পায়ের চিহ্ণ নিয়ে পড়ে
থাকা পথ......
যদিও বাড়ির সামনেই গড়খাই
আর গড়খাইয়ের পরেই পাকা সড়ক তবু খোয়া-মোরামের লাল রাস্তা নয়ত এঁটেল মাটির পথেই ছিল
আমাদের চলাচল।কোন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন পায়ে চলা পথ হেঁটে এসে আমাদের বাড়ির
সামনে বাস রাস্তায় এসে বাস ধরত।কতো রকমের মানুষ তাই আমরা দেখেছি তখন।নতুন
জামাই,ফিরে আসা বাড়ির বউ, পালিয়ে যাওয়া ছেলে,হারিয়ে যাওয়া মেয়ে.........ডুবকালুয়া
গ্রামের জানাদের বাড়ির একটি মেয়ে একটা করে বিয়ে করত আর কিছুদিন পরেই পালিয়ে
আসত।তার কোনও শ্বশুরবাড়িই ঠিক পচ্ছন্দ হোতো না।আমি তার চার থেকে পাঁচবার বিয়ে হতে
দেখেছি।ভিতর বাড়ির একজন বারবার চাকরি ছাড়ত সেও ফিরে আসত ওই পথেই।আর নিশুত রাতে
ফিরত বাসের ড্রাইভার যতীনদা, মাইতি বাড়ির কানাইদা।কানাইদা পুলিশের জিপ চালিয়ে ছিল
কিছুদিন।অনেক রাতে সে অনেক কিছুর সাক্ষী।সে সব ভুলতেই সে রাত্রে নেশায় চুর হয়ে
থাকত।তার হাতে ছিল দামি ঘড়ি। অনেকদিনই সেটাকে জমা রেখে সে নেশা করে ফিরত আর সকালে
গিয়ে ছাড়িয়ে নিত।যতীনদা ওসব কিছু করত না।নেশা করে বাড়ি ফেরার সময় মোরামের পথের
দু-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলাগাছগুলোকে জড়িয়ে ধরে মান্না দের বিরহের গান গাইত। ওই পথ
দিয়ে যাওয়া বা আসার সময় আমাদের বাড়ি থেকে হাঁক উঠত......
-কে?অ্যাতো রাতে কে যায়?
- আজ্ঞে আমি
কাঁঠাল।(কাঁঠাল তার পদবি।সে দুধ-ঘি ছানার ব্যবসা করত)বাবু রাত কতো হোলো?
- আট টা।
তখন সবার হাতে ঘড়ি থাকত
না।স্কুল মাস্টার মশায় বা ডাক্তার বা অফিসের বাবু ছাড়া খুব একটা ঘড়ি পরতই না।টাকার
অভাবে নয়,প্রয়োজন নেই তাই।তারা সময় মাপত দিনেরবেলা সূর্য দিয়ে আর রাতেরবেলা
শেয়ালের হাঁকে।তখন চার প্রহরে চারবার শেয়াল ডাকত নিয়ম করে।(সল্টলেকেও আটের দশকে
কাশের বনে শেয়ালের ডাক শুনেছি কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘুমের
ব্যাঘাত হচ্ছিল বলে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।তখনো পরিবেশবিদরা অ্যাতো সোচ্চার
ছিলেন না।) আর ভোরের বেলা হাঁস-মোরগ।মানুষজন ওই শুনেই ঘুমোতে যেত আর জাগত।ভুল হোতো
না।ভুল বললাম......সচরাচর ভুল হোতো না কিন্তু ক্বচিৎ কখনো বিভ্রম হোতো।একবার
আশ্বিনের রাত্রে এমন ঘটনা ঘটেছিল।
মেদিনীপুরে পানের চাষ
হোতো খুব।ওখান থেকে সারা ভারতে সেই পান যেত।তমলুকে ছিল পানের আড়ৎ।চাষীরা বিকেল
বেলা বরজ থেকে পান তুলে একপন দু-পন করে গুনে(পরে শ কিম্বা হাজার)রাত্রে কলাপাতায়
মুড়ে ভোর বেলায় আড়তে যেত ভোরের প্রথম বাস ধরে তমলুক শহরে ‘রূপশ্রী’ সিনেমা হলের
উল্টোদিকের আড়তে।সেদিন ছিল পূর্ণ জ্যোৎস্না আর আকাশে ছিল ছেঁড়া মেঘ।কাকেরা ভুল করে
ভোর হয়েছে ভেবে ডাকাডাকি করে উঠতেই হাটুরেরাও ভোরের বাস ধরতে বেরিয়ে পড়েছিল।তারা
যখন মাটির পথ দিয়ে গপ্পো করতে করতে বাস স্ট্যান্ডে আসত আমরাও ঘড়ি দেখতাম। কিন্তু
সেদিন শোয়ার পরে পরেই হাটুরেদের কথোপকথনে বিছানা ছেড়ে উঠে হ্যারিকেনের আলোটা
বাড়িয়ে বাড়ির দেওয়ালে থাকা সুইস দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে আর কাকেদের ডাকাডাকিতে
বুঝেছিলাম এটা কাকজ্যোৎস্নার কারসাজি।আমরা বিছানা ছেড়ে উঠে তাদের ডেকে নিলাম বাড়ির
দাওয়ায়।রাত তখন মাত্র বারোটা। তারা বাকি রাত আমাদের সংগে কথা বলে,গল্পো করে কাটিয়ে
সত্যি ভোরে ছুটল ভোরের বাস ধরতে।কাকভোর আর কাকজ্যোৎস্না বড়োই মায়াময়।
আমরা কিন্তু ভুল করে
নয়,জেনে বুঝেই কতোবার মাঝ রাতে বেরিয়ে পড়েছি পথে। একবার খবর এলো মেচেদা থেকে
হলদিয়া যে ন্যাশানাল হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে সেটায় ফাটল ধরেছে।ছুটলাম.......শীতের
দুপুরে যারা শুয়োর চরাতে আসত আর আমরা সেই শুয়োরদের চলার পথে গাছের ডাল কি কঞ্চি
ফেলে রাখতাম।ওরা ওটা মাড়িয়ে গেলেই ছুট্টে গিয়ে সেটাকে লাউ বা সিমের মাচায় রেখে
দেওয়া।ওতে নাকি ফসল ভালো হবে। সেবারে ওনেক শুয়োরের মধ্যে একটা শুয়োর বুনোকচুর বনে
কচু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।রাত্রে হিসাব মেলাতে গিয়ে একটা কম পড়াতে শুরু হোলো
ছোটাছুটি।শুয়োর ও ছোটে আমরাও ছুটি তাকে ধরতে।গ্রামের সব লোক জুটে গেল শুয়োর
ধরতে।এটা ছিল নেহাৎ শুয়োরের গোঁয়ারতুমি আর আমাদের বিনোদন।চোর ধরার জন্যেও আমরা
মেঠো পথে ছোটাছুটি করেছি অনেকবার।বিশেষ করে ভজাকে ধরতে আমাদের বিস্তর বেগ পেতে
হোতো।কিন্তু ভজা ছিল ব্র্যান্ডেড চোর আর আমরা যে কতোবার আলপথে হাঁটতে হাঁটতে আখের
খেত থেকে আখ,শাঁকালুর খেত থেকে শাঁকালু তুলে যাত্রা দেখতে ছুটেছি।কালীপূজার রাত্রে
কালীঠাকুর আর ছাগবলি দেখব বলে আলতো শীতে মাঝ রাতে গায়ে কাঁথা কি বিছানার চাদর মুড়ি
দিয়ে মেঠোপথে তারার আলোয় এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম ছুটে গেছি ভাই-বোনেরা।অনেক পরে যখন
গেয়েছি “তারার আলোর প্রদীপখানি,প্রাণে আমার জ্বালবে আনি/আমার যত কথা
ছিল......”আমার শৈশবের স্মৃতি ভেসে উঠেছে।
পৃথক অন্ন হবার আগে তো
বটেই পরেও আমরা ভাই-বোনেরা আমাদের রাধাবল্লভ পুরের মামাবাড়িতে দিদিমার কাছে যাব
বলে আমরা মাঠ পেরিয়ে,ঘাট পেরিয়ে তিন চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতাম।দিদিমার হাতের
পিঠে-পুলি সব্বাই ভালোবাসতো। দিদিমা সবচেয়ে সুন্দর রান্না করতেন নিরামিষ পদ।ছোট্টো
রান্নাঘরে কাঠ-পাতা জ্বাল দিয়েই শুক্তো থেকে টক সব কি পরিপাটি করে তৈরি করে পরিবেশন
করতেন। শীতকালে দিদিমার হাতের সজনে ফুলের বড়ি দিয়ে তরকারি,বড়ি পোস্ত এমনকি বান
মাছের কালিয়া,পাঁকাল মাছের টক......।নিজের হাতে লাগানো সূর্যমুখী লংকা দিয়ে কী
সুন্দর আলু ভাতে মাখতেন!আল্টুসি শীতের রোদে মাটির দাওয়ায় বাঁশের পাটায় তেল মাখিয়ে
বিউলি ডালের বড়ি দিতেন।থালায় তেল মাখিয়ে তার উপরে ভাজা বড়ি আঙুলের আলতো ছোঁয়ায়
সাজাতেন।আর সাদা কাপড়ে পোস্ত ছড়িয়ে গয়না বড়ি দিতেন।আমরা পাশে বসে এক একটা ডিজাইন
বলতাম আর উনি হাসিমুখে সেইরকম গয়না বড়ি তৈরি করতেন। তবে ছেলে মেয়েদের অবাধ
মেলামেশা উনি ভালো চোখে দেখতেন না।আমি আর রিনি সেই নিয়ে ওনাকে খুব ব্যতিব্যস্ত
করতাম।আমার মা কিন্তু ছিল তার মায়ের বিপরীত।মা আহামরি কিছু রান্না পারত না।রোগীর
পথ্য আর পোরের ভাত বানাত চমৎকার।অসুখ করলে নরম হাতে সেবা করত।পড়ালেখা নিয়ে একটুও
বকাবকি করত না।মা কাউকে কখনো মেরেছে দুঃস্ব্পনেও ভাবতে পারিনি। কেউ মাকে অসম্মান
কি অপমান করলে মা হেসে উড়িয়ে দিত।আমরা তাই নিয়ে কিছু বল্লে মায়ের যুক্তি ছিল “আমি
অপমানিত না হলে আমাকে অপমান করবে কে?”মায়ের মতো এমন আধুনিক নারী আমি খুব কম
দেখেছি।মা প্রশ্রয় না দিলে আমার সারাজীবনের চলাচলের পথে এতো রোদ-বৃষ্টির সংগে
দ্যাখা হোতো না।এক বার লোডশেডিংয়ের রাত্রে সল্ট লেকে চাঁদ-তারার আলোয় কবিতার লড়াই
বসেছিল। বাবা বলে উঠল রবি ঠাকুরের কবিতা।মা বলল স্বরচিত কবিতা-“এখনি উঠিবে চাঁদ
নীল গগনে”।আমরা স্তম্ভিত।বাবা কুপোকাৎ......।
আমি মেঠোপথে বৃষ্টিতে
হেঁটেছি বহুবার।আমি ধুলো ওড়া শুকনো মাঠে ঝড়ের কাছে নতজানু হয়েছি বহুদিন।আমার
কাঙালপনার চিহ্ন আজো হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে ভিখিরিপতির লালসুরকির রাস্তায় কি
রাধাবল্লভপুরের বৃষ্টিমাখা কাদা পথে।তখন বৃষ্টির ঝাপ্টায়,উতল হাওয়ায়,কখনো হঠাৎ
খুশির ঝোরায় গা ডুবিয়ে ক্ষ্ণণিকের জন্যে হয়তো বা ভুলে থেকেছি মাকে কিন্তু মা
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই শহর কলকাতার নার্সিং হোমে কিছুদিন কোমায় পড়ে থেকে
বোধনের আগে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরে আর কোনদিন মাকে ভুলে থাকিনি।
আমার দীর্ঘশ্বাস দিনে
রাতে একবার না একবার আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেবেই –“মা” “মা গো”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন