এক লা বৈশাখ
আজকের বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপনের নির্দিষ্ট দিন ১৪ই এপ্রিল।আমাদের তো তা
নয়,কখনো ১৪,কখনো ১৫......।নীল ষষ্ঠীর দিন মাটিতে কুমড়ো বিচি আর শশার বীজ লাগানো
হোতো।আর পুকুর থেকে পাঁক মাটি তুলে পুঁই শাক লাগানো হবে।এর মধ্যে গাজনের উৎসব শেষে
চড়ক মেলা......।আমরা একটু বড়ো হতে নিমতৌড়ি যেতাম পিঠ ফোঁড়া চড়ক দেখতে।সন্ধেবেলা
বাজি পুড়বে......।কতো রকমের বাজি বিশেষ করে গাছ বাজি দেখবার মতো।বাড়ি ফিরতাম
ফুটকড়াই খেতে খেতে......। কলকাতাতেও চড়কডাঙার,বাগবাজারের চড়ক দেখেছি,জেলেপাড়ার সঙ
দেখেছি কিন্তু আমার শৈশবের গ্রামের উৎসব বহরে বিশাল ছিল না,বাহারে জৌলুশ ছিল না
কিন্তু আন্তরিক ছিল।ঢাকের বোলে উৎসাহ ছিল,উদ্দামতা ছিল,বেতালাও হতো কখনো বা কিন্তু
বেহেডপনা ছিল না।
নব বর্ষের দিন মানে হালখাতা।দোকানে দোকানে আমের পল্লব শোলার রঙিন কদম ফুল
সুতলি দড়িতে ঝোলানো হবে।নিচে মাটির কলসিতে আম্রপল্লব আর ডাব আর একটা
কলাগাছ।দোকানেই পুজো হবে।এখানকার মতো কালীঘাট কি দক্ষিণেশ্বর কি ঠনঠনের কালীবাড়িতে
ভীড় জমানো নয়।বিকেল গড়ালেই সব্বাই নতুন জামা প্যান্ট পরে বাবার দেওয়া টাকা হাতে
নিয়ে দোকানে দোকানে যাব,রঙিন শরবত খাব আর একটা করে বাংলা ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির
প্যাকেট থলেতে পুরে রাত নামলে বাড়ি ফিরব।বড়োরা যেত গয়নার দোকানে কি কাপড়ের দোকানে
হালখাতা করতে।ওগুলো অনেক টাকার কারবার কি না।
একটু বড়ো হোতে আমরা নিজেরাই ধার করে খেতাম।তা না হলে বচ্ছর ফুরোলে দোকানি
আমাদের ডাকবে কেন?ধারের খাতা খুলে টাকা(এক টাকা কি দু টাকা)জমা করে গোলাপ জল
ছিটিয়ে,শরবত খাইয়ে,মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার দিয়ে আপ্যায়ন করবে কেন?সেদিন
রাতে বাড়িতে কিছু খেতে হোতো না।শুধু হঠাৎ কাল বোশেখির ঝড় উঠলে সারা বাগান ঘুরে ওই
রাতেই আম কুড়োতাম।কাঁচা মিঠে আম সব্বার আগে কুড়োতে হবে।তারপরে নাকি আম,মৌটুসি আম,মধু গুল্গুলি,সিঁদুরে
আম.....এ সবই দেশি আমের গাছ।আপনা থেকে বেড়ে ওঠা,খেয়ে আঁটি ফেলে দেওয়া তার থেকে
গাছ।কাঁচা মিঠে আমের গাছটা ছিল শতাব্দী প্রাচীণ আর বিশাল।আমি আর কোথাও আর কোন দিন
অমন মিঠে কাঁচা আম খাইনি।ওই আম পেকে গেলে কিন্তু আমরা আর খেতে পারতাম না।তখন সকালে
কাক শালিক আর রাতে বাদুড়ে খেয়ে খেয়ে ফেলত।আম গাছে সাধারণত একবছর ফলন হয়,পরের বছর
হয় না। আমাদের কাঁচা মিঠে আম গাছ প্রতিবছর ফল দিত।আমরা যখন জীবন ও জীবিকার
প্রয়োজনে মোকাম কলিকাতায় সে সময় গাছটা কেটে ফেলা হয়েছিল।আমি সেই শোকে বাবা মা
বেঁচে থাকতেও বহুদিন দেশে যাইনি।ওই গাছের শোক আমি আজও ভুলতে পারিনি, ঠিক যেভাবে
গণেশের মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি।
সারাজীবনে বহু শোক আমাকে আচ্ছন্ন করেছে.........।পোষা মাছের মৃত্যুর শোক, পোষা
হাঁসের মৃত্যুর শোক,গাছের শোক,কাছের মানুষের চলে যাওয়ার শোক।বাবা যে শীতের আগে
মারা গিয়েছিল সেই বছর ডিসেম্বরে আমার খুব কাছের মানুষ সফদর হাসমিকে মেরে ফেলা
হয়েছিল।আমি সে ক্রোধ আজো মুছতে পারিনি।আমার প্রিয় বন্ধু অশেষ(সেন গুপ্ত)আমার
টেলিফিল্মে শেষবারের মত অভিনয় করে না বলে কয়ে মারা গিয়েছিল আমারই জন্মদিনে সে শোক
আমি ভুলতে পারিনি ঠিকই কিন্তু যে মৃত্যু আমি চোখের সামনে দেখেছি অজ্ঞতার কারণে ঘটে
যেতে নববর্ষের দিনে তাকে আমি ভুলব কী করে?
আমি সে সময়ের কথা বলছি যখন বাংলায় সবুজ বিপ্লবের ডাকে পুকুরে চাষ হচ্ছে
আমেরিকার কৈ(তেলাপিয়া)আমেরিকার রুই(সাইপিনাস)আর মাঠে তাই চুং ধান। খাওয়া হচ্ছে
বজরা,ভুট্টা,মাইলো(এই মাইলো নিয়ে একটি অশ্লীল রাজনৈতিক ছড়াও ছিল।সেটা না বলাই ভালো
তবে আর একটি অরুচিকর হলেও অশ্লীল ছিল না)
“চার আনা সেরের বেগুন কিনে
মনটি বড়োই প্রফুল্ল।
ঘরে গিয়ে কেটে দেখি
তার ভেতরে কানা অতুল্য।।“
আর এক কবি তুষার রায়
লিখছেন.........
“খাদ্যাভ্যাস বদলাতে সব
ব্যাং খাও।
এই বলে তুমি মন্ত্রী মশায়
নিজে মুরগীর ঠ্যাং খাও।।“
চালের বিকল্প হিসাবে
কাঁচকলা খাওয়ার কথাও বলেছেন সে কালের মন্ত্রীরা।সেই কালে
চাষের জলের জন্যে
কির্লোস্কার কোম্পানির পাম্পসেট কেনা শুরু হোলো অনুদানে। সেগুলো চলত পেট্রোলে।
একটি ছেলে তাদের বাড়ির
পাম্পসেটের জন্যে নব বর্ষের সন্ধে বেলা জ্যারিকেনে পেট্রোল কিনে তমলুক থেকে
ফিরছিল।বাড়ির সামনে স্টপেজে নামার
পর সে বুঝতে পারল তার
জ্যারিকেন ফুটো হয়ে তেল গড়িয়ে পড়ছে।আমাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে
বললে.........”কেউ ম্যাচিস বা লাইটার জ্বালাবেন না” তখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি
আমাদের গ্রামে।সম্বচ্ছর হ্যারিকেন বা কুপীর আলো উৎসবে হ্যাজাক কিংবা ডেলাইট(এটাও
তখন এক রকম ঝোলানো হ্যাজাক)।সবাই থরথর করে কাঁপছি অজানা ভয়ে।ছেলেটার সারা শরীর
ভিজে গেছে পেট্রোলে।আচমকা একজন
নিছক কৌতুহলে একটা সিগারেট
ধরিয়ে আধপোড়া দেশলাইটা ছুঁড়ে দিল।মুহুর্তে আগুন ছুটে গেল ছেলেটার গায়ে।সারা শরীর তখন
একটা আগুনের গোলা।সব দোকান ঘর তখন খড়ের চালের।আগুনের গোলা ছুটল স্কুলের পুকুরের
দিকে।হাওয়ায় আগুন লাফাচ্ছে।জলে পড়ে কী হোলো আমাদের দেখার চোখ ছিল না।আকাশ কালো করে
মেঘ উঠল।কাল বৈশাখীর ঝড় উঠল।ধুলো উড়ছে,উড়ছে ডাল পালা।বৃষ্টি নামল তোড়ে।বিশ্বাস
করবেন কী এ আমার লেখা কোনও চিত্রনাট্য নয়।একটুও অতিরঞ্জন নেই।আমাদের কান্নাগুলো
মিশে গেল জল আর ঝড়ে।এক্ সময় ঝড় জল থেমে গেল। সামনেই প্রাইমারি হেলথ সেন্টার।ছেলেটিকে
শোয়ানো হোলো হাসপাতালের শয্যায়। চিকিৎসা হোলো ছেলেটি বাঁচল না।যে এই কান্ডটি
ঘটিয়েছিল সে ছিল ওই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের টিচার।তার কোনও শাস্তি হোলো
না.........।
সেই থেকে আমার পয়লা বৈশাখ
আমাকে একলা করে দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন