ভোটোৎকোচ্
এখন এই গরমে ভোটের হাওয়ায়
সকালবেলার কাগজ আর সারাদিনের টেলিভিশন দেখলে মনে হবে ভোটোৎকোচ্(ভোট+উৎকোচ্)বিষয়টা
এখনকার কালের।তা কিন্তু নয়।আমার ছোটোবেলায় ছিল।তবে এখনকার মতো নয়।আমার মনে পড়া
প্রথম ভোট উৎকোচের যতটা ছিল তার চেয়ে উৎসবের ছিল বেশি।
আমার জন্ম দেশ স্বাধীন
হবার সাত আট বছর পরে।তখনো আন্দোলনের রেশ কাটেনি।স্বাধীনতার মোহাবেশও ঘোচেনি।আমাদের
বাড়ির বড়রা খুব সঙ্গত কারণেই কংগ্রেস রাজনীতির সমর্থক ছিল।আমাদের বাড়ির কেউই
কোনদিনই আন্দোলনে যোগ দেয়নি আবার ব্রিটিশদের গুপ্তচরও ছিল না।আমার জ্যাঠাবাবু
কোলকাতার জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়ির পাশের বাড়িতে থাকার সুবাদে রবীন্দ্রনাথকে ছাদে
পায়চারি করতে দেখতেন আর নিজের তাগিদেই টাউন হলে তার ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন।সি আর
দাশ(চিত্তরঞ্জন দাশ) আর সুভাষ চন্দ্র বোসের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।জ্যাঠাবাবু
সর্বপ্ললী রাধাকৃষ্ণনের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন পরে।
আমাদের দেশের বাড়িতে নানা
কারণে তখনকার রাজনৈতিক নেতারা আসতেন।আমি আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির দাওয়ায় অজয়
মুখার্জি,বিশ্বনাথ মুখার্জি,গীতা মুখার্জি এদের যেমন দেখেছি তেমনি আভা মাইতি,সুশীল
ধাড়া,অরুণা আসফ আলি তাদেরও দেখেছি।ভূদান আন্দোলনের হোতা বিনোবা ভাবেকে আমাদের
বাড়ির সামনের পাকা সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি।তার জন্যে দেবদারূ পাতার তোরণ করা
হয়েছিল।আমার ‘বাস্তুভিটে’ নাটকে এ প্রসঙ্গ এসেছে।আমার প্রথম দিকের অনেক নাটকেই
আমার দেশ-গাঁ এসেছে।
আমাদের বাড়ির সামনের পিচ
রাস্তা অনেক কিছুর সাক্ষী।কোলকাতা থেকে হলদিয়া কার র্যালি,ভিন্টেজ কার র্যালি,
হলদিয়া থেকে বারৌনি তেলের পাইপ লাইন বসানোর কাজে আসা বিদেশী গাড়ি আর বিদেশী থেকে
হলদিয়া বন্দরে জাহাজে তোলার জন্যে আকরিক লোহা।তবে সেই ছোটোবেলায় সবচেয়ে অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকতাম যখন রাখাল মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে সার্কাসের তাঁবু পড়বে বলে ক্যারাভ্যান
যেত আর তার পিছু পিছু বাঘ,সিংহ, জলহস্তী,পাখির খাঁচা।তারও পিছনে যেত মস্ত মস্ত
হাতি,উট, ঘোড়া,গাধা,ভালুক।ক্লাউন যেত সবার আগে।মনে হতে পারে সবকিছু আমি কেন একাকার
করে দিলাম।বলতে কি সেই বয়সে আমার কাছে সবই ছিল পরম বিস্ময়ের।আর সেই সময়ে আমাদের
জীবনে বিনোদন বলতে ওই হঠাৎ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু।
গোরু,ছাগল,ভেড়া,হাঁস,মুরগী
ঘরে ঘরেই ছিল।না না ভুল বললাম।আমরা মুরগী দেখতাম চাপবসানে কি হাকোল্লায় কি
চোন্সৎপুরে।মুরগীর মাংস দুরস্ত মুরগীর ডিম খেয়েছি খুব অসুস্থ হলে তাও বাইরের উঠোনে
তোলা উনুনে সেদ্ধ করে।বস্তুত আমার জীবনে নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ কমিউনিস্ট হবার প্রথম
ধাপ।যদিও আমাদের বাড়ির দাওয়ায় যে কমিউনিস্টদের আমি দেখেছি তারা ব্রাহ্মণ ছিলেন।
ভোটের সময় জোড়া বলদের খুব
কদর হোতো।পরে গাই বাছুরের।তার পরে লাঙলের,তারও পরে হাত।ওদিকে কাস্তে হাতুড়ি ধানের
শিষ।দুটি ছড়া এখনও ভুলিনি “ভোট দেবেন কীসে?কাস্তে ধানের শিষে”।তখনো কমিউনিস্ট
পার্টি ভাগ হয়নি।তখনো কাস্তে হাতুড়ি তারা আসেনি।দাদা কংগ্রেস ভাই কমিউনিস্ট তার
জন্যে লাশ পড়ত না।বুথের ভেতরে সব দলের পোলিং এজেন্ট বসতে পারত পাশাপাশি।বুথের
বাইরে সবাই একসাথে মাছ ভাত খেত।আদর্শের লড়াই হতো,দলের পতাকার আলাদা মান ছিল।নেতাদের
যথেষ্ট সম্মান ছিল।পরে ইন্দিরা গান্ধী এমারজেন্সি ঘোষণা করলে, সেই কালো দিনে সি পি
আই তাকে সমর্থন করলে মুখে মুখে ফিরল সেই ছড়া “দিল্লি থেকে এলো গাই,সংগে বাছুর
সিপিয়াই”।তখন দেওয়াল লিখন ছিল,খবরের কাগজে কার্টুন ছিল,ছড়ার ছড়াছড়ি ছিল,হাতে লেখা
পোস্টার তাও ছিল,বিজয় মিছিল ছিল কিন্তু তা শ্লীলতার সীমা ছাড়াত না।ছাপ্পা ভোট সেও
ছিল,ভোটারকে প্রভাবিত করা তাও ছিল কিন্তু সায়েন্টিফিক রিগিং ছিল না।এসব আমরা
দেখলাম সঞ্জয় গান্ধীর সময়ে তখন আমি শহর কোলকাতায় নিবিড় নাট্য আন্দোলনে ন্যস্ত।
বাড়িতে রেডিয়ো ছিল তাই
গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ আসত নির্বাচনের ফলাফল জানতে। ফল ঘোষণাটা কেমন ক্রিকেট খেলার
ধারা বিবরণীর মতো শোনাত।এই এ দুহাজার ভোটে এগিয়ে আছেন তো এই পিছিয়ে গেলেন ছ হাজার
ভোটে।অমুক জয়ী হলেন আর অমুকের ‘জামানত জব্দ’ হলো।সে সময় ‘জামানত জব্দ’ কথাটায় আমরা
খুব মজা পেতাম।
আমার শৈশব কৈশোর এও ১৫
আগস্ট এর একটা অন্যরকম উৎসাহ আর উদ্দীপনা ছিল।কিছু না হোক সকালবেলা প্রভাতফেরী আর
বেদীতে রঙিন কাগজ মোড়া বাঁশের মাথার উপর একটা রিংয়ে দড়ি দিয়ে তাতে জাতীয় পতাকা
ফুলের গুচ্ছে মোড়া। উপরে তুললেই সবার মাথার উপর ফুলগুলো ছড়িয়ে পড়ত।তখন নানান
স্বরের ‘জয় হিন্দ’......তার একটু পরেই যে কাগজের ঠোঙায় মুড়ির সংগে গরম সেদ্ধ ছোলা
আর ঠান্ডা বোঁদে হাতে হাতে ঘুরবে।এ এক অন্য সুখস্মৃতি।আমার ছোটোবেলার ১৫ আগস্টের
সুখস্মৃতি মামাবাড়িতে মান্তুদির সংগে।
আমার মামাবাড়ি ছিল
তমলুকের রূপনারায়ণ নদের কাছে রাধাবল্লভপুরে।আমার দাদু ডাক্তারি করতেন।ওখানে
নয়,দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় হুগলি নদির পাড়ে রায়পুরে। দুপাড়ে সারি সারি জুট
মিল।এখানকার কথা আরেক দিন বলব।সত্যি বলতে কি দাদু বেঁচে থাকতে নদির পাড়ের দাদুর
বাড়িটাই আমার স্ব্প্নের দেশ ছিল।মায়ের হাত ধরে নৌকায় করে দাদুর দেশে
যাওয়া.........।
সে বারেও মায়ের হাত ধরেই
রাধাবল্লভপুরে মামারবাড়ি গিয়েছিলাম।ওটা ছিল চন্দ পাড়া।পুকুর,বাঁশবন,তেঁতুল আর অশোক
গাছ।পুকুরের পাড় দিয়ে পথ।ওখানেই দেখেছি জলের কিনারে নিচু জবা(তখনো শঙ্খ ঘোষ কবিতায়
এই লাইনটি লেখেননি)।কী শান্ত আর নিরিবিলি।আমাদের দেশের বাড়ির মতো কোলাহল মুখর
নয়।ঠিক যেন সহজ পাঠের ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি’।ওখানকার ছেলেরা নিজের হাতে ঘুড়ি
বানিয়ে, সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে শীতকালে ওড়াত।আলপথ ধরে অনেকটা দৌড়ে গেলে ঘুড়ি উড়ত। ঘুড়ি
তৈরি হোত খাতার পাতা কেটে তাতে নারকেল পাতার কাঠি দিয়ে আর কেন্দু ফলের আঁঠা
মাখিয়ে।ঘুড়ির তলায় মস্ত ল্যাজ না লাগালে ঘুড়ি উড়তই না।ওরা এ শহরের মতো কাটাকাটি
করত না।অনেক দূরে ঘুড়ি উঠে গেলে আর নামতে চাইত না।তখন ওরা ধান কাটা শেষের ‘নাড়া’
জেগে থাকা মাঠে পাশাপাশি বসে গপ্পো করত।ওখানে গেলে আমাকেও ওরা খেলতে নিত।ঠিক সেই
ভাবেই ওরা আমাকে ১৫ আগস্টের উৎসবে সেবার সামিল করেছিল।
মান্তুদি ওদের লীডার
ছিল।মান্তুদি মামাবাড়ির আর এক শরিকের কলেজে পড়া মেয়ে। দুদিন আগেই মিটিং হোলো পুজোর
মন্ডপে।মান্তুদি ঠিক করে দিল স্কুলের মাঠে পতাকা তোলা হবে।এবার এক একজনকে এক একটা
দায়িত্ব দেওয়া হোলো...।কে ফুল আনবে, কে দড়ি,কে বাঁশ,কারা কারা কাগজ কেটে আঁঠা
মাখিয়ে শিকলি বানাবে,কে পতাকা কিনে আনবে।শিকঁলি বানানোর কাজে আমাকেও নেওয়া
হোলো।আমি কিন্তু তখন হাঁ করে মান্তুদির দিকে তাকিয়ে আছি।(আমি চিরকাল ক্যাবলা
ছিলাম,আছিও।তাছাড়া সেই প্রথম এমন সামনে থেকে কলেজে পড়া কোনও সুন্দরী যুবতীকে
দেখছি)মান্তুদি কিন্তু আমাকে চেয়েও দেখল না।দেখবে কেন?আমি যে তখন ইজের পরা হাফ
হাতা জামা গায়ে ক্যাবলা ছেলে।মিটিং শেষে সবাই যার যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে যখন আমিও
ঘরে ফিরতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম......মান্তুদিইইইইইইইইই”
অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে
পাচ্ছিনা।মান্তুদি বলে উঠল......”কে রে......?” আমি দৌড়ে ঘরে ঢুকছি।কে যেন
বলল......”ও তো পারুল পিসির ছোটো ছেলে”।পরের দিন রাতে স্কুলের মাঠে সব্বাই জড়ো
হলাম।মান্তুদি আমাকে কাছে ডাকল।আমি ভাবলাম এই বুঝি আমাকে বকবে!কিন্তু আমার সেদিনের
ডাকে নিশ্চয় কোনো আকুলতা ছিল যা মান্তুদিকেও নাড়া দিয়েছিল।সবাই যখন কাজ করছে
মান্তুদি আমাকে পাশে বসিয়ে আমি কোন ক্লাসে পড়ি,কবিতা বলতে পারি কি না,গান জানি কি
না সব সব জানতে চাইল।আমি সেই ক্লাস ওয়ান থেকে জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজের
প্রতিযোগিতায় অংশ নিই।কবিতা বলি, অভিনয় করি।আমি একের পর এক কবিতা বলে গান গেয়ে
মান্তুদিকে মুগ্ধ করে দিলাম।মান্তুদিও গাইল “পথে এবার নামো সাথি” (তার কতো পরে এই
গানের গীতিকার সুরকার সলিল চৌধুরির সঙ্গে কথা বলেছি।) সেই থেকে ১৫ নয় ১৪ আগস্ট
আমার সুখস্মৃতি.........।
তারপর কয়েকবার মামাবাড়ি
গেছি......।মান্তুদির সংগে দেখা হয়েছে কি হয়নি মনে রাখিনি।মান্তুদিও আমাকে ভুলে
গেছে হয়ত!কথা হয়েছে,গল্প হয়েছে কিন্তু সেই প্রাণ ছিল না।সেই আগের উচ্ছলতা কোথায়
গেল?মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে প্রাপ্তবয়স্ক কেচ্ছা শুনেছি
মান্তুদি কলেজের এক অহিন্দু ছেলের প্রেমে পড়েছে। আমার একটুও খারাপ লাগেনি, মন
খারাপ হয়নি শুধু সেই প্রেমিককে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে।কিন্তু কোনদিন মান্তুদিকে সে কথা
বলতে পারিনি।
তখন বাড়িতে বাড়িতে
ছারপোকা আর উকুন মারার ওষুধ থাকত।টিক টুয়েন্টি এমনি এক বিষ।তাম্রলিপ্ত
মহাবিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারের ছাত্রী মান্তুদি একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে কাউকে না
জানিয়ে অভুক্ত শরীরে পুরো শিশির বিষ মুখে ঢেলে যন্ত্রণায় কাৎরাতে কাৎরাতে সবাইকে
মুক্তি দিয়ে চলে গেল।
মান্তুদি এমন হঠকারী হবে
দুঃস্ব্প্নেও ভাবিনি।এ আমার সুখস্মৃতি নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন