কেবলই স্বপন করেছি বপন......
“বহুদিনের সাধ ছিল, তাই কইতে কথা বাধছিল/দুয়ার খুলে দেখিনি
ওই একটি পরমাদ ছিল” শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পংক্তিগুলো বড়ো বেশি মিশে ছিল ধুলো খেলার
ছত্রে ছত্রে।স্কুলে পড়ার সময় যারা বাসে কি সাইকেলে চড়ে
তমলুকের কলেজে পড়তে যেত তাদের দেখে আমার কী যে উদাস হতো মন।পরে নিজে যখন পড়তে
গেলাম আর এক উদাসপনা খেলে বেড়াতে থাকল।বাড়ির থেকে বাসে চড়ে শিরীষতলায়(কোর্ট
চত্বর)নামতাম।হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যেতে গিয়ে ‘বার লাইব্রেরি’ পেরিয়ে, শহীদ
মাতঙ্গিনীর রক্তাত শরীরটা(যেখানে উনি লুটিয়ে পড়েছিলেন)সম্ভ্রমে পাশে রেখে ক্লান্ত
মনে যখন ক্লাস রুমে ঢুকতাম ফ্যানের তোবড়ানো ব্লেডগুলো আমার হয়ে ঘ্যাসঘ্যাস শব্দ
করে চলেছে এক টানা।এক স্কেলে এক টানা মাত্র কয়েকটি স্বরের ওঠানামায়
স্ট্যাটিস্টিক্সের লেকচার আমার কাছে তখন গ্রীক কিম্বা হিব্রু।চাহিদা ও জোগানের
অর্থনীতির অর্থহীন পাঠক্রম আমার কাছ থেকে চাইছে ছুটি।
আমি এক ছুটে পালিয়ে যেতাম পিছনের রূপনারায়ণ নদের
কাছে।সেখানে কেউ নেই শুধু জলের জোয়ার ভাটা,গাংশালিখ আর কাদাখোঁচাদের মাছ খুঁজে
বেড়ানো।আবার ফিরে আসা ক্লাস রুমে।আবার জোর করে মন বসানো রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে
নিম্নমানের নাটক ‘রাজা ও রানি’তে......।সেখান থেকে
ছুটকারা মিললেই একছুটে দল বেধে ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনির ‘রাজাজানি’ কি ডিম্পল
কাপাডিয়ার ‘ববি’।এগুলো হিন্দি সিনেমা তাই দেখতে হোলে ছুটতে হতো ‘চলন্তিকা’য় আর
বাংলা ছবির জন্যে ‘রূপশ্রী’।‘ববি’ দেখেছি কতবার গুনে রাখিনি।বন্ধুদের অনুরোধ রাখতে
বাংলা ‘বই’ দেখেছি কয়েক’শ তাও মনে রাখার প্রয়োজন আছে কী?
আমাদের সিনেমা দেখা শুরু হয়েছিল স্কুলের মাঠে কি পাড়ার
ক্লাবে ফিল্ম ডিভিসন-এর সৌজন্যে।“পথের পাঁচালি” প্রথম দেখেছি ওইখানে।একটা করে রীল
শেষ হয় আর ফিলামেন্ট বাল্ব জ্বলে উঠে সব মায়া কাটিয়ে রীল গোটানো শেষ করে আবার একটা
রীল......।যত বিখ্যাত খেলার তথ্যচিত্র......
পেলে,ইউসোবিও,পতৌদি,ব্র্যাডম্যান...... নাদিয়া কিমোনোভিচ-এর প্রথম জিমন্যাস্টিকে
দশে দশ, সের্গেই বুবকার পোল ভল্টে আকাশ ছোঁয়া আরো কত। ইউরি গ্যাগারিন আর লাকিকে
দেখেছি।আফ্রিকার অরণ্যে ব্যাং কে দেখেছি মস্ত সাপ খেতে। অ্যানাকোন্ডা দেখেছি ঘাষের
মাঠে বসেই। ওলিম্পিকের খেলা দেখেছি চটের উপর পা ছড়িয়ে আধভাজা বাদামের আধকাঁচা দানা
চিবোতে চিবোতে।
এসব আমার শৈশবের দিনযাপন।তখন তো এমন বড় হইনি যে সিনেমা হলে
গিয়ে সিনেমা দেখব!ইচ্ছে খুশি সিনেমা দেখা শুরু হলো কলেজে ওঠার পরে।ইন্টারভ্যালে
বেরিয়ে রঙিন শরবত কি লস্যি আর সিনেমা শেষ-এ মিষ্টিপাতা পান যাবতীয় মশলা সহযোগে
খাওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক।ওটাই যে ছিল প্রাপ্তবয়স্ক হবার প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু
ভালো সিনেমা কটাই বা আসত?আর এলেও থাকতই বা কদিন?তাই তপন সিংহ,মৃণাল সেন আর সত্যজিৎ
রায়ের সিনেমা এলেই প্রথম দিনেই ছুটতাম।তরুণ মজুমদারের ছবি দেখেছি ভুরি ভুরি।দীনেন
গুপ্তের ছবিও দেখেছি অনেক।পরে যখন এদের সংগে কাজ করেছি কি ইন্টারভিউ নিয়েছি
শুরুতেই একটু স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়তাম।
একবার দীনেনদার সংগে কাজ করার সুযোগ এলো।আমার বন্ধু রাজা
সেন(তখন নিয়মিত রাজার সব কাজের চিত্রনাট্য সংলাপ লিখছি)আমাকে ফোন নাম্বারটা দিয়ে
বলল ফোন করতে।এই কথার আগে একটা কথা বলা ভালো কাহিনি আছে।যখন টেলিভিশন বলতে কেবল
দূরদরশন সেই সময় বাংলায় একটি প্রাইভেট চ্যানেল এলো। তারা বাংলার ক্লাসিক নিয়ে
কাজের জন্যে রাজাকে আমন্ত্রণ জানালো।স্থির হলো শংকরের কালজয়ী উপন্যাস ‘চৌরংগী’
নিয়ে কাজ হবে।আমি আর রাজা ছুটলাম এস্প্ল্যানেডের ভিক্টোরিয়া হাউসে লেখকের সংগে
দেখা করতে।উনি তখন ওখানকার পাব্লিক রিলেশন অফিসার।এক বিশাল ঘরের এক প্রান্তে বিশাল
টেবিলের মাঝখানে রাখা এক রিভলবিং চেয়ারে বসে আছেন ‘কত অজানারে’, ‘ঘরের মধ্যে ঘর’,
‘এক ব্যাগ শংকর’ সবচেয়ে বড় কথা আমাদের প্রয়োজনের চৌরংগীর লেখক তখন আমাদের জন্যে
অপেক্ষা করছেন।বসতে না বসতেই সুদৃশ্য পিরিচ পেয়ালায় সুগন্ধী চা এলো।উনি সম্মতি
দিতে রাজি এক বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে।টেলিভিশন নিয়ে অনেক কথা হোলো।আমরা টাকার
অংক মাথায় নিয়ে উঠে এলাম।কাজটা হোলো না। টাকার অংকে চৌরংগী কেনা গেল না।আমার
চিত্রনাট্য হয়ে গেছে অনেকটাই।তাতে কি?আমার সারাজীবনে এমন অনেক সন্তানের জন্ম
দিয়েছি যারা আজও আতুড় ঘরে গোঙাচ্ছে।কিম্বা ইনকিউবেটরে তা নিচ্ছে।‘সিরাজ-উদ-দৌল্লা’
তেমনি এক তথ্যনাটক চৌরংগী তেমনি এক চিত্রনাট্য।
তখন আমার আর রাজার প্রতিদিন সকালে চায়ের মগ হাতে
ল্যান্ডফোনে কথা হোতো। একদিন রাজা বললে চ্যানেল দীনেন গুপ্তকে কাজটা
দিয়েছে।দীনেনদা তাই রাজাকে ফোন করেন।রাজা আমার কথা বলেছেন দীনেনদাকে।আমি ফোন করে
একদিন ওনার কথা মত নারকেল ডাঙায় অরোরা স্টুডিয়োয় হাজির হলাম।সেখানে তিরিশ পয়ত্রিশ
কিলোগ্রামের ভারী ক্যামেরা চালাচ্ছেন নিজেই।শটের মাঝে এক পলক আমার দিকে
তাকালেন।প্রোডাক্সনকে একটা চেয়ার দিতে বল্লেন।কাজের মাঝে মাঝে কথা হোলো।কী জানি
আমার সংগে কথা বলে ওনার কী মনে হোলো উনি আমাকে গলফ গ্রীনের বাড়িতে ডাকলেন।চিত্রনাট্য
পড়লেন।খুশি হলেন।চোখ তুলে বল্লেন-“এতোদিন কোথায় ছিলে?তোমরা ইন্ডাস্ট্রিতে আসোনা
কেন?”নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে নিয়ে ছুটলেন স্ক্রিপ্ট ফটো কপি করতে।আমি সত্যি
বলতে এমন ভদ্রলোক পরিচালক ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেছি তবে খুব সামান্য।এ কাজটাও হোলো
না।টাকায় পোষালো না। একদিন আক্ষেপ করে বললেন-“সলিল আর কাজের পরিস্থিতি নেই” তারপরে
যে কথাটা বল্লেন-“আমি আজো পরিচালনার থেকেও ক্যামেরা চালাতেই বেশি ভালোবাসি। তুমি
কোন দিন যদি কাজ করো আমি তোমার ক্যামেরার কাজ করব”।হতভাগা আমি।যখন পরিচালনার কাজ
শুরু করলাম দীনেনদা তার কয়েক মাস আগেই আচমকা ‘কাট’ বলে জীবনে ‘প্যাক আপ’ করে চলে
গেলেন।আমার কলেজ জীবনের ‘বসন্ত বিলাপে’র পরিচালক ‘অযান্ত্রিক’এর চিত্রগ্রাহক
অকারণে ফ্রেম হয়ে গেলেন।আমার প্রিয় মানুষদের আমি বহুবার এইভাবে হারিয়েছি যেমন আবার
আচম্বিতে ফিরেও পেয়েছি।তাদের কেউ কেউ আজও রয়েছেন।
আমার প্রিয় নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা সেন,সাবিত্রী
চট্টোপাধ্যায়,সন্ধ্যা রায়,মাধবী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন।দুই সেন ছাড়া
বাকি তিন জনের সংগেই পরে কাজ করেছি। যার মধ্যে সাবুদি(সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়)আমার
সবচেয়ে কাছের মানুষ।মঞ্চ,চলচ্চিত্র, টেলিভিশন তিন মাধ্যমেই আমি তাকে কাছে পাবার
মতো ভাগ্যবান।সাবুদির আতিথেয়তা যিনি না পেয়েছেন তিনি বা তারা অভাগা।আমার এই জীবনের
কথা আর এক সময় বলব যার মধ্যে সুখ-বেদনা-হতাশা-উত্তেজনা সব মিলে মিশে আছে।
আমার এ জীবনেও সুখ-বেদনা-হতাশা-উত্তেজনা ছিল তবে হতাশা মাঝে
মাঝেই আমার ঘরে বসত করত।সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরে মনে হোতো এ আমি কী করছি?এ জীবন
আমার নয়।আমি সিনেমা হাউসে যাবার পথে একদিন বই কেনার অছিলায় ‘রিডার্স কর্ণার’ এ
ঢুকে পড়লাম।এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে ঝুপ করে দুটো বই কিনে ফেললাম শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ আর ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি এক পোস্টম্যান’।কবিতার বই কিনছি
দেখে মালিক কি খুশি। আমি কে,কী করি,কেন বই ভালোবাসি জানতে চাইলেন।আমি তো এটাই
চাইছিলাম। আলাপ যখন উঠল জমে আমি সুড়ুৎ করে বলে বসলাম-আমার তো পয়সা নেই।আমি যদি
আপনার দোকানের এক কোণে বসে বই পড়ি কিছুক্ষণ আপনি অনুমতি দেবেন?কী আশ্চর্য উনি রাজি
হয়ে গেলেন আর আমারও হিল্লে হয়ে গেল।ক্বচিৎ কখনও দুটাকা চারটাকার বই কিনি আর ঘন্টার
পর ঘন্টা নিত্য নতুন সদ্য প্রকাশিত বই পড়ি।এক সময় আমার কলেজের ক্লাস রুম হয়ে গেল
‘রিডার্স কর্ণার’।
বাড়ির আলমারি লাইব্রেরি কবেই শেষ করেছি।এবার বইয়ের
দোকান।তমলুক টাউন লাইব্রেরি ছিল,সেখানেও যেতাম কিন্তু মন ভরত না।কুমোরগঞ্জ-এ
জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজে যা সংগ্রহ ছিল তাও শেষ করে ফেলেছিলাম।ওখানেই সন্ধান
পাই ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’-র।অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ওই বক্তৃতা
রবীন্দ্রনাথ শুনেছিলেন মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন শ্রোতার সংগে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির
সেনেট হলে। আর আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে চললাম লাইব্রেরিয়ান জন্মেজয় বাবুর একলা
পাঠাগারে। জন্মেজয়বাবু ছিলেন সংসারী মানুষ আবার পড়ার নেশা।আমাকে পেয়ে বি এ পাশ
করার ইচ্ছে জাগল।আমি তখন এক্সাম দেব আর ওনাকেও এক্সামের জন্যে প্রস্তুত করতে
থাকলাম।আজ বলতে দ্বিধা নেই অনেক বছর ধরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছি কিন্তু ওনার
মতো এমন সিনিয়র বাধ্য ছাত্র পাইনি।খুব ভালোভাবেই উনি পাশ করেছিলেন পার্ট ওয়ান ও
পার্ট টু।একটা কথা আজ বুঝতে পারি বাংলার গ্রাম-গঞ্জের নিভৃতে কত যে সিরিয়াস
পাঠিকা-পাঠক রয়েছে যারা কোনও দেখন্দারি না করেই জ্ঞান অর্জন করে চলে।এমন ঘটনা আমার
জীবনে ঘটেছে বহুবার।
বাগবাজারে গংগার ধারে একটা বাড়িতে শ্যুটিং ছিল।সৌমিত্রদা
করছেন গিরিশ ঘোষ। কাজের অবসরে কবিতার কথা উঠল।তারও একটা কারণ ছিল।সৌমিত্রদাকে
চরিত্রের কারণেই গৈরিশ ছন্দের কবিতা মুখস্থ করতে হচ্ছিল।সৌমিত্রদা কি অসম্ভব
মনযোগী হয়ে মুহুর্তে আয়ত্ত করে ফেলে স্ক্রিপ্টের পাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে বলে
যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় আমি বললাম –‘দাদা আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জলপ্রপাতের ধারে
দাঁড়াব বলে” বেরোতেই কিনে পড়েছি’।উনি স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ না তুলেই বল্লেন-‘ও’।আমি
বললাম –প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়।লাল রংয়ের উপর কালো কালিতে
ক্যালিগ্রাফি।এবার উনি চমকে স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ তুলে-“সে তো কবেকার কথা!আপনার মনে
আছে?” উনি সবাইকেই আপনি সম্বোধন করেন।–“কোথায় কিনেছিলেন?” বললাম-‘তমলুকে।চার টাকা
দিয়ে রীডার্স কর্ণারে।’আরো বললাম আপনার ও নির্মাল্যবাবুর সম্পাদনায় “এক্ষণ” নিয়মিত
পড়েছি।বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ আপনাদের পত্রিকায় প্রথম পড়া......।আমি বলে চলেছি......।উনি
উদাস হয়ে ঘরের দেওয়াল জানালা ছাড়িয়ে নদির দিকে তাকিয়ে তখন।নাকি উনি তখন এ শহর,এ
কোলাহল থেকে অনেক দূরের কবিতার জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?
Dilip Majhi Sundar chitro
উত্তরমুছুনLike · Reply · 28 May at 18:54
Samir Mitra
Samir Mitra Onake pronam janai. Parichyo aache..
Like · Reply · 28 May at 20:15
গৌতম চৌধুরী
গৌতম চৌধুরী এটা কি ধারাবাহিক?
Like · Reply · 1 · 28 May at 22:48
Salil Sarkar
Salil Sarkar Hope so......
Like · Reply · 1 · 29 May at 00:27
Salil Sarkar
Salil Sarkar গৌতম তুমি কি লেখাগুলো নিয়মিত পড়ছ?সাহস দিলে তোমাদের সবায়ের কথায় আসতে ইচ্ছে হয়।
Like · Reply · 31 May at 20:02
গৌতম চৌধুরী
গৌতম চৌধুরী Salil Sarkar এর পর আরও লিখেছ ? পেলেই দেখছি। লিখতে থাকো...
Like · Reply · 31 May at 20:18
Salil Sarkar
Write a reply...
Choose file
Sutapa Chakraborty
Sutapa Chakraborty অসাধারণ ও অনন্য.....
Like · Reply · 29 May at 00:00
Piyali Palit
Piyali Palit Can I share this one ?
Like · Reply · 29 May at 00:43
Salil Sarkar
Salil Sarkar Oh.... Sure.......
Like · Reply · 1 · 29 May at 08:50