MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

উদ্বাস্তুর হলফনামা
উদ্বাস্তু বল্লেই সবাই ভাবেন বাঙ্গালনামা।ঘটিরাও যে বাস্তুহারা হতে পারে......।হয়ে চলেছে......। এ কথা কারো মনে হয় না।সেই চারের দশক এর দেশভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অবধি যারা পুব থেকে পশ্চিমে
পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা কেউ আর বাসা বাড়িতে থাকেন?বাড়িয়ালার তাড়া খেয়ে কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ান?ঘটিরা আজ নিজভূমে পরবাসী।ঘটিদের ঘটে কী ঘটল তা নিয়ে কার মাথা ব্যথা?কেই বা ঘাটাঘাটি করতে চান?
ও বাংলার সবার আমজাম মাছমাংস পান সুপুরি ছিল এটা ঘটিদের ঠাট্টা হতে পারে।দোখ্নোদের সবার সুন্দরবনের লাটে জোতজমি ছিল সেটাও অতিকথন।তবে মেদিনীপুরের লোকেদের সংগে বাঙালদের পান আর
পানি......মাছ আর মাছ ভাত খাওয়ানোর আতিথেয়তার খুব মিল আছে।বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষ আর মেন্নিপুরের(মেদিনীপুর)লোক গোঁয়ারতুমিতে এ বলে “মোকে দ্যাখ” ও বলে “মোরে দ্যাখসস”......।
আমার ছোটবেলায় মেন্নিপুরের মানুষ সম্বচ্ছর জমির ধান, খাল বিলের মাছ, গোয়ালের দুধ,বরজের পান চিবিয়ে সময় কাটাত।গায়ে ফতুয়া আর হেটো ধুতির চেয়ে হাটের গামছাই ছিল মানানসই...।
আমাদের বাড়ির বড়োজামাই আদতে ছিলেন কলকাতার কিন্তু ছোটবেলায় ছিলেন বাঙাল,বড়োবেলায় আদিবাসী।বাবার ডাক্তারির সুবাদে তার এই যাযাবর জীবন।জামাইবাবু বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসে হাটে গিয়ে মাছের দাম দেখে উত্তেজিত হয়ে থলির বদলে দু-বালতি(কমপক্ষে দশ সের।আজকের বারো কেজি)ভরে মাছ কিনে এনেছিলেন।মেছোনিরা হাটের শেষে মাছ বিক্রি না হলে সব মাছ বাবার কাছে বেচে দিয়ে যেত।রাতের বেলা দল বেঁধে মাথায় কুপীর আলো জ্বেলে গল্প করতে করতে তাদের ঘরে ফেরা বাকি হাটুরেদের সংগে সে এক সুন্দর কথামালা।একবার আমার ছোটকাকা এমন জোরে বায়ু নিঃসরণ করেছিল ওরা চমকে বলে উঠেছিল .........”বাপো লো বাপো যেন চড়কা প্যালাইলো”(বাবা রে বাবা ঠিক যেন বাজ পড়ল)।  
তখন শুধু মাছ নয় আনাজপাতিও বিক্রি হতো থোবকায় পশ্চিম মেদিনীপুরে আর আমাদের দেশ গাঁয়ে বেত কাঠের দাঁড়িপাল্লায় সের দরে।দরদামের কথা নাইবা বল্লাম।শুধু বলতে পারি আমরা থোড় মোচা কচু কলা ওল হলুদ নেবু(লেবু)নঙ্কা(লংকা)লাউ পেপে পুঁইশাক কাঁঠাল এঁচোড় সজনে ডাঁটা নিম পাতা কলমি কুলেখাড়া শুষনি গিমে আম আমড়া জাম জামরুল পেয়ারা দেশিখেজুর তাল তেঁতুল নারকেল সুপুরি নারকেল তেল বিড়ি (বিউলি)কড়াই অড়হর খেসারি খই মুড়ি মুড়কি চাল চিড়ে কোন দিন কিনে খাইনি.........।
এসব খাদ্য আন্দোলনের আগের কথা.........তা কেন?ষাট সত্তরেও এসব কিছুটা সত্যি ছিল।মাছ তখনো অঢেল ছিল।শাক পাতাও.........।
এই যে চোত-বোশেখ মাস এখন গড়খাইয়ে মাছ ধরার সময়।মেজকত্তার(আমার বাবা)অনুমতি নিয়ে দশ বারোজন জেলে আর তাদের বোউয়েরা এসে পড়ল জাল আর খালুই নিয়ে।নেমে পড় খালে পানা সরাতে।একটু পরে আদুড় গায়ে জেলেদের কচিরা পান্তা খেয়ে নেমে পড়বে জলে......। কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কই মাছ ধরবে তারাও.........।আমাদের কাজ পাহারা দেওয়া চিল আর জেলেদের লুকিয়ে রাখা মাছে নজর রাখা।ফ্যাঁকা জাল ছুঁড়ে দিয়ে টুপ টুপ জলে ডুব দিয়ে বড় বড় শোল মাছ তুলে আনত আর শিঙি মাগুরের কাঁটা আঙুলে বিধে ওই ঘোলা জল কেমন লাল হয়ে যেত।
দিনের শেষে উঠোনে মাছ ভাগ হবে আধাআধি.........।মেজকত্তার একটা চালাকি ছিল।সব মাছের আধাআধি ভাগ হবে শুধু শাল, মহাশোল(বাঙালরা যাকে গজাড় বলেঘটি কায়েত বামুনরা ও মাছ খায় না)জেলেরাই নেবে আর পোনা মাছ বাবুরা।ওগুলো পুকুর থেকে ভেসে যাওয়া মাছ কি না!বাকি শোল ল্যাঠা ভেটকি পুঁটি কই ন্যাদস ফলুই ট্যাংরা পাঙাস খলসে খয়রা পারশে ভাসা তারোই বেলে ভোলা চ্যাং চেঙো সিঙি মাগুর পাঁকাল বোয়াল বাণ ভাগের পর জেলেরা হাটে বেচতে যাবে আর আমরা জিওল মাছ মাটির হাঁড়িতে জিইয়ে বাড়ি বাড়ি বিলোতে ছুটব।সেও এক উৎসব।বাড়ির মেয়েরা বঁটি নিয়ে মাছ কুটতে আর ভাজতে বসবে।কেউ কেউ মস্ত শিল নোড়ায় সর্ষে লঙ্কা বাটতে থাকবে.........।কদিন শুধু মাছের গন্ধে ম ম করবে সারা বাড়ি।সারা পাড়া।
সারা বছর মাছ ছাড়া কারো ভাত উঠত না মুখে।দিনের বেলা জাল ফেলা ছাড়া পুকুরের পাড়ে ছাঁকনি জালে মাছ ধরে কি রাত্রে একটা কাপড় দু টুকরো কঞ্চিকে বেঁধে তার চার মাথায় কাপড়ের চার খুঁট বেঁধে তার ভেতরে গোবর আর তূষ মেখে মস্ত মস্ত গোলা করে তার মধ্যে আম জাম পাতার পল্লব দিয়ে পুকুর আর খালের জলে ডুবিয়ে রাখা আর কিছু পরে পরে তুলে দেখা চিংড়ি আর কাঁকড়া উঠল কি না।
এমন করে রাতের বাটি চচ্চড়ি হয়ে যাবেগরম ভাতে মাছের বাটি চচ্চড়ি যে না খেয়েছে সে এর সোয়াদ জানবে কী করে?
দক্ষিণ বাংলার গরম বড় মারাত্মক।লোকে বলত আম কাঁঠাল পাকার গরম।বিশেষ করে তমলুক অঞ্চলে ভ্যাপ্সা গরম।আমরা বাইরের উঠোনে খোলা আকাশের তলায় শুতাম সারি দিয়ে।ঘরের দরজা থাকত হাট করে খোলা।চুরি?সে আবার কী?রাতের খাবার পর কাঁসার পিতলের বাসনপাতি পুকুর ঘাটে ডোবানো থাকত কেউ নিত না।শুধু ঘেটো রুই মাছ মস্ত হাড়িতে ঢুকে পড়ত।চুরি হতো না বলে চোর ছিল না তা কী করে হয়?(ভজা চোরের কথা পরে বলব।বড় মজার চোর ছিল সে)
গরম কাল মানেই ভোরের স্কুল।আম কুড়িয়ে চান(স্নান)সেরে ভেজা চিড়ে পাটালি গুড় মাখা খেয়ে ঘুম চোখে ছোটা.........।সারা দুপুর আম গাছের তলায় ঝ্যাঁতলা(ঘাসের চাটাই)পেতে শুয়ে থাকা।বিকেল হলে বড়তলার (বটতলা)দলুইদের দোকানের গরম ফুলুরি হাতে নিয়ে জলে ঝাঁপ.........।জল থেকে উঠতাম দরদর করে জলের মধ্যে ঘামলে তবেই......
রাতের বেলা জল ঢালা ভাত(পান্তা ভাত নয়) আর মাছ চকুটা(ভাজা মাছ তেল পেঁয়াজ লংকা নুন দিয়ে মাখা)সংগে একটু কাগজি লেবু কিংবা গন্ধলেবু।মাঝে মাঝে কুচো চিংড়ির বড়া কি ডালের বড়াও খাওয়া হতো।বাটা মাছ ধরতাম জলে ডুব দিয়ে।খড়কে বাটা ভাজার সোয়াদ আহা......।গরম এর কালে আমাদের খেলা ছিল জলের গভীরে ডুব দিয়ে চুপ করে বসে থাকা।কে কতক্ষণ থাকতে পারে।মাছেরা আমাদের শরীরে মুখ বোলাত।আমাদের ভয় করত না।আমাদের গণেশ এ ব্যাপারে ছিল মহা ওস্তাদ।গণেশ আমাদের পোষা মাছের নাম।
আমরা ছিপ ফেলতে বসলে গণেশ খুব বিরক্ত করত।সব মাছকে তাড়িয়ে দিত......।এম্নিতে কিন্তু ও খুব ভদ্র।ডাকলেই এসে আমাদের হাতে ভাত খেত।জলের মধ্যে আমরা ওকে তুলতাম।কুড়ি পচিশ সের কিন্তু জলের মধ্যে হাল্কা করে দিত শরীরটা।মেজদা ছিল খুব রগচটা।মেজদার হাতে ভাত খায়নি বলে মেজদা খুন্তি দিয়ে ওকে মেরেছিল।মাথার কাছে একটু ছাল উঠে গিয়েছিল।বাবা বলেছিল – “গণেশ যদি মরে তবে তুইও বাঁচবি না” গণেশের মুখে কোরামিন আর মাথায় বোরোলিন মাখাতে মাখাতে গণেশ বেঁচে গেল।বেঁচে গেল মেজদাও।একবার ভাদ্রের ভরা বাণে সব মাছ ভেসে গেল......।একা গণেশ আমাদের ছেড়ে কোত্থাও যায়নি।
সেই গণেশ আমাদের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থেকেই মরেছিল।আমরা ছোটরা গণেশের ওই মৃত্যু চাইনি কোন্ও দিন।

ইংরাজী ডেইলি “টেলিগ্রাফ” একবার পোষ্য নিয়ে সাক্ষাতকার নিয়েছিল।সেখানে আমি বলেছিলাম “আমি এখনো কলকাতায় নিজেকে পোষ মানাতে পারিনি।“এখানে আমি গণেশের কথা বলেছিলাম।যে মেয়েটি আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছিল সে পরম বিস্ময়ে শুনঞ্ছিল গণেশের কথা।তারপর লিখেছিল সবিস্তারে।গণেশ বেঁচে আছে টেলিগ্রাফের পাতায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন