সপ্তপর্ণী
“যত্র বিশ্ব ভবতি এক নীড়ম্” যেখানে এই ভুবন একটিই
নীড়......।যেখানে প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ,আত্মার শান্তি।
সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়ানো
যার স্বভাব সেই আমার ভবঘুরে জীবনের শেষ
কয়েকটি বছর সাত পাতার ছাওয়াতেই কেটে গেল। সেখানেই আমার রোদ, এখানেই আমার জল-ঝড়, আলো-ছায়া,রাত
আর ভোর। কলকাতার পড়ালেখায় বিশেষ করে রবীন্দ্রভারতীতে
পড়ার সময় নানা দেশের ছাত্রদের পেয়েছিলাম ঠিক কিন্তু শান্তিনিকেতনের মতো নয়।
শান্তিনিকেতনে
বারো মাসে তের পার্বণের মতো সারাবছর উৎসব লেগেই আছে আর জোড়াসাঁকোয় হয় পড়াশোনা নয়
সেমিনার,নয় প্রোডাকশন।শান্তিনিকেতনে সারা বছরের আবর্জনা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা হয়
গান্ধী পুণ্যাহ এ(মনের ময়লা যে তাতে দূর হয় তা নয় তবে উৎসব নিঃসন্দেহে......)ধুলো
উড়িয়ে ধুলোমাখা হাতে ক্যান্টিনের লুচি আলুর দম আর মিষ্টি খেয়ে।আর জোড়াসাঁকোয় আমরা
অপেক্ষা করে থাকতাম কবে বৈশাখ আসবে।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই আমরা
তখন ক্লাস করতাম।ছাত্র থাকাকালীন ঠাকুরবাড়ি প্রদর্শশালার (মিউজিয়ম)গাইড ছিলাম।কতো
রকম মানুষের সংগে যে মোলাকাত হয়েছে...।
রাশিয়ার মানুষ থেকে রাঁচির
মানুষ......।লন্ডন এর সাহেব থেকে লাউহাটির মানুষ।
পোদোম্পুরের পরিবার থেকে
পোল্যান্ড এর পরিবার তাও।সারা বাড়ি তাদের ঘুরিয়ে
দেখাতাম।কখনো একলা দুপুরে
একা একা ঠাকুরবাড়ির আঁতুড় ঘর থেকে বউঠানের
সংগে কাটানো সেই ছাতেও একা
বসে থাকতাম.........।মিউজিয়ম কিউরেটর সমর ভৌমিক সমরদা আমাকে খুব স্নেহ করতেন।একবার সমরদা কোন
একটা কাজে আটকে ছিলেন বলে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন লন্ডন থেকে আগত এক সাহেবকে
মিউজিয়ম ঘুরিয়ে দেখাতে।সে বারেও বেশ গরম পড়েছিল কলকাতায়।সাত সকালেই সেই সাহেব
ভালুক(বিয়ার)সেবন করে রবিঠাকুরের পেন্টিং দেখতে এসেছেন।আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব
দেখালাম কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট নয়।তার কথা আমি টেগোরের সব পেন্টিংয়ের ওরিজিন্যাল
দেখতে চাই।আমি আমার সাধ্যমতো আমার ভাষায় তাকে বললাম টেগোরের সব ওরিজিন্যাল তো
এখানে নেই,আপনি চাইলে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে যান সেখানে কিছু আছে।কিন্তু তার
একটাই কথা এটা টেগোরের বাড়ি এখানে কেন সব থাকবে না?আমি লন্ডন থেকে এসেছি শুধু
টেগোরের পেন্টিং দেখতে?এক সময় ভদ্রলোক রেগে লাল হয়ে আমাকে থ্যাংক্স জানিয়ে বেরিয়ে
গেলেন।লাল লাল রাগ মুখের ধন্যবাদ যে কেমন ছিল তা নাই বা বললাম।আর একবার কিছু
ফরাসিকে মিউজিয়ম ঘুরিয়ে দেখানোর সময় আচমকা পাওয়ার কাট হোলো।ওরা জানতে চাইলো কী
হয়েছে?আমি বলতে তারা বিশ্বাসই করল না।তখন মিউজিয়মে কোনো এমারজেন্সি লাইট ছিল
না।এখানকার মানুষজন ওই অন্ধকারেই ভীড় জমাতেন নয়ত ঘামতে ঘামতে বেরিয়ে যেতেন।তখন
বাড়িটা সুন সান হয়ে যেত।আমি একা একা অবনীন্দ্রনাথের নিজের হাতে তৈরি তুলিগুলোর
দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
পঁচিশে বৈশাখের আগে থেকেই
বাড়িটা গমগম করত।আমাদের গরমের ছুটি পড়ত
ওই সময়।তার আগে আমাদের
বিভাগের নাট্য প্রযোজনা দেখার জন্যে সব্বাই মুখিয়ে
থাকত।কুমারদা(কুমার
রায়)নাটক শেখাতেন......নাটকের গান শেখাতেন সুচিত্রা মিত্র।
নাচ শেখাতেন বেলা অর্ণব,
মঞ্চ প্রকল্পনায় মাস্টারমশায় প্রখ্যাত রবি চট্টোপাধ্যায়, আলো কণিষ্ক সেন,রূপ
সজ্জায় শক্তি সেন।কুমারদা করাতেন সব রবীন্দ্র নাটক।আর
বাকি সময় বিভূতি
মুখোপাধ্যায় কিম্বা গণেশ মুখোপাধ্যায়।গণেশবাবু আমাদের দিয়ে
যাত্রাপালা “তরণীসেন বধ
পালা” করিয়েছিলেন।সেটা আমরা পরে দূরদর্শনেও করেছি।
তখন দূরদর্শন ছিল রাধা
স্টুডিয়োয়।বিভাসদা(বিভাস চক্রবর্তী) ছিলেন প্রোডিউসার,
ধ্রুবদা(ধ্রুব মিত্র)ফ্লোর
ম্যানেজার।আমার লেখা নাটক “প্রবহতি” টেলিকাস্ট হয়েছিল তার পরে।আটের দশকের শুরুতে
ওই স্টুডিয়ো থেকেই কলকাতা দূরদর্শনে।
সে সময় আমরা মঞ্চ আর মনগড়া
নাট্য আন্দোলোন নিয়ে যত মাতামাতি করেছি
তার চেয়ে বেশি হেলা করেছি
টেলিভিশনকে।টেলি মাধ্যম যে কতো শক্তিশালী হতে
পারে সেটা নেতারা বুঝেছিলেন
অনেক পরে।
আমরা সতু সেনের হাতে গড়া
নাট্যবিভাগে পড়েছি......আর তরুণ রায়, কুমার রায়
রবিবাবু,শক্তিদা এদের মতো
প্রতিভার কাছে হাতে কলমে শিখেছি।আমি যখন রিসার্চ
ফেলো হিসাবে ওখানে পড়াচ্ছি
তখন মনোজদা(মিত্র)রুদ্রদা(সেন গুপ্ত) অশোকদা(মুখোপাধ্যায়)বিষ্ণুদা(বসু)ও
পড়াচ্ছেন।উৎপল দত্ত এসে বারটোল্ট ব্রেখট
নিয়ে বলছেন......।সারা ভারত
থেকে নাটকের দিকপালরা আসছেন নাটক নিয়ে বলতে।
কথায় আছে না ঢেকি সর্গে
গেলেও ধান ভাণে.........বিশ্বভারতীতেও আমাকে গাইডের
কাজটা করতে হয় যখন কেউ
অনুরোধ করেন।তবে রবীন্দ্রভারতীতে ওই কাজটা করে
পয়সা মিলত......।এখানে এমনি
এমনি......।
শান্তিনিকেতনে কিন্তু সারা
বিশ্বের মানুষের সান্নিধ্য যেভাবে পেয়েছি,পাই তা আর কোথাও
পাইনি।পোল্যান্ড,ফ্রান্স,ইতালি,আমেরিকার সংগে কেরালা,কলকাতা,কটক একাকার।
কলাভবনে যখন “ভাতজোছনা”
করেছি সেখানে থাইল্যান্ডের কর্মা সিরিগোকর এর
সংগে,কলকাতার মিনি
চক্রবর্তি আর কেরালার জমি অভিনয় করছে বিনা দ্বিধায়।
যারা পড়তে এসেছে তারা কেউ
আমাকে অধ্যাপক বলে দূরে সরিয়ে রাখেনি বরং
বন্ধুর মতো মিশেছে বলেই
কাজটা করতে পেরেছি।
কেরালার পাভেল,গোয়ার
রেমন্ড,পোল্যান্ডের মাগদালেনা,আমেরিকার ল্যাক্সি কি
হুমকারা,
তাইওয়ানের হাং,ফ্রান্সের
ক্যারোলা,জাস্তিন দে লা ব্রসে,থাইল্যান্ডের ছেলে মেয়েরা।
আবার চীন থেকে
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কাজ করতে এসে লী আর ইয়ো ইয়ো
বন্ধু হয়ে গেছে যে
কখন......।
মহর্ষি ছাতিম গাছ
লাগিয়েছিলেন উপাসনার বেদীমূলে।সেইকাল থেকে একালেও সেই
গাছ ছাতার মতো মাথার উপর
ধরা আছে বলেই আজো হাজার মলিনতা লক্ষ সঙ্কীর্ণতা কোটি টাকার খেলা আশ্রমকে কলুষিত
করতে চেয়েও পারেনি.........।
“অসতো মা
সদ্গময়,তমসো মা জ্যোতির্গময়............”
ঘুঘুর বাসায় ডিম পেড়েছেন
কেউ......ঘুঘুর বাসায় ঢিল মেরেছেন কেউ।চর্যাশ্রমকে পরচর্চা পরনিন্দার,পরকীয়ার
পরিবেশ করেছেন সেই গুরুদেবের কাল থেকেই কেউ কেউ তবু প্রতিভা আর পরিব্রাজকরা কিন্তু এই
ভুবনডাঙার ভুবনেই ফিরে ফিরে আসেন।তাদের প্রতিভার স্ফুরণ আর প্রকাশ ভুবন ডাঙা থেকে
পারুল ডাঙায় আটকে থাকেনি কোন কালেই।এখানেও সেই সমুদ্রের বিস্তার আর
বহমানতা।যদিও
এ আমার তাম্রলিপ্ত বন্দর নয়
তবে ভুবনডাঙার সরাইখানা,শান্তির জলসত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন