MON KHEROR KHATA

MON KHEROR KHATA
Memories

রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

সকলেই কবি নয়......
জীবনানন্দ দাশ কথাটা যেন আগামীর আমার জন্যেই লিখেছিলেন।আমার তাম্রলিপ্ত বন্দরের কাল থেকে নোঙরবিহীন একাল অব্দি কবিতা লিখেছি যত তার চেয়ে বোধ হয় অন্য কবিদের কবিতার বইয়ের ও কবিতা পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছি বেশি এমনকি আমার নাটকেও কবিতা ফিরে ফিরে আসে কিন্তু কবি হয়ে উঠতে পারিনি কখনোই। কবি হতে বিশেষ কিছু লাগে যা আমার নেই।আমার মনে হয় কবি হয় দুই রকমের সেয়ানা কবি আর দিওয়ানা কবি।বলা বাহুল্য দিওয়ানা কবি চিরকালই মাইনরিটি। আমি সেই সৌভাগ্যবান যে সেয়ানা কবির পাশাপাশি দিওয়ানা কবিদেরও সাক্ষাৎ পেয়েছি,সখ্যও।তাদের মধ্যে একজন আদ্যোপান্ত কবি হয়েও বাংলা নাটকের সংগে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন এই সেদিনও।আমার সে প্রিয়জনের কথায় আসব একটু পরে। আপাতত ফিরে যাই বন্দরের কালে যেখানে শুধু সন্ধ্যায় নয় দুপুরেও মজে ছিলাম কবিতায়।
অশোকতরু কবিতা লেখার পাশাপাশি কবিতা পত্রিকার প্রকাশকও ছিল।সেটা নিজের কবিতা ছাপার জন্যে নয়।অন্যদের প্রকাশিত করার জন্যে।একাই কবিদের কবিতা সংগ্রহ করে প্রেসে যেত।কবিতা কম্পোজ হোতো।তার প্রুফ দেখতে হোতো বার কয়েক তারপর কাগজ কিনে প্রেসে দিয়ে প্রিন্ট অর্ডার দেওয়া তার পর ছাপা।সে যে কি ঝক মারির কাজ ছিল তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।আবার ছাপাখানার কালি,সীসের গন্ধ, ভেজা কাগজের প্রুফ,হাতে গরম প্রিন্ট এ যে গরম ভাতের চেয়েও সুস্বাদু।আবার ভাতে যেমন বালি কি কাঁকড় পড়লে মেজাজ খিচড়ে যায় সেইভাবে ছাপাতে ভুল থাকলে ওই এক অসোয়াস্তি হোতো।কম্পোজিটরদের নিয়ে ঝক্কিও পোয়াতে হোতো বেশ। মফস্বল টাউনের প্রেসের এক চিলতে ঘরের সংগে শহর কলকাতার এক চিলতে গলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা মস্ত ছাপাখানার এ ব্যাপারে কোনও তফাত চোখে পড়েনি আমার।
একবার অশোক ঠিক করল কবিতা পত্রিকা শুধু শিক্ষিত মানুষ কিনবে আর পড়বে তা হবে না।যারা খেটে খায়,মাঠে ঘাটে কাজ করে তাদের কাছেও কবিতা নিয়ে হাজির হব।এমনকি গ্রামের মেলাতেও পত্রিকা নিয়ে হাজির হব।কবিতা বেচব।যেমন ভাবা তেমন কাজ।সামনে রথের মেলা।মহিষাদলের রথের মেলা বিখ্যাত।আমরা সেই মেলাতেই যাব স্থির হোলো।শুরু হোলো প্রেসে গিয়ে কবিতা দেওয়া আর প্রুফ দেখা। এর মধ্যে একদিন গিয়ে শুনলাম আজ কোনও প্রুফ পাওয়া যাবে না।কারণ? কম্পোজিটর কিছু কবিতা কম্পোজ করতে চাইছে না।কারণ কী?জানা গেল এক কবির কবিতায় বহুল পরিমাণে ‘স্তন’ আর ‘যোনি’ শব্দ আছে।প্রেসের মালিকও তাকে দিয়ে ওই কবিতা কম্পোজ করাতে পারেননি।শেষমেশ আমি আর অশোক তাকে বোঝালাম এটা নিছক কবিতা।কবিতার প্রয়োজনেই এই শব্দ......এখানে আর কোনও শব্দ ব্যবহার করা গেলে কবি তাই করতেন।কম্পোজিটর নিমরাজি হোলো তবে একটি শর্তে।এখন স্তন-যোনি ছাড়াই প্রুফ দেখতে হবে।প্রিন্ট অর্ডারও ওইভাবে দিতে হবে।ম্যাটার মেশিনে ওঠার সময় সে শব্দগুলি বসিয়ে দেবে যথাস্থানে।এ যে কী যন্ত্রণা!বিস্তর সময় ভুগেছি এ নিয়ে যা সবিস্তারে বলতে গেলে সে এক মহাভারত হয়ে যাবে।সেবার তাই বহু শ্রমের পর আমরা স্তন-যোনির দেখা পেয়েছিলাম।
তমলুক থেকে মহিষাদল বেশ কয়েক কিলোমিটার।যখন মেলায় পৌঁছলাম সবে রথের দড়ি টানা শুরু হয়েছে আর মানুষজন কেউ বা দড়ি টানায় ব্যস্ত কেঊ বা অস্থায়ী নিষিদ্ধ পল্লীর ঘরে ঠায় অপেক্ষায়।আবার কেউ বা ঘুরে ঘুরে পাপড় ভাজা খাচ্ছে।এর মধ্যে এক দল লোক কুড়ি বাইশ কিলোগ্রাম ওজনের খাজা কাঁঠাল কিনে পাকা রাস্তার ওপরে বসে পড়ে হাতে তেল না মেখেই কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে।আমরা সেই সব মানুষদের কাছেও পত্রিকা নিয়ে গেলাম।বিক্রীও হোলো।আমাদের কবিতা বেচা হোলো কিন্তু রথ দেখা হোলো না।
একবার কালোবরণ পাড়ুই তার গ্রামে কবি সম্মেলনের আয়োজন করল।আমরা দল বেঁধে চললাম কবিতা পড়তে।মাটির দাওয়ায় বিশাল জাজিম পেতে দেওয়া হয়েছে। পৌঁছতেই প্রায় এক লিটার জল ধরে এমন সাইজের কাচের গ্লাসে শরবত দেওয়া হোল।এবার হ্যারিকেনের আলোয় কবিতা পাঠের শুরু।ছোটোরা উঁকি ঝুকি দিয়েই পালালো।বড়রা কেউ কেউ চুপ করে বসে থাকলেও অধিকাংশ বয়স্ক মানুষ আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।মেঝেতে পাত পেড়ে এলাহি খাওয়া হোলো।আর একবার সুচরিতা দাশ তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ে কবিতা পাঠের আয়োজন করলেন। সুচরিতা দাশ ছিলেন ওই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।জীবনানন্দ দাশের বোন।অপর্ণা সেন তমলুকে “কোলকাতার হ্যামলেট” নাটকে অভিনয় করতে এসে ওনার কাছেই উঠেছিলেন সেবার।অসিত বসু ছিলেন এই নাটকের নাট্যকার ও পরিচালক।এই নাটকে সুনীল মুখোপাধ্যায় অভিনয় করত।কী দক্ষ অভিনেতা।অভিনয় দেখে চমকে গিয়েছিলাম।পরে সুনীলদার সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে তখনও সুনীলদা ঢাকুরিয়ার বস্তিতেই থাকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘নিম অন্নপূরর্ণা’ কি গৌতমদার(ঘোষ) ‘পাড়’ ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি।
আর এক সুনীলদাও(গঙ্গোপাধ্যায়)সুচরিতা দাশের আমন্ত্রণে তাঁর সেই ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে কলকাতা থেকে তমলুকে এসে কবিতা পড়ে ফিরে গেলেন কলকাতায়।এই আমিও কলকাতায় যখন পাকাপাকি থাকছি, মঞ্চের কাজে জড়িয়ে পড়েছি তখনও কবিদের ডাকে ফিরে ফিরে গেছি ওখানে।সেবার তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় কবি সম্মেলনের আয়োজন করল।আমন্ত্রণ পেয়ে আমিও হাজির হয়েছিলাম।কবিতা পাঠের পর অধ্যাপকদের ‘কমন রুমে’ আলোচনা ও চা পান।তর্ক উঠল রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজ কতটা প্রাসঙ্গিক?সবাই যখন চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলতে ব্যস্ত আমি তখন দিনান্তের শেষ আলোয় বলে উঠেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতার কী দশা হবে জানিনা তবে তার গান বেঁচে থাকবে কালাকাল পার করে।তার গান দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের গানের এপারেই......ওপারে নয়।

ঠিক তখন তখনই স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়মে সুর তুলে এক কিশোরী গেয়ে উঠেছিল-“ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি”।এর পর আর কোনদিন আর কোনও কবি সম্মেলনে কবিতা পাঠ করিনি।কবিতাকে ছুটি দিয়ে এক ছুটে ফিরে এসেছিলাম মোকাম কলিকাতায় নাটকের মহড়া কক্ষে।গুটিপোকা কখন যে খোলস কেটে বেরিয়ে পড়েছিল সকলের দৃষ্টির অগোচরেই।    

1 টি মন্তব্য:

  1. লেখাগুলো তো বড়ই সাংঘাতিক ! 'ঢেউ'য়ের পরে 'ঢেউ' তুলে মনে তরঙ্গভঙ্গ-টঙ্গ জাতীয় সব ব্যাপার ঘটাচ্ছে ! আর এদিকে দূরস্থিতির আড়াল রেখে কী সব মারকাটারি মালমশলার নির্মাণ ! এ তো দেখি পেটে- পেটে রত্ন পুষে সত্যিই রত্নাকর !
    দুঃখ একটাই : কোথায় বসে আছে----- এখনও জীবনের এত রসে রসস্থ হয়ে চলেছি অফুরান সেও হয়তো সব দেখছে ------ ভাগাভাগির কোনো পথ নেই ।
    Walter de la Mareর Ĺisteners কবিতাটার মর্মার্থ এমন মর্মে মর্মে বুঝিয়ে ছাড়বে জীবন ভাবিনি কখনও ।Ramita Sengupta

    উত্তরমুছুন