গুটিপোকা
আমার দেশের বাড়ির বাগানে
আম-জাম-নারকেল-কাঁঠাল-তাল-সুপুরির পাশাপাশি সদর রাস্তার দু-পাশে বাবার হাতে তৈরি
ফুলের বাগানও ছিল।সেখানে এই গ্রীষ্মে ভুঁইচাপা ফুটত।সামারলিলিও ফুটত।আর ফুটত
বেলফুল,জুঁইফুল,রংগন,টগর,গন্ধরাজ আর রজনীগন্ধা।বর্ষা এলে বেলফুল তার মান হারাত
কিন্তু জুঁই আর রজনীগন্ধা কী অপূর্ব সুবাস ছড়াত।হয়ত একটু চড়া তবু এই দুই ফুলের
সংগে বাসরশয্যার অনুষংগ মিলে মিশে থাকে।কৈশোরে দাদা-দিদিদের বিয়ের গাড়ি কি বাসরঘর
আমরাই সাজাতাম।রজনীগন্ধার শিকলি আর ঝাউ-গোলাপ।বিছানায় ছড়াতাম গোলাপের পাপড়ি।একটা
উগ্র গন্ধের পারফিউম স্প্রে করে দেওয়া হোতো।বর-বউ সারারাত ওই গন্ধে কী করে ঘুমোত
কে জানে!কোনও কোনও পূর্ণিমা রাতে আমরাও ঘুমোতে পারতাম না সারারাত।আমাদের বৈঠকখানার
রোয়াকের পাশে যে কামিণী গাছ ছিল তাতে যখন ফুল আসত পুরো গাছটাই জ্যাঠাবাবুর মাথার
মতো সাদা হয়ে যেত। আমরা যেমন দুপুরবেলা জ্যাঠাবাবুর পাকাচুলে হাত বোলাতাম
মৌমাছিরাও সারাদিন ওই গাছ জুড়ে উড়ে বেড়াত।সারাক্ষণ একটানা বিনবিন শব্দ কেমন ঝিম
ধরাত।এই সাউন্ড পরে শুনেছি তারকভস্কির আর আন্তোনিওনির চলচ্চিত্র-এ।এই ঝরাফুল বহু
পরে পেয়েছি উত্তরবঙ্গে তারও পরে শান্তিনিকেতনে।উত্তরবংগে ছবির কাজ করতে গিয়ে
মৌমাছি নয় হাতির পালের সামনে পড়েছি ঠিকই কিন্তু বৃষ্টির পর সারা পথ জুড়ে ছিল জারুলফুল।আর
শান্তিনিকেতনে অমলতাস,ফাগুনবউ,রুদ্রপলাশ আর কুর্চিফুল। ছাতিমের কথা বললাম না এই
জন্যে বৃষ্টিঝরা ছাতিম ফুল দেখেছি শুশুনিয়া পাহাড়ের নিচে।ঝরাফুল নিয়ে ছোটোরা অক্ষর
লেখে পথে।যেমন আগুন রঙের পলাশ অবহেলায় ঝরে থাকতে পুরুলিয়া আর
চান্ডিলে।শান্তিনিকেতনের মতো ওখানে কাউকে পলাশের মালা গেঁথে পরতে দেখিনি।ওরা এখন
খোঁপায় গোঁজে সস্তার প্লাস্টিকের ফুল।মালা গেঁথে পরবার সময় কোথায়?ভোর হলেই যে
ছুটতে হবে স্টোন ক্রাসারে কি স্পঞ্জ আয়রনের কারখানায়।মালা গাঁথি আমরা।কখনও কল্পনার
কখনও কেনা ফুলের।
আমাদের যে বিশাল টগর গাছ
ছিল তার ফুলে মালা গেঁথে যেমন রবিঠাকুরকে পরানো হোতো আবার ঝুলন পূর্ণিমায়
রাধা-কৃষ্ণকেও সাজানো হোতো। কার বাড়ির গোড়ের মালা কতো বড়ো তাই নিয়ে একটা
প্রতিযোগিতা চলত।এক্টুও বাড়িয়ে বলছিনা আমার দিদিদের হাতের গোড়ের মালা সব বারেই
জিতে যেত।হলুদ কল্কে ফুলের গাছও ছিল।তার মালাও বেশ শোভা পেত।তবে কল্কে গাছের বিচির
থেকে আমরা সযত্নে দূরে থাকতাম।ওই বীজ বেটে খেয়ে অনেক মানুষ যে মরার চেষ্টা করেছে
বিশেষ করে মেয়েরা।খালের পাড়ে ছিল কল্কে ফুলের গাছ আর পুকুর পাড়ে ছিল শিউলি ফুলের
গাছ।শরৎ এলে সন্ধ্যের শিশির পড়ে শিউলি তার সুবাসে পাড়া মাৎ করত।সবাই বলেন ভোরের
শিউলির কথা কিন্তু আমি ওই মাঝ রাতেই তাকে ভালোবাসতাম।ভোরেরবেলা ভালোবাসতাম
স্থলপদ্ম আর শিশির ভেজা কুমড়োফুল। বকুলফুল আর স্বর্ণচাঁপা আর এক মাধুরী ছড়াত।এর
ফাঁকে তেমন গন্ধ ছড়াত না কিন্তু শ্বেতকরবী আর রক্তকরবীর পাশে সাদা কাঞ্চনফুল বেশ
লাগত।সকালের রোদে করবীর পাতায় নানা রঙের খেলা চলত কেন না ওখানে প্রজাপতি আর মথ
গুটি মেলেছে।সেই গুটিতে রোদ পড়ে সাত রঙের খেলা চলত।পরে জেনেছিলাম রক্তকরবী
বিষাক্ত।তখন শিখেছিলাম গুটিপোকা হতে।খুব খেয়াল করলে দেখতে পেতাম গুটির ভেতরের
পোকাদের নড়াচড়া।তারপর একদিন গুটি কেটে বেরিয়ে পড়া।
আমি তখনও গুটি হয়েই
আছি।পড়ার খাতার সাদা পাতায় নয়ত ফেলে দেওয়া ডায়েরিতে কাটছি আকিবুকি আর ফাউন্টেন
পেনে কবিতা।এক গনগনে দুপুরে লিখেছিলাম-‘ব্যস্ত ছিলাম জ্যোৎস্না থেকে ফুল কুড়োতে’.........।আমার কবিতা তখন নানা
জেলার লিটল ম্যাগাজিনে বেরোচ্ছে এমন কি কলকাতাতেও।পোস্টকার্ড কি খামে লেখা পাঠিয়ে
দিতাম ঠিকানা লিখে।কোনও কোনও ভোরে পোস্টমাস্টার কি পিওন ডেকে আমার হাতে ধরিয়ে
দিতেন বুকপোস্ট-এ পত্রিকা যেখানে থাকত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গংগোপাধ্যায়,তারাপদ
রায়,তুষার রায়ের পাশাপাশি আমার কবিতাও।কেউ কেউ বিক্রির জন্যে আমার সৌজন্য সংখ্যার
সংগে আরো কিছু কপি পাঠাতেন।আমি সেগুলো নিয়ে যেতাম ‘রীডার্স কর্নার’এ।উনিও সানন্দে
সেই পত্রিকা সাজিয়ে রাখতেন।কী আশ্চর্য সেগুলো বিক্রিও হোতো।উনি ওনার কমিশন রেখে বাকি
টাকা আমাকে দিলে আমি মানি অর্ডার করে সে টাকা পাঠিয়ে দিতাম সম্পাদককে। এই সুযোগে
বিনম্র অহংকারে জানিয়ে রাখি কোনদিন কোনও বহুল প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায়
ছাপার আশায় লেখা পাঠাইনি।পরেও লেখার বরাত পেলে তবেই লিখেছি।আসলে তেমন গুছোনো কবি ও
লেখক হয়ে উঠতে পারিনি কোনদিন।এই কলকাতা শহরে যখন নাট্যচর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি
পত্র-পত্রিকায় অর্থ উপার্জনের কারণে ধারাবাহিক রচনা কি সমালোচনা লিখছি সে সময় কিছু
কবি ও দম্পতিকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা সম্পাদকের দপ্তরে বসে থাকতে।পরের সংখ্যাতেই
প্রকাশিত হয়েছে তাদের একগুচ্ছ কবিতা।তাদের কিন্তু পয়সার অভাব ছিল না।নামও হয়েছিল।
পরে জেনেছি বিদেশ যাওয়ার তাগিদ ছিল।আমার আবার তাগিদটা ছিল নামের নয় মাণের।নাটক
লিখেছি মঞ্চে প্রযোজনার প্রয়োজনে।প্রবন্ধ আর কবিতা লিখেছি স্রেফ ভালোবেসে।নামের
জন্যে কাঙালপনা করিনি কোনদিনই।
আমি খুব চিঠির কাঙাল
ছিলাম।সকালবেলার ডাকে আমার চিঠি আসবে এটা আমার এক মস্ত কাঙালপনা।পত্র-পত্রিকা হলে
তো কথাই নেই।সে আমার লেখা থাকুক আর নাই থাকুক।পুজো সংখ্যায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারে
আমার কোনদিন কোনও কাঙালপনা ছিল না।একবার কলকাতার এক শারদ সংখ্যায় আমার কবিতা
প্রকাশ পেল।আমি তখনও হাতে পাইনি কিন্তু কবিতা পড়ার ডাক পেলাম তমলুকে কবি সম্মেলনে
নিখিল বংগ সাহিত্য সভায়।বেশ কয়েকদিন ধরেই নানা অনুষ্ঠান চলছে।বেশ মনে আছে রুমা
গুহঠাকুরতা তাঁর গান নাচের ট্রুপ নিয়ে এলেন।তিনি মঞ্চ থেকেই নিজে গাইতে গাইতে
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নেমে সবাইকে দিয়ে গাওয়ালেন-“চিও চিও চি”।সেই প্রথম উদয়শংকর
ব্যালে ট্রুপের কয়েকজনকে নাচতে দেখলাম “ধিনাক নাতিন তিনা”গানের সংগে।আমি উত্তেজনায়
কাঁপছি।এই মঞ্চেই আমি পরের দিন স্বরচিত কবিতা পাঠ করব?আক্ষরিক ভাবেই প্রায় সারারাত
জেগেছিলাম।ভোর হতে রেডিওতে শুনলাম রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদ এর প্রয়াণ
হয়েছে।সকাল থেকে আকাশবাণীতে সারেংগী আর এস্রাজ-এ একঘেয়ে বিলম্বিত।অনুষ্ঠান মঞ্চে
পৌঁছে শুনলাম আমার আশংকা সত্যি করে সাতদিনের শোক পালন হবে।ওটা সরকারি অনুষ্ঠান ছিল
তাই।এই প্রথম আমি এভাবে ফকির হয়েছিলাম।
স্থানীয় কবিরা সবাই আমার
মতো এসে পড়েছেন সংবাদটা জেনে বা না জেনেই। সবার ঘরে তখন রেডিও ছিল না।শুধু কলকাতার
কবিরা আসেননি।তারা জানতেন বা আসতে বারণ করা হয়েছে তাই।আমরা যখন হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরব
ভাবছি ঠিক তখন কবি বাসুদেব দেব তার বাংলোয় আমাদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানালেন।আমরা
হাতে চা নয় চাঁদ পেলাম।বাসুদেববাবু তখন ওখানকার সরকারি প্রশাসক।ওনার বাংলোটা ছিল
নদীর কাছে কিছুটা নির্জনে।আমরা সবাই হাঁটা দিলাম।হাঁটতে হাঁটতে ফেলে আসা একটা কথা
বলে নেওয়া যাক।
‘রীডার্স কর্ণার’এ যখন
পড়ি আর কবিতার পত্রিকা রেখে আসি তখন আসা যাওয়ার পথে বর্গভীমা মন্দিরের কাছে দেখলাম
আরো একটি বইয়ের দোকান ‘লিপিকা’।এক শান্ত মানুষ বসে থাকেন তার সহকারীকে নিয়ে।একদিন
সাহস করে গিয়ে পত্রিকা রাখার কথা বললাম।ভেবেছিলাম উনি মুখ বাঁকাবেন কেন না ওখানে
কবিতা-গল্পের চেয়ে পাঠ্যপুস্তক বেশি থাকত।উনি কিন্তু আমাকে অবাক করে বললেন-‘আমি তো
ওসব ঠিক বুঝি না।তুমি বরং আর একদিন এসো যেদিন আমার বড়ো ছেলে থাকবে। ওর নাম
অশোকতরু।আমার ছেলেও তো কবিতা টবিতা লেখে’।
অশোকতরু মিশ্র এক
সৌম্যকান্তি যুবক।একমুখ দাড়ি গোঁফ,লম্বা চুল,মুখে প্রশান্তি আর ভাষায় মেদিনীপুরের
আঞ্চলিকতা।বাড়ির ঠিকানায় লেখে ‘তমোলোক’।আমার স্বভাবের একেবারে বিপরীত।বাড়ির নীচেই
দোকান।বাড়িটা রাস্তার ওপরে তিনতলা।অসম্ভব ধার্মিক।কালীর ভক্ত এবং সমস্ত শুকনো ও
ভেজা নেশাতেই অভ্যস্ত।আমি কোনদিনই বাহ্যিক নেশায় বিশ্বাসী ছিলাম
না।পান-বিড়ি-গাঁজা-সিগারেট আমার কাছে অসহ্য চিরকাল।কিন্তু আমি কাউকে নাও করতাম
না।যার ফলে আমার কোনদিন কারো সংগে ওই কারণে বন্ধু হওয়াটা বাধা হয়নি।তাই বিপরীত
মেরুর আমরা দুজন শুধু কবিতার কারণেই নিবিড় বন্ধু হয়ে গেলাম।কালে কালে দুজনেই দুই
পরিবারের খুব কাছে চলে এলাম।এর ফলে আমার ‘রীডার্স কর্ণার’এর পড়াশোনাটা উঠে এলো
‘লিপিকা’য়।দুপুর থেকে রাত আটটা দোকানে।তারপর দোকান বন্ধ করে বাসস্ট্যান্ডের কাছে
চায়ের দোকানে।ওখানে আমি আর অশোকতরু ছাড়া কালোবরণ পাড়ুই আসত। কালোবরণের একটি লাইন
আমার আজও মনে আছে-“নীল পাখি উড়ে গেছে দূরে/গাছ তাকে বাঁধতে পারেনি”।আর এক খ্যাপা
মল্লিনাথ যার সংগে আলাপ হয়েছিল কলেজেই সেও ছিল কবি।এই কয়েকজন থাকতাম প্রায়
প্রতিদিন।এবার তার সংগে আসা শুরু হোলো রতনতনু ঘাটি,শোভন মহাপাত্র,শ্যামলকান্তি
দাস,শাস্ত্রবিরোধী কবি বাবলু আর ক্বচিৎ কখনো অনুরাধা মহাপাত্র।আর একজনও আসত যার
নাম ছিল দুরন্ত কুমার বিজলী।
বাসুদেব বাবুর বাংলোয়
জমিয়ে আড্ডা হোলো।কবিতা,গান,রসালো কথা আর কোন শারদ সংখ্যায় কোন লেখা প্রকাশিত
হোলো।কলকাতার পত্রিকা যাদের হাতে সেখানে আমার নাম দেখে সবাই একটু সমীহের চোখে
তাকালেও আমার নিজেকে তেমনভাবে কবি কবি মনে হচ্ছিল না।মনে হবেই বা কেন?কবিতা লেখার
অনেক আগে থেকেই যে নাটকের ভূত আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
গুটিপোকা আমি তাই খোলসের
ভেতরেই কখনো কবিতা, কখনও ছবি আর কিছু কিছু নাটক নিয়ে নড়াচড়া করছি।জোনাকি না
প্রজাপতি হব তখনও জানি না।শুধু জানতাম এ জীবন আমার নয়।এ পরবাসে আমি থাকব না।আমি
নিজভূমে যাব।হায়!মিলন হবে কতোদিনে......?
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন