এমনকি প্রবন্ধও পাঠ করা
হোতো।জোড়াসাঁকো নয় যেন এই ভিখিরিপতি গ্রামটাই ছিল তাঁর জন্মভূমি।একবার আমরা সকালে
নয় সন্ধ্যেবেলায় অনুষ্ঠান করব ঠিক করলাম। আমাদের সেদিনের বিশেষ গায়ক অতিথি এলেন
খেজুরি থেকে।তিনি ছিলেন সাগর সেনের ছাত্র।আর তবলা সংগত করার জন্যে এলেন উস্তাদ
কেরামত্তুল্লা খাঁ সাহেবের শিষ্য ত্রম্ব্যক কর।ত্র্যম্বকদা ছিলেন আবার অনুকুল
ঠাকুরের শিষ্য।আমিষ খেতেন না কিন্তু বিস্তর দুধ-ঘি খেতেন।আর খেতেন পান।বাজানোর
হাতটি ছিল ভারি সুন্দর। সেদিনের সন্ধ্যা আমার কাছে আর এক পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যার
মতোই স্মরণীয়। যেবার জোড়াসাঁকোয় রাতের ঘরোয়া আসরে শুনেছিলাম অমিয়া ঠাকুর,মেনকা
ঠাকুর শুভো ঠাকুর আর শৈলেন দাসের গান।তার কিছু পরে শৈলেনদার সংগে আড্ডা দিয়েছি
গণনাট্য আর গ্রুপ থিয়েটার দপ্তরে।মুখোমুখি বসে গান শুনেছি কতো।দমদমের
মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান হবার পরেও।বলেছিলেন ঘুঘুর বাসা ভাঙবেন।একদিন ঘুঘুর
ডিমের সাইজের গুলির দানাগুলো তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে আমাদের বুক ভেঙে দিয়ে চলে
গেল।আমার পঁচিশে বৈশাখ সেই থেকে পঁচিশে ডিসেম্বর হয়ে গেল।পরে উপাসনা মন্দিরে যখন
খৃস্টোৎসবে শুনেছি “একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে/এযুগে তারাই
জন্ম নিয়েছে আজি,মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি/ঘাতক সৈন্যে ডাকি ‘মারো’ ‘মারো’ ওঠে
হাঁকি/গর্জনে মেশে পূজা মন্ত্রের স্বর/মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন ‘হে
ঈশ্বর....”(না না শৈলেন দা নাস্তিক ছিলেন।তিনি একাধারে মার্ক্সসিস্ট আর রবীন্দ্র
ভক্ত ছিলেন)আমার বার বার মনে হয়েছে আমাদের ছাত্ররা নয় শৈলেন দা গাইছেন।শৈলেন দা
ভীষণ আশাবাদী ছিলেন।“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” এটা মনে প্রাণে
মান্তেন।কিন্তু শৈলেনদা কারা মানুষ?সেদিন যারা আপনাকে মেরেছিল তারা?আজ যারা
শান্তিনিকেতনকে আশ্রমকে গোচারণভূমি করে তুলে গুরুদেবকে নিত্য ঘাষের মতো মুড়িয়ে
মেরে চলেছে তারাও মানুষ?এ শহর কলকাতায় ‘রবি ঠাকুর মূর্তি গড়া’ হয়ে রইলেন আর আমার
জন্মের গ্রামে রবি ঠাকুর নিত্যসেবার বিগ্রহ ছিলেন না।ছিলেন প্রাণের মানুষ।
বিষ্ণু দে লিখেছিলেন
“বড়োতেই দাও যদি ছোটো উপমা......”আমিও এই সুযোগে রবি ঠাকুরের জন্মের কথা বলার
অবসরে আমার জন্মের খুড়সিনামা(কুর্সিনামা)টা খুলে বসি।চার অধ্যায় উপন্যাসে অন্তু
এলাকে বলছে মানুষের জন্ম হয় জন্মদিনে না জন্মতিথিতে?আমারও সেই দশা।আমার জন্ম ২৯
জ্যৈষ্ঠ সোমবার কিন্তু আমার কখনো জন্মদিন পালন হয়নি।আমাদের পালিত হোতো
জন্মতিথি।আমাদের বললাম এই কারণে আমার জন্মের ঠিক সাতদিন আগে জন্মেছিল আমার খুড়তুতো
ভাই ছোট্টু।যেহেতু একান্নবর্তী পরিবার তাই পালনটা এক সাথেই হোতো।
সময়টা গরম কাল হলেও
আমাদের সামার ভ্যাকেশন হোতো জুন-জুলাই মিলিয়ে।বেশির ভাগ ছেলে চাষির বাড়ি থেকেই আসত
তাই ধান চাষের সময়টাকেই গুরুত্ব দেওয়া হোতো।আমাদের জন্মতিথিটা তাই স্কুল খোলা
থাকতেই হোতো।স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম সদর পুকুর আর খিড়কি পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা
হচ্ছে।সদর পুকুর থেকে বাটা মাছ,রুই মাছ আর চিংড়া(গলদা চিংড়ি)খিড়কি পুকুর থেকে
কাতলা মাছ সবার খাবার জন্যে।শুধু বাড়ির লোকই চল্লিশ পঞ্চাশজন এতো মাছ তো লাগবেই।আর
দুই সন্তানের পাতে দিতে হবে একটি করে রুই মাছের মাথা।কাতলা মাছের মাথা আর তেল দিয়ে
ছ্যাঁছড়া হবে।বাটা মাছ ভাজা সবার পাতে পড়বে।গলদা চিংড়ির মালাইকারিও সবাই পাবে।কী
কী থাকত ব্যঞ্জন?
কাঁসার থালা আর গ্লাস
বাটিতে ছিলেট(সিলেট)ধানের ভাত,ঘি,শাক ভাজা,আলু ভাজা,পটল ভাজা,বাটা মাছ
ভাজা,শুক্তো,ছ্যাঁছড়া,চিঙড়ির মালাইকারি,পোনা মাছের কালিয়া,আলুবক্রার চাটনি,পায়েস
আর আম-মাখা সন্দেশ।দুপুরবেলা নেওয়াপাতি ডাবের জল।রাত্রেবেলা লুচি আলুর দম।মুরগির
মাংস তো দূরের কথা খাসি বা পাঁঠার মাংস নিষিদ্ধ ছিল শুভকাজে।শেষ কবে এভাবে আমার
জন্মতিথি পালিত হয়েছে মনে করতে পারি না।কলকাতায় চলে আসার পর বাবা-মা বেঁচে থাকতেও
হয়নি।তখন যে সব টুকরো টুকরো......।ইংরাজি তারিখটা খুঁজে বের করেছিলাম বংগীয়
সাহিত্য পরিষদে পঞ্জিকার পাতা ঘেঁটে......১৩ জুন ১৯৫৫।
এখন মন খেরোর
খাতায়(ফেসবুক)বহু মানুষ শুভেচ্ছা জানান।কেক-মোম বাতিও পাঠান তারা।আমার দিন কাটে সে
সব শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দিয়ে আর নাটক চলচ্চিত্রের কাজে।মেয়ে বউয়ের কাছেও কিছু না কিছু উপহার
প্রাপ্তি হয়।পঞ্চ ব্যঞ্জন না হলেও কিছু পদ অপর্ণা নিজের হাতে করে।
শুধু রাত্রিবেলা যখন আমি
এসেছিলাম বাইরে মায়ের গর্ভ থেকে ঠিক সেই রাত সাড়ে দশটায় নিজের মধ্যে চিৎকার করে
বলি.........আমি এসেছিলাম তোমাদের চাওয়া থেকে কিন্তু আমার যাওয়াটা যেন ইচ্ছামৃত্যু
হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন