MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

তপ্ত...।পান্তা......আমানি ও চমৎকারী
আমার শৈশবে ঘাট ছিল মেয়েদের মুক্তকথার মুক্তিস্থল।সকালবেলা ততটা না হলেও দুকুরবেলা(দুপুর)নাইতে(স্নান)এসে কি সাঁঝেরবেলা গা ধুতে এসে মন উজাড় করে কথা আর কেচ্ছা এই ছিল তাদের ক্ষণিকের বিনোদন।আর সেখানেই জন্মেছিল অনেক কাহিনি,অনেক গাথা।বস্তুত এই ঘাট ছিল লোকায়ত কাহিনির আঁতুড় ঘর।পরে কুয়ো আর টিউকল(টিউব ওয়েল)সেই স্থান দখল করে।
শোনা যায় উইলিয়ম ক্যারি লুকিয়ে লুকিয়ে এমন অনেক কথা সংগ্রহ করেছিলেন।তবে সেটা মেদিনীপুরে নয় শ্রীরামপুরে।আমি যখন ছোটো ছিলাম সেখানে আমার প্রবেশ ছিল।বিশেষ করে সেই বয়সেই হাত পা নেড়ে ছড়া বলে তাদের আদর কুড়োতাম।ওই বয়সেই এমন কিছু শোনা কথা শিশু ল্যাপটপের মেমারি কার্ডে ছিল যা আজ ভেসে উঠছে স্ক্রিনে।
মা,কাকিমা,জেঠিমাদের সংগে চান করতে যেত চমৎকারিও।চমৎকারী আমাদের ছোটো বেলার অভিভাবিকার নাম।তাকে আমরা কোনোদিন বাড়ির ঝি বা কাজের মেয়ে ভাবতে শিখিনি।সে আমাদের সব্বাইকে জন্মাতে দেখেছিল।সে আমাদের সবাইকে রোদে ফেলে তেল মাখাত কিন্তু কোনদিন তেল দিত না।সে আমাদের বকুনি দিত কিন্তু কোনও দিন গায়ে হাত তোলেনি।সে আমাদের স্নান করাত, গা মোছাত কিন্তু ভাত খাওয়াত না।সে ছিল তথাকথিত নিম্নবর্গের কিন্তু সে ছিল সরকার বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের একজন।
চমৎকারী কথায় কথায় বলত “দ্যাখো মেজদ্দি(মেজ দিদি)ভাত দ্যায় কি ভাতারে? ভাত খাই মোর গতরে।“ আরো বলত “হুঁঃ ভাত দিবার কেউ নয় কিল মারার গোঁসাই” আর যদি মেজদ্দি(আমার মা)কোন দিন বলত – এখনো তো ভাত বসেনি পান্তা আছে খাবি?চমৎকারী ছিল আনপ্রেডিক্টবল।সে না বলতেও পারত।কেন না সে তাই খায় যা ও বাড়ির কত্তা মেজদ্দা(আমার বাবা)খায়।খেতে বসে বাবা যদি কোন দিন কোনো রান্নাকে খারাপ বলত বা খেত না,তাহলে পরে চমৎকারী খেতে বসে বলবেই “ল্যাসোনি ল্যাসোনি মেজদ্দি।ও মুই খাবুনি” অর্থাৎ এনো না,এনো না মেজদি ও আমি খাব না।সেই নারী সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল –“ল্যাসো ল্যাসো বলে মূলে মা রাঁধেনি তপ্ত আর আমানি”
আমানি হোলো পান্তাভাতের ঠান্ডা বাসি জল।তখন দিন মজুর আর মাঠে কাজ করা মানুষজন আমন ধান ওঠার পর বেশ কয়েকদিন আধপাকা ধানের চাল সেদ্ধ করত হাঁড়িতে একটু হলুদ দিয়ে।তারপর কিছুদিন সাদা ধব ধবে ভাত খেত গরম গরম।যে মানুষ মাটির হাঁড়ির গরম ভাত না খেয়েছে তার জন্ম বৃথা।ঘরে চাল ফুরিয়ে এলে দিনে দিনে চাল সেদ্ধ হোতো যত তার চেয়ে ফ্যান হোতো বেশি।ওরা নুন দিয়ে ফ্যান খেত।তারপর ভাত ঠান্ডা হলে তাতে জল ঢালা হোতো.........।দিনের পর দিন ভাত যেত কমে আমানি যেত বেড়ে।চমৎকারীকে সে দারিদ্র কোন দিন অনুভব করতে হয়নি কিন্তু তাকে ভাতারের(স্বামী)সান্নিধ্যও কোনোদিন পেতে দেখিনি।
মেদিনীপুরে ভাষায় ক্রিয়াপদের ব্যভারটি(ব্যবহার)বড়োই চমৎকার।খাবুনি,যাবুনি, করবুনি,বলবুনি কিম্বা খায়ঠে,যায়ঠে,করেঠে,বলেঠে অথবা খ্যাচে, করছে, করতিছে, বলতিছে,ভাবতিছে।মেদিনীপুরের কথার চলনে কিছুটা চাটগাঁইয়া ধমক বা গমক আছে। আর কথায় কথায় ‘শ্লা’ বলা সে কালেও ছিল দস্তুর।ভিতর বাড়ির ঘোষ ঠাকুরদা ‘শ্লা’ বলতে বলতে এক বালতি পাঁঠার মাংস খেতেন।সে গপ্পো আর একদিন করব। এখন চমৎকারীর কথায় ফিরে যাওয়া যাক............।
চমৎকারীর সকাল হোতো ভোর চারটেয়।ওই বিশাল বাড়ির ঘর-দোর-উঠোন ঝাঁট দিয়ে গোয়াল থেকে গোবর তুলে বালতিতে গুলে সারা বাড়ি নিকানো।গোয়াল থেকে গোরু বের করে গোয়াল পরিষ্কার করা।তারপর পুকুর ঘাটে ডোবানো একতাড়া বাসন ছাই দিয়ে মেজে পুকুরের জলে ধোয়া।এর মাঝেই এর ওর ফাই ফরমাস খাটা লেগেই আছে।চমৎকারীকে আমরা কোনদিন বসে থাকতে দেখিনি।শুধু সব কাজের শেষে চান সেরে সে তার ভেজা চুল রোদে শুকাতো এক মনে।ছোটোরা কেউ বিরক্ত করলে ধমক দিত খুব।আর রাত নামলে তার সব কাজ সাঙ্গ হোতো।সে তখন দাওয়ায় বসে ঝিমোত।দুপুরবেলা সে সবার শেষে খেত আর রাতেরবেলা সবার আগে খেতে বসত। যদিও দুপুরের খাবার খেতে বিকেল তিনটে চারটে বেজে যেত আর রাতের খাবার দশটার আগে হোতো না।একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিবেলা কিছু না হোক তিরিশজনের পাত পড়ত।তা বাদে বাইরের লোকের আনাগোনা লেগেই থাকত।সন্ধেবেলা তরিবৎ করে মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।
বাড়িতে ভাজা চালভাজা কি মুড়ি কক্ষনো এমনি খাওয়া হোত না।ঘানির তেল,আম তেল,পেয়াঁজ লঙ্কা এসব এলেবেলে খাওয়া ছিল।তরিবৎ করে খাওয়া বলতে হয় ঘন করে খেসারির ডাল সেদ্ধ,নয় গোটা মুগ কড়াই সেদ্ধ কিম্বা ডালের বড়া।দাওয়ায় পেতে রাখা মস্ত শিলে লম্বা নোড়া দিয়ে চমৎকারী ডাল বাটত আর আমরা পড়তে না বসলে খুব বকত।হ্যারিকেনের আলোয়(এক একটা হ্যারিকেন পিছু চারজন)আমরা পড়তে বসতাম আর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত বড়া ভাজার গন্ধ।সেই গন্ধে উদাস হলেই জুটত চমৎকারীর ধমক।
চমৎকারী শুধু ছোটোদের ধমক দিত না বাড়ির মেয়েরা এমনকি বাড়ির বউয়েরাও পান থেকে চূণ খসলে তার ধমক খেত।চমৎকারী যখন তখন ঘরের কাজ করতে করতে গজগজ করে বলত –‘আছি তাই বুঝতে পারছনি।চলে গেলে বুঝবে’।যদিও চমৎকারীকে আমরা কোন দিন কোথাও যেতে দেখিনি।হয়ত চমৎকারীর কোন দিন কোত্থাও যাওয়ার ছিল না।শুধু এক শীতের রাত্রে চমৎকারী কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে গেল......।বাড়ির ডাক্তার জ্যাঠামশায়ও(ও অঞ্চলের সবাই জ্যাঠামশায়কে ধনন্ত্বরী বলেই জানত)তাকে ধরে রাখতে পারলেন না।
আমাদের বাগানের সবচেয়ে ভালো আম গাছটা কাটা হোলো তার সৎ্কারের জন্যে। যতদূর মনে পড়ে জ্যাঠাবাবু তার মুখাগ্নি করেছিলেন।ওই রাত্রে ঘরের দিদিমা(এরও একটা ইতিহাস আছে)সব শবযাত্রীদের লুচি ভেজে আলুর দম করে খাওয়াল।কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেনি।তবু কেন যে কদিন সবাই চুপ করে ছিল!

এর অনেক পরে এসেছিল রাণুর মা কিন্তু রাণুর মা কোন দিন চমৎকারী হয়ে উঠতে পারেনি।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন